আরেক রকম ● দশম বর্ষ ঊনবিংশ-বিংশ সংখ্যা ● ১-৩১ অক্টোবর, ২০২২ ● ১৬ আশ্বিন - ১৫ কার্তিক, ১৪২৯

প্রবন্ধ

প্রকাশ রায় এবং ডাক্তার পুর্ণেন্দু ঘোষঃ সুন্দরবন থেকে ছত্তিশগড়

রঞ্জন রায়


ষাটের দশকের শেষে কবি সমীর রায় ‘নন্দন’ পত্রিকায় লিখেছিলেনঃ

‘‘কাকদ্বীপ আর ডুবির ভেড়িতে
নাতিনাতনির কাছে অশোক বোসের গল্প শোনাতে শোনাতে
বুড়ো চাষীর চোখ জ্বলে ওঠে।
’’


আজকে একটু অশোক বোস ওরফে প্রকাশ রায়ের কাহিনি শোনাতে বসেছি। সঙ্গে আসবে আরও একজনের কথা, ডা. পুর্ণেন্দু ঘোষ ওরফে রাঙা ডাক্তার। দু’জনেই কাকদ্বীপ এলাকার তেভাগা আন্দোলনের বিশিষ্ট নায়ক। কিন্তু দুজনেরই বাকি জীবন কেটেছে ছত্তিশগড়ে - একজনের রাজনন্দগাঁওয়ে, অন্যজনের বিলাসপুরে।

অশোক বোস অবিভক্ত বাংলার তেভাগা কৃষক সংগ্রামের এক প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব। কিন্তু ছত্তিশগড় তাঁকে জেনেছে শুধু প্রকাশ রায় বলেই। জন্মেছিলেন যুক্ত বঙ্গের নদীয়া জেলার এক সম্পন্ন ভূস্বামী পরিবারে। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই অশোকের মনে গরীব ও শোষিত মানুষের জন্যে এক আলাদা সহানুভূতি ছিল। এ তাঁর ঠাকুমার দেশপ্রেমের সুবাদে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। ঠাকুমা ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ ও ডঃ ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের ভাইঝি।

ছাত্রাবস্থায় ১৯৩৭ সালে, আন্দামানের সেলুলার জেলের রাজবন্দীদের মুক্তির দাবির সমর্থনে কলকাতার একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে স্ট্রাইক করায় নেতৃত্ব দেন। এর জন্যে অশোক ও তাঁর বন্ধুদের একমাস ধরে রোজ একঘন্টা করে বেত খেতে হয়। সে বছরই তিনি এন্ট্রান্স পরীক্ষা পাশ করে কলেজে ভর্তি হন। সময়টা চল্লিশের দশক। ঘটনাচক্রে অশোকের পরিচয় হল কমিউনিস্ট পার্টির এক কর্মীর সঙ্গে। রুশ বিপ্লব, মার্ক্সীয় দর্শন ও সর্বহারাদের জন্যে বিশ্ববিপ্লবের স্বপ্নের রূপরেখা নিয়ে নিয়মিত আলোচনা অশোকের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল।

অশোক পার্টিতে যোগ দিলেন। তারপর জমিদার বাবার বিরুদ্ধে কৃষকদের গোপন সংগঠন তৈরি করে পার্টির বিশ্বাসভাজন হিসেবে তিনি নিজেকে প্রতিপন্ন করলেন। বাবার সঙ্গে বিবাদের ফলে অশোককে পিতৃগৃহের নিরাপদ আশ্রয় ও পড়াশুনো ছেড়ে ডাক ও তার বিভাগের চাকরি নিতে হল। সেখানে তিনি ট্রেড ইউনিয়ন করার সুযোগ পেয়ে অচিরেই ডাক ও তার বিভাগের ইউনিয়নের সংগঠক ও পদাধিকারী হয়ে উঠলেন।

বিশ্ব পরিস্থিতি তখন উত্তাল। ভারতের অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলন সংগঠিত করছে। ব্রিটিশ সরকারের তাদের ফৌজের জন্যে বাজার থেকে সমস্ত ধানচাল ক্রোক করে নিল। আর এভাবেই শুরু হল ইতিহাসে কুখ্যাত সেই গ্রেট বেঙ্গল ফেমিন! বঙ্গের মহা-মন্বন্তর। অনুমান, সেই সময়ে প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ লোক অনাহারে মারা গিয়েছিল। কমিউনিস্ট পার্টি এই অসহনীয় কষ্ট লাঘব করতে রেশনের মাধ্যমে খাদ্য বিতরণ ও লঙ্গরখানা চালু করল।

সেই ক্রান্তিকালে অশোক বোস চাকরি ছেড়ে পার্টির পূর্ণসময়ের সদস্যপদ গ্রহণ করলেন। পার্টির আহ্বানে সাড়া দিয়ে তিনি জমিদারী প্রথার বিরুদ্ধে কৃষকদের সংগঠিত করতে লাগলেন, বাদ পড়ল না বাবার জমিদারি এলাকাও।

ইতিমধ্যে বঙ্গ সরকার নদীয়া জেলার হরিণঘাটায় ডেয়ারি গড়ে তুলবার জন্যে কোনো ক্ষতিপূরণ না দিয়েই, পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করেই, ৯০০০ একর কৃষিজমি দখল করল। সরকারের থেকে ক্ষতিপূরণ না দেওয়া চাষের জমি ছিনিয়ে নিয়ে, তাতে সরকার যে ফসল বুনেছে তা কেটে নিজেদের গোলায় তুলতে তিনি কৃষকদের সংগঠিত করলেন। হাজার দুয়েক সংগঠিত লাঠিধারী স্বেচ্ছাসেবক নেতৃত্বের ইশারায় লালঝান্ডা উড়িয়ে লাঠিসোটা ও কাস্তে নিয়ে ক্ষেতে নেমে পড়ল। জমিদখল ও বিতরণ, ফসল কেটে ঘরে তোলা চলতে লাগল। পরের দিন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্বয়ং বিশাল বাহিনী নিয়ে এলাকায় এলেন, ঘুরে বেড়ালেন নদীয়া জেলার হরিণঘাটা থেকে চব্বিশ পরগণার আমডাঙা পর্য্যন্ত। কিন্তু খামোখাই। কোন সাক্ষীসাবুদ পাওয়া গেল না, জেলা প্রশাসন খালি হাতে ফিরে গেল, জয় হল কৃষকদের। এই খবরটা দাবানলের মত গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল। ফলে এক বছরের মধ্যেই চাষীরা আর্থিক ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের জন্যে জমির প্লট পেয়ে গেল।

এদিকে ক্ষমতা হস্তান্তরের দিন ঘনিয়ে আসতে লাগল আর ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীরা ছেড়ে যাবার আগে তাদের ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ নীতি অনুয়ায়ী সাম্ম্প্রদায়িক দাঙ্গার উস্কানি দেওয়ার ব্লু-প্রিন্ট বানাতে লাগল। হিন্দু-মুসলিম ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে দুর্বল করে দিল। অশোকের কার্যক্ষেত্রও, অর্থাৎ নদীয়া জেলার হরিণঘাটা মহকুমা থেকে চব্বিশ পরগণার বারাসত মহকুমাতে দাঙ্গার আগুন ধিকি ধিকি জ্বলতে লাগল। দাঙ্গা থামল ১৯৪৭ সালের ১৫ই অগাস্ট। কিন্তু তার আগে দাঙ্গা থামানোকে প্রত্যেক কমিউনিস্টের অবশ্য কর্তব্য মনে করে লাঠি ও ঝাণ্ডা নিয়ে তাঁরা রোজ রাতপাহারা দিতেন।

এলাকার মানুষজন সেদিনের কথা ভোলেনি। তাই ১৯৭৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে--দীর্ঘ ২৫ বছরের পর যখন চারদিনের জন্য ওই এলাকায় তিনি এসেছিলেন তখন রোজ কাতারে কাতারে লোকের ভিড় হত শুধু তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্যে, কথা বলার জন্যে!

১৯৪৪-৪৮, এই চারবছরে অবিভক্ত বঙ্গের তেভাগা নামে ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন তার শিখরে পৌঁছেছে। তেভাগা আন্দোলনের মূল দাবি ছিল, ভাগচাষীরা ফসলের তিনভাগের দুভাগ ঘরে তুলবে আর জমিদার পাবে বাকি একভাগ। এর সঙ্গে আরও কিছু দাবি ছিল যেমন, চাপ দিয়ে অতিরিক্ত আদায় চলবে না; ফসল চাষীদের গোলায় তুলে তারপর ভাগ-বাঁটোয়ারা করতে হবে আর তেভাগার রসিদ দিতে হবে। সেই সময় পার্টি অশোক বোসকে সুন্দরবন এলাকায় পাঠালো আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে গরীব চাষীদের মধ্যে সংগঠন গড়ে তোলার জন্যে।

হেই সামালো ধান হো, কাস্তেটা দাও শাণ হো
জান কবুল আর মান কবুল, আর দেবনা আর দেবনা
রক্তে বোনা ধান মোদের প্রাণ হো।।

আজ থেকে ৭৫ বছর আগের সুন্দরবন ছিল কলকাতা থেকে ৫০ মাইল দূরে ঘন জঙ্গল আর অসংখ্য নদীনালা সমুদ্রের খাঁড়ি দিয়ে ঘেরা এক বিশাল এলাকা। চব্বিশ পরগণার দশটি পুলিশ থানা নিয়ে প্রায় ৪০০০ বর্গমাইল বিস্তৃত এই এলাকা বাঘ, কুমির ও সাপের আস্তানা। অবশ্য এই নাবাল জমিও গরীব ও ভূমিহীন চাষিদের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমে সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা হয়ে উঠেছিল।

তবে এই নতুন উপনিবেশেও ধীরে ধীরে দেখা দিল ভূস্বামী ও মধ্যসত্ত্বভোগীরা। জমিদারেরা মাঝে মাঝেই বাঁধ ভেঙে দিয়ে কৃষকের ক্ষেতে ঢুকিয়ে দিত সমুদ্রের খাঁড়ির লোনা জল, নষ্ট হত ফসল আর দরিদ্র কৃষকেররা দরিদ্রতর হয়ে বড়ো ভূস্বামীদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ত। এভাবেই ক্রমশঃ বড়ো জমিদারেরা গরীব চাষীদের বহু পরিশ্রমে গড়ে তোলা অধিকাংশ কৃষিযোগ্য ক্ষেত নিজেদের কব্জায় নিয়ে নিল। শুরু হল ভাগচাষ, প্রথমে ৫০/৫০ ভাগাভাগির ভিত্তিতে। কিন্তু তখনকার দিনে অধিকাংশ কৃষকই ছিল নিরক্ষর, ঠিক করে গুণতে পর্যন্ত জানত না। তাই তাদের সহজেই ঠকানো যেত। ওরা অনায়াসে একমণ ধান, কিছু আনাজ ও কাঠকুটোর বদলে ৫ থেকে ১০ বিঘা জমি বন্ধক রাখতে রাজি হয়ে যেত। ফসল কাটার পরও গরীব চাষীর পিঠে চেপে বসত চড়া সুদে নেওয়া ঋণের বোঝা। গরীব চাষিদের নিয়তিই ছিল আরও গরীব বা নিঃস্ব হয়ে যাওয়া।

এল ১৯৪৬, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠন বঙ্গীয় কৃষক সভার নেতৃত্বে শুরু হল ফসলের তিনভাগের দুভাগ চাষির গোলায় তোলার দাবিতে তেভাগা আন্দোলন। এই আন্দোলনে যোগ দিল ৬০ লক্ষ কৃষক। নিঃসন্দেহে এটাই ছিল ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির জন্মের পর সবচেয়ে বড় আন্দোলন। নিবেদিত প্রাণ কমিউনিস্ট সংগঠকদের আত্মত্যাগে এই আন্দোলন সবচেয়ে বেশি ছাপ ফেলেছিল সুন্দরবন এলাকায়। হেমন্ত ঘোষাল, রাসবিহারী ঘোষ, মানিক হাজরা, কংসারি হালদার ও অশোক বোস ছিলেন এঁদের অগ্রগণ্য। এঁরা তিরিশের দশক থেকে সুন্দরবন অঞ্চলে একটু একটু করে কৃষকদের সংগঠিত করছিলেন।

ছেচল্লিশের ঝোড়ো দিনে অশোক বোস প্রবাদপ্রতিম কৃষক নেতা কংসারি হালদারের সঙ্গে মিলে জোর করে ক্ষেতের ধান কেটে কৃষকের গোলায় তোলার কায়দাকৌশল রপ্ত করছিলেন। শেষে কংসারি হালদারকে “শ্যুট অ্যাট সাইট” অর্ডার বেরোনোয় আন্ডারগ্রাউন্ড যেতে হল আর অশোক বোসকে গ্রেফতারের জন্য ওয়ারেন্ট জারি হল। পুলিশের গুলি প্রথম চলেছিল ক্যানিং থানার ডোঙ্গাজোড়া গাঁয়ে। ক্ষিদের চোটে জমিদারের বাড়িতে ধান চাইতে গিয়ে চারজন চাষী শহীদ হয়। অনেকে জেলে গেল। সুন্দরবন এলাকার সমস্ত কোর্ট কাছারি পুলিশ ক্যাম্পে ছেয়ে গেল। সপ্তমুখী নদীর অপর পাড়ে দক্ষিণ চন্দনপিঁড়ি ও আশপাশের গাঁয়ে হাজির হল শ’য়ে শ’য়ে পুলিশ। ঘরে ঘরে বেজে উঠল শঙ্খ, আগাম সতর্ক হওয়ার সংকেত। পনেরজন স্বেচ্ছাসেবকের দল নিয়ে অশ্বিন দাস দৌড়োলেন, উদ্দেশ্য ৩৬ গোর্খা রাইফেল্স এর জোয়ানদের হাত থেকে গাঁয়ের মেয়েদের সম্মান বাঁচানো। লালঝান্ডা হাতে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়লেন ওদের মাঝখানে, আর বুকে গুলি লেগে লুটিয়ে পড়লেন। ওঁর বোন অহল্যা, আটমাসের পোয়াতি, ছিনিয়ে নিল লাল নিশান কিন্তু বুকে বিঁধল বেয়নেট। তলপেট এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে গেল ওই বেয়নেটের খোঁচায়। আটজন কৃষক শহীদের মৃত্যু বরণ করলেন। অশ্বিনী, অহল্যা, সরোজিনী, বাতাসী, উত্তমী, গজেন, অধর ও দেবেন।

গুলির শব্দে নদীর ওপারে লালগঞ্জের কৃষকবাহিনী সচকিত হয়ে উঠল। বাঁশের লাঠি নিয়ে শত শত কৃষক শীতের মধ্যে সাঁতরে এপারে পৌঁছে দেখতে পেল লাশের ঢল। অহল্যার বেয়নেটবিদীর্ণ পেট থেকে বেরিয়ে আছে শিশুর হাত। সপ্তমুখী নদীর পাড়ে আটটি চিতার আগুনে ম্লান হয়ে গেল সাঁঝবেলার আঁধার।

তেভাগা ছড়িয়ে গিয়েছিল দুই বাংলার অধিকাংশ জেলায়। ১৯৪৬-এর মে দিবসে প্রতিরোধ আন্দোলনের ঘোষণা হল। গড়ে উঠল ‘‘ছোটো তেলেঙ্গানা’’। সংঘর্ষ সমিতির নেতৃত্বে এই আন্দোলন জারি রইল ১৯৫০ অবধি।

শহরেও মানুষ ভিতরে ভিতরে রাগে ফুঁসছিল। দিনটা ছিল ১৯৪৯ সালের ২৭শে এপ্রিল। মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির একটি মিছিল সেদিন লালবাজারের পুলিশ হেড কোয়ার্টারের দিকে স্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে যাচ্ছিল। তাদের দাবি, আমাদের স্বামী ও ছেলেপুলেদের মুক্তি চাই! স্লোগান উঠছিল, ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়, দেশ কী জনতা ভুখা হ্যায়। মিছিল বৌবাজার স্ট্রীট ধরে লালবাজারের কাছাকাছি পৌঁছুতেই আচমকা পুলিশের গুলি চলল। মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন অমিয়া-প্রতিভা-গীতা-লতিকা, শহীদ হলেন চার নেতৃস্থানীয়া মহিলা। লতিকার স্বামী ডঃ রণেন সেন পরবর্তীকালে সারা ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট ও খ্যাতনামা সাংসদ হয়েছিলেন।

সেই সব অত্যাচার ও দমনপীড়নের দিনে পুলিশের গুলি ও শহীদের মৃত্যু ছিল এক নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। গুলি চলেছিল বুধাখালি, শিবরামপুর, রাজনগর ও আরও অনেক গ্রামে। বুধাখালিতে শহীদ হলেন সুরেন্দ্র, সুধীর ও নীলকন্ঠ। সুরেন্দ্র শেষ মুহূর্তেও মুখ খোলেননি, কৃষক আন্দোলনের নেতাদের নাম বলে দেননি। সংঘর্ষের এলাকা ক্রমশঃ বিস্তৃত হচ্ছিল। সোনারপুর, ভাঙ্গড়, নয়াবাদ, মথুরাপুর, ডোঙ্গাজোড়া, বিষ্ণুপুর, জয়নগর, দাউদপুর, পাথরপ্রতিমা, হাসনাবাদ, সন্দেশখালি থেকে ছড়িয়ে পড়া প্রতিরোধের গল্পগুলো ইতিহাসের পাতায় স্থান পেল।

ইতিমধ্যে ভারতের অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে তৎকালীন হায়দ্রাবাদ রাজ্যের তেলেঙ্গানা এলাকায় আর এক স্মরণীয় ঐতিহাসিক সংগ্রাম শুরু হয়ে গেছে। এটি ছিল হায়দ্রাবাদের নিজাম ও তার কুখ্যাত রাজাকার বাহিনীর বিরুদ্ধে কৃষকদের সশস্ত্র সংগ্রাম। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ল পাহাড়ী জনজাতি অধ্যুষিত এলাকায়; এগিয়ে চলল গরীব ভূমিহীন দলিত ও জনজাতিদের মধ্যে উদ্বৃত্ব জমি বন্টনের কাজ। প্রতিরোধের ওই বীরগাথা বঙ্গের কমিউনিস্ট নেতাদের প্রেরণা যোগায়। পার্টি অশোক বোসকে জেলার দায়িত্ব নিয়ে প্রতিরোধ সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে নির্দেশ দিল। কংসারি হালদার তখন কৃষক সভার অবিসংবাদী নেতা। আর সমান্তরাল ভাবে শিল্পক্ষেত্রে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার বিশেষ দায়িত্বে রইলেন নিত্যানন্দ চৌধুরি, সুরেন্দ্র ধর চৌধুরি এবং নরেন গুহ।

অশোক বোস ও কংসারি হালদারের প্রেরণায় সুন্দরবন অঞ্চলে গড়ে উঠল স্থানীয় নেতৃত্ব। গজেন মালী, বিজয় মন্ডল, ভুষণ কামিলা, ভরত, তরণী সাহু, ভীম ঘোড়ুই, দ্বিজেন দিন্দা, মঙ্গল সারেং, যতীন মাইতি, মঙ্গল ও আরও অনেকে। পুলিশ কখনই অশোককে সাধারণ চাষীদের থেকে আলাদা করে চিনতে পারেনি। বৃটিশ সরকার অশোকের মাথার ওপরে ৫০,০০০/- টাকার ইনাম ঘোষণা করে। একবার গ্রাম বুধাখালিতে সশস্ত্র পুলিশের একটি দল অশোককে বন্দী করে কোমরে দড়ি আর হাতে হাতকড়া লাগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল গুলি করে মেরে ফেলতে। কিন্তু সেই আদেশ পালিত হওয়ার আগেই চারদিক থেকে দলে দলে জোয়ান বুড়ো এসে ছাড়িয়ে নিয়ে যায় অশোককে।

সেসব দিনে তিনি ক্রমশঃ রূপকথার নায়ক হয়ে উঠছিলেন। অশোক বোস আর একজন ব্যক্তি মানুষ রইলেন না; হয়ে উঠলেন এক লোকগাথার নায়ক -- অগণিত কৃষক ও সর্বহারার বিদ্রোহ ও আত্মত্যাগের প্রতীক।

।। ২ ।।

সুন্দরবন থেকে পালিয়ে গেল জমিদারের দল; ওদের কাছারিঘরের ছাদে উড়ল লালপতাকা। এই ঘরগুলো আগে ছিল গরীবগুর্বো চাষীবাসী ও মেয়েদের উপর অত্যাচারের আখড়া। জমিদার ও তাদের নায়েবদের গদিতে প্রতিরোধ সমিতির নেতারা বসলেন। শুরু হল জমিদারের বাজেয়াপ্ত জমি ও ধান গরীবদের মধ্যে বন্টনের গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এছাড়া চাষের জন্যে হালবলদ বন্টনও করা হল। আর একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল নিজেদের মধ্যে বিবাদ ঝগড়া আপোষে মিটিয়ে দেওয়া এবং প্রতিরোধ আন্দোলন পরিচালনা করা। প্রতিরোধ সমিতির ডাকে কলকাতা থেকে সদ্য পাশ হওয়া তরুণ ডাক্তারের দল সুন্দরবন গিয়ে কৃষকদের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য এবং রোগ প্রতিষেধের শিক্ষা দিতে লাগলেন।

এইভাবে সুন্দরবনের গরীব চাষী ও ক্ষেতমজুরের দল কয়েক বছর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সম্মানজনক জীবনযাপনের সুযোগ পেল। সে সময়ে অনামা নায়কদের বীরোচিত বলিদানের অসংখ্য ঘটনা অগোচরে রয়ে গেছে। নগেন ঢালি গুলি খেলেন, সুরেন্দ্রকে জেলের ভেতর পিটিয়ে মারা হয়। দুটো ছেলেকে সন্দেহের বশে গাঁ থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে পুলিশের লোক তাদের বুকে চড়ে নাচল, অন্ডকোষ পাথর দিয়ে থেঁতলে দেয়। ওরা মরে গেল কিন্তু মুখ থেকে একটা কথাও বের করা গেল না। শ্যামের বুকের উপর চাপিয়ে দেওয়া হল বরফের চাঙড়, নখের নীচে সূঁচ ফোটানো হল আর গুহ্যদ্বারে বিদ্যুতের শক, কিন্তু আন্দোলনের নেতাদের হদিশ পাওয়া গেল না। চন্দনপিঁড়ি গাঁয়ের সূরজমুখী বেওয়ার বুলেটের ঘা থেকে গ্যাংগ্রিন হয়ে যাওয়া হাত জেল হাসপাতালে কেটে ফেলতে হল। কিন্তু হাসপাতালের ডাক্তারবাবুরা পুলিশের নির্দেশে অ্যানাস্থেসিয়া না দিয়ে সজ্ঞানে হাতটা কাটতে লাগলেন। অপরেশন চলছে আর পুলিশের ইন্টারোগেশন করছে।

তেলেঙ্গানা ও তেভাগার বীরত্বগাথা অগুণতি ও স্মরণীয়। ৯ই জুন, ১৯৪৯। দমদম সেন্ট্রাল জেলের অনশনরত বন্দীদের উপর পুলিশের গুলি চলল, মারা গেলেন রেলের ট্রেড ইউনিয়নের এক নেতা সুমথ চক্রবর্তী, প্রভাত কুন্ডু ও ছাত্রনেতা মুকুল চক্রবর্তী। শেষোক্ত জন কাকদ্বীপে তেভাগা আন্দোলনের সময় ধরা পড়েছিলেন।

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা এদেশ ছেড়ে যাওয়ার পর সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে ১৯৫০-এ শুরু হল ‘‘ক্ষুদে তেলেঙ্গানা’’ কে গুঁড়িয়ে দেবার পাল্টা আক্রমণ।

সুন্দরবনে জমিদারদের হৃতরাজ্য ফিরিয়ে দিতে পাঠানো হল টেরিটোরিয়াল আর্মির নানজাপ্পা রেজিমেন্টকে। এই এক বছরে সুন্দরবনের উপর দিয়ে অত্যাচার ও নিপীড়নের যেন ঝড় বয়ে গেল। ক্ষুদে তেলেঙ্গানা অচিরেই বড়ো তেলেঙ্গানার মতো একই পরিণতি পেল। সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের স্মৃতিকথায় ভি শঙ্করণ বলছেন, কমিউনিস্টরা তেলেঙ্গানায় এক আতঙ্কের বাতাবরণ তৈরি করেছিল আর ওয়ারাঙ্গল জেলায় সমান্তরাল প্রশাসনিক ব্যবস্থা কায়েম করেছিল; নালগোন্ডা জেলাও ব্যতিক্রম ছিল না। একইভাবে, সুন্দরবন ও কলকাতার নিকটবর্তী কিছু এলাকায়ও সমান্তরাল প্রশাসন চলছিল। কমিউনিস্টদের গুঁড়িয়ে দিয়ে পরিস্থিতি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে প্রায় একটা গোটা বছর লেগে গেল।

শ্রেণিশত্রুদের তীব্র আক্রমণের সামনে কাকদ্বীপের সশস্ত্র প্রতিরোধ ভেঙে পড়ল। জনগণের সক্রিয় সমর্থন সত্ত্বেও কম্যুনিস্টরা আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলল। নেতারা এবং সশস্ত্র স্কোয়াডগুলো ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। জমিদাররা ফিরে আসতে শুরু করল। কংগ্রেস ভলান্টিয়াররা পুলিশ-মিলিটারির সাহায্যে আন্দোলনের নেতা ও সক্রিয় কর্মীদের গ্রেফতার করাতে ব্যস্ত। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে কমিউনিস্ট পার্টি ও তাদের সহযোগী গণসংগঠনগুলোকে নিষিদ্ধ করা হল। পার্টির জন্যে নেমে এল দুঃসময়।

ইতিমধ্যে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের অবিসংবাদি নেতা জোসেফ স্তালিন কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক বি টি রণদিভের বালখিল্য দুঃসাহসী রণনীতি ও প্রোগ্রামের তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিকে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের কথা ভেবে সে হিসেবে নতুন লাইন স্থির করতে পরামর্শ দিলেন। পার্টির ভেতরে আত্মসমীক্ষা শুরু হল। কাকদ্বীপের কমরেডদের নতুন পরিস্থিতির কথা জানিয়ে দেওয়া হল। অশোক বোস ও কংসারী হালদার আরও অনেক কমরেডের সঙ্গে সুন্দরবন ছেড়ে চলে এলেন।

ভাগচাষী ও অন্যান্য কৃষকদের আত্মদান ব্যর্থ হয়নি। জমিদারদের ঘৃণার চোখে দেখা আজ সাধারণ ব্যাপার। আজকের ভারতবর্ষে সামন্ততন্ত্র ও জমিদারী প্রথার বাহ্যিক উচ্ছেদ আসলে কাকদ্বীপ, তেলেঙ্গানা, ভায়লার ও ওয়ার্লি কৃষক অভ্যুত্থানের ফলশ্রুতি।

আন্দোলনকে পিষে ফেলার পর কংগ্রেস সরকার আন্দোলনের নেতাদের রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে বন্দী করে মামলা শুরু করল। এর জন্যে এক বিশেষ আদালত গঠিত হল। শুরু হল সাতটি মামলা যাতে অভিযুক্ত হলেন অশোক বোস, কংসারি হালদার, গজেন মালী, বিজয় মন্ডল, ভুষণ কামিলা, মানিক হাজরা, তরণী সাহু, ভীম ঘোড়ুই, ক্ষীরোদ বেরা, সূর্য বারিক, দ্বিজেন দিন্দা, এবং আরও ছাব্বিশ জন। কিন্তু কলকাতা হাইকোর্ট ও সুপ্রীম কোর্ট এই বিশেষ আদালতকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করায় বঙ্গ সরকার একটি ব্রিটিশ জমানার ক্রিমিনাল জুরিসডিকশন অ্যাক্ট, ১৯১৫’র সাহায্যে ট্রাইব্যুনাল গঠনের অর্ডিনান্স জারী করল। এই ট্রাইব্যুনাল ১৯৫৯ সালে তার রায় ঘোষণা করল, উপরোক্ত নেতারা রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে দোষী, শাস্তি যাবজ্জীবন কারাবাস। অন্যান্যদের মুক্তি দেওয়া হল। সেই রায়ে স্পেশাল জজ লিখলেন যে অপরাধীদের তাদের ঘৃণ্য রাষ্ট্রদ্রোহের জন্যে ফাঁসি দিলেই ঠিক হত; কিন্তু পরিস্থিতির জন্য ওদের তুলনামূলক ভাবে লঘু শাস্তি দিতে হল। কারণ, আসল অপরাধী হল নদীয়া জেলার অশোক বোস নামে এক যুবক যে আজও অধরা। সে গরীব মানুষদের অসহায়তা ও দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে তাদের ভুলপথে চালিত করেছে। একদিন আইনের হাত ঠিক তাকে ধরে আনবে।

অশোকেরও তখন বিষম পরিস্থিতি। সমস্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহকর্মীরা জেলের ভেতরে। নিজের মাথার উপরে পঞ্চাশ হাজার টাকার ইনামের খাঁড়া ঝুলছে। নিরাপদ আশ্রয়স্থল ও টাকাপয়সার সাশ্রয় নেই বললেই চলে। এদিকে গোপন জীবনের কঠিন শ্রমের ফলে বুকে বাসা বেঁধেছে কালব্যাধি যক্ষ্মা। আবার পার্টি বলছে গোপন অবস্থান চালিয়ে যেতে। ওঁর স্ত্রী মাধবী গেলেন নিজের শ্বশুর ও দাদাশ্বশুরের কাছে আশোকের চিকিৎসার জন্যে কিছু আর্থিক সাহায্য চাইতে। মাধবী নিজে একজন প্রশিক্ষিত নার্স। অশোক সেরে উঠলেন। শুরু হল নতুন জীবন। ১৯৫২ সালের জুন মাসে ওঁরা দুজনে চলে গেলেন তৎকালীন মধ্যপ্রদেশের, অধুনা ছত্তিশগড়ের, রাজনন্দগাঁওয়ে। সেখানে তখন পার্টি ও গণসংগঠন ছিল ভ্রূণ অবস্থায়। অশোক নতুন নাম নিলেন প্রকাশ রায়। তারপর নতুন পরিচয়ে নতুন রাজনৈতিক লাইনে পার্টি গড়ে তোলার কাজে লেগে পড়লেন।

প্রকাশ রেলস্টেশন এলাকায় বিড়ি শ্রমিকদের সংগঠিত করতে লাগলেন যদিও তৎকালীন পার্টি নেতৃত্ব বিড়ি শ্রমিকদের ইউনিয়ন নিয়ে তেমন কোনো উৎসাহ দেখায়নি। গোড়াতেই স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন যে ইউনিয়ন কমিউনিস্ট আন্দোলন গড়ে তোলার জন্যে একটা পদক্ষেপ মাত্র। তাই তার মাধ্যমে বেশি কিছু আর্থিক সুবিধে আদায়ের স্বপ্ন দেখলে সেটা ভুল হবে। ঠিক তাই ঘটল। ইউনিয়ন করার অপরাধে ৫০০ শ্রমিক ছাঁটাই হলেন। মহিলা শ্রমিকেরা একজোট হয়ে ঠিক করলেন যে যতদিন না অবস্থা ভাল হচ্ছে ততদিন প্রকাশ ও তাঁর পরিবারের বেঁচে থাকার আবশ্যক ভাতকাপড়ের ভার তাঁরা পালা করে নেবেন, সাপ্তাহিক ভিত্তিতে। এই ব্যবস্থা কায়েম ছিল পুরো চার বছর।

তেভাগা আন্দোলনের রাঙা ডাক্তার, অর্থাৎ ছত্তিশগড়ের বিলাসপুর নিবাসী পুর্ণেন্দু ঘোষের উল্লেখ অপ্রাসঙ্গিক হবে না। কলকাতায় আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে এমবিবিএস পড়ার সময় তিনি কমিউনিস্ট আন্দোলনের সংস্পর্শে আসেন। পড়া শেষ হলে ডা. ঘোষ পার্টির ডাকে সাড়া দিয়ে পিপলস্ রিলিফ কমিটির মাধ্যমে সুন্দরবনে মেডিক্যাল স্কোয়াডে যোগ দেন। সেখানে আহত কমরেডদের শুশ্রুষা ও চিকিৎসা করার ফাঁকে ফাঁকে কৃষকদের ট্রেনিং দিয়ে কিছু প্রাথমিক চিকিৎসা ও নার্সিং এর দল গড়ে তোলেন। সেই সময় ডা. ঘোষের যোগাযোগ হয় প্রবাদপ্রতিম নেতা কংসারি হালদার ওরফে মধুদার সঙ্গে। ডা. ঘোষ ঘনিষ্ঠ হন অশোক বোসের সঙ্গে। ১৯৪৯ নাগাদ শহর ও গ্রামাঞ্চলের আন্দোলন ক্রমশঃ এক নতুন মাত্রা পেল। কাকদ্বীপের চাষীরা পুলিস ও মিলিটারির থেকে ছিনিয়ে নেওয়া স্টেনগান ও রিভলভার নিয়ে সশস্ত্র দলে সঙ্ঘবদ্ধ হতে শুরু করল। ডা. ঘোষ ধরা পড়লেন এবং তাঁকে কলকাতার ১ নং লর্ড সিনহা রোডের কুখ্যাত যন্ত্রণাগারে নিয়ে আসা হল। ছাড়া পাবার পরে তিনি ফিরে গেলেন ছত্তিশগড়ের বিলাসপুর শহরে ও সেখানে ‘গরীবের ডাক্তার’ হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করলেন। সত্তরের দশকে নকশালবাড়ি অভ্যুত্থান ও সিপিআই (এম-এল) গঠন হলে সিপিআই(এম-এল)-এর মধ্যপ্রদেশ রাজ্য কমিটির সদস্যপদ গ্রহণ করলেন ডা. ঘোষ।

ডা. ঘোষ ১৯৮৩ নাগাদ জানতে পারলেন যে ছত্তিশগড়ের রাজনন্দগাঁওয়ের ট্রেড ইউনিয়ন নেতা প্রকাশ রায় আসলে তাঁর তেভাগা আন্দোলনের দিনের সাথী ও গুরু অশোক বোস। তিনি লেখিকা মহাশ্বেতা দেবীকে সঙ্গে নিয়ে রাজনন্দগাঁও শহরে অশোক বোসের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। সেইসময় মহাশ্বেতা অশোক বোসের ‘‘কাকদ্বীপ - শিশু তেলেঙ্গানা’’ নামে পুরনো রিপোর্ট নিয়ে কাজ করছিলেন। মহাশ্বেতা পরে যুগান্তর পত্রিকার সাময়িকীতে লিখেছিলেন, এক রিকশাওয়ালাকে নাম বলতেই তাঁদের পুরনো সাথী অশোক বোসের আস্তানা, দু’কামরার খুপরি ঘরে পৌঁছে দিয়েছিল।

১৯৫৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে কংসারি হালদার ডায়মন্ডহারবার সংসদীয় কেন্দ্র থেকে কমিউনিস্ট পার্টির টিকিটে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে সাংসদ হলেন। তাঁকে পুলিশ সংসদের অধিবেশন চলাকালীন গ্রেফতার করে। দীর্ঘ চার বছরের আইনী লড়াইয়ের পর অবশেষে সুপ্রীম কোর্ট তাঁকে নির্দোষ ঘোষণা করে মুক্তি দেয়।

২২শে নভেম্বর, ১৯৫৭। প্রকাশ বিড়ি কারখানার গেটের সামনে বিড়ি মজদুরদের আমরণ ভূখ হরতালের নেতৃত্ব দেন। এ ধরণের স্ট্রাইক রাজনন্দগাঁওয়ে অভূতপূর্ব ছিল। হরতালের ১১ দিনের মাথায় মধ্যবিত্তদের বিবেকদংশন, কিছু প্রবুদ্ধ নাগরিক ও ব্যবসায়ীদের একটা অংশ ফ্যাক্টরি মালিকের উপর এমন চাপ সৃষ্টি করল যে তিনি বেশির ভাগ দাবি মেনে নিতে বাধ্য হলেন। এই আন্দোলন জনসাধারণের মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টি সম্বন্ধে বিশেষ আগ্রহ ও সমীহ জাগিয়ে তুলল। একটা বছরও গেল না, প্রকাশ আবার ওই ফ্যাক্টরির একতরফা লক-আউট ঘোষণার প্রতিবাদে গেটের সামনে অনশনে বসলেন। মালিকপক্ষ অনড়। তাই দেখে শাকির আলী ঘোষণা করলেন, হয় গেটের তালা খুলবে, নয় এখান থেকে প্রকাশ রায়ের শবযাত্রা শুরু হবে। শেষে দশদিনের মাথায় ফ্যাক্টরির তালা খুলল।

১৯৫৮ সালে ভিলাই ইস্পাত সংযন্ত্রের সাবসিডিয়ারি হিসেবে রাজাহারা আয়রন মাইনসের উৎপাদন শুরু হয়। স্থানীয় জনজাতির কিছু শ্রমিক, যারা আগে বালাঘাটে ম্যাঙ্গানীজ মাইনসে কাজ করছিল, তারা রাজাহারায় এসে মাইনসের কাজে যোগ দিল।

সন ১৯৫৮ থেকে ১৯৬১; বড় কঠিন বড় সংকটময় সময়। রাজনন্দগাঁওয়ে বিএনসি মিল বন্ধ হয়ে গেল। পার্টি রাজনন্দগাঁওয়ের কমরেডদের নির্দেশ দিল প্রকাশের সঙ্গে কাজ করতে কয়েক জনকে পাঠাতে। বাজীরাও শেন্ডে, অর্জুন, শ্যাম কর, গণেশরাম যাদব, মহাদেব বমলে, দৌবা ও আরও কয়েকজন রাজাহারায় প্রকাশের কাজে সাহায্য করতে এল। রাজাহারার বিড়ি মজদুরেরা চাঁদা তুলে পার্টি ইউনিটের খরচা চালাতে লাগল। অবশ্য ভিলাই সংযন্ত্রের কর্তৃপক্ষ কমিউনিস্ট ইউনিয়নের বাড়বাড়ন্তকে ভালো চোখে দেখছিলেন না। যান্ত্রিক উৎখনন প্রক্রিয়া তখনও মাত্র শৈশবে। খনিতে মাল তোলার কাজ প্রধানতঃ ঠিকেদারদের মাধ্যমেই করা হত। একজন অফিসার তো প্রকাশ্যেই বলে বেড়াচ্ছিলেন, কেউ প্রকাশ রায় বলে লোকটাকে একবার জীপের তলায় পিষে দিক গে! যদিও প্রকাশ রাতবিরেতে জঙ্গলের রাস্তায় একা চলে যেতেন শ্রমিকদের সঙ্গে দেখা করতে, তবু কোনো জীপ ড্রাইভার তাঁকে জীপ চালিয়ে মেরে ফেলার কথা ভাবেনি। কারণ সব ড্রাইভারই ততদিনে লালঝান্ডা ইউনিয়নের সদস্য হয়ে গেছে।

১৯৬০ সালে ভিলাই ইস্পাত সংযন্ত্র ২০০০ শ্রমিকদের লে-অফ করার ঘোষণা করল। ইউনিয়নের আপত্তি সত্ত্বেও প্রকাশ এর প্রতিবাদে অনশন শুরু করলেন আর গ্রেফতার হলেন। তাঁকে বন্দী করে রায়পুর জেলে পাঠানো হচ্ছে এমন সময় লালঝান্ডা হাতে বিশাল মজদুর জনতা ওদের ঘিরে ফেলল। নেতৃত্বে সাবিত্রী বাঈ। সে ধর্ণায় বসে আওয়াজ তুলল, ‘হয় কমরেড প্রকাশকে ছেড়ে দাও, নয় আমরাই ওকে ছাড়িয়ে নেব’। হাওয়া গরম। দূর্গ জেলার এডিএম মিঃ রাজপুত এক বিশাল রাইফেলধারী বাহিনী নিয়ে এলেন, কিন্তু একজন শ্রমিকও নড়ল না। এবার এডিএম ভয় পেয়ে প্রকাশকে অনুরোধ করলেন সব মজদুরকে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিতে। প্রকাশ বললেন, আগে আপনি আপনার রাইফেলবাহিনীকে ফিরিয়ে নিন আর আমাকে আমার কমরেডদের সঙ্গে কথা বলতে দিন। ভরসা রাখুন, আমি পালাবো না। প্রকাশ ও তাঁর সাথীরা শ্রমিকদের বুঝিয়ে ফেরত পাঠালেন। পরে তিনি ও তাঁর কমরেডরা মাথাপিছু চল্লিশ হাজার টাকার জামানতে ছাড়া পেলেন। শেষমেষ ইস্পাত কর্তৃপক্ষ ইউনিয়নের সঙ্গে এক লিখিত চুক্তি করলেন। তাতে ১৬০০ শ্রমিক পুনর্বহাল হল।

প্রকাশ কিছু কিছু গ্রামে, যেমন খয়রাগড়, সিংহোলা ইত্যাদিতে বিড়ি শ্রমিকদের নিয়ে পার্টি ও ইউনিয়ন গড়ে তুলছিলেন, নেটওয়ার্ক বিস্তৃত হচ্ছিল। কিন্তু নতুন কিছু সমস্যা দেখা দিল। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বিভাগ এই দম্পতির ব্যাপারে ১৯৫৭-৫৮ থেকেই সন্দিহান ছিল। এরা ছদ্মনামে সেই অশোক বোস দম্পতি নয় তো, যাদের মাথার উপরে ইনাম ঘোষণা করা হয়েছে? ইতিমধ্যে রাজনন্দগাঁও বিএনসি কটন মিলের গেটের সামনে শ্রমিকেরা মিল খোলার দাবিতে ধর্নায় বসেছেন। রায় দম্পতি সেই ধর্নাস্থল থেকে জেলে গেলেন। ধীরে ধীরে রাজবন্দীদের মুক্তি, রাষ্ট্রদ্রোহিতার চার্জ ও অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট খারিজ করার দাবিতে আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে। এতে কমিউনিস্ট ছাড়াও গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষেরা যোগ দিলেন।

১৭ই ডিসেম্বর, ১৯৬১। কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে একটি প্রতিনিধিদল দেশের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর সঙ্গে দিল্লিতে দেখা করে এক স্মারকপত্র দিলেন। তাতে প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করা হল, তিনি যেন দীর্ঘদিন ধরে কারাবন্দীদের মুক্তির ও গ্রেফতারিনামা খারিজের দাবিগুলো সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করেন। ওঁকে আরও বলা হল যে, তিনি যেন ঝুলে থাকা কোর্ট কেসগুলো তুলে নিয়ে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দেন। এর ফলশ্রুতিতে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের মধ্যে বোঝাপড়ায় ১৯৬২’র ১৫ই অগাস্টে সমস্ত রাজবন্দীদের মুক্তি দেওয়া হল। ছ’জন আন্ডারগ্রাউন্ড কমিউনিস্ট, অশোক বোস, তেজ সিং স্বতন্ত্র, রাজারাম, দর্শন সিং ঢাকলা, ইন্দর সিং ও সাখা সিং-এর উপর থেকে গ্রেফতারি পরোয়ানা তুলে নেওয়ায় অশোক বোসের ১৪ বছরের দীর্ঘ অজ্ঞাতবাস সমাপ্ত হল।

১৯৭৩ এর ফেব্রুয়ারি মাসে অশোক বোস ফের কাকদ্বীপে যাওয়ার সুযোগ পেলেন। পুরনো সাথী গজেন মালি প্রয়াত। অনেক বয়োঃজেষ্ঠরাই নেই। কিন্তু যাঁরা আছেন, তাঁরা অশোককে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। অশোক গেলেন চন্দনপিঁড়ি গাঁয়ে, যেখানে শহীদ মায়েদের রক্তে মাটি ভিজেছিল, আর অহল্যা মার বেয়নেটে চিরে দেওয়া কোখ থেকে বেরিয়ে এসেছিল এক অজাত শিশুর হাত।

৩রা সেপ্টেম্বর, ১৯৮৩। অশোক বোস রাজনন্দগাঁও শহরে মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে মারা গেলেন। শরীর সুস্থ ছিল না, তবু জিদ করছিলেন যে আন্দোলনরত শ্রমিকদের জমায়েতে ভাষণ দেবেন বলে। মঞ্চে অচেতন হয়ে লুটিয়ে পড়লেন, আর উঠলেন না।

প্রকাশ ছিলেন পুরনো কমিউনিস্টদের সেই বিরলদের অন্যতম, যাঁদের তুল্য আজকালকার মুখ্যধারার কমিউনিস্ট নেতাদের মধ্যে সাধারণতঃ দেখা যায় না। জীবনের শেষদিন অবধি তিনি চরম দারিদ্র্যের মধ্যে কাটিয়েছেন। স্ত্রী এবং সহযোদ্ধা মাধবী রায় অনেক আগেই, ১৯৭৫ সালের ৩রা ডিসেম্বর প্রয়াত হয়েছিলেন। তারপর বহু দিন কেটে গেছে, ওঁর পার্টি পরিবারের বাকিদের কোনো খোঁজখবর নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি।

তেভাগার সময়ে কাকদ্বীপে অশোক বোস ছিলেন শ্রেণিশত্রুদের চোখে লালসন্ত্রাসের মুখ। আন্দোলনে ভাটার টান ধরলে তিনি স্ত্রী মাধবীকে নিয়ে সুদূর রাজনন্দগাঁওয়ে চলে এলেন। তখন তিনি নিঃস্ব, যক্ষায় আক্রান্ত, সহায়সম্বলহীন, বড্ড একলা। তবু মনের জোরে আর অক্লান্ত পরিশ্রমে গড়ে তুললেন সিপিআইয়ের শাখা আর আজীবন বিশ্বস্ত রইলেন নিজের দলের প্রতি।

১৯৬৪তে দল বিভক্ত হয়ে নতুন আর একটি দল, সিপিআই(এম) জন্ম নিল। এরপর ১৯৬৭তে নকশালবাড়ির বিদ্রোহে ধ্বনিত হল ‘বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ’! এর ফলে ১৯৬৯এ জন্ম নিল সিপিআই (এম-এল), লক্ষ্য ছিল সমস্তরকম সংশোধনবাদী লাইনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কর্মসূচীকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।

১৯৬৭র নকশালবাড়ির কৃষক আন্দোলনের প্রভাবে যাঁরা ছত্তিশগড়ে আসল সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ও কৃষিবিপ্লবের পতাকা তুলে ধরেছিলেন তাঁরা হলেন শংকর গুহনিয়োগী, যোগী রায়, ডা. পূর্ণেন্দু ঘোষ, হরেকৃষ্ণ কর্মকার ও মধু ভট্টাচার্য্য। কিছুদিন পরেই শংকর গুহনিয়োগী সংকীর্ণ খতম অভিযানের লাইন ও ‘কেবল সশস্ত্র সংগ্রামই মুক্তি আনবে’ এমন লাইনের বিরোধিতা করে আলাদা হয়ে যান। ১৯৭৭ নাগাদ তিনি একের পর এক জঙ্গী মজদুর আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন, প্রথমে দল্লী-রাজহরা, পরে ভিলাই ও তারপরে রাজনন্দগাঁওয়ে। নিয়োগীর সঙ্গে মতাদর্শগত ফারাক সত্ত্বেও প্রকাশ কখনও নিয়োগীকে প্রয়োজনীয় সহায়তা ও পরামর্শ দিতে দ্বিধা করেননি। একথা নিয়োগী নিজেই ওঁর ‘মিতান’ নামের লেখায় উল্লেখ করেছেন। ১৯৯১য়ে নিয়োগী নিজেই তৎকালীন বিজেপি রাজ্য সরকারের প্রত্যক্ষ মদদপুষ্ট ভাড়াটে খুনীদের হাতে নিহত হলেন।

ছত্তিশগড় রাজ্যের রাজনন্দগাঁও জেলা অনেক প্রগতিশীল আন্দোলন ও সর্বোচ্চ বিপ্লবী ঐতিহ্যের ধারক; প্রথম শহীদ রামাধীন গোঁড় বা পরের শহীদ জরহু গোঁড় অথবা প্যারেলাল ঠাকুর, গজানন মাধব মুক্তিবোধ, রুইকারজী, রমেশ যাজ্ঞিক ও বিপ্লবী অশোক বোস ওরফে প্রকাশ রায়।

অশোক বোস ছিলেন একজন বামপন্থী বুদ্ধিজীবী, ভারতের বাম আন্দোলনের এক অগ্রণী যোদ্ধা এবং বঙ্গের বিপ্লবী কৃষক আন্দোলন বা তেভাগার নেতৃত্ব দেওয়া এক কমরেড। জীবনের পরবর্তী অধ্যায়ে তিনি রাজনন্দগাঁওকেই ঘাঁটি করে অন্যায় ও অসাম্যে ভরা সমাজ বদলানোর লড়াই শুরু করেছিলেন এবং স্থানীয় মজদুর, গরীব ও বঞ্চিতদের সংগ্রামী চেতনার বিকাশের হোতা হয়ে উঠেছিলেন আর এভাবেই সমাজতন্ত্র গড়ার দিকে অগ্রসর হয়েছিলেন।

ওঁকে স্মরণ করছি, আশা করছি নতুন প্রজন্মের যুব-ছাত্ররা ওঁর জীবন ও আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে এক শোষণহীন সমতাভিত্তিক স্বপ্নের ভারত নির্মাণের কাজে ব্রতী হবে।


স্বীকৃতিঃ
১। তেভাগা - এক সংস্মরণ (বাংলা ও হিন্দীতে), ডা. পূর্ণেন্দু ঘোষ, ১৯৯০।
৩। কাকদ্বীপ - শিশু তেলেঙ্গানা (হিন্দী), প্রকাশ রায়।
৫। লালগঞ্জে পৌঁছবই ও অন্যান্য কবিতা (বাংলা), ডা. পূর্ণেন্দু ঘোষ।