আরেক রকম ● দশম বর্ষ ঊনবিংশ-বিংশ সংখ্যা ● ১-৩১ অক্টোবর, ২০২২ ● ১৬ আশ্বিন - ১৫ কার্তিক, ১৪২৯

প্রবন্ধ

ধর্মতলায় বাম সভা - বিশে সেপ্টেম্বর, ২০২২

শুভময় মৈত্র


হাজার পঞ্চাশ লোকের একটা সভা পশ্চিমবঙ্গে নতুন কিছু নয়। সুতরাং এ প্রশ্ন উঠবেই যে এরকম একটা সভা নিয়ে বিশ্লেষণী আলোচনা আদৌ হতে পারে কিনা। পশ্চিমবঙ্গে প্রায় সাত কোটি ভোটার। সাধারণভাবে তার মধ্যে পাঁচ কোটি মত ভোট যন্ত্রবন্দী হয়। এর মাত্র এক শতাংশ হল পাঁচ লক্ষ। অর্থাৎ গত বিশে সেপ্টেম্বর, ২০২২-এ ধর্মতলায় ইনসাফ চাওয়ার জন্যে মূলত সিপিআই(এম) সমর্থক ছাত্র-যুবদের যে সমাবেশ তাতে পশ্চিমবঙ্গে প্রদত্ত ভোটের শূন্য দশমিক এক শতাংশ উপস্থিত ছিলেন। এরা আরও দল বাড়িয়ে আগামী বছর পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারবেন, নাকি আসনের হিসেবে শূন্যের প্রতিবেশীই থেকে যাবেন, তা নিয়ে সংবাদমাধ্যম বা সন্ধ্যার তরজায় আলোচনা চলতেই থাকবে। ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার পর দশ বছরে ক্রমাগত সমর্থন কমেছে বামেদের। তবে সদ্য ২০২১ বিধানভা নির্বাচনের পর থেকে এক বছরের কিছু বেশি সময় ধরে সেই ধারার পরিবর্তন ঘটছে। অর্থাৎ বিজেপির ভোট এখন সামান্য হ্রস্বমান, সিপিআই(এম)-র আলতো বাড়ার দিকে। আর সত্যি ভোটে তৃণমূল সম্ভবত এখনও এগিয়ে, যদিও সেই মাপ সঠিক অনুমান করা শক্ত। ছাপানো অঙ্ক বলে শাসন ক্ষমতার ফাউ যোগ করে শাসক দল ধরাছোঁয়ার বাইরে। তবে সাম্প্রতিক দুর্নীতির এক তাল অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে। বিরোধীদের পিঠে তাল পড়ার ধমক দিয়ে সামলানোর কিছুটা চেষ্টা করছেন শাসককুল। এই পরিস্থিতিতে বামেদের মিছিল এবং সমাবেশ। একটু খুঁজে দেখা যাক, এই রাজনৈতিক কার্যকলাপের চরিত্র কতটা আলাদা, এবং তা কতটা ইতিবাচক।

প্রথম ইতিবাচক বিষয় হল ভাড়া করা বাস কিংবা টেম্পো নেই। পশ্চিমবঙ্গে বাসে করে লোক আনা একেবারে বামফ্রন্ট রাজত্বে শুরু হওয়া বিষয়। বাস ভাড়া করা কথাটা সবক্ষেত্রে সত্যি নয়। কারণ ক্ষমতায় বলীয়ান পার্টি নেতারা তো আর সবসময় ভাড়া দেওয়ার সময় পেতেন না। সেই রকম অতীতের মাঝের সারির সবল বাম নেতাদের একটা অংশ এখন তৃণমূল এবং বিজেপিকে পথ দেখাচ্ছেন। এমনকি বিরোধী থাকাকালীনও ব্রিগেডের সভায় দূর দূরান্ত থেকে বাসে করে মানুষ এনেছেন বামফ্রন্ট নেতৃত্ব। বিজেপি আজকাল আবার ট্রেন ভাড়া করে। শাসক তৃণমূল তো এখন রাজ্যের মালিক, ফলে সেভাবে ভাড়ার জটিলতায় না গিয়ে চেয়ে নিলেই হল। কিন্তু বাম ছাত্র-যুবদের কুড়ি তারিখের সভায় এই চরিত্র সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে মানুষ উপস্থিত হয়েছেন গণপরিবহনে। এবং তাঁরা অনেকেই বেশ দূর থেকে এসেছেন। অর্থাৎ কলকাতা শহরের বুকে সেদিনের সমাবেশে যারা এসেছিলেন, তাঁরা নেতৃত্বের আদেশে আসেননি, আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন। সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় এসেছেন ইনসাফ, কাজ এবং শিক্ষার দাবিতে। এটি এই সভার বিশেষত্ব। বাস ভাড়া করে কলকাতা বেড়ানোর এবং রাস্তায় রান্না করে খাওয়ার উপরি পাওনা এখানে হিসেবের খাতায় লেখার দরকার পড়েনি।

দ্বিতীয় বিষয় হল সমাবেশে আগত সমর্থকদের মধ্যে নিয়মানুবর্তিতা এবং আগ্রাসনের মিশেল। আবেগ তো ছিলই, সুতরাং সে নিয়ে আলাদা করে বলার কিছু নেই। মূল বিষয় ছিল আনিস খানের মৃত্যুর সঠিক তদন্তের দাবি। এরকম একটা বিষয়ে যে ক্ষোভের আগুন, তা স্বাভাবিক নিয়মেই সময়ের সঙ্গে কিছুটা প্রশমিত হয়েছে। ফলে সুদীপ্ত, বরুণ, মইদুল বা আনিসকে এখন মূলত স্মরণ করা হচ্ছে বিরোধী আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে। সেই শহীদ কমরেডদের ছবি হাতে শ্লোগান দিয়েছেন মিছিলে হাঁটা মানুষ। গোটা পথে গণপরিবহনে যে মানুষেরা পৌঁছেছেন হাওড়া বা শিয়ালদায়, তাদের বিরুদ্ধে সামাজিক মাধ্যমে তো বটেই অন্যত্রও কোনও অভিযোগ শোনা যায়নি। সভাস্থল পরিবর্তন হওয়ায় অবশ্যই কিছু মানুষের অসুবিধে হয়েছে। সেকথা বারবার মনে করিয়ে দিয়েছেন নেতৃত্ব, বলেছেন যে প্রশাসন রাস্তার একদিক ছেড়ে দিয়ে সভা করার অনুমতি দিলে এই সমস্যা হত না। ফলে সোজা ইংরিজিতে ডিসিপ্লিনের কোন অভাব ছিল না। আজকের বাংলার রাজনীতিতে হঠাৎ করে হট্টগোল পাকিয়ে ব্যারিকেড, ইট, লাঠি, জলকামান, কাঁদানে গ্যাসের যে চেনা রুটিন, তা একেবারেই অনুপস্থিত এই সমাবেশে। সবথেকে উল্লেখযোগ্য বিষয়, লোক বেশি হওয়ায় যখন সমাবেশ ওয়াই চ্যানেল থেকে ভিক্টোরিয়া হাউসের দিকে সরিয়ে নিতে সিদ্ধান্ত জানালেন নেত্রী, তখন যে মসৃণতায় সভাস্থলের মানুষ ট্রামলাইনে হাঁটলেন, তা একেবারে যেন ময়দানে ট্রাম চলার সাবলীল ছন্দ। জীবনানন্দের মৃত্যুতে যে বেদনার ইতিহাস, সেই কলকাতার ট্রামে ছুঁয়ে থাকল দেড়শো বছর উদযাপনের প্রাক্কালে হাজারো ছাত্র-যুবর এই উৎফুল্লতার স্মৃতি। পঞ্চাশ হাজারের মধ্যে একজন মানুষও ট্রামলাইনে হোঁচট খেয়েছেন বলে মনে হয় না। এইখানে ধর্মতলা দখলের নিদানে যে সারল্যমাখা দৃঢ়তা ছিল নেত্রীর গলায়, সেখানে আলাদা করে আগ্রাসন প্রকাশ করতে হয়নি। এই নেত্রীর সবথেকে বড় গুণ দলীয় সমর্থকদের তাঁর পরিবারের সদস্যের মত আগলে রাখার আবেদন। মিছিল ছাত্র-যুবদের হলেও তাতে প্রৌঢ়দের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মত। সমাবেশের স্থান পরিবর্তনের সময় তাঁদের যেন হুড়োহুড়িতে অসুবিধে না হয়, সেকথা ক্রমাগত প্রতিধ্বনিত হয়েছে নেত্রীর কণ্ঠে। গোটা সমাবেশের সুর যে তালে বাঁধা ছিল, তাতে সবথেকে নিশ্চিন্ত হয়েছেন আইনরক্ষকেরা। বাধা দেওয়ার সাহস হয়নি, প্রয়োজনও। নীরব দর্শকের ভূমিকায় থাকলেও, তাঁদের চোখেমুখে ছিল স্বস্তির ছাপ। পুলিশকর্মীরা এখানে যেন নীরব দর্শকের মতো আচরণ করেছেন। সভায় অংশগ্রহণকারীদের প্রতি তাদের প্রচ্ছন্ন সমর্থনের আভাসও হয়তো কিছুটা পাওয়া গেছে। এমনটা বহু বছর এ রাজ্যের রাজনীতি দেখেনি।

রাজনীতির একটা বড় অংশ একসাথে হওয়া। আনিসের মুখোশ এই সমাবেশের একটি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য বিষয়। তৃণমূল বা বিজেপির রাজনীতিতে মুখোশের চল অনেক বেশি। আর সেই মুখোশ মূলত বড় নেতাদের অনুকরণে তৈরি হয়। সেখানে আনিসের মত একজন সাধারণ কর্মীকে স্মরণ করে ছাত্র-যুবদের এই দলবদ্ধ পদক্ষেপ অন্য ধারার সৃষ্টি করলো। আনিসের সঙ্গে ছিল সুদীপ্তর বিশাল ছবি। নেতা-নেত্রীদের মুখ নয়, শহীদ বন্ধুদের মনে রাখা, এ অবশ্যই উন্নততর গণতান্ত্রিক ভাবনার পরিচয়। আর ছিল ছোটো ছোটো ব্যঙ্গের রঙ দিয়ে আঁকা ত্রিমাত্রিক চলমানতা। একজন সমর্থক যেভাবে চানাচুর-বাদাম-ছোলা-ডালমুটের ডালা নিয়ে ঘুরছিলেন, সত্যিকারের বিক্রেতাদের সঙ্গে বারবার গুলিয়ে ফেলতে হচ্ছিল তাঁকে। মাথায় একটা বেশ নধর পাকা তাল নিয়েও সমাবেশে এসেছিলেন জনৈক সমর্থক। বাড়ি ফিরে গিয়ে সেই তালের বড়া বানিয়েছেন কিনা সে খবর অবশ্য সন্ধ্যার ঘটমান ভঙ্গুর সংবাদে জানা যায়নি। শহীদ স্মরণে বামপন্থীদের সভামঞ্চে যে ব্যবসায়িক বাংলা ছবির চটুল নাচ হবে না সেকথা সকলেই জানেন। তবে মিটিং-এর শুরুতে গিটারে বাজানো গানের সঙ্গে দু-একজন প্রৌঢ় কমরেডের শালীন এবং স্বতস্ফূর্ত শরীরী তরঙ্গ অবশ্যই প্রত্যক্ষ করা গেছে। আগেই বলেছি শহীদ স্মরণে তীব্র ক্ষোভের স্কেলে এই সভার সুর বাঁধা ছিল না। বরং লাগামছাড়া না হলেও উৎফুল্লতা ছিল যথেষ্টই। একজনকে বলতে শোনা গেল ভাগ্যিস 'বিশ্ব বাংলা'র কোন ‘ব’ ধারেকাছে নেই, নাহলে কেউ হয়তো উপড়ে ফেলতে যেত। উল্লেখ্য, সাম্প্রতিক বর্ধমানের জনসভার, যেখানে অশান্তি হয়েছিল কিছুটা। এই আলোচনা করার সময়েও উত্তরবঙ্গে জেলাশাসকের কার্যালয় অভিযানে ব্যারিকেড ভাঙা থেকে জলকামানে স্নানে সামিল হয়েছেন বাম কর্মীরা। তুলনায় ধর্মতলার সভায় দৃঢ়তা এতোটাই বেশি ছিল, আগ্রাসন এতোটাই মাপা ছিল, যে অতিপরিচিত হুড়োহুড়ি একেবারেই চোখে পড়েনি। এই সভা সেই প্রেক্ষিতে একেবারে আলাদা। বামপন্থীরা যে বেশি করে এই ধরনের মিছিল এবং সমাবেশ করতে শিখছেন, তার প্রমাণ কয়েকদিন আগে বিধাননগরে তাঁদের সভা। একেবারে সাম্প্রতিক সময়ে বাঁকুড়াতেও একটি দু-কিলোমিটারের বেশি লম্বা মিছিলের ছবি দেখা গেছে সমাজমাধ্যমে, যেখানে কোনো গোলমাল নেই। তীব্র আন্দোলনী ট্রাম পোড়ানো কম্যুনিস্ট থেকে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট হিসেবে আত্মপ্রকাশের একটা রূপ দেখা যাচ্ছে এই সময়ের সিপিআই(এম)-র মধ্যে। গণতান্ত্রিক ভাবনায় এই বিবর্তনকে অনেকে উত্তরণ হিসেবে ভাবতেই পারেন।

সিপিআই(এম) দলে যুব নেতৃত্বের উত্থান আইনসভার নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছিল। তাঁরা ভোটে জেতেননি, কিন্তু দলের এই দীর্ঘমেয়াদী কর্মসূচি যে কাজে দিচ্ছে তার প্রমাণ এই জনসভা। বাম যুব নেতৃত্বের মুখগুলো সমর্থকদের মনে দাগ কেটেছে, এবং বিশেষ করে নেত্রীর অধিনায়িকায় রূপান্তর এর মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। এই সমাবেশের নিরিখে নেত্রীর উল্লেখে বারবার উঠে এসেছে ‘ক্যাপ্টেন’ শব্দটি, যা নিয়ে সিপিআই(এম)-এর মধ্যে সামান্য হলেও অস্বস্তির জায়গা তৈরি হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ এই দলের কিছু নিয়ম নীতি আছে, যার মধ্যে একটি হল ব্যক্তিপূজাকে প্রশ্রয় না দেওয়া। পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল বা বিজেপির মধ্যে যে ধরনের প্রকাশ্য অন্তর্দ্বন্দ্ব, সিপিআই(এম)-র মধ্যে ততটা নেই। দলের মধ্যে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ক্ষমতা দখলের চোরা সংঘাত তো থাকবেই। সেখানে এই 'ক্যাপ্টেন নেত্রী' নিয়ে আলোচনায় সংবাদমাধ্যমের সামনে খুব একটা সাবলীল নন পার্টির প্রবীণ নেতারা। ধর্মতলায় সভাস্থল বদলানোর পর চোঙা মাইকের বদান্যতায় এবং জনগণের বাঁধভাঙা শ্লোগানে যেমন ছ-চাকার টেম্পোর ওপরে গলার শির ফোলানো নেতাদের কথা পরিষ্কার শোনা যায়নি, জনগণের কাছে ঠিক ততটাই অস্পষ্ট ক্যাপ্টেন নেত্রী সম্পর্কে সিপিআই(এম)-র ভবিষ্যৎ ভাবনা। প্রতিটি নির্বাচনের আগে যেমন তাঁরা জিতলে পঞ্চায়েত প্রধান কিংবা মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান থেকে কলকাতার মেয়র বা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কে হবেন সেই বিষয়ে সিপিআই(এম) পুরো বিষয়টি জনগণের কাছে গোপন রেখে দেয়, সেরকমই একটা হাবভাব নেত্রীকে ক্যাপ্টেন মানার ক্ষেত্রে। এই নেত্রীকেই তো বিধানসভা নির্বাচনে পরাজিত মুখ্যমন্ত্রী আর জয়ী বিরোধী নেতার বিরুদ্ধে প্রার্থী করেছিল সিপিআই(এম)। তার অর্থ সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে নেত্রীকে ক্যাপ্টেন বানানোর কাজ শুরু করে সিপিআই(এম) এখন সফল। কিন্তু সেই সাফল্যকে সরকারিভাবে মেনে নেওয়ার সীমাবদ্ধতা এখনও রয়ে গেছে নীতিবাগীশ দলের। তবে বিশ্লেষণের জায়গা থেকে বলাই যায় যে, ধর্মতলার এই সমাবেশে নেত্রীর নামের পাশে 'ক্যাপ্টেন' সীলমোহর খোদাই করে দিলেন সমর্থকেরা। পশ্চিমবঙ্গে এই উচ্চতার সিপিআই(এম) নেত্রীর খবর আর নেই, আগেও ছিল বলে মনে পড়ে না। অন্তর্দলীয় ঈর্ষা এবং চিরাচরিত দলীয় শৃঙ্খলা থেকে নিজেদের মুক্ত করে সিপিআই(এম) ২০২৬-এর মুখ্যমন্ত্রী প্রার্থী হিসেবে এখন থেকেই ক্যাপ্টেনকে প্রোজেক্ট করতে পারে কিনা সে প্রশ্ন বারবার উঠে এলো ধর্মতলার সমাবেশে। অবশ্যই মঞ্চ থেকে নয়, একেবারে রাস্তায় - উপস্থিত সভ্য সমর্থকদের প্রতিটি টুকরো বাক্যবিনিময়ে।

[এই আলোচনাটি লেখা শুরু করেছিলাম বিশে সেপ্টেম্বরের সভার অব্যবহিত পরেই। 'আরেক রকম' এই সময় পক্ষকালের বদলে এক মাসের বিরতি নেয়। ফলে অনেকটা স্ববিরোধিতার তাগিদেই এই অংশটুকু যোগ করছি অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে। সময়ের সঙ্গে রাজনীতি বদলায়, এবং পুজোর সময়ের বিভিন্ন ঘটনায় অবশ্যই সিপিআই(এম)-র বিভিন্ন আন্দোলন এখন মানুষের মুখে মুখে, খবরের শিরোনামে। বামপন্থীদের শারদীয়া বইয়ের স্টলে হামলা এবং বিশিষ্ট চিত্র পরিচালক কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়কে গ্রেফতারের বিষয় নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি সরগরম। সেপ্টেম্বরের সভার পরে বেশ কয়েকটি জায়গায় সিপিআই(এম)-র সভায় জনসমাগম বেড়েছে। দীর্ঘতর হয়েছে বিভিন্ন মিছিল। নেতৃত্বে বারবার উঠে এসেছে সিপিআই(এম)-র রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের নাম। কলকাতায় শিক্ষকদের চাকরি নিয়ে দুর্নীতির বিভিন্ন আইনি লড়াইতে বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যও সিপিআই(এম)-র সামনের সারিতে। দল হিসেবে সিপিআই(এম) যৌথ নেতৃত্বের কথা বলে। বিশে সেপ্টেম্বরের সমাবেশের অভিঘাতে তাই মীনাক্ষী দেবীকে একমাত্র নেত্রী বলে মনে হলেও বাম রাজনীতির দীর্ঘ ইতিহাসের নিরিখে অবশ্যই যৌথ নেতৃত্ব অনেক বেশি যৌক্তিক। অর্থাৎ এই আলোচনা বিশে সেপ্টেম্বরের আগে-পরে একটি স্বল্প সময়কে ধরার চেষ্টা মাত্র, এবং সেই কারণেই এই লেখাটি অধিকতর গুরুত্বের দাবি রাখে না। তৃতীয় বন্ধনীর মধ্যে তাই এই উত্তর-সূত্র যোগ করতেই হল।]

আলোচনা এই জায়গাতেই শেষ হতে পারতো। তবে শাসক তৃণমূল যে দয়া করে এই সভা করতে দিয়েছেন, কিংবা তাঁদের কোনো কোনো নেতা যে বিজেপির তুলনায় সিপিআই(এম)-র সাফল্যয় বেশি খুশি হয়েছেন, এই ধরণের অগভীর রাজনৈতিক আলোচনা না করলে বিশ্লেষণ সম্পূর্ণ হয় না। বিজেপি নেতারাও অগভীরতর নৈর্বর্ত্তিক ভাবনায় বুঝতে পেরেছেন যে এই সভা তৃণমূল এবং সিপিআই(এম)-র মধ্যে গোপন আঁতাতের ফল। তাঁদের কোনো এক বিধায়ক আবার সরাসরি বাম আন্দোলনের প্রশংসাও করে ফেলেছেন। আসলে তৃণমূল বা বিজেপির মতো কোনো রাজনৈতিক দলের প্রশংসা নয়, এমনকি সিপিআই(এম)-র পুরনো নেতাদের প্রশস্তিও নয় - আদতে চৌত্রিশ বছরে ‘‘সিপিয়েমে’’ বদলে যাওয়া দলটির আরও এগারো বছর লাগলো ঠিকঠাক ‘‘সিপিআইএমে’’ ফিরে আসতে। সেই বৃত্ত সম্পূর্ণ হল এই সমাবেশে, এবং সেই কারণেই এতসব বিশ্লেষণ ছাড়াও এই সমাবেশ ঐতিহাসিক। অনেকেই বলছেন যে ভাগ্যিস সিপিআই(এম) ২০১১-তে হেরেছিল। নাহলে ষাট সত্তরের দশকের ইতিহাসে শোনা আর উপন্যাসে পড়া বামপন্থী মুখগুলোকে কি এভাবে চোখের সামনে ফিরে দেখা যেত আধ শতক পরে? প্রশ্ন এখন একটাই। আবার কবে সিপিআই(এম) ক্ষমতায় এসে ভবিষ্যতের মাঝের সারির তৃণমূল এবং বিজেপি নেতা তৈরির কারখানা চালু শুরু করবে? ততদিন পর্যন্ত আসন বিশেষ না পেলেও বামপন্থী দল হিসেবে আজকের সিপিআই(এম) যথেষ্ট সম্পূর্ণ, বিরোধী হিসেবে অবশ্যই নির্ভরযোগ্য। পুরনো নেতাদের দায়ভার যে আর এই প্রজন্মকে বহন করতে হচ্ছে না, সে বার্তা দিয়ে গেল বিশে সেপ্টেম্বর ২০২২, মেঘ-বৃষ্টি-রোদ্দুরে মাখানো অচেনা এক শরৎ খোঁজা ধর্মতলায়।