আরেক রকম ● দশম বর্ষ ঊনবিংশ-বিংশ সংখ্যা ● ১-৩১ অক্টোবর, ২০২২ ● ১৬ আশ্বিন - ১৫ কার্তিক, ১৪২৯

প্রবন্ধ

তবে তো প্রাণ জাগবে

অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়


‘‘হম অহ্‌ল-এ-সফা, মর্দুদ-এ-হরম
মসনদ পে বিঠায়ে জায়েঙ্গে,
সব তাজ উছালে জায়েঙ্গে,
সব তখ্‌ত গিরায়ে জায়েঙ্গে।
’’

(আমরা, যাদের অন্তর নির্মল, যারা পুণ্যভূমি থেকে নির্বাসিত, তাদের মসনদে বসানো হবে; মুকুটগুলো সব উড়িয়ে দেওয়া হবে, গুঁড়িয়ে ফেলা হবে সব সিংহাসন।)

ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ-এর ‘হম দেখেঙ্গে’ কবিতা-গানের এই লাইনগুলো এখন আমাদের অনেকেরই সুপরিচিত, গোটা গানটির মতোই। নাগরিকত্ব নির্ধারণের নামে সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িকতার যে আগ্রাসন এই দেশকে বিপন্ন করেছে, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর গৌরবময় অভিযানের অন্যতম আহ্বান হিসেবে প্রতিবাদী তরুণ-তরুণীদের দৃপ্ত কণ্ঠে ছড়িয়ে পড়েছিল এই অসামান্য প্রতিস্পর্ধার কথা ও সুর। অক্ষমতার স্বখাতসলিলে গলা অবধি নিমজ্জিত জীবনের নিত্যসঙ্গী গ্লানি আর হতাশার উপশম খুঁজতে মাঝে মাঝেই ইউটিউবের দ্বারস্থ হয়ে শুনি এই গানের নানা সংস্করণ, কখনও ইকবাল বানো-র স্বকীয় শৈলীতে, কখনও তরুণ ভারতের প্রতিবাদী জমায়েতে। বিশেষ করে নাড়া দেয় সেই ভিডিয়ো-চিত্রটি, যেখানে দিল্লির এক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশস্ত সোপানমালার একটিতে বসে এক তরুণী আপনমনে এ-গান গেয়ে চলেন, তাঁর চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসা বন্ধুরা তাল দেন, মাথা ঝাঁকান, কখনও গলা মেলান, কখনও বা দু’হাত তুলে অভিবাদন জানান, যে অভিবাদনে নিহিত থাকে প্রত্যয়ী প্রতিস্পর্ধা।

এই গানের প্রথম আবেদন অবশ্যই আমাদের আবেগের স্তরে। সেটা তার দুর্বলতা নয়, তার শক্তি। ক্ষমতাবানের দুরাচারের বিরুদ্ধে চেতনাকে জাগিয়ে তুলতে কোনও যুগেই আবেগের কোনও বিকল্প ছিল না, আজও নেই। তথ্য এবং যুক্তি সে-লড়াইয়ে অপরিহার্য হাতিয়ার, কিন্তু শুধু সেই অস্ত্রে লোকের মন জয় করা যায় না, আর মন জয় না-করতে পারলে বহুজনের মস্তিষ্কের নাগাল পাওয়া কঠিন, পেলেও তাকে লড়াইয়ে শামিল করা দুষ্কর। পুরনো ইতিহাস ছেড়েই দিলাম, সাম্প্রতিক ভারতেও দুরাচারী রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে যে-সব আন্দোলন জোরদার হয়েছে তাদের প্রত্যেকটির ক্ষেত্রে আবেগের ভূমিকা অত্যন্ত স্পষ্ট। সচরাচর কোনও না কোনও গান বা পঙ্‌ক্তি বা স্লোগান তার অন্যতম অভিজ্ঞান হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেমন ‘আজাদি’, যেমন ‘হোক কলরব’, যেমন ‘হম দেখেঙ্গে’। হৃদয় স্পর্শ করার এই গুরুত্বকে যেন কখনও ভুলে না যাই।

কিন্তু শুধুই আবেগ নয়, ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের এই সৃষ্টিতে খুঁজে পাই এক গভীর রাজনৈতিক দর্শনের সঙ্কেত। তিনি কতটা সচেতনভাবে তেমন কিছু ভেবেছিলেন বা ভাবাতে চেয়েছিলেন তার হদিশ বিশেষজ্ঞরা দিতে পারবেন, তাঁর ভাবনার সঙ্গে আমাদের ধারণা মিলবে কি না সে-কথাও জানা নেই, তবে পাঠক এবং শ্রোতা হিসেবে আপন ধারণার কথা বলা যেতেই পারে, বিশেষত তা যদি সমকালের রাজনীতির পক্ষে প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়। অতএব ফিরে যাওয়া যাক শুরুতে উদ্ধৃত পঙ্‌ক্তিগুলিতে। আমরা দৃষ্টি নিবদ্ধ করব কেবল একটি বিষয়ের ওপর, একটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু তীব্র মোচড়ের ওপর। এই অংশটির শুরুতে বলা হচ্ছে, (ক্ষমতার অধীশ্বরদের টেনে নামিয়ে) আমরা মসনদে বসব। আমরা, মানে যারা নৈতিকতার পক্ষে থাকা সত্ত্বেও, কিংবা পক্ষে থাকার কারণেই, ক্ষমতার পরিসর থেকে নির্বাসিত। কথাটা পরিচিত ও বহুব্যবহৃত - বিদ্রোহ আর বিপ্লবের বাগ্‌ধারায় চিরকাল শোনা গেছে প্রতিস্পর্ধার এই নির্ঘোষঃ অনাচারী ক্ষমতাবানদের সরিয়ে দিয়ে ন্যায়শীল ক্ষমতাহীনেরা মসনদের দখল নেবে। ফয়েজের কবিতাও তারই পুনরাবৃত্তি করে।

কিন্তু সেখানেই থামে না সে। এক নিঃশ্বাসে উচ্চারিত হয় পরের কথাগুলোঃ মুকুটগুলো সব উড়িয়ে দেওয়া হবে, গুঁড়িয়ে ফেলা হবে সব সিংহাসন। শুনে একটা খটকা লাগতে পারে। যে মসনদে আমরা বসব, সেই মসনদই গুঁড়িয়ে ফেলা হবে? কথাটা স্ববিরোধী হল না কি? তবে কি আবেগের প্লাবনে যুক্তির শৃঙ্খলা ভেসে গেল? না কি, বক্তব্য এই যে, ওদের মসনদ গুঁড়িয়ে ফেলে আমরা আমাদের মসনদ তৈরি করে নেব? এ-গানের অন্যত্রও তো শুনিঃ অত্যাচারের পর্বত উড়ে যাবে পেঁজা তুলোর মতো, আমাদের পায়ের নীচে থরথর করে কাঁপবে এই ধরিত্রী, আমরাই সেই পবিত্র বাহিনী যারা রাজত্ব করবে। অর্থাৎ, অত্যাচারী ন্যূনাংশিকের আধিপত্যের বদলে কায়েম করা হবে ন্যায়পরায়ণ বৃহদাংশিকের রাজত্ব, এটাই দেখে নেব আমরা? এ-গানের এমন অর্থ হতেই পারে। রাজ্যপাট পরিবর্তনের ইতিহাসে এমনটাই তো সচরাচর দেখা গিয়েছে, এক দলকে হটিয়ে আর এক দল ক্ষমতা দখল করেছে। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব বা পালাবদল বলে যে-সব পরিবর্তন অভিহিত হয়েছে, সেখানেও - ক্ষমতার কাঠামোয় যখন বাস্তবিকই বড় রকমের বদল ঘটেছে, সমাজব্যবস্থায় মৌলিক পরিবর্তন এসেছে তখনও - দেখেছি মসনদে একের বদলে অন্যের অধিষ্ঠান, মসনদ তো উড়ে যায়নি! ফয়েজও কি তবে শেষ পর্যন্ত সেই ছকেই নিজেকে সীমিত রাখছেন? অসম্ভব নয়।

দেড়শো বছর আগে

অসম্ভব নয় ঠিকই, কিন্তু অবধারিতও নয়। অন্য অর্থও সম্ভব এই গানের। সেই অর্থ উদ্ধার করার জন্য ফিরে যেতে পারি দেড়শো বছর আগে, ১৮৭১-৭২ সালে। ১৮৭১-এর মধ্য-মার্চ থেকে মে-এর শেষ অবধি আড়াই মাস প্যারিস শহর শাসন করেছিল প্রধানত শ্রমজীবী মানুষের কমিউন। প্যারিস কমিউনের পরিপ্রেক্ষিত এবং পরিণাম প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছিল কার্ল মার্কসকে, ‘দ্য সিভিল ওয়র ইন ফ্রান্স’ গ্রন্থে সঙ্কলিত তাঁর তিনটি বক্তৃতা-প্রবন্ধে তার গভীর পরিচয় আছে। অতঃপর, ১৮৭২ সালে প্রকাশিত হল 'কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো'-র দ্বিতীয় জার্মান সংস্করণ, প্রথম প্রকাশের চব্বিশ বছর পরে। এই সংস্করণটির পূর্বকথায় মার্কস-এঙ্গেলস লিখলেন যে ১৮৪৮-এ রচিত ইস্তাহারের কর্মসূচি "কিছু কিছু ব্যাপারে আর কালোপযোগী নেই", তার সংশোধন প্রয়োজন। কার্যত একটিই বড় রকমের সংশোধন করেছিলেন তাঁরা, যার সার কথাঃ "কমিউন একটা কথা বিশেষভাবে প্রমাণ করেছে, সেটা এই যে, শ্রমিক শ্রেণি স্রেফ একটা রেডিমেড রাষ্ট্রযন্ত্রের দখল নিয়ে সেটিকে নিজের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ব্যবহার করতে পারে না।" লক্ষণীয় ব্যাপার হল, এই সংশোধনী বাক্যাংশটি সরাসরি মার্কসের ‘দ্য সিভিল ওয়র ইন ফ্রান্স’ থেকে উদ্ধৃত। স্পষ্টতই, কমিউনের শিক্ষাকে তাঁরা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছিলেন যে কমিউনিস্ট ইস্তাহারে সংশোধন আনলেন।

এই সংশোধনের গুরুত্ব ঠিক কোথায়? মার্কস সেটা আরও স্পষ্ট করে বলেছিলেন ১৮৭১-এর এপ্রিলে। প্যারিস কমিউনের তখন মধ্যপর্ব। বন্ধু ডাক্তার ও সমাজকর্মী লুডউইগ কুগেলমানকে লেখা একটি চিঠিতে তিনি জানালেন, ‘‘তুমি যদি আমার এইটিনথ ব্রুমেয়ার-এর ('দি এইটিনথ ব্রুমেয়ার অব লুই বোনাপার্ত') শেষ অধ্যায় পড়ো, দেখবে সেখানে আমি বলেছিলাম - ফরাসি বিপ্লবের (ধারায়) পরের উদ্যোগটি আর আগের (প্রচেষ্টাগুলির) মতো আমলাতান্ত্রিক-সামরিক যন্ত্রটিকে এক হাত থেকে অন্য হাতে হস্তান্তরে সীমিত থাকবে না, তার লক্ষ্য হবে ওই যন্ত্রটিকে চুরমার করে ফেলা... প্যারিসে আমাদের নির্ভীক পার্টি কমরেডরা এখন সেটাই করছেন।’’ প্রায় অর্ধ শতাব্দী পরে এ-কথার গুরুত্ব চিহ্নিত করেছিলেন লেনিন। ১৯১৭ সালে ‘দ্য স্টেট অ্যান্ড রেভলিউশন’-এ 'কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো'র সংশোধনী এবং কুগেলমানকে পাঠানো মার্কসের চিঠিটির কথা আলোচনা করার পরে তাঁর মন্তব্যঃ ‘‘এই ‘আমলাতান্ত্রিক-সামরিক যন্ত্র চুরমার করে দেওয়ার’ কথাটাই হল একটা বিপ্লবের কালে রাষ্ট্র বিষয়ে প্রোলেতারিয়েতের কর্তব্য সম্পর্কে মার্কসবাদের প্রধান শিক্ষা।’’

এই ইতিহাস বহুচর্চিত। প্যারিস কমিউনের ঘটনাবলি এবং সে বিষয়ে মার্কসের বিশ্লেষণ লেনিনের চিন্তায় কতটা প্রভাব ফেলেছিল, বলশেভিক বিপ্লবে ও সোভিয়েট রাষ্ট্র গঠনে তার কী ভূমিকা ছিল, তা নিয়েও মহাভারত-প্রমাণ লেখালিখি হয়েছে। কিন্তু এটাও ঠিক যে, বুর্জোয়া রাষ্ট্রের দখল নেওয়া এবং তাকে চুরমার করার যে দ্বৈত সঙ্কল্পের কথা এই বিশ্লেষণ থেকে উঠে এসেছিল, সোভিয়েট ইউনিয়ন তথা বিংশ শতাব্দীর ফলিত ‘সমাজতন্ত্র’ তার মর্যাদা রাখেনি। তার অন্যতম প্রমাণ - ‘ডিক্টেটরশিপ অব দ্য প্রোলেতারিয়েত’-কে একটি অস্থায়ী এবং মধ্যবর্তী পর্ব হিসেবে দেখবার যে ধারণা মার্কসের লেখায় ছিল - যে ক্ষমতাহীনের শাসনপর্ব ক্ষমতার কাঠামো বিলুপ্ত করার মধ্য দিয়েই নিজের অবসান ঘটাতে চায় - তাকে উপেক্ষা, অগ্রাহ্য অথবা অস্বীকার করে সমাজতন্ত্রের নামে পার্টি-রাষ্ট্রের একচ্ছত্র শাসন পাকাপাকিভাবে কায়েম করা হয়েছিল, যার পরিণাম বিংশ শতাব্দীই দেখে গিয়েছে। আজ যদি সমাজতন্ত্রের ধারণা এবং বাস্তবকে পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করতে হয়, তবে এই ইতিহাসের শিক্ষাকে কাজে লাগানো কেবল জরুরি নয়, অপরিহার্য। সমাজতন্ত্র মানে সর্বশক্তিমান পার্টি শাসিত রাষ্ট্রীয় অচলায়তন নয়, বস্তুত সমাজতন্ত্রের কোনও পূর্বনির্ধারিত মডেল নেই যার ছাঁচে ঢেলে সমাজব্যবস্থাকে তৈরি করে নেওয়া যাবে। সমাজতন্ত্র একটি প্রক্রিয়া, একটি সংগ্রাম, একটি নির্মাণ। এই কথাটাও আজ আর নতুন নয়, ‘একুশ শতকের সমাজতন্ত্র’ নিয়ে গত দু’দশকে বিস্তর আলোচনা আমরা পড়েছি এবং শুনেছি। প্রশ্ন হল, কথাটাকে বাস্তব রূপ দেওয়া হবে কী করে? কীভাবে আমরা নতুন পথে সমাজতন্ত্রের অনুশীলনে অগ্রসর হতে পারি?

অতঃপর

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে আমাদেরই। দীর্ঘ, কঠিন এবং বহুমাত্রিক সেই সন্ধান শুরু করার জন্য ফিরে যাওয়া যায় ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের গানটির কাছে। সেই গান যা বলে এবং যেভাবে বলে, দুটোই পথ খোঁজার কাজে প্রাসঙ্গিক। মসনদের দখল নিতে হবে তা দখলে রাখার জন্য নয়, তাকে ভেঙে চুরমার করে উড়িয়ে দেওয়ার জন্য - এই কথাটায় আন্তরিক বিশ্বাস রাখতে না পারলে এবং তাকে সত্য করে তোলার জন্য যত্নবান না হলে ক্ষমতাহীনের শাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। যাকে আমরা বামপন্থী রাজনীতি বলি, তার পথিকরা কি এই কাজটি করতে পারবেন? তারও আগের কথা, তাঁরা কি সেটা করতে চাইবেন? তাঁরা কি আদৌ মনে করেন যে সমাজতন্ত্র সম্পর্কে এইভাবে ভাবতে হবে? সমাজতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করতে গিয়ে প্রতি মুহূর্তে মনে রাখতে হবে যে ক্ষমতা দখল করাটা শেষ কথা নয়, সেই ক্ষমতা দিয়েই ক্ষমতার কায়েম-হয়ে-থাকা কাঠামোগুলোকে ভেঙে ফেলাটাই সংগ্রামের প্রকৃত লক্ষ্য? আমাদের বামপন্থী রাজনীতির কথা শুনে এবং আচরণ দেখে তেমন ভরসা হয় না। এই রাজনীতি আজও সেই পুরনো ক্ষমতার ভাষাতেই কথা বলে, বিংশ শতাব্দীর সমাজতন্ত্রের ভেকধারী রাষ্ট্রবাদের প্রকরণগুলিই আজও তার পরম প্রিয় এবং আরাধ্য বলেই মনে হয়। রাষ্ট্রযন্ত্রটির দখল নিতে পারলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এটাই তার ধ্যান এবং জ্ঞান।

আমাদের বামপন্থী আন্দোলনের ভাষাতেও সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। ভাষার প্রশ্নটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেবল এই কারণে নয় যে, রাজনীতিকে জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজে, শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে তার সংযোগ সাধনের কাজে ভাষার গুরুত্ব আছে। আরও বড় কারণ এই যে, রাজনীতিকে কীভাবে ভাবব, সেটাও কখনওই ভাষা-নিরপেক্ষ হতে পারে না। ভাষা মানে কেবল শব্দ নয়, সেই শব্দ উচ্চারণের সুর এবং ভঙ্গিও ভাষার অঙ্গ, অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এখানেই ফয়েজের গানটির দৃষ্টান্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। যে ভাষায় সে-গান রচিত ও গীত হয়, যেভাবে সে শত সহস্র লক্ষ হৃদয়ে আলোড়ন তোলে, তা নিছক জনসংযোগের ব্যাপার নয়, তার মধ্যে ঘুম ভাঙানোর, প্রাণ জাগানোর শক্তি আছে। আমাদের বামপন্থী আন্দোলনের গানে, কবিতায়, স্লোগানে এই শক্তি আমরা একদিন দেখেছি, আজও নানা অনুষ্ঠানে সেগুলি কিছু কিছু ফিরে আসে। সেই ঐশ্বর্যের আরও অনেক বেশি সদ্‌ব্যবহারের অবকাশ আছে, প্রয়োজনও আছে, রাজনীতির পরিচালক ও কর্মীরা তা নিয়ে ভাবতে পারেন। কিন্তু তার পাশাপাশি তৈরি করা দরকার নতুন ভাষা, যা আজকের জনসমাজের মনে অভিঘাত সৃষ্টি করতে পারবে।

বলা বাহুল্য, তার প্রথম শর্ত বামপন্থী রাজনীতির কর্মীদের সঙ্গে জনসমাজের দৈনন্দিন সংযোগ। যে সংযোগ না থাকলে সলিল চৌধুরী ‘বিচারপতি তোমার বিচার’ গানে কীর্তনের সুর লাগাতে পারতেন না, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ও শ্রমিকদের জন্য মার্কসের লেখা শ্রম তত্ত্বের পুস্তিকা বাংলায় রূপান্তরিত করে সে-বইয়ের নাম ‘ভূতের বেগার’ দেওয়ার কথা ভাবতেন না। এই উদাহরণ দুটি কিছুটা সচেতনভাবেই বেছে নিয়েছি। যেমন বেছে নিয়েছি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজকেও। এই সব দৃষ্টান্ত দেখিয়ে দেয়, প্রতিস্পর্ধী রাজনীতির কণ্ঠস্বর মানুষের প্রাণে পৌঁছে দিত সৃষ্টিশীলতা জরুরি, সৃষ্টির প্রতিভা না থাকলে কেবল তত্ত্ব, তথ্য আর যুক্তি দিয়ে বহুজনের হৃদয় দুয়ার খোলা সম্ভব নয়। আবার একই সঙ্গে জরুরি বহুজনের সঙ্গে সংযোগ। পোশাকি, আনুষ্ঠানিক, দায়সারা সংযোগ নয়, জীবনে জীবন মেলানোর প্রকৃত সংযোগ। অবশিষ্ট ভারতের কথা জানা নেই, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের সমাজে সৃষ্টিশীলতার আজও অভাব নেই, জনসংযোগের অবকাশ তো সর্বদাই অফুরন্ত। অভাব যে বস্তুটির, তার নাম উদ্যোগ। প্রত্যয়ী এবং সংগঠিত উদ্যোগ। তার দায় নিতে হবে বামপন্থী রাজনীতিকেই।