আরেক রকম ● দশম বর্ষ ঊনবিংশ-বিংশ সংখ্যা ● ১-৩১ অক্টোবর, ২০২২ ● ১৬ আশ্বিন - ১৫ কার্তিক, ১৪২৯

প্রবন্ধ

হায় গগন নহিলে

আশীষ লাহিড়ী


রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য
(১০ ডিসেম্বর, ১৯৪৭ – ২ অক্টোবর, ২০২২)


আমরা যারা ১৯৪৭-এর ক্ষমতা হস্তান্তরের পরে পরেই জন্মেছি, কৈশোরে খাদ্য আন্দোলন দেখেছি, কংগ্রেসের ‘গণেশ উলটায়ন’ দেখেছি, দেখেছি নকশালবাড়ি, দেখেছি কমিউনিস্ট পার্টির ত্রিধাবিভক্তি, দেখেছি কমিউনিস্টদের আত্মহনন, ইন্দিরার এমার্জেন্সির প্রতি একদল কমিউনিস্টের সমর্থন, আর যারা এখন ভারতজুড়ে দেখছি হিন্দুত্ববাদের উত্থান এবং দেখতে দেখতে পরিশেষে পশ্চিমবঙ্গে এক নির্মনন অবমানবিক জমানায় অধঃক্ষিপ্ত হচ্ছি – তাদের এই সমস্ত কিছু উত্থান-পতনের মধ্যে অন্তত একটা সান্ত্বনার আশ্রয় ছিল শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে পুরোনো এক বাড়ির চারতলার ছাদের ঘরে সদাজাগ্রত এক সূর্যসম মন। অনেকেই তাঁকে বুশ শার্ট আর পাজামা পরে সিঙাড়া খেতে খেতে শ্যামবাজারের ফুটপাতে হাঁটতে দেখেছেন। তিনি রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য। তিনি আর নেই। তাঁর বোন, তাঁর অগণিত ছাত্র, শিষ্য, গুণমুগ্ধকে হতাশ করে ফুসফুসের ক্যানসারে ভুগে চিত্তরঞ্জন ক্যানসার হাসপাতালের নিউ টাউন শাখায় ২ অক্টোবর সকাল আটটা পঞ্চাশে তাঁর মৃত্যু ঘটেছে। নিঃশব্দে। এই সমাজে যেরকম নৈঃশব্দ্য তাঁর মতো পূর্ণ মানুষের কাম্য ছিল।

স্কটিশ চার্চ কলিজিয়েট স্কুলের ডাকসাইটে ছাত্র ছিলেন রামকৃষ্ণদা। তাঁর চেয়ে এক ক্লাস নীচের এক ছাত্রর আজও পরিষ্কার মনে পড়ে মাস্টারমশাইদের মন্তব্য, "রামকৃষ্ণ বলে ছেলেটার কী আশ্চর্য মাথা!" ১৯৬৩ সালে আর্টসে দুর্দান্ত রেজাল্ট করে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করে প্রেসিডেন্সি নামক মক্কায় না গিয়ে তিনি ভর্তি হলেন বিদ্যাসাগর কলেজে। খাতায় কলমে ইংরেজি সাহিত্য তাঁর বিষয়; কিন্তু আসলে আলাদা করে বিষয় বলে তাঁর কিছু ছিল না। মানবিকী চর্চার সমস্ত ক্ষেত্রে তো বটেই, এমনকী বিজ্ঞান আর গণিতেও তাঁর অনুসন্ধিৎসা ছিল প্রবল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন। অধ্যাপনার চাকরি নিয়েছিলেন আমহার্স্ট স্ট্রিটের সিটি কলেজের সান্ধ্য বিভাগে, যার নাম আনন্দমোহন কলেজ। উদ্দেশ্য পরিষ্কার। দিনের বেলাটা পড়াশোনা আর লেখালিখির কাজ করবেন, সন্ধেবেলা ছাত্র পড়াবেন। সান্ধ্য কলেজে পড়ানোর চাপ অনেক কম। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থায়ী অধ্যাপক হিসেবে পড়িয়েছেন। পিএইচ ডি করেছেন বেশ পরে।

কিন্তু ইংরেজির অধ্যাপক বললে রামকৃষ্ণদা সম্পর্কে কিছুই বলা হয় না। অল্পবয়স থেকে অনেকেরই মতো তিনি মার্কসবাদে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। কিন্তু অনেকের সঙ্গে তাঁর তফাত এই যে মার্কসবাদকে কয়েকটা ক্ষণ-প্রযোজ্য রাজনৈতিক ফরমুলায় পর্যবসিত না-করে তার অনেক গভীরে চলে গিয়েছিলেন। তাঁর জীবনের শিকড় আর ডানা দুই-ই ছিল মার্কসবাদে উজ্জীবিত। একদিকে ‘ধাঁধা’ পত্রিকা বার করছেন অল্পবয়সীদের বুদ্ধিকে নাড়া দেবার জন্য, অন্যদিকে ইরফান হাবিবের ইতিহাস বইয়ের অনুবাদ-সম্পাদনা করছেন, যার মান দৃষ্টান্তস্বরূপ হয়ে রয়েছে আজও। ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত মারফত মার্কসবাদ কীভাবে ছড়াল এদেশে, তা নিয়ে যেমন লিখছেন, বলছেন, তেমনি ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে ধর্ম কীভাবে জাতীয়তাবাদের বিকল্প হিসেবে কাজ করেছিল তাও বুঝিয়ে বলছেন। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মার্কসবাদ চর্চার বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করছেন। লোকায়ত-খ্যাত দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ডান হাত হয়ে উঠেছিলেন। গুরুর শিক্ষা তাঁর জীবনে সার্থক হয়েছিল। চার্বাক দর্শন নিয়ে এদেশের ভাববাদী পণ্ডিতরা কীভাবে ছেলেখেলা করেছেন, কীভাবে ভ্রান্তি ছড়িয়েছেন, তার তথ্যভিত্তিক দুরূহ কিন্তু অকাট্য ব্যাখ্যা হাজির করেছেন। এমনকী শূল্বসূত্র নিয়ে আলোচনা করে প্রাচীন ভারতীয় জ্যামিতির সঙ্গে প্রাচীন গ্রীক জ্যামিতির মূল পার্থক্য কোথায় তা নিয়ে ইংরেজিতে লিখেছেন বই। পাশাপাশি লিখেছেন ক্ষীণকায় ‘দর্শন পড়ার ভূমিকা’, যাতে সুখপাঠা সরস গদ্যে দর্শন জিনিসটাকে অবিশেষজ্ঞ উৎসুকের নাগালে এনে দিয়েছেন।

বিদ্যাসাগর তাঁর লড়াইয়ের এক প্রধান ক্ষেত্র হয়ে উঠেছিলেন। বিদ্যাসাগর যেন তাঁর দোসর। মধ্য-উনিশ শতকে যে-মানুষ প্রকাশ্যে মায়াবাদকে ভ্রান্ত দর্শন বলতে পেরেছিলেন, তাঁর মনোগহন নিয়ে সারা জীবন গবেষণা করেছেন রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য। যেখানেই মনে হয়েছে কেউ ভুল ব্যাখ্যা করেছেন, তিনি যত বিখ্যাত পণ্ডিতই হোন, সেখানে নির্মমভাবে ছিন্নভিন্ন করেছেন সে-ভ্রান্তি। যে-যুক্তিবাদ ছাড়া মার্কসবাদ দাঁড়ায় না, তার সমর্থনে নিয়ত জাগ্রত ছিল তাঁর মেধা। অক্ষয়কুমার দত্ত নিয়ে আজ বাঙালিদের মধ্যে যেটুকু সচেতনতা জেগেছে তার মধ্যেও রয়েছে রামকৃষ্ণদার অবদান। উত্তর-আধুনিকতাবাদের ‘এই দুনিয়ায় ভাই সবই হয়’ - ভাবনাকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেছিলেন তিনি।

তিনি জানতেন, হিন্দুত্ববাদী সেয়ানা নির্বুদ্ধিতার সঙ্গে লড়াইয়ের শ্রেষ্ঠ পন্থা হল মূল সংস্কৃত রচনায় ফিরে যাওয়া। তাই খুব যত্ন করে সংস্কৃত শিখেছিলেন। জার্মান আর ফরাসি না জানলে মার্কসবাদী ও অন্যান্য মনীষীদের লেখা মূলে পড়া যাবে না, তাই ও দুটো ভাষাতেও ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে ‘মানবমন’ পত্রিকায় বেরিয়েছে তাঁর ধারাবাহিক মহাভারত-বিশ্লেষণের শেষ কিস্তি। ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় প্রতিষ্ঠিত-সম্পাদিত এই পত্রিকার কনিষ্ঠতম কিন্তু প্রাজ্ঞ সদস্যরূপে ১৯৬০-এর দশক থেকেই যুক্ত ছিলেন রামকৃষ্ণদা। মাও সেতুঙের সেই কথাটা মনে পড়ে যায়ঃ "অনেকে মনে করেন মার্কসবাদ একটা শৌখীন সোনার তীর; সেটাকে সাজিয়ে রাখা যায়, কিন্তু ছোঁড়া যায় না।" রামকৃষ্ণদার কাছে মার্কসবাদ ছিল সত্যিকারের লক্ষ্যভেদী তীর। এতই নিখুঁত আর তথ্যনিষ্ঠ ছিল তাঁর ভারত-চর্চা যে সেটাকে খাতির না করে বিদ্যায়তনের উপায় ছিল না। ইউজিসি-র ইমেরিটাস অধ্যাপক ছিলেন তিনি, ‘ভারতত্ত্ববিদ’ রূপে দেশে-বিদেশে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। তাই ওয়েন্ডি ডনিগারের মতো বিদেশি ভারততত্ত্ববিদের পক্ষে রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যর চার্বাক-গবেষণাকে বাদ দিয়ে বই লেখা সম্ভব হয় না।

আক্ষরিক অর্থে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নিজের জায়গা থেকে নড়েননি তিনি। শুধু অগাধ পাণ্ডিত্যর জন্য নয়, সেই পাণ্ডিত্যকে মানুষের সেবায় নিয়োজিত করার স্বঘোষিত দায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন দল-গোষ্ঠী নির্বিশেষে যেকোনো মার্কসবাদ-অনুসন্ধিৎসুর অবধারিত আশ্রয়। একই কারণে, পার্টির গুরুত্ব সম্বন্ধে লেনিনীয় তত্ত্বে পূর্ণবিশ্বাসী হয়েও কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তাঁর আত্মীয়তা ছিল না। কিছুদিন সিপিআই-এর সদস্য ছিলেন, সম্ভবত একবার জেলও খেটেছিলেন, কিন্তু ১৯৬৮ সালে পার্টি সোভিয়েত ইউনিয়নের চেকোস্লোভাকিয়া আক্রমণ সমর্থন করায় সদস্যপদ ছেড়ে দেন। বামফ্রন্ট জমানাকে রাজনৈতিকভাবে সমর্থন করলেও কখনো তাঁদের ঘনিষ্ঠ হননি। বেশ কিছু বছর ধরে নকশালপন্থী রাজনীতির দ্বারা প্রভাবিত - এবং মোহমুক্ত - বহু তরুণ তাঁর আপন হয়ে উঠেছিল। তারা তাঁকে ‘স্যার’ বলেই ডাকত। তাঁদের নিয়েই ছিল তাঁর ‘সংসার’। সুখে, দুঃখে, মৃত্যুকালেও তারাই তাঁর পাশে ছিল।

মার্কসবাদী আদর্শনিষ্ঠায় এই দলহীন মানুষটি এতটাই আপোশহীন ছিলেন যে, ষাটের দশকে আনন্দবাজার গোষ্ঠীর কমিউনিস্ট বিরোধী ন্যাক্কারজনক ‘শিল্পীর স্বাধীনতা’ কার্যক্রম দেখে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, ওই গোষ্ঠীর কোনো কাগজে কোনোদিন লিখবেন না। সে প্রতিজ্ঞা মৃত্যুকাল পর্যন্ত ভাঙেননি। কয়েক দশক আগে ‘দেশ’ পত্রিকার তখনকার সম্পাদক সসম্মানে তাঁর কাছ থেকে একটি লেখা প্রার্থনা করায় তিনি লিখিতভাবে উত্তর দিয়েছিলেন, এরকম ঔদ্ধত্য আশা করি আর কখনো দেখাবেন না। অথচ একেবারে অখ্যাত অজ্ঞাত লিটল ম্যাগাজিনের প্রতি তাঁর ছিল অনন্ত বদান্যতা। কত অমূল্য লেখা যে কত দীনহীন পরিচয়হীন পত্রিকায় ছাপিয়েছেন তিনি তার হিসেব আছে কিনা জানি না।

ডি ডি কোসাম্বির অসম্ভব ভক্ত ছিলেন তিনি। অনেকটা যেন সেই ধাঁচেই নিজেকে গড়ে নিয়েছিলেন। সেই ক্ষুরধার যুক্তি ও তথ্যবিন্যাস, অযুক্তির প্রতি সেই একই আপোশহীনতা (কোসাম্বি সংসদীয় মার্কসবাদী দলগুলোর আদর্শকে ‘অফিশিয়াল মার্কসিজম’ নামে বিদ্রূপ করতেন), আর সেই একই অবিনয়। না, অকারণ বিনয়-রোগে ভুগতেন না রামকৃষ্ণদা। নিজের উচ্চতা তিনি খুবই বুঝতেন, কিন্তু জাহির করতেন না। কেবল হীনপ্রাণ দুর্বলের স্পর্ধা দেখলে তখন ঝলসে উঠত তাঁর অহংয়ের খড়্গ। বন্ধুদের লেখার সমালোচনাতেও নির্মম ছিলেন। কার্ল পপারের মতো ঘোর মার্কসবাদ-বিরোধী দার্শনিককে নিয়ে লেখবার অপরাধে, কিংবা 'বাঙালি যুক্তিবাদ' এই হাস্যকর শব্দবন্ধ ব্যবহারের পাপে অত্যন্ত স্নেহভাজন লেখককেও ভর্ৎসনা করতে বাধত না তাঁর। আবার তার পাল্টা যুক্তি শোনাতেও অনাগ্রহ ছিল না।

আজ যখন ‘বাস্তব ক্ষেত্রে বিরাজিত সমাজতন্ত্র’ পরাজিত, ফলিত মার্কসবাদের অভ্রান্ততা প্রায় এক রসিকতায় পর্যবসিত, তখন রামকৃষ্ণদার মতো প্রজ্ঞাবান মানুষ কী করে মার্কসবাদের প্রতি আস্থা অটুট রাখলেন, সেটা অনেক বিদ্যায়তনিক পণ্ডিতেরই প্রশ্ন। তাঁর উত্তর ছিল পরিষ্কার। একটা সিস্টেম হিসেবে পুঁজিতন্ত্র গড়ে উঠতে কতশো বছর লেগেছে? সে তুলনায় সমাজতন্ত্র নিজেকে প্রতিষ্ঠা করবার কতটুকু সময় পেয়েছে? সুতরাং ইতিহাসের দীর্ঘ প্রেক্ষণিকায় ‘বাস্তব ক্ষেত্রে বিরাজিত সমাজতন্ত্র’র এই পরাজয় মোটেই মার্কসবাদের পরাজয় সূচিত করে না; বরং আমাদের নতুন পথসন্ধানে প্রবৃত্ত করে। কংক্রিট সিচুয়েশনের কংক্রিট অ্যানালিসিসের জন্য মার্কসবাদ তাই অপরিহার্য। এই ভাঙা পৃথিবীতে তার প্রয়োজন তাই বেড়েছে বই কমেনি।

জানি না, রামকৃষ্ণদার এই যুক্তি-উৎসারিত প্রাজ্ঞ প্রত্যয় অন্তরে গ্রহণ করে এগিয়ে চলার হিম্মৎ আমাদের কতটা আছে। হায়, গগন নহিলে তোমারে ধরিবে কে বা।