আরেক রকম ● দশম বর্ষ ঊনবিংশ-বিংশ সংখ্যা ● ১-৩১ অক্টোবর, ২০২২ ● ১৬ আশ্বিন - ১৫ কার্তিক, ১৪২৯

প্রবন্ধ

যুগ, যুগান্ত

পবিত্র সরকার


ভূমিকা

আমি কিছুদিন আগে ‘রবীন্দ্রনাথের যুগ শেষ হয়ে গেছে’ বলে এক প্রবীণ কবির লেখা দেখলাম একটি দৈনিক কাগজে। সেটি পড়ে এই লেখাটার কথা মনে এল। তিনি তাঁর মতো যুক্তি দিয়ে লিখেছেন, তাতে কোনও অসুবিধে নেই। তবু একটু খটকা লাগল আমার, তাই এ বাগ্‌বিস্তার। ভাবলাম, একটু খোঁজ করে দেখি কার যুগ কীভাবে শেষ হয়। শেষ হলে তাঁকে নিয়ে আমরা কী করি। এটা সাহিত্য-সংস্কৃতির ইতিহাস-সমাজতত্ত্বের সঙ্গে জড়িত একটা প্রশ্ন। আমরা সবাই এর সমস্ত দিকে বিবেচনা করে একটা মতামত তৈরি করি, এমন প্রায়ই হয় না। এই প্রবন্ধটির লেখক কবিও, প্রিয় এবং সমর্থ কবি আমাদের সময়কার, আমার ক্ষুদ্র মতে তা করেননি। এই নিয়ে আগ্রহী পাঠকেরা যদি আমার ভাবনার সঙ্গী হন, সমালোচনা বা যুক্তিবিস্তারের দ্বারা, অবশ্যই কৃতার্থ বোধ করব। ওই প্রবন্ধটির শিরোনামে যেমন একটি সিদ্ধান্ত প্রায় চূড়ান্তভাবে দিয়েছিলেন, লেখক নিজে না সম্পাদক ঠিক জানি না। কিন্তু ওই শিরোনামটি, আমাদের ক্ষুদ্র মতে, ঠিক হয়নি। আমাদের পক্ষের যুক্তিগুলি একে একে বলি।

এই আলোচনায় শিল্পসংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ স্রষ্টাদের ‘যুগ’ আর তার অবসান নিয়ে আলোচনা করব। এ ধরনের আলোচনা পশ্চিমদেশে হয়েছে কি না আমি জানি না, হয়ে থাকলে তা আমি দেখিনি। আমি তাই আমার নিজের মতো করে নানা প্রশ্ন তুলব, উত্তর খোঁজার চেষ্টা করব। কাজেই পাঠক আমার লেখায় পাশ্চাত্যের পণ্ডিতদের উল্লেখ বা উদ্ধৃতি আশা করবেন না, দেরিদা, আলতুসের, বা ফ্রাংক্ফুর্ট স্কুল বা মার্কিনি, নিউম্যান, জেমসন প্রভৃতি মহাত্মাদের কারও নয়। তাঁরা তাঁদের মতো অপার গৌরব নিয়ে বিরাজ করুন, আমি আমার মতো তুচ্ছ বিবেচনা নিয়ে এগিয়ে যাই।

যুগ বলতে কী বুঝব?

‘যুগ’ কথাটার নানা প্রতিশব্দ বাংলা সমালোচনায় ব্যবহার হয়, মূলত এটি একটি ঐতিহাসিক ধারণা। এর প্রতিশব্দ হিসেবে ‘কাল’ (‘হায় রে কবে কেটে গেছে কালিদাসের কাল’) বা লৌকিক কথাবার্তায় ‘সময়’ও চলে। ইতিহাসে তো ‘হিন্দু যুগ’, ‘বৌদ্ধ যুগ’, ‘মোগল যুগ’ ইত্যাদি চলে। তার মানে একটি বিশেষ গোষ্ঠীর - কখনও ধর্মের কখনও অন্য গোষ্ঠীপরিচয়ের - ‘শাসন’-এর কাল। ‘শাসন’ একটা রাজনৈতিক ধারণা। কিন্তু ব্যক্তির নামের সঙ্গে সমাস করে বা সম্বন্ধ বিভক্তি করে যখন 'যুগ' কথাটা ব্যবহার করা হয়, তখন সব সময় সেটা রাজনৈতিক ধারণা থাকে না। যেসব ব্যক্তির রাজনৈতিক ভূমিকা প্রধান তাঁদের ক্ষেত্রে তা থাকতেই পারে, কিন্তু অন্যদের ক্ষেত্রে তা হয় না। নির্দিষ্ট ব্যক্তিটি যে বিষয়ে অবদান রেখেছেন সেই বিষয়টির স্বীকৃতি যেন প্রচ্ছন্নভাবে তাতে জেগে ওঠে। ফলে তাঁর জন্ম, পরিবার, শিক্ষাকাল ইত্যাদির চেয়েও তাঁর সৃষ্টিকাল বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, কারণ তাঁর সৃষ্টির আপেক্ষিক উৎকর্ষই, অন্যদের তুলনায়, প্রধান বিবেচ্য হয়ে ওঠে ওই যুগের ধারণা তাঁর নামের সঙ্গে লিপ্ত করতে।

সেই সঙ্গে প্রচ্ছন্নভাবে জেগে ওঠে তাঁর সময়কার তাঁর সমধর্মী বা ভিন্নধর্মী অন্যান্য স্রষ্টাদের কথা, যাঁরা তার অনুগামী বা বিরোধী, তবু তাঁর পিছনে একটি চালচিত্রের মতো তৈরি করেন। তাঁর নামে একটা যুগ চিহ্নিত হয়েছে, তার অর্থ তিনিই এক দিক থেকে সেই সময়কার প্রধান ব্যক্তি বা প্রতিনিধি। যুগনেতাও বলা যায়। সাহিত্যক্ষেত্রে যদি বঙ্কিম-যুগ বলি তা হলে বঙ্কিমচন্দ্র এইভাবে privileged হন বা মাহাত্ম্য পান। বলা বাহুল্য, ক্ষেত্র অনুযায়ী নানা যুগের সমাপতনও বা পরস্পর-প্রবেশও ঘটতে পারে। যেমন আঠারো বছরের বড় বিদ্যাসাগরের যুগ আর বঙ্কিমচন্দ্রের যুগ অনেকটা সময় পাশাপাশি চলেছে, কিন্তু বঙ্কিমের যুগ বলতে আমাদের যে দিকটায় নজর পড়ে, বিদ্যাসাগরের যুগ বলতে আমাদের নজর অন্য একটা দিকে নিক্ষিপ্ত হয়। ফলে লক্ষ্যের বিভিন্ন মাত্রা ধরে যুগের আলাদা আলাদা নাম হতেই পারে। ব্যক্তির নামেও তা চিহ্নিত হতে পারে, আবার শাসন, সৃষ্টি বা আন্দোলন - অনেক কিছুর নামেও হতে পারে। যেমন উপনিষদের যুগ, মহাকাব্যের যুগ, কম্পানির আমল, রোমান্টিক যুগ ইত্যাদি। যে ধরনের নামেই হোক, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তার একটা আরম্ভ আর অন্তের, অস্পষ্ট হলেও ধারণা থাকে। যুগের ধারণাটার মধ্যেই দু'দিকের সীমার ধারণা নিহিত আছে। যদি কবি বা লেখকের নামে যুগ হয়, তা হলে তাঁর পুরো জীবনকাল হয়তো নয়, যখন থেকে তাঁর সৃষ্টি গৃহীত, সমাদৃত হতে, এবং প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে তখন থেকে তার আরম্ভ ধরা যেতে পারে। তাঁর শৈশব-কৈশোর সে হিসেব থেকে সাধারণভাবে বাদই যাবে। কিন্তু তাঁর নামাঙ্কিত যুগের শেষ কি তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ঘটে? তা কেউ বলেন বলে মনে হয় না।

যুগের ব্যাপ্তি

যুগ কথাটার নানা ক্ষেত্রে নানা রকম অর্থ পায়। যুগ বলতে যদি শাসন বা প্রশাসন বোঝায়, তবে তার সীমানা খানিকটা স্পষ্টভাবে নির্দেশ করা যায়। ভারতের ইতিহাসে ‘গুপ্ত যুগ’ বা ‘মোগল যুগ’কে যেমন নির্দিষ্ট বছর দিয়ে আরম্ভ আর শেষ চিহ্নিত করা যেতে পারে। কিন্তু সাহিত্য আর সংস্কৃতির নেতা-নেত্রীদের নামে যে যুগ চিহ্নিত হয়, তা কি তাঁদের জন্ম-মৃত্যুর তারিখের দ্বারা সীমাবদ্ধ? তা কী করে হবে? যতদিন না তিনি তাঁর সৃষ্টির দ্বারা তাঁর সময়কে প্রভাবিত করার অবস্থায় আসছেন ততদিন সময়টা তাঁর নামে চিহ্নিত করার সূত্রই তো তৈরি হচ্ছে না। এমনকি তখনও হচ্ছে না, কারণ তাঁর সমগ্র সৃষ্টির পরেই তাঁর সময় তাঁর প্রভাবের বা প্রাধান্যের হিসেব করতে পারি আমরা। ফলে ব্যক্তির নামে চিহ্নিত যুগ অনেক সময় একটা পশ্চাৎগণনার হিসেব, তা ব্যক্তির সমগ্র জীবন ও সৃষ্টি আর ওই সময়ে (এমনকি পরেও, যেমন আমরা শেষে দেখব) তাঁর আধিপত্যের পুরো হিসেব করতে পারি আমরা। তখনই তাঁর নামের সঙ্গে একটা যুগকে যুক্ত করি। এই পরম্পরার সময়মাত্রার কথায় আমরা পরে আসছি। সময়টা ধারাবাহিকতার সঙ্গে যুক্ত, ইংরেজিতে অনেক সময় তা বোঝাতে longitudinal কথাটা ব্যবহার করা হয়। প্রথমে আসি তার latitude বা ব্যাপ্তির কথায়। যুগন্ধর ব্যক্তির যুগে কী থাকেন, কারা থাকেন? থাকেন তাঁর সমসাময়িকেরা, তাঁর সমধর্মী, বা ভিন্নধর্মী মানুষেরা। সাহিত্যের ক্ষেত্রে সাহিত্যের সব ধরনের স্রষ্টাই হতে পারেন, কবিতা, নাটক, গল্প-উপন্যাস, সমালোচনা। এমনকি অন্য শিল্পের কথাও চলে আসতে পারে। ওই যুগন্ধরের প্রভাব বা অনুকরণের ক্ষেত্রটি দেখানো যেতে পারে, আবার তাঁর রচনা ও নন্দনতত্ত্বের বিরোধীদের রচনার কথাও আসতে পারে। যেমন বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে, ধরা যাক। বঙ্কিম যুগ। বঙ্কিমচন্দ্র ১৮৬৫ থেকেই ‘দুর্গেশনন্দিনী’ লিখে শোরগোল ফেলে দিয়েছেন, ১৮৬৬-তে বেরিয়েছে ‘মৃণালিনী’, তার পর ১৮৭২ সালে ‘বঙ্গদর্শন’ প্রকাশ করে বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে নেতৃত্বের অবস্থানটি নিজেই নির্মাণ করেছেন। তাতেই তাঁর ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ বা ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ প্রকাশিত হতে শুরু হয়েছে, তা পাঠকেরা মুগ্ধ হয়ে পাঠ করছেন।

তাঁর লেখার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে, দেখা গেল, একাধিক মানুষ ঐতিহাসিক উপন্যাস বা রোমান্স লিখতে এগিয়ে এসেছেন। তাঁর অগ্রজ সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৪-১৮৮৯), ছোট ভাই পূর্ণচন্দ্র (১৯৪৯-১৯২২), বৈবাহিক দামোদর মুখোপাধ্যায় (১৮৫৩-১৯০৭), রমেশচন্দ্র দত্ত (১৮৪৭-১৯০৯) ভূদেব মুখোপাধ্যায় (১৮২৭-১৮৯৪), স্বর্ণকুমারী দেবী (১৮৫৫-১৯৩২) থেকে শুরু করে প্রতাপচন্দ্র ঘোষ (?-১৯২১) পর্যন্ত। ওই সময়েই প্রচ্ছন্ন স্বদেশপ্রেমাত্ম ঐতিহাসিক-রোমান্টিক নাটকও প্রচুর রচিত হয়েছে, বিশেষত জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৪৯-১৯২৫) নাটকগুলি। পরে রাজকৃষ্ণ রায় (১৮৪৯-১৮৯৪)-ও লিখেছেন কিছু ও ধরনের নাটক। এমনকি তাঁর মৃত্যুর পরে দ্বিজেন্দ্রলাল, গিরিশচন্দ্রও লিখেছেন। তার পিছনে বঙ্কিমচন্দ্রের প্রভাব অস্বীকার করা যায় না।

কিন্তু একই সঙ্গে বঙ্কিমবিরোধী বা বঙ্কিমচন্দ্র থেকে পৃথক কিছু প্রবণতাও দেখা যায়, ওই উপন্যাস সাহিত্যেই। তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায় (১৮৪৩-১৮৯১) তাঁর ‘স্বর্ণলতা’ উপন্যাসে (১৮৭৪) রোমান্সের প্রতিস্পর্ধী হিসেবে বাস্তব জীবনচিত্র উপস্থাপন করার চেষ্টা করেন, বা ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় (১৮৪৭-১৯১৯) গ্রামীণ সামাজিক বাস্তবতার সঙ্গে ভূতপ্রেতের ফ্যান্টাসিকে অদ্ভুতভাবে মিলিয়ে দেন। আমার একটি প্রবন্ধে (‘স্বর্ণলতা’র ভূমিকা) আমি রবীন্দ্রনাথের বঙ্কিম-প্রভাবমুক্তির একটি ইতিবৃত্তের খসড়া করেছিলাম। ফলে 'বঙ্কিম যুগ' কথাটা একটা অদ্ভুত সরলীকরণ মনে হয় শেষ পর্যন্ত। একই রকম কথা 'রবীন্দ্র যুগ' সম্বন্ধেও। অর্থাৎ সাহিত্যের ইতিহাসে ‘যুগ’ কথাটা যখন ব্যক্তির নামাঙ্কিত হয়, তখন তা নানাভাবে প্রশ্নাধীন হয়ে ওঠে।

যুগ কি একচ্ছত্রতার প্রমাণ?

কিন্তু এই যুগ কথাটার তো আর-একটা অর্থ দাঁড়িয়ে যায়। আগের অংশে আমরা সে আলোচনার সূত্রপাত করেছি। সেটা হচ্ছে যুগচিহ্নক ব্যক্তিটির প্রভাব। এই প্রভাবের চরিত্রটি আমরা একটু বোঝবার চেষ্টা করি। হতে পারে কারও কারও ক্ষেত্রে যুগ এই স্বীকৃতিটা আদায় করে নেয় যে, হ্যাঁ, এই ব্যক্তিটি ওই যুগে প্রধান ছিলেন, তাঁর এক ধরনের আধিপত্য ছিল। কিন্তু প্রায়ই দেখা যায় যে, ওই আধিপত্যের মধ্যেও, ওই যুগেই কিছু ছিদ্র বা ভাঙন তৈরি হয়, ওই যুগসীমানার মধ্যেই। যেমন বঙ্কিম যুগ সম্বন্ধেই বলা যায়, রবীন্দ্র যুগ সম্বন্ধেও। মার্কস-এঙ্গেল্‌স কথিত দ্বান্দ্বিকতার সূত্র সব যুগেই মেলে। আপেলের গাড়ি উলটে দেবার মতো না হলেও, বিরোধিতা বা ভিন্নতা দেখা দেয়। বঙ্কিম যুগের কথা আমরা বললাম। রবীন্দ্র যুগ সম্বন্ধেও একই কথা বলা যায়। তাঁর যৌবনে কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ, বিশেষত দ্বিজেন্দ্রলাল রায় আর চিত্তরঞ্জন দাস এবং পরে মোহিতলাল মজুমদার, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬), ‘কল্লোল’-এর লেখকবৃন্দ (১৯২৩--) যে অন্যরকম শোরগোল তুলেছিলেন, তার কিছুটা ব্যক্তিগত বিদ্বেষপ্রসূত হলেও সবটা নয়; কিছুটা দৃষ্টিভঙ্গি আর জীবনদর্শনেরও তফাত ছিল। অর্থাৎ একজনের নামাঙ্কিত যুগ যতটাই বিস্তারিত হোক, তার মধ্যে নানান ছিদ্র ও ফাটাফুটো থাকে। বস্তুতপক্ষে ওই আধিপত্যই দ্বান্দ্বিকতা তৈরি করে, নানা ধরনের বিরোধ আর প্রতিবাদকেও আমন্ত্রণ করে। তবু ওই ব্যক্তিটির নামকে যুগের বিশেষণ হওয়া থেকে উৎখাত করা সম্ভব হয় না। এটা হয়তো রাজনীতি, প্রশাসন, শিক্ষা প্রশাসন, দর্শন নানা ক্ষেত্রেই সত্য। আমার সমাজতত্ত্ব আর সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাস সম্বন্ধে জ্ঞান সামান্য, দেশ-বিদেশের দৃষ্টান্তও আমি বেশি টানতে পারব না। তবু, বাংলার সামাজিক-সাহিত্যিক ইতিহাসের সীমাবন্ধ জ্ঞান থেকে এই রকমই আমার মনে হয়। অবশ্যই যুগচিহ্নিত ব্যক্তিদের প্রভাবের বা আধিপত্যের চরিত্র এক হয় না, তাদের বিরোধিতার সূত্রগুলিও এক নয়।

যুগ আর প্রভাবঃ সৃষ্টিতে, উপভোগে

আমরা রবীন্দ্র-যুগ শেষ হওয়া নিয়ে প্রশ্নটা তুলেছিলাম প্রথমে, সেই প্রসঙ্গে যুগ বলতে কী বোঝায় তার দু-একটা সুলুকসন্ধান নেবার চেষ্টা করেছি। আমাদের সন্ধান খুব ব্যাপক নয়। তা বিষয়ের দিক থেকে তুলনামূলক নয়, এমনকি সংস্কৃতির দিক থেকেও তুলনায় এগোয়নি। তার কারণ আমাদের নিজেদের অধিকারের সীমাবদ্ধতা। এবারে আমরা যুগ কথাটার অর্থ আরও সীমাবদ্ধ করে যাঁর নামে যুগ তাঁর প্রভাব অর্থটির দিকে নজর দেব। কারণ ‘রবীন্দ্র-যুগ’ বা ‘বঙ্কিম-যুগ’ বলতে অনেকে ওই অর্থটাও ধরেন, হয়তো একটু বেশি করেই ধরেন। ‘রবীন্দ্র-যুগ’ শেষ হয়ে গেছে’ বলতে বোঝেন রবীন্দ্র-প্রভাব শেষ হয়ে গেছে।

এখন এইখানে আমাদের প্রথম প্রশ্ন। প্রভাবটা ঠিক কীসের? কাদের উপর? কী হিসেবে? একদিকে আছে রবীন্দ্রনাথের (শুধু সাহিত্য যদি ধরি), কবিতা আর গদ্যে অজস্র রচনা। তাঁর কবিতার ঢঙ অনুসরণ করে আজ যে গ্রহণযোগ্য বাংলা কবিতা লেখা হয় না, সে কথা হয়তো ঠিক, কারণ তাঁর পরে বাংলা কবিতার ভাষাভঙ্গি অনেকটাই বদলে গেছে। তাঁর কবিতার এক সময়কার সুঠাম মিল ও ছন্দ, সরলতা আর আবেগ এখনকার কবিদের কাছে অনুকরণযোগ্য নয়, এটা অবশ্যই মেনে নিতে হবে। তাঁর গানের শৈলীও তাঁর কবিতার চেয়ে অনেক বেশিদিন ধরে বাংলা সংগীত রচনায় প্রভুত্ব করেছে। পরে, বিশ শতকের নব্বইয়ের দশক থেকে সুমন চট্টোপাধ্যায় আধুনিক জীবনচর্যার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ভাষায় হয়তো প্রথম রবীন্দ্রনাথের গানের শৈলী থেকে বিচ্ছিন্ন হলেন। তার পরে ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ থেকে শুরু করে বাংলা ব্যান্ডের গীতরচয়িতারা রবীন্দ্রনাথের গানের ধরন থেকে আলাদা হয়ে এলেন খুব স্পষ্টভাবেই।

অর্থাৎ, যাঁরা স্রষ্টা, কবিতার বা গানের, তাঁরা রবীন্দ্রনাথ থেকে অনেকটা সরে এসেছেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই। অনুকরণের আদল হিসেবে রবীন্দ্রনাথ এখন আর তত গ্রহণযোগ্য নেই। অন্তত কবিতা আর গানের ক্ষেত্রে। তাঁর সময় পর্যন্ত বাংলা কাব্যভাষার একটা মূল পরম্পরা ছিল, তাতে ধারাবাহিকতার স্পষ্ট ছাপ থাকত। গত শতকের তিরিশের বছরগুলি থেকেই তার পশ্চাদপসরণ ঘটতে থাকে। তাই রবীন্দ্রনাথের পরবর্তীকালে কবিতা হোক, গল্প-উপন্যাস হোক, সব কিছুই এত প্রখরভাবে ব্যক্তিত্ব চিহ্নিত হয়েছে যে, কারও শৈলী কারও কাছে অনুকরণযোগ্য নয়, প্রত্যেকেই নিজস্ব বয়ান তৈরি করেই চলেন, সেটাই রীতি। চিত্রকলা সম্বন্ধে আমি বলবার অধিকারী নই, কিন্তু চিত্রকলাতে যেহেতু মানুষের নিজস্বতা অনেক সময় সবচেয়ে বেশি করে ফুটে ওঠে সেহেতু কবিতা আর গানকে যেমন সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতায় ফেলা যায়, চিত্রকলাকে সেভাবে ফেলা যায় না। তাই তার অনুকরণ বা অনুসরণের প্রশ্নটি তত প্রকট নয়। কিন্তু গল্প, উপন্যাস ইত্যাদি আখ্যানমূলক কথাবস্তু, অজস্র নানা ধরনের প্রবন্ধ - যাতে ধর্ম, দর্শন, রাজনীতি, সমাজচিন্তা ইত্যাদি সবই আছে, সেগুলির সময়নিহিত চিহ্ন জীর্ণ হলেও প্রাসঙ্গিকতা একেবারে বিলুপ্ত হয়েছে, এ সবের লেখকদের কাছে, তা সম্ভবত বলা যাবে না।

ইংরেজিভাষী পাশ্চাত্যে যাকে reception বলা হয়, সমসাময়িক বা পরবর্তী স্রষ্টাদের অনুকরণ বা অনুসরণ নিশ্চয়ই এক হিসেবে তাই। জানি না, আজকালকার intertextuality কথাটা বলে তাকে কোনও আলাদা গৌরব দেওয়া যায় কি না। তাই ‘রবীন্দ্রানুসারী’ কবিসমাজ আছে, আবার রবীন্দ্রনাথের জীবিতকালেই রবীন্দ্রাপসারী কবিসমাজও দেখা দিয়েছিল। অবশ্যই অনুসরণ কাউকে গ্রহণের সাক্ষ্য, পরবর্তীদের সৃষ্টিতে। কিন্তু আর-এক ধরনের reception-ও আছে। তা হল উপভোক্তাদের কাছে। যদিও অনেক স্রষ্টাও উপভোক্তা হন, কিন্তু আমরা সেইসব মানুষের কথা ভাবছি, যাঁরা শুধুই পাঠক, শুধুই শ্রোতা, শুধুই দর্শক। তাঁরা কি রবীন্দ্রযুগ অতিক্রম করে গেছেন? রবীন্দ্রনাথকে তাঁরা এখন আর পড়েন না, পড়ে মুগ্ধ হন না? রবীন্দ্রনাথের গান শোনেন না, শুনে মুগ্ধ হন না? মুগ্ধ হন না, এমন লোক কিছু থাকবেন না তা হতে পারে না, কিন্তু আমাদের চর্মচক্ষে যা দেখি তাতে রবীন্দ্রনাথের কবিতার পাঠ ও আবৃত্তি, রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়া আর শোনা, রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্য গীতিনাট্যের অভিকরণের সীমাসংখ্যা দেখি না। শুনেছি যখন সিডি-ক্যাসেটের বাজার ছিল তখন রবীন্দ্রনাথের গানের ওসবই সবচেয়ে বেশি বিক্রি হত। স্কুলে, কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ, আলোচনা, অভিকরণে রবীন্দ্রনাথ যতটা উপস্থিত, এমন আর কেউ নন।

এই অবস্থাটা একটা অসুস্থ বা অস্বাভাবিক অবস্থা, তা নিশ্চয়ই কেউ বলবেন না। এমনও বলবেন না যে, বাঙালি অতীতে মুগ্ধ, বর্তমানের দিকে মুখ ফিরিয়ে আছে। অবশ্যই পাঠ, গ্রহণ, অনুকরণ, অভিকরণ - এই সমস্ত কাজ শ্রেণির উপর নির্ভর করে। এগুলি লেখাপড়া-জানা মধ্যবিত্ত বা তার উপরের শ্রেণির কাজ, নিরক্ষর কৃষক-শ্রমিক এখনও এই সাংস্কৃতিক জগতে ততটা প্রবেশ করার সুযোগ পাননি। ধরে নিচ্ছি, পরের অমৃত মহোৎসবে (পরেরটা কী মহোৎসব হবে জানি না, কারণ অমৃতের চেয়ে আরও দুর্লভ কী আছে তা আমার জ্ঞানের অতীত) তাঁরা কেউ কেউ সেই সুযোগ পাবেন। কিন্তু যে সব স্রষ্টা আমাদের উজ্জ্বল উত্তরাধিকারের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যান, তাঁদের যুগ কীভাবে শেষ হয় বা হয় না, তা সতর্ক বিচারের অপেক্ষা করে। এক হিসেবে গ্রিক ট্র্যাজেডিকার, শেক্সপিয়ার প্রভৃতির যুগ শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু তাঁদের নাটকের সংগ্রহণ শেষ হয়ে যায়নি। আর শুধু একটি সংস্কৃতির হিসেব নিলে চলবে না। যখন দেখি অড্রি হেপবার্নের সৎকার-সভায় গ্রেগরি পেক রবীন্দ্রনাথের ‘অনন্ত প্রেম’-এর ইংরেজি অনুবাদ আবৃত্তি করেন এই সেদিন, বা আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী ডাক্তারের লেখা, মার্কিনদেশে প্রিমেডিক্যাল স্তরে পাঠ্য মৃত্যু সম্বন্ধে ইংরেজি বইয়ে (On Death and Dying, by Dr. Elizabefh Kubler-Ross) শুধু রবীন্দ্রনাথেরই উদ্ধৃতি থাকে, তখন মনে হয়, কার যুগ কখন শেষ হয় তার কোনও একটা মাত্রা নেই।