আরেক রকম ● দশম বর্ষ ঊনবিংশ-বিংশ সংখ্যা ● ১-৩১ অক্টোবর, ২০২২ ● ১৬ আশ্বিন - ১৫ কার্তিক, ১৪২৯

প্রবন্ধ

সঞ্জয় উবাচ


কর্তব্য পথ

মহারাজ, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এইমাত্র দেশের অগ্রগতির দিকে নজর রেখে একটা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়ে ফেললেন। রাজধানী দিল্লি নগরে 'কর্তব্য পথ' নামে এক জরুরি সড়কের উদ্‌বোধন করে জাতির নামে তিনি সেটা উৎসর্গ করলেন।

এটা কি কোনো নতুন সড়ক নির্মিত হল? অরুণাচল কিংবা লাদাখ সেক্টরে অনেকদিন ধরেই চীনের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত সংঘর্ষ এবং অবৈধ নির্মাণকে কেন্দ্র করে নাকি নিয়মিত খিটিমিটি লেগেই আছে। তা এই সড়ক কি সে সবের সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো কৌশলগত নির্মাণ? যুদ্ধকালে এতে ভারতের কী ধরনের সুবিধা প্রত্যাশা করা হচ্ছে তা আমাকে জানাও, সঞ্জয়।

না, মহারাজ। রাজধানীর এই সড়কের সঙ্গে যুদ্ধযাত্রার কোনো সম্পর্ক নেই। সত্যি কথা বলতে কি, এই সড়ক কল্পনায় রণকৌশলের মতো তুচ্ছ জিনিসের চিন্তা কোনোভাবেই প্রভাব ফেলেছে বলে মনে হয় না। এই সড়ক সম্ভবত বিশুদ্ধ দার্শনিক চিন্তার ফসল। ওই রণকৌশল টৌশলের মতো সংকীর্ণ চিন্তা নিতান্ত বিরোধীপক্ষের অপপ্রচার বলে জানবেন, মহারাজ।

আমার কৌতূহল বাড়ছে সঞ্জয়। তুমি আমাকে বলো, সড়কের মতো ইট কাঠ বালি সিমেন্ট না কী ওই ম্যাকাডামাইজড সলিউশন টন কিসব বলো তোমরা তাই দিয়ে বানানো একটা বস্তুগত উপাদানে নির্মিত জিনিস। তার উদ্দেশ্যও নিতান্ত বস্তুগত। এক কথায় যাতায়াতের সুবিধা। এ কথা আমি মানি যে, জীবনের অত্যন্ত কেজো প্রয়োজনের জিনিসের পিছনেও দার্শনিক চিন্তার ভূমিকা অগ্রাহ্য করার নয়। কিন্তু এই কর্তব্য পথের পিছনে সেই দার্শনিকতার ভূমিকা আমি দেখতে পাচ্ছি না। তুমি বিশদে ব্যাখ্যা করো, সঞ্জয়।

আমার ব্যাখ্যা করার কিছু নেই, মহারাজ। আপনার এরকম সমস্যার সম্ভাবনা সম্ভবত তিনি আগাম অনুমান করেছিলেন। তাই যা ব্যাখ্যা করার তিনি নিজেই করেছেন, অন্যের উপরে এমন সূক্ষ্ম ব্যাখ্যার দায়িত্বভার অর্পণ করার মতো অবিবেচক তিনি নন। তবে মহামহিম তাঁর ভাষণে যা বলেছেন তাকে ব্যাখ্যা বলা আমার পক্ষে উচিত হচ্ছে কিনা সেকথা বিচার্য। তিনি যা বলেছেন তা হয়তো প্রকৃতপক্ষে সূত্রায়ণ। কারণ ভারতীয় দর্শন প্রবাহে আদিমুখে যে উচ্চারণ হয় তাকে সূত্র বলাই সংগত। সেই সূত্র নিয়ে অন্যেরা যা বলবেন তার গোত্রবিচারের জন্য আছে ভাষ্য টীকা বার্তিক ইত্যাদি সব প্রকরণ। আর আপনি অবগত আছেন, মহারাজ, আমার কাজ মূলত প্রতিবেদকের, ব্যাখ্যাতা, ভাষ্যকার বা টীকাকারের নয়। তবে এ কথাও আপনার ভূয়োদর্শনে অবিদিত নয় যে বস্তুত কোনো কথাই নিরঞ্জন প্রতিবেদনের স্তরে থাকে না বা থাকতে পারে না। সকলের সব কথাই প্রকৃতপক্ষে ব্যাখ্যা রঞ্জিত। আমরা বস্তুত এক ব্যাখ্যালব্ধ পৃথিবীর বাসিন্দা। আমরা সকলেই ভাষ্যকার লালিত। হয়তো সেই অদৃশ্য ভাষ্যকার আমাদের অচেনা।

তোমার কথাবার্তা এবার রীতিমতো দার্শনিক স্তরে পৌঁছে যাচ্ছে।

সেটাই কি স্বাভাবিক নয়, মহারাজ। আপনি মানবেন কিনা জানি না আমাদের দৈনন্দিনে যে-বয়ান আমরা সবাই মিলে বুনে চলেছি তারই মধ্য থেকে একদিকে রূপ পাচ্ছে বিভিন্ন দর্শনের চেহারা। আবার আর এক দিকে নানা দর্শন নিহিত হয়ে থাকছে আমাদের সেই দৈনন্দিনের আচারে আচরণে। আর তা থাকছে বলেই ওই রূপ পরিগ্রহ ব্যাপারটাও সম্ভব হচ্ছে। দর্শন যে আমরা সন্ধান করে বেড়াই বিশ্ববিদ্যালয়গুলির দর্শন বিভাগে সে আমাদের এক মস্ত ভাবনা বিপর্যাস। সেখানকার সমস্ত পুঁথি পাণ্ডুলিপি ঘেঁটেও আপনি যা পাবেন তা বড়জোর প্রত্নদর্শন। আগের দিনের মানুষেরা যেসব দর্শনের সন্ধান পেয়েছিলেন তার যতটুকু বিবরণ পাওয়া গেছে বড়োজোর সেটুকু। এই যে এই মুহূর্তের কর্তব্য পথের দর্শন সে আপনি সেখানে কোথায় পাবেন, মহারাজ। পাবেন, হয়তো আজ থেকে হাজার বছর বাদে। কিন্তু মহারাজ, আপনার কাছে এসব কথা বলা আমার পক্ষে ধৃষ্টতা।

না, ধৃষ্টতা কেন হবে। যুক্তি তর্কের কোনো আলোচনার মধ্যেই ধৃষ্টতা বা বিনয়-অবিনয়ের কোনো প্রশ্ন নেই। যে-কোনো আলোচনার নৈতিক মাত্রাও নিশ্চয় আলোচনার যোগ্য। কিন্তু নির্দিষ্ট কোনো যুক্তিতন্ত্রের প্রসঙ্গে বিনয়-অবিনয় অনালোচ্য। সবিনয় নিবেদনে পেশ করা ভুল যুক্তিও ভুল। দুর্বিনীত অকাট্য যুক্তিও তেমনি গ্রাহ্য হবার কোনো বাধা নেই।

আমার সকৃতজ্ঞ স্বীকৃতি গ্রহণ করুন, মহারাজ। আপনার এ কথায় আমি অনেক বল পেলাম। মহামহিমের মুখনিঃসৃত যে বচন আমি আপনাকে নিবেদন করতে পারছি তার জন্য আমার সূতজন্ম সার্থক।

বলো, তোমার মুখ থেকে কর্তব্যপথদর্শন সূত্র শোনার জন্য আমি উৎসুক হয়ে আছি।

রাজধানীতে বিজয়চক থেকে ইণ্ডিয়া গেট পর্যন্ত যে সড়কের নাম ছিল 'রাজপথ' তা এখন থেকে পরিচিত হবে 'কর্তব্য পথ' নামে। এই সামান্য পরিবর্তনটুকু সামান্য নয় মহারাজ। এক দিকে রাজপথের সঙ্গে জড়িয়ে আছে রাজার স্মৃতি। দাসত্বের স্মৃতি। উপনিবেশের স্মৃতি। এক কথায় এই বিরাট কলঙ্কজনক ইতিহাস চিরকালের মতো ইতিহাসের গর্ভে নিমজ্জিত হল। কিন্তু মহারাজ, রাজার ভাগ্নেরা আপনি জানেন ঝোপেঝাড়ে এদিকে ওদিকে কোথায় না কোথায় যে লুকিয়ে থাকে এবং ঠিক সময়মতো মোক্ষম ফুট কেটে ওঠে।

তা এখানে তারা কী বলছে, কী বলার আছে তাদের। ভারতের দীর্ঘকালের উপনিবেশের ইতিহাসের কথা ইতিহাসের ছাত্র ছাড়াও আরো পাঁচ জনে জানে। ভাগ্নে কি সে কথাও অস্বীকার করতে চায়।

সেসব তর্কের মধ্যেই যায়নি। খিক খিক করে বলে কি না, রাজপথ কি রাজার পথ না পথের রাজা? আপনাকে অকপটে বলি মহারাজ, কথাটা প্রথম কানে আসায় উপেক্ষা করতে গিয়েও কেমন একটু খটকা লাগল। দৌড়ে বাড়ি গিয়ে চট করে হাতের কাছে যা অভিধান পেলাম একটু তাড়াতাড়ি উলটে নিলাম। দেখি কি যা লিখেছে তাতে ভাগ্নের কথাটা তৎক্ষণাৎ ফেলতে পারলাম না। উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে বলছি মহারাজ, লিখেছে ‘যানবাহন চলাচলের উপযোগী প্রশস্ত পথ’। তার পরে আবার ব্রাকেট দিয়ে লিখেছে 'চল্লিশ হাত চওড়া'। ভাগ্নের খিক খিক হাসিটা কানে লেগেই রইল। মনে শান্তি আসে না। আরো অভিধান ঘাঁটলাম। আমি সূতপুত্র, আমার কি এসব পোষায় মহারাজ। তবুও আপনাদের সান্নিধ্যে যেটুকু পুণ্যার্জন সম্ভব হয়েছে তার জোরে যা বুঝলাম তাতে মনে হল কথাটা একেবারে উড়িয়ে দেবার মতো নয়। একটা অভিধানে তো 'পথের রাজা' মানেটাই লিখেছে। পর নিপাত করে মানে দিয়েছে রাজার যাবার পথ, ওই চওড়া বলেই, রাজার যাবার জন্য প্রশস্ত বলেই।

তা এর মধ্যে তুমি দার্শনিকতার আভাস পাচ্ছ কোথায়?

এই যে রাজপথের নাম বদলে 'কর্তব্য পথ' করা হল এর মধ্যে গূঢ দার্শনিকতা নিহিত আছে। ওই পথে গেলেই মানুষের মনে সচেতনতা জেগে উঠবে যে এই আমার কর্তব্য। আমার ভয় হচ্ছে মহারাজ রাজার ভাগ্নে না আরো বেশি খিক খিক করে।

কেন? এতে তার খিক খিক করার কি কারণ?

কারণ এই মহারাজ, বলতে আমারই ভয় হয়, যদিও জানি আমার ইমিউনিটি আছে, তবুও।

বলো, নির্ভয়ে বলো।

ওইটুকু রাস্তায় কর্তব্যের বোধে নাগরিকেরা না হয় সচেতন হয়ে উঠল, তার পর, ওই রাস্তার বাইরে গেলেই যদি তাদের সে বোধ উবে যায়।

আবার ওই রাস্তায় ফিরে এলে, যেদিন আসবে সেদিন, আবার জেগে উঠবে। এতে তোমার রাজার ভাগ্নে কিংবা তোমার, কার কীই বা অসুবিধা?

না মহারাজ, এমনি অসুবিধা কিছু নেই, কোনো সাংবিধানিক সমস্যা উঠবে কিনা সেটা ভাবছি।

এখানে আবার সংবিধানের কথা উঠছে কেন?

উঠছে এই কারণে যে, ১৯৭৬ সালের ৪২-তম সংবিধান সংশোধনী আইন অনুসারে পার্ট ফোর এ শিরোনামে মৌলিক কর্তব্য বলে যে ৫১(এ) ধারার দশটি অনুচ্ছেদ গুঁজে দেওয়া হয়েছে তাদের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। মহারাজ, 'গুঁজে দেওয়া' ক্রিয়াপদটা ব্যবহার করে ফেললাম বলে কিছু মনে করবেন না। দেখবেন তার আগের ৫১ নং এবং পরের ৫২ নং ধারার অনুক্রমে কোনো বদল না ঘটিয়ে সুকৌশলে দশটি অনুচ্ছেদ সমেত একটা গোটা অধ্যায় বসিয়ে দেওয়া গেল। অধ্যায়ের শিরোনামও ওই জন্যে পার্ট ফোর এ।

তাহলে ব্যবস্থা সবই তো যথাযথ আছে, অসুবিধা কোথায়?

ভাগ্নেকে এসব করে থামানো যাচ্ছে না, মহারাজ। সে হেসেই চলেছে। বলছে, পুজোর আলোকসজ্জার মতো কর্তব্যবোধ বিষয়ে সচেতনতা ওই রাস্তায় গেলে জ্বলে উঠছে আর বেরিয়ে এলে নিভে যাচ্ছে। কী মজা। ভাগ্নে হাসছে আর মাঝে মাঝে বলে চলেছে, ওই সংশোধনীর পাঁচ নম্বর অনুচ্ছেদ (ই)-তে আছেঃ

ভারতের সমস্ত নাগরিকের কর্তব্য - to promote harmony and the spirit of common brotherhood amongst all the people of India transcending religious, linguistic and regional or sectional diversities; to renounce practices derogatory to the dignity of women.

আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করা ছাড়া এই সূতপুত্র আর কি করতে পারে মহারাজ।


(সৌরীন ভট্টাচার্য)