আরেক রকম ● দশম বর্ষ ঊনবিংশ-বিংশ সংখ্যা ● ১-৩১ অক্টোবর, ২০২২ ● ১৬ আশ্বিন - ১৫ কার্তিক, ১৪২৯
প্রবন্ধ
নিজেকে নিয়ে
শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়
(শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রায় সমস্ত শাখায় তাঁর অনায়াস বিচরণ। তাঁর তথ্য নির্ভর, যুক্তিনিষ্ঠ বিশ্লেষণ সম্পৃক্ত প্রত্যয়ী উপস্থাপনায় সবসময়ই দর্শক-শ্রোতা-পাঠক মুগ্ধ-সমৃদ্ধ। নিজের সম্পর্কে তিনি কিন্তু সাধারণত নীরব। তাঁর ৮৩তম জন্মদিনে (১৭ জুন, ২০২২) সম্ভবতঃ এই প্রথম তিনি নিজের বড়ো হওয়ার, নিজেকে গড়ে তোলার আখ্যান শোনালেন। দে'জ পাবলিশিং আয়োজিত তাঁর জন্মদিন উদযাপনের পরিসরে উপস্থিত অতিথিদের সঙ্গে আলাপচারিতায় নির্মিত হয় এই আখ্যান। - সম্পাদকমন্ডলী, আরেক রকম)
শুভঙ্কর (অপু) দেঃ নমস্কার। আজ ১৭ই জুন। শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মদিন উপলক্ষ্যে আমরা এখানে সমবেত হয়েছি। দে’জ পাবলিশিং-এর পঞ্চাশ বছরে তাঁর সম্পাদিত প্রথম বই, যদ্দূর মনে পড়ছে উৎপল দত্তের গদ্যসংগ্রহের প্রথম খণ্ড। এই বইটা প্রকাশের সময় থেকে আমাদের সঙ্গে তাঁর পঁচিশ বছরের সম্পর্ক। সেই সুবাদে তাঁর বই সম্পাদনার অভিজ্ঞতা শুনতে শুনতে শুরু করা যাক আজকের আলাপচারিতা।
শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ঃ দে’জ-এর কথা বলতে গেলে যেটা আমায় বলতে হয় - বাংলা প্রকাশনা ব্যবসা, শিল্প এগুলোর সঙ্গে কিন্তু আমার সেভাবে কোনো পেশাগত, কর্মগত যোগ তৈরি হতে একটু সময় লেগেছিল। আমি প্রকাশনায় যেভাবে চলে আসি সে-কথা তো আজকের আলোচনায় পরেও আসতে পারে। সব সময় যেটা বলে থাকি, আমি মাস্টারের ছেলে, মাস্টার হতে চেয়েছিলাম। অন্য কোনোরকম সাধ, স্বপ্ন, কল্পনা, আদর্শ, লক্ষ্য - কিচ্ছু ছিল না। কোনোদিনই ছিল না। মাস্টারি শুরু করি। মাস্টারির জন্য যে প্রস্তুতি লাগে, সেই প্রস্তুতিটা সম্পন্ন করি। আমি খুব ভাগ্যবান যে, অসামান্য, মহীয়ান মাস্টারমশাইদের পেয়েছি। তাঁদের কাছে শিক্ষা পেয়েছি। নানা বিষয়ে শিক্ষা পেয়েছি। আগ্রহ তৈরি হয়েছে নানা বিষয়ে। যদিও আমি মূলতঃ সাহিত্যের ছাত্র, কিন্তু আগ্রহটা ছড়িয়ে পড়ে। ব্যাপ্ত আগ্রহের একটা ক্ষেত্র তৈরি হয়। কিন্তু ইচ্ছে ছিল যে সবটাই, আমার মাস্টারির মধ্য দিয়ে - যা আমি শিখছি, যা আমি আয়ত্ত করছি, আমি আমার ছাত্র-ছাত্রীদের দেব এবং তাদের কাছ থেকে নেব। কারণ আমার সব সময় মনে হয়েছে তখন যে, আমি যেটুকু দিচ্ছি সেটা শুধু খণ্ড খণ্ড কিছু জ্ঞান বা তত্ত্ব বা তথ্য নয়। মানুষ হবার, মানুষ তৈরি করার, মানুষের সমাজকে উত্তরণের কোথাও নিয়ে যাওয়া - এই সবকিছুর সঙ্গে কিন্তু শিক্ষা জড়িত। সেইজন্যই শিক্ষা। আর কোনো কারণ নেই শিক্ষার। আর কোনো প্রয়োজন নেই শিক্ষার - আমার মনে হয়েছিল। একটা সময় আসে যখন আমি উপলব্ধি করি যে, যা আমি করছি সেটা সেই অর্থে আর মাস্টারি থাকছে না। পুরো ব্যবস্থাটা এমনভাবে ধ্বস্ত তাতে আমার ভূমিকাটাও আর মাস্টারের ভূমিকা নয়। শিক্ষা নির্মাণের ভূমিকা নয়। শিক্ষা দেওয়া নয়, শিক্ষা নির্মাণ। তখন কষ্ট হয়, এবং স্থির করি এভাবে মাস্টারি আর পারব না। ছেড়ে দিই। কী করব ভবিষ্যতে, তখন জানি না। একেবারেই ঘটনাক্রমে, রবীন্দ্রভারতীতে আমার সহকর্মিণী ছিলেন রুবি চট্টোপাধ্যায়, ইংরেজির খুব ভালো অধ্যাপিকা। রুবিদির সঙ্গে গল্প করছিলাম, যে পারছি না, ছেড়ে দেব। জিজ্ঞেস করলেন, কী করবে? বললাম, জানি না কী করব। কিন্তু এটা মাস্টারি নয়। মাস্টারির প্রতি প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ এই বিশ্বাসঘাতকতা, আমি আর পারছি না। রুবিদির স্বামী নিরুপম চট্টোপাধ্যায়, ইংরেজির খুব ভালো ছাত্র। একসময় অধ্যাপনাও করেছেন। নিরুপমবাবু তখন কলকাতায় 'অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস'-এর রিজিওনাল এডিটর। নিরুপমবাবু তিন দিন পরে আমায় ফোন করে বললেন, আপনি নাকি চাকরি ছেড়ে দেবেন ভাবছেন? আসুন, অক্সফোর্ড-এ আসুন। সম্পাদনার কথা কিন্তু কোনোদিন সেইভাবে ভাবিনি। যদিও পত্র-পত্রিকার সম্পাদনা - সেগুলো করেছি। তার একটা ইতিহাস আছে। কিন্তু বই সম্পাদনার ব্যাপারটাই তখন জানি না। সত্যিই একেবারেই জানতাম না। হঠাৎ এই প্রস্তাব। আমি বললাম, আমি তো জানি না! বললেন, আমি এখনও ছ'-মাস কলকাতায় আছি। তারপর দিল্লিতে এই প্রতিষ্ঠানের অন্য একটা পদে চলে যাব। আমার পদটা আপনি নেবেন। ছ'মাসে আমি আপনাকে শিখিয়ে দেব। আপনি পারবেন।
এই ভরসাতে 'অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস'-এ ১৯৭৩ সালে যোগ দিই। এবং এইখানে পেশাগতভাবে সম্পাদনার বৃত্তি আমি গ্রহণ করি। তার আগে ভাবিনি কিন্তু।
এবং শিখতে-শিখতে, কাজ করতে-করতে অক্সফোর্ড-এ আর একটা ঘটনা ঘটেছিল। একটা দুর্ঘটনা থেকে ঘটনা। যেমন একটা দুর্ঘটনা থেকে মাস্টারি ছেড়ে সম্পাদনায় আসা; এটাও আর একটা দুর্ঘটনা। আমি অক্সফোর্ডে এসে জানলাম ওঁরা একটা পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন - ইংরেজি মাধ্যমের ইশকুলে বাংলা পড়ানোর জন্য ওঁরা একটা সম্পূর্ণ পাঠক্রম তৈরি করেছেন। এবং সেই পাঠক্রম ধরে প্রায় তিরিশটা বইয়ের একটা পরিকল্পনা ওঁরা গ্রহণ করেছেন। একটা সম্পূর্ণ গ্রন্থমালা। প্রায় আট বছরের শিক্ষাক্রম ধরে ধরে বই তৈরি করা হবে। সেটা সম্পাদনার দায়িত্ব ওঁরা প্রথম দিয়েছিলেন গণেশ বাগচীকে। গণেশ বাগচী তখন কলকাতার ব্রিটিশ কাউন্সিলের ইংরেজি ভাষা শিক্ষার দায়িত্বে ছিলেন। ওঁদের ইএলটি অফিসার - 'ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ টিচিং' অফিসার নামের একটি পদে উনি তখন নিয়োজিত। তার আগে গণেশ আফ্রিকার অনেকগুলো দেশে ব্রিটিশ কাউন্সিলের হয়ে ইংরেজি শিক্ষা প্রসারে কাজ করেছেন। সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে উনি এসেছেন। তাঁকে ওঁরা দায়িত্ব দিয়েছেন। উনি বললেন, অন্যভাষীদের ইংরেজি শেখানোর পদ্ধতি, বিজ্ঞান - এগুলো আমি চর্চা করেছি। এবং সেটা বাংলার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করার একটা পরীক্ষায় আমি নামতেই পারি। কিন্তু অনেকদিনের অনভ্যাস, চর্চার অভাব ইত্যাদি কারণে বাংলা ভাষাটার ওপরে আমার ততটা দখল নেই, যতটা গভীরে যাওয়া দরকার। তবেই ওই ভাষাটা শিক্ষার বিশেষ যে প্রয়োজন, দাবি - সেগুলোকে পূরণ করতে পারি। তখন উনি বলেন, যে শান্তিনিকেতনে এক ভদ্রমহিলা আমার স্ত্রীর বান্ধবী ও সহপাঠিনী ছিলেন। নাম মহাশ্বেতা দেবী, তাঁকে যদি এটার সঙ্গে যুক্ত করা যায়। তখন ঠিক হয় মহাশ্বেতা দেবী এবং গণেশ বাগচী - এঁরা দু'জন সম্পাদনা করবেন ‘আনন্দ পাঠ’ নামে এক গ্রন্থমালা। মহাশ্বেতা দেবীই নামকরণ করেছিলেন। ইতিমধ্যে গণেশ আমার অসমবয়সী বন্ধুই হয়ে উঠেছিলেন। চিনতাম আগে থেকেই। গণেশ ইতিমধ্যে, কী বলব ইংরেজিতে ওঁর বস, তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে প্রেমে জড়িয়ে পড়লেন। বিরাট একটা কেলেঙ্কারি। ব্রিটিশ কাউন্সিলের বড়ো কর্তার স্ত্রীর সঙ্গে বাঙালি ভদ্রলোক, ভাষা শিক্ষার দায়িত্বে, তাঁর প্রেম। গণেশের সেই বস, তিনিও আমাদের বন্ধুস্থানীয়, প্রথম নাম জন। জন এখানকার চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে গেলেন অন্য জায়গায়। গণেশকেও কলকাতা ছাড়তে হল ওঁর নতুন বান্ধবীকে নিয়ে। তার ফলে ‘আনন্দ পাঠ’-এর পরিণতিটা সাময়িকভাবে একটু নিরানন্দময় হয়ে গেল। তো, ওই দুর্ঘটনাটার সময়ই আমি এসে পড়েছি অক্সফোর্ড-এ।
মহাশ্বেতাদির সঙ্গে আমার তখন কোনো বন্ধুত্ব বা পরিচয় ছিল না। এমনি আনুষ্ঠানিক ঔপচারিক পরিচয় হয়তো ছিল। তার বেশি কিছু নয়। আর বিজনদার (ভট্টাচার্য) সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব, বিজনদার প্রতি আমার আনুগত্য, সেটা তখন অনেকটাই শক্তপোক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক ব্যাপারে বিজনদা আমার ওপর নির্ভরও করেন। মহাশ্বেতাদি সম্পর্কে দূরত্ব তো নিশ্চয়, একটা বিরোধও আমার মধ্যে কিন্তু তখন বেশ জমাট বেঁধে রয়েছে। কিন্তু কাজ বড়ো বালাই। এই কাজটা করতে করতে একটা বন্ধুত্ব তৈরি হয়। দীর্ঘদিন সে বন্ধুত্ব ছিল। আর সময়টা খুব দারুণ! কারণ, মহাশ্বেতাদি ঠিক তখনই ওই ’৭৩ সালেই, আমি যখন ‘আনন্দ পাঠ’ নিয়ে মহাশ্বেতাদির সঙ্গে সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করেছি, ‘হাজার চুরাশির মা’ লিখছেন। যেটা মহাশ্বেতাদির লেখক-জীবনের একটা সম্পূর্ণ পর্বান্তর। এটা ‘ঝাঁসীর রাণী’-র মহাশ্বেতা নন; এটা ‘মধুরে মধুরে’-র মহাশ্বেতা নন; সম্পূর্ণ আরেকটা মহাশ্বেতা। এবং ‘হাজার চুরাশির মা’ যখন লিখছেন, তখন তার অংশবিশেষ পড়ে শোনাচ্ছেন আমাকে। সেই অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। আর একটা জিনিসও লক্ষ্য করছি, এই মানুষটা যার সঙ্গে আমার একটা বিরোধ, দূরত্ব, কী বলব, অভিমান বহুদিন ধরে জমে ছিল, সেটা আস্তে আস্তে ভাঙছে। কারণ অনেক কাছ থেকে দেখছি এই মানুষটাকে। আর দেখছি ‘হাজার চুরাশির মা’ লেখার মধ্য দিয়ে।
পুত্র নবারুণের (ভট্টাচার্য) সঙ্গে মহাশ্বেতাদির দূরত্ব তখন প্রবল। নবারুণ সম্পূর্ণভাবে তার বাবাকে ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে। এবং কোথাও তার বাবার (বিজন ভট্টাচার্য) কাছ থেকে মহাশ্বেতাদির সরে যাওয়াটা, আরেকটা সম্পর্কের মধ্যে চলে যাওয়াটা ক্ষমা করেনি ও। প্রচণ্ড রাগ। আর ততদিনে, আমি নবারুণকে পড়াতেও শুরু করেছি। নবারুণ জিওলজি নিয়ে পড়তে শুরু করেছিল আশুতোষ কলেজে। এক বছর পরে ওর পছন্দ হয় না। ও ইংরেজিতে চলে আসে। বিজনদা আমাকে দায়িত্ব দেন বাপ্পাকে (নবারুণ ভট্টাচার্য) পড়াবার। এবং বাপ্পার সঙ্গেও আমার আত্মীয়তা, বন্ধন তখন তৈরি হচ্ছে। ওকে পড়াচ্ছি, নিয়মিত আসছে আমার কাছে। আমি বিজনদার কাছে যাচ্ছি বারবার। আর যে বাড়িটায় আমি তখন থাকি, সেটাও খুব মজার। আমি তখন জ্যোতি বসুর পৈত্রিক বাড়িতে ভাড়া থাকি। ৫৫বি, হিন্দুস্তান পার্ক-এ। সময়টা সত্তরের দশকের মাঝামাঝি। আপনারা জানেন যে ’৬৭ সালে প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার হয়েছে। সে সময় আমরা ওই বাড়িতেই। রাস্তাটার ঠিক মোড়ে ‘সুরতীর্থ’ বলে গানের একটা ইশকুল ছিল। সেইখানে সন্ধেবেলা বিজনদা তাঁর নাটকের মহলা দেন। আর মহলা হয়ে গেলে রাত্তির আটটা-সাড়ে আটটা নাগাদ আমার বাড়িতে চলে আসেন আমার সঙ্গে গল্প করতে, কথা বলতে, অনেক কিছু নিয়ে আলোচনা করতে। এইভাবে সম্পর্কগুলো তৈরি হয়ে যাচ্ছে। আপনারা হয়তো অনেকেই জানেন পরে আমি ‘হাজার চুরাশির মা’ উপন্যাসটি ইংরেজিতে অনুবাদও করেছি। এটির একটা নাট্যরূপ দেন মহাশ্বেতাদি। সেটারও অনুবাদ আমি ইংরেজিতে করেছি। কাজ করেছি ওঁর সঙ্গে। ফলে আমার মনে হয়েছে কোথাও নবারুণের সঙ্গে মহাশ্বেতাদির দূরত্ব, মায়ের সঙ্গে ছেলের দূরত্ব - সেইটাই কিন্তু ‘হাজার চুরাশির মা’-র বিষয়। নকশাল আন্দোলন নয়। ‘হাজার চুরাশির মা’ লেখা হয়ে যাবার পরে, নকশালপন্থী কিছু ছেলে মহাশ্বেতাদির কাছে এসে অনুযোগ করে যে, আপনি আমাদের কথা জানেন না। বাইরের লোক হিসেবে লিখেছেন। কেন লিখেছেন? প্রতিবাদ করে তারা। তারপর মহাশ্বেতাদি সত্যি-সত্যি, সরাসরি এই আন্দোলন সম্বন্ধে ভাবতে থাকেন। আন্দোলনের অন্দরে-গভীরে যেতে চান এবং আদিবাসী বিদ্রোহ সম্পর্কেও তাঁর আগ্রহ, কৌতূহল তৈরি হতে থাকে। বন্ধুত্বের সূত্রেই এই বিষয়গুলো নিয়ে ওঁর সঙ্গে তখন আমার আলোচনা হচ্ছে। আপনারা জানেন যে ‘হাজার চুরাশির মা’, মহাশ্বেতা দেবীর রচনাবলী অজয়ের (গুপ্ত) অসামান্য সম্পাদনার গুণে দে’জ প্রকাশ করেছেন, তাতে পাবেন, প্রথম ভাষ্য যেটা পত্রিকায় বেরিয়েছিল। সেটার সংস্কার, সংশোধন করেন মহাশ্বেতাদি। ওই আলোচনাগুলো থেকেই। এবং কোথাও নকশালপন্থী আন্দোলনটা কলকাতার আন্দোলন নয়, নকশালবাড়িরই আন্দোলন - এইখান থেকে উনি শুরু করতে চেয়েছিলেন এবং খোঁজ করতে থাকেন যে আদিবাসীদের অবস্থান, আদিবাসীদের ইতিহাস - সেখান থেকে আন্দোলনের উৎস, এটাকে সন্ধান করতে চান। এবং আমার মেজদা, সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় নকশালবাড়ি আন্দোলনে একটা সময় কাজও করেছেন, তার ইতিহাসও রচনা করেছেন। দেবজ্যোতি (দত্ত) আছেন এখানে, সংসদের, দেবজ্যোতি প্রকাশ করেছেন, সুমন্তর লেখা 'ইন দ্য ওয়েক অফ্ নকশালবাড়ি'। সুমন্তর সঙ্গে আমি যোগাযোগ করি মহাশ্বেতাদির জন্যই। সুমন্ত বলেন যে, কলকাতায় তাঁদের গ্রন্থাগারে নির্মল ঘোষ আছেন। তিনি ওখানে সংগৃহীত পুরোনো কাগজপত্র, বই - এগুলোর সন্ধান জানেন। মহাশ্বেতাদির সঙ্গে নির্মলবাবুর যোগাযোগ করিয়ে দিই। নির্মলবাবুই প্রথম বই জোগান দিতে থাকেন নকশালবাড়ি আন্দোলনের ওপরে। আপনারা জানেন যে পরবর্তীকালে নির্মলবাবুর সঙ্গে মহাশ্বেতাদির একটা সম্পর্ক তৈরি হয়। দীর্ঘদিন সেটা ছিল। নির্মলবাবুর মৃত্যু পর্যন্তই ছিল। সেইখান থেকেই প্রথম উনি কুমার সুরেশ সিং-এর ‘দ্য ডাস্ট-স্টর্ম অ্যান্ড দ্য হ্যাঙ্গিং মিস্ট’ বলে বিরসা মুন্ডার আন্দোলনের ওপর লেখা বই, সেইটা নির্মলবাবুর কাছেই পান। মহাশ্বেতাদি পরে একটা সময় ধরে যেটা করেছেন, সেটা হল একটা কোনো সূত্র পেলেই, সেই সূত্রটাকে ধরে তার উৎসে গিয়ে আরো তথ্য, আরও খবর জোগাড় করে আনতেন। প্রায় খনন করে তুলে আনতেন। সেই কাজ শুরু করার পর খোঁজ পান আইএএস্ অফিসার কুমার সুরেশ সিং-এর। তিনি তখন আবার ছোটোনাগপুরে কর্মরত। মহাশ্বেতাদি যোগাযোগ করেন। সুরেশ সিং-ও তখন তাঁর বই সংশোধন করে তার একটা রূপান্তর তৈরি করছেন। তখন সুরেশ সিং খুব সোৎসাহে মহাশ্বেতাদিকে ওঁর যা কিছু সরকারি সুযোগ-সুবিধা ছিল তা দিয়েছিলেন, যাতে পুরো ছোটোনাগপুর অঞ্চলটা এবং যেখানে যেখানে বিরসার আন্দোলনের বীজ উপ্ত হয়েছিল, সেই জায়গাগুলোতে যাবার সুযোগ করে দেন, পৌঁছে দেন, নিয়ে যান। এবং এই অভিজ্ঞতা থেকেই ‘অরণ্যের অধিকার’ লেখা। সেটাও লেখা হচ্ছে যখন আমি ওঁর সঙ্গে ‘আনন্দ পাঠ’ নিয়ে কাজ করছি। আর ওই বইটা উনি আমাকে উৎসর্গ করেছিলেন। আর বিভিন্ন অংশ আমাকে পড়ে-পড়ে শোনাচ্ছেন। আর সুরেশ সিং-ও তাঁর পুরোনো বই ‘দ্য ডাস্ট-স্টর্ম অ্যান্ড হ্যাঙ্গিং মিস্ট’ পুরোটা আবার নতুন করে লিখলেন। সেটা অক্সফোর্ড থেকে আমি সম্পাদনা করে প্রকাশ করি। এই সূত্রেই সুরেশ সিং-এর সঙ্গেও আজীবন বন্ধুত্ব তৈরি হয়ে যায় - মহাশ্বেতাদিরও, আমারও। এ-কথাগুলো এইজন্যেই বলছি, কোথাও এইখানে সম্পাদনার পেশাটা, যে একটা বই থেকে আরও বই, তার সন্ধান, অনুসন্ধান - সৃষ্টির এই প্রক্রিয়াটা ছিল। ‘আনন্দ পাঠ’ থেকে ‘হাজার চুরাশির মা’ সেখান থেকে ‘বিরসা মুন্ডা অ্যান্ড হিজ মুভমেন্ট’ বলে সুরেশ সিং-এর নতুন বই, মহাশ্বেতাদির ‘অরণ্যের অধিকার’ এইরকম।
মহাশ্বেতাদির আর একটি লেখা পরে আমি ইংরেজিতে অনুবাদ করি। ‘অপারেশন বসাই টুডু’ নামে একটা বড়ো গল্প বা ছোটো উপন্যাস, যেটাই বলেন, সেটাই বাড়িতে এসে সন্ধ্যাবেলায় কিছু অংশবিশেষ মহাশ্বেতাদি মাঝে-মাঝে শোনান। পরে বলেছেন, ওঁর একটা সাক্ষাৎকারে আছে, যে, বসাই টুডু চরিত্রটি আন্দোলনে বারবার নিহত হয়। আদিবাসী আন্দোলনের নেতা হিসেবে, নেতৃত্ব করতে গিয়ে। আর প্রতিবার তাকে, এক কম্যুনিস্ট সাংবাদিক যিনি ছোট্ট একটা কাগজ বার করেন ছোটো মফস্সল শহর থেকে, তিনি কালী সাঁতরা, এই যে প্রত্যেকবার লাশ শনাক্ত করেন বসাই টুডুর। প্রতিবার তিনি এটা করেন। বারবার বসাই মরে আর বারবার কালী সাঁতরা গিয়ে তাকে শনাক্ত করেন। এটা বারবার ঘটতে থাকে। আর পুলিশ যখন বসাইকে লক্ষ্য করে, অর্থাৎ বন্দুকের লক্ষ্য হিসেবে স্থির করে, তখন বসাইকে চেনার লক্ষ্যটা হয় তাদের, বসাই তার হাতের একটা ভঙ্গি করে, যাতে মনে হয়, মহাশ্বেতাদির ভাষায় - বসাই যেন বাতাসকে মোচড়াচ্ছে। এবং হাতের এই মুদ্রাটা দেখে পুলিশ শনাক্ত করে এই-ই বসাই, লক্ষ্য স্থির করে তাকে হত্যা করে। বারবার এটা ঘটে। মহাশ্বেতাদি পরে বলেছেন - উনি তখন বালিগঞ্জ স্টেশন রোডে থাকেন, ওঁর দ্বিতীয় বিবাহ ভেঙে গেছে, দেশপ্রিয় পার্ক-এর পাশ থেকে ওখানে চলে গেছেন। ওখান থেকে উনি রিকশো নিয়ে ভেতরের অনেকগুলি গলিঘুঁজি দিয়ে এসে গোলপার্ক-এ নামেন, রাস্তাটা পেরিয়ে আমার বাড়িতে আসেন। আর রিকশোয় যখন আসেন, ওই গলির মোড়গুলো চেনানোর জন্যে উনি বারবার হাতটাকে মুচড়ে দেখিয়ে দেন এইদিকে ওইদিকে মাথার ওইদিকে। তাই ওই হাত মোচড়ানোর মুদ্রাটা মহাশ্বেতাদির আমার বাড়িতে রিকশোয় আসার মুদ্রা। সেটা হয়ে যায় বসাই টুডুর আশ্চর্য রোমহর্ষক মুদ্রা। যখন আমি এইগুলোর স্বাদ পেতে থাকি, তখন থেকে আমার মনে হতে থাকে যে, আমি আর এই অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস-এর বাঁধাধরা নিয়ম পরিকল্পনা - এগুলো থেকে বেরিয়েও আমার ওই মাস্টারির স্বাদটাকে, এর মধ্যেও একটা মাস্টারি, এর মধ্যেও জীবনকে পালটানোর একটা চেষ্টা, যেটুকু আমরা পারি, একজন মানুষ একজন মাস্টার পারে, সেটা যদি বই দিয়ে করা যায়। বই তৈরি, বই তৈরির মানুষরা, তাঁদের সঙ্গে জড়িয়ে মিলিয়ে এটা যদি তৈরি করা যায়, বইগুলো যদি তৈরি করতে পারি, এই স্বাদটা তৈরি হতে থাকে, এবং তারপরে আবার আর একটা কোথাও আমার বিশ্বাস-চিন্তা, তাতে একটা ধাক্কা খাই। অক্সফোর্ড-এর একটা নিজস্ব নতুন পরিকল্পনা হচ্ছিল, তাতে আমাকে দিল্লিতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। মাইনে বাড়ত, দিল্লির আরেক রকম জীবনযাত্রা - জানি না মানিয়ে নিতে পারতাম কি পারতাম না, কিন্তু একটু সংশয় ছিল সে-ব্যাপারে। কিন্তু কোথাও যেন একটা রাজনীতি ছিল এই পুনঃসংগঠনে, যেটা আমি মানতে পারিনি। ওই মাস্টারের ছেলে, মাস্টারির অনেকগুলো এরকম ধাতের মধ্যে থেকে যায়, অদ্ভুত কীরকম সব ব্যাপার। তাই আমি দুম করে চাকরিটা ছেড়ে দিই।
এবং তখন আবার প্রশ্ন আসে, কী করে চলবে? তো, প্রথমে ঠিক করি টিউশনি করব, ভালো ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াব, ইংরেজি আর তুলনামূলক সাহিত্য - অনার্স-এ, এম-এতে। একজন দু'জন বড়োজোর তিনজন একসঙ্গে আসতে পারেন। আর বলে দিতাম, কারো যদি পাশ করা নিয়ে সংশয় থাকে, আমার কাছে আসবেন না, আমি পারব না কিছু করতে। যাঁরা অন্তত পঞ্চাশ তুলতে পারেন বলে বিশ্বাস করেন, আসবেন, আমি পঞ্চান্নতে তুলবার চেষ্টা করব। যদি পঞ্চান্ন তোলার বিশ্বাস রাখেন, আমি ষাটে তুলবার চেষ্টা করব। এইটে করে চালাচ্ছিলাম, আর পাশাপাশি বই সম্পাদনা স্বাধীনভাবে করা যায় কিনা ভাবছিলাম। এই সময়ে দে’জ-এর সঙ্গে আমার যোগাযোগ এবং কলেজ স্ট্রিট পাড়ার প্রকাশনা, সেটাকে সরাসরি চিনবার, তার সঙ্গে কাজ করবার এবং যেটুকু আমি অক্সফোর্ড-এ শিখেছি, এবং আমার অভিজ্ঞতা চর্চার মধ্য দিয়ে শিখেছি। মহাশ্বতাদির সঙ্গে কাজের ওই পুরো পরিমণ্ডল, সেটা তো অক্সফোর্ড-এর হিসেবের ছকের মধ্যে ছিল না। আমি মাস্টারের ছেলে মাস্টার, ওটার মধ্য দিয়ে একভাবে বড়ো হয়েছি। পেয়েছি অনেক কিছু। সেগুলোকেও যদি আমি বাংলা প্রকাশনার মধ্যে, বৃহত্তর যে প্রকাশনার ক্ষেত্র, যেটাতে তখন দে’জ একেবারে তার মূলে এসে পৌঁছেছেন এবং অনেক বেশি দুঃসাহসিক মনে হয়েছিল বাকি প্রকাশকদের থেকে। তাই দে’জ যখন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন, আমি খুব সাগ্রহে সেটাতে যোগ দিই। এবং এখনও থেকে গেছি। আমার হঠাৎ খেয়াল হল যে এখানে যত্ন করে সাজানো অনেকগুলো বই আমার সম্পাদনার অথচ মাস্টারির নির্মাণ। অবদান শব্দটা আমার ভালো লাগে না। বড্ড ভারী।
অপু দেঃ এখানে মনোজ মিত্রের একটি বই আছে ‘রামায়ণীর মহাভারতী’, এই বইটিতে ওঁর রামায়ণ এবং মহাভারত নিয়ে লেখা চারটি নাটক আছে। তাঁর পরামর্শে বইটির ভূমিকা লেখেন শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়। এই বিষয়ে মনোজ মিত্র এখন অভিজ্ঞতা বিনিময় করবেন।
মনোজ মিত্রঃ শমীক বোধ হয় জানেন না, ওঁর সঙ্গে কথা বলে আমি অন্তত তিনটে নাটক লিখেছিলাম। একদিন আমরা আসছিলাম শিলিগুড়ি থেকে। নাট্য অ্যাকাডেমির কোনো অনুষ্ঠানে বোধহয় আমরা ওখানে গিয়েছিলাম। ফিরে আসছিলাম একই গাড়িতে। সারা রাত্তির আমি কী লিখতে চাই সে নিয়ে কথা বলেছিলাম। তারপরে যখন কলকাতায় এলাম, মাঝখানে শুধু একবার চা খেয়েছিলাম, ভাবলাম, যে সারা রাত্তির একজন মানুষকে জাগিয়ে রাখলাম! আর উনিও জেগে থাকলেন এবং বলে গেলেন! - যে এটা এরকম করলে কীরকম হয়; ওটার ভাঙচুর কোথায় কী করতে হবে। এই নাটকটা আমি লিখেছিলাম ‘দেবী সর্পমস্তা’। এটা দেবেশ (চট্টোপাধ্যায়) করেছিল ‘মিনার্ভা থিয়েটার’-এ। ওই নাটকটা শমীকের জন্যেই হয়েছিল। এছাড়া যখনই আমরা বাইরে-টাইরে গেছি, যদি ওঁকে পেয়েছি, যখন পেয়েছি, দু-চারবার পেয়েছি তো! তখনই একটা-না-একটা নাটকের প্রসঙ্গ উঠেছে, নতুন নাটকের কথা আমি ভাবছি, সেটা অন্য লোকের ঘাড়ে চাপিয়ে আমি বলে গেছি, উনিও তাঁর মতামত দিয়ে গেছেন, সেগুলোও আমি পেয়েছি। তার মানে আমি নিজে চাওয়াতে পেয়েছি, অন্যের হয়ে চেয়েও পেয়েছি। অনেকভাবেই ওঁর কাছ থেকে যতটুকু পেয়েছি, সংগ্রহ করে নিয়েছি।
অপু দেঃ এতগুলো বছর ধরে সমস্তরকম শিল্প-মাধ্যম নিয়ে মূল্যবান আলোচনা এবং লেখার পরেও বাদ পড়েছিল আলোকচিত্র শিল্প। সম্প্রতি সে-অভাবও পূর্ণ করলেন আমাদের শিল্পের অভিভাবক। 'চিদানন্দ দাশুগুপ্ত স্মৃতি স্মারক বক্তৃতা'য় আলোকচিত্র নিয়ে প্রথম কথা বললেন শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়। এখানে রয়েছে 'চিদানন্দ দাশুগুপ্তের গদ্যসংগ্রহ'। সে আর এক গল্প। তিনি বললেন ওটা তৈরি হয়ে যাবে। হল বুকিং-ও হয়ে গেছে। নন্দন-২-এ অনুষ্ঠান। তখনও পাণ্ডুলিপি হাতে পাইনি, মাস দেড়েক বোধহয় বাকি ছিল। মাস দেড়েকের মধ্য একটা চারশো পাতার বই কীভাবে তৈরি করব? তখনও পাণ্ডুলিপি হাতে পাইনি আর সেটা সম্পাদনা করছেন শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়। কবে পাব জানি না। তো সেইরকম অবস্থায় বললাম, ঠিক আছে, আপনি আমাকে দিন। যখন হাতে পেলাম, বই বেরোবে, পরের দিন অনুষ্ঠান। আর আগের দিন রাত বারোটা পর্যন্ত এইখানে বসে উনি কাজ করেছেন। এবং কী অমানুষিক পরিশ্রম করেছেন যে বলার নয়। সকাল দশটার সময় গাড়ি পাঠিয়ে ওঁকে এখানে নিয়ে আসা হত। এখানে বসে একটানা কাজ করতেন। দেবাশিস বলে আমাদের একজন কর্মী আছেন, তিনি বলছেন, দাদা, উনি তো জলও খাচ্ছেন না দেখছি! সেই যে মুখ গুঁজে আছেন, একবারও দেখিনি যে মুখ তুলেছেন। শেষ করার পর কাজটা আমাকে দিয়ে বললেন যে, হয়ে গেছে, এবার ছাপতে দে। পরের দিন ছেপে নিয়ে গেছি, নন্দন ২-এ বইটা প্রকাশিত হয়েছে। এরকম ঘটনা আরও অনেকবার ঘটেছে।
বই তৈরির আরেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ইনডেক্সিং-এর কাজ অদ্ভুত দক্ষতার সঙ্গে তিনি স্বচ্ছন্দে করেন। অনেককে দেখেছি কার্ড তৈরি করে ইনডেক্সিং করতে কিন্তু শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় যেভাবে করেন সেটা হচ্ছে, খাতাটা সামনে থাকে, প্রুফ-ও দেখছেন, তার সঙ্গে ইনডেক্সিং-ও করছেন। কীভাবে নির্ঘণ্ট তৈরি করেন সেটা উনি জানেন। আমি বলতে পারব না। পাতার পর পাতা অ্যালফাবেটিক্যালি সাজানো, বিশেষ করে বাংলা ভাষায়, কতটা কঠিন সেটা আমরা সবাই জানি। উনি যে কীভাবে পুরোটা মাথার মধ্যে নিয়ে করেন সেটাই আশ্চর্যের। 'সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের গদ্যসংগ্রহ' প্রকাশ করতে গিয়ে দেখেছি, হাতে লেখা দু-দিস্তের ওপরে ইনডেক্সিং তৈরি করেছেন। সেটা আমার কাছে এখনও আছে।
দেবাশিস মজুমদারঃ আসলে আমরা যারা শিল্পের কর্মী বা কাজ করি তাদের পক্ষে শমীকদার সামনে দু-কথা গুছিয়ে বলা প্রায় গাভাসকারের সঙ্গে ক্রিকেট খেলার মতো। মানে সেটা প্রায় অসম্ভব। আমার একটা কথাই বলার যে, নাটকের জায়গা থেকে যেমন, আমার মনে হয় যে আমাদের থিয়েটারে যেহেতু সবরকম শিল্প-মাধ্যমের জায়গা করতে হয় বা খোঁজ করতে হয়। এই মানুষটি বোধহয় তার সম্পূর্ণ দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন। যে-কোনো বিষয়ে, যে-কোনো প্রশ্নে, যে-কোনো সন্ধানে আমাদের পথ দেখাতে পারেন। এইজন্যে এত বছর ধরে কৃতজ্ঞ হয়ে আছি। আমরা সর্বতোভাবে এই পথ চলার ক্ষেত্রে যাঁদের মনে করি সামনের আলোকবর্তিকা, শমীকদা অবশ্যই সেই মানুষ।
সোমেশ্বর ভৌমিকঃ আমার মনে হত যে আমাদের দুজনেরই ইংরেজি নামের আদ্যাক্ষর এক এবং দুজনেই ইংরেজিতে ও বাংলা ভাষায় লিখি। সেটা কথা নয়। এইমাত্র শুনলাম যে কীভাবে একই সঙ্গে একটা টেক্সট তৈরি করতে-করতে বা সেটাকে কারেকশন করতে-করতে ইনডেক্স তৈরি করেন। তেমন আরেকটা ঘটনার আমি সাক্ষী। আমি তো তাঁর কাছে অনেকদিন ধরেই যাতায়াত করি। কোনো একটা বইয়ের সূত্রে আলোচনা হচ্ছে, সে-সময় একটা ফোন এল কোনো একটি খবরের কাগজ থেকে। অনুরোধ এসেছে সেইদিনই কোনো এক বিশিষ্ট ব্যক্তি মারা গেছেন তাঁর সম্পর্কে কিছু জানাতে হব। শমীকদা বললেন, তাহলে কী? বলতে হবে কিছু? নাকি লিখতে হবে? লিখতে আমি পারব না। না, আপনি বলুন। শমীকদা জিজ্ঞেস করলেন যে, কত শব্দ? একটা শব্দ-সংখ্যা বলে দেওয়া হল। আচ্ছা, পাঁচ মিনিট পরে ফোন করুন। তারপর আমি কথা বলছিলাম কিন্তু বুঝতে পারছিলাম একটু সময় ওঁকে দিতে হবে। পাঁচ মিনিট পরে ফোনটা এল। শমীকদা, যেমনভাবে লেখেন, সেইভাবেই, সেই ভঙ্গিতেই বলে গেলেন। একটা লেখা তৈরি হল আসলে, কিন্তু সেটা মুখের কথায়। বললেন, পাঁচ মিনিটে। নিজেই বললেন, আমার মনে হয় আপনার ওই দু'শো শব্দ হয়ে গেছে। ওপাশ থেকে উত্তর এল, হ্যাঁ। এ এক অসামান্য ক্ষমতা।
আজ শমীকদার বিরাশি। অনেক বছর আগে ছিয়াশি সালে বোধ হয় শমীকদার সঙ্গে একটা কাজ করব বলে এগিয়েছিলা। শুরু করেছিলেন। সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে একটা ধারাবাহিক লেখা লেখানোর চেষ্টা আমি করছিলাম। 'অনুষ্টুপ'-এর জন্যে। যাই হোক, অনেকদিন ঘোরাঘুরির পরেও লেখা তো পাওয়া যায় না। একদিন আমি ঠিক করলাম যে অফিসে যাব না। আমি গিয়ে বসব। যতক্ষণ না লেখেন আমি থাকব ওঁর বাড়িতে। ওঁর সেই গলফ্ গ্রিনের চারতলার ফ্ল্যাটে। বেল বাজিয়ে ঢুকলাম। বললাম যে আমি বসছি। আপনি লিখলে তারপর আমি যাব - সন্ধে হোক রাত্রি হোক আগামীকাল হোক। এবং আমার সৌভাগ্য ঘণ্টা চারেকের মধ্যে উনি ওঁর সেই সুন্দর হস্তাক্ষরে ‘সত্যজিৎ রায় ঐতিহাসিক অনৈতিহাসিক’ বলে একটি লেখা তৈরি করে দিলেন। সেই ম্যানাস্ক্রিপ্ট-টা আমি রেখে দিয়েছি। ছাপা অংশটা ওঁকে দিয়ে দিয়েছি। তখন আমি খেয়াল করিনি যে এর ভেতরে একটা ষড়যন্ত্র আছে। গত বইমেলাতে নিজেই বলেছেন যে, আমি এই বিষয়ে আবারও লিখব ভাবছি; এই বিষয়ে আরও লেখার ব্যাপারে সোমেশ্বর আমাকে সাহায্য করবেন বলে কথা দিয়েছেন। উনি যেদিন ডাকবেন আমি সেদিন যাব। কিন্তু ওই ‘ঐতিহাসিক অনৈতিহাসিক’ লেখাটা শমীকদাকে শেষ করতেই হবে।
দেবাশিস মুখোপাধ্যায়ঃ শমীকদার পাশে বা ওঁর সঙ্গে কোনো বিষয়ে কথা বলতে রীতিমতো ভয় করে। কারণ, ওঁর পাণ্ডিত্য আমি এই সময়ের কারোর মধ্যে দেখিনি। আমি সত্যজিৎ রায়কে মনে করেই বলছি। এবং এত বেশি পড়া, এত বিষয়ে পড়া। শমীকদা খুব সুন্দর কথা বলেন, কিন্তু কোনো বক্তৃতাতেই কোনো বিষয় নিয়ে তিনি সেই জায়গায় থাকেন না। মুশকিলটা হচ্ছে যে, উনি বলতে বলতে একটা বিষয় থেকে আরেকটা বিষয়, সেটা থেকে আরেকটা বিষয়, সেটা থেকে আরেকটায় এমনভাবে চলে যান, বল গড়াবার মতো করে গড়িয়ে যায় যে, শ্রোতাদের পক্ষে খেই ধরে রাখা বেশ অসুবিধাজনক হয়ে পড়ে। শমীকদার আসল কাজটা তো বইকে মানুষ করা। ফলে ওঁর কাজ বইগুলো দেখলে বোঝা যায়। আর একটা জিনিস আমার মনে হয়, ‘আজকাল’-এ উনি একটা কলাম লিখতেন ‘বই বৈভব’, সেটাতে উনি ওঁর পড়া নিয়ে, ওঁর অভিজ্ঞতা - খুব ছোটো-ছোটো করে লিখতেন। এবং সেখানে বেশ কিছু বইয়ের কথা উনি লিখেছিলেন যেগুলি নানা বিষয়ের এবং বেশ গুরুত্বপূর্ণ বই। ওইরকম পাঠ, তার আগে লিখতেন শঙ্খ ঘোষ। শঙ্খ ঘোষের বই নির্বাচন এবং শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বই নির্বাচনের মধ্যে অনেকটা তফাত আছে। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় যে শমীকদার আসল বিষয়টা কী? নাটক না চলচ্চিত্র না বিশ্ব-সাহিত্য? ফলে উনি নাটকটা যেভাবে দেখেন এবং চলচ্চিত্রটা যেভাবে দেখেন, সেখানে আমার মনে হয়েছে, বাঙালিকে উনি ক্রমশ শিক্ষিত করে তুলছিলেন। শমীকদার না লেখাটা কিন্তু আমাদের জন্যে খুব ক্ষতির।
দেবজ্যোতি দত্তঃ আমাকে সুধাংশু (সুধাংশুশেখর দে) বলেছিল শমীকদার জন্মদিনে একটা অনুষ্ঠান হবে। বেশ উৎসাহ নিয়ে এখানে এলাম। কী-কী হয়, কার-কার সঙ্গে দেখাশোনা হয়, আলাপ হয়। অনেকের সঙ্গে অনেকদিন দেখাশোনা হয় না তো! এখানে সবাই বেশ ভালো-ভালো বক্তা আছেন। আমি খুব একটা ভালো বলতে পারি না। শমীকদাকে যেমন বলা হয়, বইয়ের কারিগর, আমি হচ্ছি বইয়ের মিস্তিরি। এঁরা সমস্ত করে দেন আমি সেগুলো কীভাবে পাঠকের কাছে ভালো করে পৌঁছে দেওয়া যায় সেটুকু করি। এবং সেই শিক্ষাটা কিন্তু আমি ওঁর কাছ থেকেই নিয়েছি।
আমার সঙ্গে ওঁর আলাপ সেই সত্তর দশকের বুক ফেয়ারের সময় থেকে। অক্সফোর্ড-এ তখন যেতাম, সেখানে আলাপ-আলোচনা হত। তারপরে আমাদের জড়িয়ে দিয়েছিলেন আমাদের শিক্ষক, ওঁরও শিক্ষক, ডঃ সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত। সংসদের অভিধানের একটা মর্যাদা আছে। সুবোধবাবু ছিলেন আমাদের প্রধান সম্পাদক। একদিন আমি বললাম, স্যার, আপনার তো বয়স হয়ে যাচ্ছে, এরপরে কী হবে? "তোমার কোনো চিন্তা নেই বোঝলা। আমি একজনের নাম দিমু, তুমি একটু যোগাযোগ কইরো।" ঠিক আছে স্যার। উনি বললেন, "আমি যদি না পারি, এই শমীক, বোঝলা, এই শমীকের সঙ্গে যোগাযোগ করবা।" সেই সূত্রে, শমীকও তো স্যারের কথা ফেলতে পারেন না! এইভাবে উনি আমাদের সঙ্গে যুক্ত হলেন। আমার মনে আছে, কথা হয়েছিল, সপ্তাহে তিনদিন, আমার বাড়িতে আমি একটা চেয়ার-টেবিল আর ঘরের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম, সেখানে এসে সমস্ত ডিকশনারিগুলো সম্পাদনা করবেন, রিভাইজ করবেন ইত্যাদি। এবং সেটা অনেকদিন চলেছিল, চলছিল, এখনও চলে। এই সূত্রে কিছু কথা, ওঁর পক্ষে একটু মুশকিল হতে পারে, আমাকে সুবোধবাবু বলেছিলেন। সুবোধবাবু তখন খুব অসুস্থ, আমি তখন প্রায়ই যেতাম ওঁর কাছে। বলেছিলেন, "বুঝলা, আমার খুব ইচ্ছা, শমীকরে যদি তুমি আমার কাছে একবার আনতে পারো।" আমি বললাম, আচ্ছা স্যার। উনি তখন রোগশয্যায়, সর্বক্ষণ শুয়ে থাকেন। আমি একদিন শমীকদাকে বললাম যে, উনি চাইছেন আপনাকে নিয়ে যাই। বললেন, স্যার বলেছেন? একদিন সকালবেলা শমীকদাকে নিয়ে ওঁর বাড়িতে গেলাম। সুবোধবাবু বিছানায় শুয়ে ছিলেন। বললাম, স্যার, এসেছি! "তুমি এসেছ?" আমি বললাম, আর একজনকে কিন্তু নিয়ে এসেছি, শমীকদাকে। সঙ্গে সঙ্গে দেখি চোখটা খুলে গেল, উজ্জ্বল হয়ে গেল। "তুমি শমীকরে আনছ! দেখি!" শমীকদা তখন এগিয়ে গেলেন। নিজেদের মধ্যে অনেকক্ষণ কথাবার্তা হল। পরে বললেন, "দ্যাখো, শমীকরে কিন্তু ধইরা রাইখ্য। ওর কোনোকিছুর ঠিক নাই কিন্তু। ওর ঘরের ঠিক নাই, ওর কথার ঠিক নাই, ওর সময়ের ঠিক নাই, কোনোকিছুরই ঠিক নাই।" শমীকদার কান-টান লাল হয়ে যাচ্ছে। শেষে কী বললেন জানেন? "ইংরাজিটা যা ল্যাখে না, ঠিক ল্যাখে। এর বাইরে কারো কিছু করতে লাগব না।" তখন দেখি শমীকদার মুখটা উজ্জ্বল হল।
শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ঃ মাঝখানে দেবজ্যোতি দত্ত একটু সেন্সরশিপ করেছেন। সুবোধবাবু 'ওর কিচ্ছু ঠিক নাই' বলতে গিয়ে বলেছিলেন, ও একটা ভ্যাগাবন্ড, কিন্তু ইংরেজিটা ভুল করে না।
দেবজ্যোতি দত্তঃ এইরকম অনেক ঘটনা আমার সঙ্গে আছে। এখনো সেই যোগটা আছে। প্রায় সাঁইত্রিশ বছর! হয়তো তারও বেশিই উনি আমাদের সঙ্গে আছেন। আমাদের এই অভিধানগুলি উনি চর্চা করেন এবং এখনও বিভিন্নভাবে সাহায্য করেন। সম্প্রতি একটা বই করেছি হরেন ঘোষের ওপর। সমস্ত কিছু করার পরে ওঁর কাছে নিয়ে গেছি, একটু দেখুন সবকিছু ঠিকঠাক আছে কি না। আমার মনে হয় আপনি দেখলে একটু ভালো হয়। সেই সূত্রে আমি দেখলাম যে নামটা আমরা জানতাম না, হরেনবাবু সম্বন্ধে আমরা কেউ জানতাম না, আমাদের কেউ জানায়নি। সাতচল্লিশ সালে মারা গেছেন, তারপরে সেরকমভাবে ওঁকে নিয়ে আর আলোচনা হয়নি। অথচ, ভারতবর্ষের প্রথম একজন মানুষ, আন্তর্জাতিক ইম্প্রেসেরিও বলতে হরেন ঘোষকে বোঝায়, যিনি কত লোককে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন বিভিন্ন কালচারাল ওয়ার্ল্ড-এর সঙ্গে, ভাবতে পারা যায় না। আজকে আমরা উদয়শঙ্করকে জানি, বালা সরস্বতীকে জানি, সেরাইকেলার ছৌ-কে বিখ্যাত করেছেন।। তিরিশের দশক থেকে আন্তর্জাতিক জায়গায় সবাইকে পৌঁছে দিয়েছিলেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁর শংসাপত্র লিখেছিলেন। সেটা কিন্তু অনেকেই জানেন না। অত ভালো বোঝার, কালচারের দিকটা আর কেউ পেরেছেন কি না আমি জানি না। দেখলাম শমীকদা জানেন এবং তাঁর ঘষামাজায় বইটি আরও তথ্যসমৃদ্ধ হয়ে গেল। শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় সম্বন্ধে আমি আর একটা কথা বলি সংস্কৃতির যতগুলো অ্যাভেনিউ আছে, পথ আছে - নাটক, সিনেমা, লিটারেচার, পেন্টিং, নাচ - সবকটার সঙ্গে যোগসূত্র এই একটিমাত্র ব্যক্তিকে আমি দেখেছি, যিনি একসঙ্গে করতে পারেন। অনেকেই আছেন। নাটক সম্বন্ধে অনেকেই ভালো-ভালো বলতে পারেন, সিনেমা নিয়ে অনেকে ভালো-ভালো বলতে পারেন কিন্তু সমস্ত পরিধিটাকে নিয়ে একটা মূল স্রোতের মধ্যে মিলিয়ে দেওয়া, এটা শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়া আর কাউকে খুব একটা করতে দেখিনি। যে-কোনো বিষয়ে, সংস্কৃতির জগতে আমার কাছে খুব আশ্চর্য লাগে যে কী করে এই মেলবন্ধনটা উনি সমস্ত বিষয়ের মধ্যে করতে পেরেছেন। এর জন্য ওঁর কাছে কৃতজ্ঞ আমি। আর ওঁর কাছে থেকে বইয়ের সম্বন্ধে যেভাবে জানতে পেরেছি তা আমি সব সময় স্বীকার করি। বইয়ের যে গ্রামার, বই তৈরি করার যে গ্রামার সেটা ওঁর থেকে ভালো এই মুহুর্তে আর কেউ জানেন না। আর একজন ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, দিল্লিতে থাকতেন। পরে কলকাতায় এসেছিলেন। মারাও গেছেন। এঁদের কাছ থেকে যা শিখেছি তা নিয়েই আমি আজ অবধি চলছি।
শিলাদিত্য সেনঃ শমীকদা যত কম লিখবেন তত আমাদের ক্ষতি। এটা আমি বলছি এ-কারণে যে, আমি একটু-আধটু লেখালিখি করি, আমার খুব একটা বিদ্যে-টিদ্যে নেই। তো আমি যা-নিয়ে লিখি মূলত চলচ্চিত্র, কখনো নাটক, সাহিত্য - এগুলো আমার লেখালিখির বিষয়। আমি লেখালিখি করতে শিখেছি শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা পড়ে। যাঁরা আসছেন নতুন প্রজন্মের, যাঁরা লেখালিখি করেন, যাঁরা এই চলচ্চিত্র, নাটক, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, সাহিত্য - এগুলো নিয়ে, তার সাহিত্যরীতি ও শিল্পরীতি নিয়ে কথা বলতে আসেন তাঁদের অবগতির জন্য জানাই ‘থিয়েটারের জল হাওয়া’ বলে একটা বই আছে আর একটা হচ্ছে ‘দেখা সিনেমা সিনেমা দেখা’ সিনেমা নিয়ে। আপনারা সেগুলো যদি পড়েন, বুঝতে পারবেন যে শমীকদা কীভাবে আমাদের শিল্পরীতি, শিল্পবিচার, শিল্প নিয়ে লেখালিখি করতে জানতে হয় সেটা প্রায় শিখিয়ে দিচ্ছেন। ওইরকম বাগ্মী, উনি বলে যাচ্ছেন, সেটা অন্য কেউ নথিবদ্ধ করছেন। আমরা যখন ইউনিভার্সিটি-তে পড়ি তখন, ‘ঘরে বাইরে’ রিলিজ করল। আমি পড়তাম যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। সেটা খুবই নামিদামি বিভাগ ছিল। স্বাভাবিকভাবেই বিপ্রতীপের হাওয়া যাকে বলে, ‘ঘরে বাইরে’-র বিরুদ্ধে বইতে শুরু করল। সত্যজিৎ রায়ের। আমার এখনও মনে আছে শমীকদা একটা নিবন্ধ লিখলেন। সেই লেখাটার মধ্যে উনি বলেছিলেন যে, রবীন্দ্রনাথ একজন শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক আর সত্যজিৎ রায় একজন শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রকার। এই দুজনের মিথোষ্ক্রিয়াটা..., এই শব্দটা উনি ব্যবহার করলেন। কী অসামান্য একটা শব্দ। এটা কী করে কাজ করছে, সেইটা আমরা বিচার করছি না। আমরা বলছি ‘ঘরে বাইরে’-তে কী আছে, সত্যজিৎ রায় কী করেননি, সত্যজিৎ রায় কী করেছেন যা ‘ঘরে বাইরে’-তে নেই - ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু আমরা কখনো দেখছি না একজন শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রকার এবং একজন শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিকের যে পারস্পরিক আদান-প্রদানটা। শিল্পের অনেকগুলো ধর্ম থাকে। চলচ্চিত্রের আলাদা ধর্ম, নাটকের আলাদা ধর্ম - এরকমভাবে হয় না। হয় আসলে যে প্রত্যেকটার নিজস্ব ভাষা আছে। কিন্তু ভাষা মানেই ফর্ম, তার মানে সেটা টেকনিক নয় শুধু। অর্থাৎ চলচ্চিত্র, ভাস্কর্য, কবিতা, সাহিত্য - এ সমস্ত কিছুকে সমন্বিত করে যে-শিল্পধর্মটা তৈরি হচ্ছে, বিশেষত একটা চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে বা একটা নাটকের ক্ষেত্রে, সেইটা যদি আমরা না ধরতে পারি, না বুঝতে পারি, তাহলে আমরা কখনোই শুধুমাত্র মেকিং, তৈরি করার ক্ষমতা দিয়ে কোনো নাটকও বানাতে পারব না, যেটাকে আমরা শ্রেষ্ঠ বলতে পারি, কোনো সিনেমাও বানাতে পারব না, যেটাকে আমরা শ্রেষ্ঠ বলতে পারি, কোনো ছবিও আমরা আঁকতে পারব না বা কোনো ভাস্কর্যও তৈরি করতে পারব না। এই যে সমস্ত শিল্পের আঙ্গিকগুলোকে একসঙ্গে সামগ্রিকতায় দেখা এবং সেটা প্রত্যেকটা আর্ট ফর্ম-এর ভেতর দিয়ে পড়তে পারা, এইটা অসামান্যভাবে শমীকদা করেন। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলছি। আমি এটা ইচ্ছে করেই বলছি যে, আমার কাছে স্মৃতি-অভিজ্ঞতা থেকেও ওঁর মনন আমাকে অসামান্যভাবে মুগ্ধ করে রাখে। চার পাতা ফুলস্ক্যাপ কাগজে একটা লেখা দেবেন শমীকদা। আমি কিন্তু চারদিন গেছি। আজকে বসেছি। লিখে দিয়েছেন। তার পরের দিন আরেক পাতা। তার পরের দিন আরেক পাতা। এইভাবে চলত। আমার খুব ভালো লাগত কিন্তু! শমীকদা নিবিষ্ট চিত্তে লিখে যাচ্ছেন। আমি বসে আছি, তারপর নিয়ে গেছি। কারণ, ওইটাই ছিল আমার জয়।
অজয় গুপ্তঃ আমার সঙ্গে শমীকের প্রথম দেখা হয় ১৯৬০-’৬১ সালে। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আর প্রেসিডেন্সি কলেজ। দুজনেই এম.এ. পড়ি। আমি বাংলা, ও ইংরেজি। এবং আলাপটা এভাবে হল। আগে ওর লেখা পড়েছি। ‘পরিচয়’-এ। দেখছি যে লেখার থেকে ফুটনোট বড়ো। ও হচ্ছে লেখাপড়ার লোক আমি হচ্ছি প্রেম করার লোক। ইউনিভার্সিটি-তে ১৯৬১ সালটা খুব ইম্পর্ট্যান্ট। সেটা ছিল রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষ। জন্মশতবর্ষে ইউনিভার্সিটি-র যে ছাত্র সংসদ, তাদের মুখপত্র হচ্ছে ‘একতা’। বিশেষ সংখ্যা বেরোবে, বিরাট মোটা, সেটাতে একটা বড়ো সম্পাদকমণ্ডলী আছে, তার মধ্যে শমীকের নাম আছে, আমার নামও আছে। আমাদের আর এক বন্ধু, সে এখন নেই, নৃপেন্দ্র সাহা, ‘গন্ধর্ব’ পত্রিকার সম্পাদক ছিল। ওই পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীতে যাঁরা রয়েছেন, তাদের মধ্যে ছাপাখানার কাজ একমাত্র আমি আর নৃপেন জানতাম। শমীক তখনও ছাপাখানার সঙ্গে পরিচিত নয়। তার ফলে কাগজটা করা হল এবং যথারীতি আমি আর নৃপেন পরীক্ষা দিতে পারলাম না। কারণ কাগজ বেরোল সেপ্টেম্বর মাসে, ডিসেম্বরে পরীক্ষা। সম্ভব নয়। স্যারেরা বললেন, একটু চিন্তা করে দেখলে পারতে। চিন্তা তো করেইছি। প্রমথ বিশী মশাই বললেন যে, তোমরা একবার ভেবে দেখ। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় বললেন যে, এ তো কবে থেকেই জানি, ক্লাস করো না, পড়ো না। কাজেই রবীন্দ্রনাথ করছ, তো করো। যাই হোক, সেইখানে শমীকের একটা লেখা ছিল। ছোটো লেখা। লেখাটার নাম হচ্ছে ‘শিশুতীর্থ খ্রিস্টপুরাণের রূপান্তর’ - সম্ভবত এটাই নাম। আর একটা লেখা ছিল, তার নাম এখন সকলেই জানেন, গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক, তখন স্পিভাক ছিল না। সেই লেখাটার বিষয়বস্তু খুব কঠিন। কিন্তু লেখাটার শিরোনাম হচ্ছে - ‘এক দেশ দুই ফুল’। আমি লেখাটা ছাপলাম ‘এক দেশ দুই ভুল’। শমীক এসে বলল, যে লেখার নামটা তো ভুল হয়েছে! ওই থেকে আলাপ। কারণ, ওই ম্যাগাজিনটা প্রথম আমার এবং নৃপেন - দুজনেরই লাইনো ছাপায় হাতেখড়ি। তখন কলকাতায় 'মডার্ন ইন্ডিয়া প্রেস'-এ লাইনো এসেছে। লাইনো-তে ছাপা হবে। প্রেসের মালিক বীরেনবাবু বললেন যে, এই এক-একটা মেশিনের কত দাম জানো? না, জানি না। দাম তুলতে গেলে চব্বিশ ঘণ্টা মেশিনটা চালাতে হয়। তার মানে আমাদের ম্যাগাজিনের কাজ চব্বিশ ঘণ্টা চলবে। আমি আর নৃপেন তোশক বালিশ আর মশারি নিয়ে চলে গেলাম। ওর মধ্যে পরীক্ষার কথা-টথা আর আসে না। কাজেই সেইভাবে কাগজ বেরোল। কিন্তু আমরা দুজনেই হ্যান্ড কম্পোজ-এর প্রুফ দেখতে জানি। এখানে বেশি কথা বলে লাভ নেই, কারণ অনেকেই প্রুফ দেখতে জানেন না। হ্যান্ড কম্পোজ আর এখনকার একরকম প্রুফ। কিন্তু লাইনোয় তা নয়। লাইনো-তে পুরোটা যতক্ষণ না নির্ভুল হচ্ছে, প্রিন্ট অর্ডার দেওয়া যায় না। আমরা ওখানে রাত কাটাতাম। কিন্তু প্রচুর ভুল। তো ওই ফুলের বদলে ভুল হয়েছে, সহপাঠিরা বলল, কী করেছ দেখেছ? কী? রামমোহনের বয়স ১২৩ হয়ে গেছে। আমি বললাম, কী করব? মহাপুরুষ যদ্দিন বাঁচেন ততই ভালো। নেহাত ম্যাগাজিন বিশেষ কেউ পড়ে না বলে খুব গালাগাল কিছু খাই-টাইনি। তো সেই থেকেই শমীকের সঙ্গে আলাপ। ‘থিমা’ বলে ওদের একটা প্রকাশনী আছে, আর আমি সেই যে পঞ্চান্ন সালে প্রুফ দেখতে শিখেছিলাম প্রথম কলেজে ভর্তি হয়ে, এখনো তাই-ই করি। আমি ছাপাখানার মজুর। ও যেমন বইয়ের কারিগর, আমি ছাপাখানার মজুর। ওই কাজকম্মো করি, কিছু পাই, তাই দিয়ে চলে। কিন্তু ওই ‘থিমা’ হওয়ার পরে শমীকের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতাটা বেশি হল। কারণ ও চায় ভালো বই করতে, আমিও সেরকমভাবে ভাবি। ওর মতো অতটা নয়, কিন্তু কিছুটা। আজকে শুধুমাত্র এটাই কামনা করি ও যা ভেবেছে, ও যখন 'অক্সফোর্ড'-এ কাজ করত, তখনো আমি গেছি, কাজ-টাজের জন্য। কারণ, পরবর্তীকালে মহাশ্বেতাদির সঙ্গে আমিও কাজ করেছি। ওঁর 'অক্সফোর্ড'-এর বই। তখন শমীক অবশ্য ছিল না। কাজেই ও যেন সুস্থ শরীরে, চাকরি না করে এভাবে কাজকর্ম করে বাকি জীবনও যেন এই কাজটাই করে যেতে পারে। কারণ, ভালো করে প্রকাশ করার বই খুব বেশি নেই। কিন্তু তার মধ্যেও শমীক যেভাবে পরিশ্রম করে, শুনলাম ও সারা রাত এখানে বসে কাজ করেছে। কাজ করলেও মানুষ তো বটে! শুধু খাবারদাবার নয়, অন্যান্য বিষয়গুলোর ভার কে নেবে? কাকে বলব? আমি শুধু চাই, ও নিজে যেটা ভেবেছে, সেই কাজটাই করুক। আশেপাশে আমরা যারা আছি, কাজটা যাতে সুসহ হয়, সেদিকে যেন একটু নজর দিই।
প্রণব বিশ্বাসঃ শমীকদা সব সময় একটা বিষয় এড়িয়ে চলেন, বলতে চান না, সেটা হচ্ছে ওঁর ব্যক্তিগত জীবনের কথাবার্তা। রোজকার যে জীবন সেগুলো শমীকদা বাইরে আনতে চান না। আজ সকালবেলা আমাকে দু'জন টেলিফোন করেছিলেন। একজন অমিয় দেব আর একজন সৌরীন ভট্টাচার্য। দুজনেই আমাকে বলেছেন যে, শমীককে আমাদের অভিনন্দন জানিও আর শমীককে বোলো আজকে যেন খুব ঘরোয়া কথা বলে।
আমাকে বলেছেন শমীকদাকে যা ইচ্ছা প্রশ্ন কোরো। আমি সেই সুযোগ নিয়ে একেবারেই প্রথমে জানতে চাই, সুব্রতদার বইতে সুব্রতদার ছোটোবেলাটা ভারী সুন্দর করে বলেছেন। এমনকী ওঁর মা দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখতেন সেটাও। আপনি আপনার ছোটোবেলার কথা একটু বলুন।
শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ঃ আমার ছোটোবেলার সঙ্গে আরেকটা জিনিস, ওই মাস্টারির বদভ্যাস, একটু মাস্টারিও চলে আসুক। একটা সময়, ’৬১ সালে এম.এ. পাস করি, অজয় বলছিলেন, আমরা সহপাঠী, রবীন্দ্রশতবার্ষিকীর বছরে। ’৬২ সালে আমি ইশকুল মাস্টারি শুরু করি। সাউথ পয়েন্ট স্কুলে। তখন ওই সময়টা, মোটামুটি ধরুন, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় থেকে, চল্লিশের দশকের শুরু থেকে, বিশ্ব প্রকাশনার ইতিহাসে একটা খুব বৈপ্লবিক ঘটনা ঘটে। এবং ইংরিজিতে ‘পেপারব্যাক রেভলিউশন’ - এই বলে ওটাকে আমরা চিহ্নিত করে থাকি। আপনারা জানেন যে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের বিস্তৃতি এতগুলো দেশ, এতগুলো মহাদেশ এ-যুদ্ধের মধ্যে জড়িয়ে পড়ে, যে প্রত্যেকটা দেশকে, প্রত্যেকটা যুদ্ধমান দেশকে একাধিক লড়াইয়ের ময়দানে নামতে হয়। অতগুলো লড়াইয়ের ময়দানে, সারা পৃথিবীব্যাপী লড়াইয়ের ময়দানে লড়বার মতো অত সৈন্য কোনো দেশে ছিল না। এখনও নেই। তার ফলে জোর করে সাধারণ মানুষকে একটা বিশেষ বয়সের ওপরে হলেই, মোটামুটি স্বাস্থ্যটা ঠিক থাকলেই তাকে যুদ্ধে যোগ দিতে বাধ্য করা হত। যার ফলে মবিলাইজেশন বা কনস্ক্রিপশন - এই শব্দগুলো এসে গেল ইংরেজি ভাষাতে। তার বিশেষ অর্থবহ হয়ে। এই অনিচ্ছুক, অনাগ্রহী সৈন্যদের ঠিক রাখার জন্যে তাদের কিছু ঘুষ দিতে হয়, তাদের মন যাতে ঠিক থাকে। তার ফলে একদিকে যেরকম প্রচুর প্রমোদোপকরণ, অর্থাৎ সিনেমা পাঠানো হতে লাগল, বিভিন্ন দেশে, মার্কিন সৈন্যরা বা ইংরেজ সৈন্যরা যেখানে-যেখানে লড়ছে, এইগুলো তারা দেখবে, দেখে আনন্দ পাবে। বই পাঠানো হতে লাগল। এবং বিশেষ করে সস্তায় বই ছাপা হতে লাগল কারণ, যুদ্ধে তখন অন্য ব্যাপারে খরচ এত বেড়ে গেছে, ভালো কাগজে, দামি কাগজে ছাপতে গেলে যুদ্ধের খরচে টান পড়বে। তাই সস্তা কাগজে পেপারব্যাক ছাপা হতে লাগল। তার আগে ভালো বই মানেই কিন্তু বাঁধাই বই। পেপারব্যাক-এর একটা বিরাট প্রসার ঘটল এই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়। এবং এর মূল লক্ষ্যটাই হচ্ছে সৈন্যদের কাছে পাঠানো। তারা নানা বিষয়ে পড়তে চায়। শুধু যে সময় কাটানোর গল্প-উপন্যাস পড়বে তা নয়। তাদের জোর করে ছিনিয়ে আনা হয়েছে - বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি থেকে, তার সুযোগ থেকে। তার ফলে নানা বিষয়ের বই, নানা ক্ষেত্রের বইয়ের পেপারব্যাক সংস্করণ যেগুলো আগে কখনো কিন্তু পেপারব্যাক-এ পাওয়া যেত না। দামী বাঁধাই সংস্করণ গ্রন্থাগারে থাকে বা যাঁরা অধ্যাপনা করেন, মাস্টারি করেন, তাঁদের সংগতি আছে, তাঁরা কিনতে পারেন। আর ছাত্র-ছাত্রীরা এগুলো বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজের গ্রন্থাগারে পাবে। এই বইগুলো কিন্তু এবার পেপারব্যাক-এর মাহাত্ম্যে পৌঁছে যাচ্ছে এই সৈন্যদের কাছে এবং তার বাইরেও একটা বাজার তৈরি হচ্ছে। এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ যখন শেষ হচ্ছে তখন এই ‘পেপারব্যাক রেভেলিউশন’, পেঙ্গুইন, ফেলিক্যান, অ্যামেরিকাতে সিগনেট, নিউ অ্যামেরিকান লাইব্রেরি - এই প্রকাশনাগুলোর একটা বিরাট রমরমার যুগ। এবং নানা বিষয়, উচ্চমার্গীয় বই, সেগুলো কিন্তু পেপারব্যাক-এর মাধ্যমে আমরা পেতে পারি। সেইটা আসতে থাকে। এবং স্বভাবতঃই আমাদের প্রজন্মটা, আমার জন্ম ১৯৪০, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মধ্যেই। আমরা যখন কৈশোর-যৌবনে পৌঁছোচ্ছি, তখন পেপারব্যাক-এ পৃথিবীর যাবতীয় সাহিত্যের বই, নৃতত্ত্বের বই, ইতিহাসের বই - মহামূল্য একটা গ্রন্থসম্পদ আমাদের সামনে উন্মোচিত হয়েছে। পাগলের মতো আমরা নানা বিষয়ে বই পড়বার সুযোগ পেয়েছি। সেগুলো কিন্তু গ্রন্থাগারের বাইরে আমরা পেতে পারতাম না এবং অত দামী বই কেনবার আমাদের সামর্থ্য ছিল না। তখন বামপন্থী রাজনীতিতে আমি জড়িয়ে গেছি। বাড়ির পরিবেশেও সেটা ছিল।
এসব করতে-করতে নৃতত্ত্বের প্রতি আমার খুব কৌতূহল হয়। আগ্রহ হয়। এবং আমি পড়তে শুরু করি। পেপারব্যাক-এ পাওয়া যাচ্ছে। একটার পর একটা বই কিনতে থাকি। একটা বইয়ের ভেতর অন্য একটা বইয়ের উল্লেখ আছে, সেটা কিনছি। খুব কম দাম তখন। তিন শেলিং ছ পেন্স দাম। অর্থাৎ সাড়ে তিন টাকা। আর আমার একটা সুবিধা হয়েছিল কলেজ আমলে, বি.এ. পরীক্ষায়, অনার্সে, ইংরেজিতে ভালো নম্বর পেয়েছিলাম। কী ঠিক মনে নেই, কেন। যখন এম.এ. পড়ছি তখনই প্রতি তিন মাস অন্তর সাড়ে তিনশো টাকা সরকারি বৃত্তি পেতাম। বাবা বলে দিয়েছিলেন, যে তোমার প্রয়োজনের জন্য এই টাকা খরচ করবে না; তোমার শখে ও ইচ্ছায় খরচ করবে। কারণ তোমার প্রয়োজনের দায় মেটানোটা আমার দায়িত্ব। ফলে, তিন মাস অন্তর আসা সাড়ে তিনশো টাকা সেই সময় প্রচুর। এবং সেই পুরো টাকাটা দিয়ে আমি বই কিনতাম। পেপারব্যাক-এ নানা বিষয়ের বই। তার মধ্যে নৃতত্ত্বটা আমার একটা নেশা হয়ে যায়। ওই সময়টায়। কলেজে পড়তে-পড়তে এবং সেটা যখন মাস্টারি করতে শুরু করেছি সাউথ পয়েন্ট-এ তখন খুবই জমে গেছে। এইবার মুশকিল হল ম্যাডানস্কি, রুথ বেনেডিক্ট এঁদের বই পড়ে যাচ্ছি। একটা সময় এসে দেখি যে এইবার আটকে যাচ্ছে। যাকে বলে প্রায়োগিক শর্ত, টেকনিক্যাল শর্ত আসছে, আমি আর বুঝতে পারছি না। হোঁচট খাচ্ছি। তখন বয়স কম তো! টেলিফোন ডাইরেক্টরি, বিশাল মোটা টেলিফোন ডাইরেক্টরি, এখন উঠে গেছে। সেই টেলিফোন ডাইরেক্টরি খুলে, নির্মলকুমার বসু, ভারতবর্ষের নৃতত্ত্বের অত বড়ো নাম খুবই কম, তখন 'অ্যান্থ্রোপলিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া'র ডিরেক্টর জেনারেল এবং কলকাতায় ভারতীয় জাদুঘরের ওপরে ওঁর দপ্তর। টেলিফোন ডাইরেক্টরি থেকে ওঁর নম্বর খুঁজে পেয়ে সোজা ওঁকে ফোন করেছি। এখন হলে স্পর্ধা হত না। ওঁকে বললাম, দেখুন আমি সাউথ পয়েন্ট ইশকুলে মাস্টারি করি, ইংরেজির ছাত্র, কিন্তু একটা বিপদ হয়েছে। আমি বছর দুয়েক ধরে এই-এই-এই বই পড়েছি, এইবার এসে আমি আটকে যাচ্ছি, পারছি না। কী করব? নির্মলবাবু আমাকে বললেন, অমুক তারিখে আপনি আসুন। ওঁর দপ্তরে আমি গেলাম। উনি বললেন যে, যেখানে আপনার আটকাচ্ছে, আপনার প্রশ্নগুলো আপনি বলুন। গান্ধিবাদী, বিশাল পণ্ডিত কিন্তু অসাধারণ বড়ো মাপের একজন মানুষ, আমি কোনোদিন তাঁকে দিয়ে তুমি বলাতে পারিনি। উনি আপনি বলে গেছেন সারা জীবন, যদ্দিন জীবিত ছিলেন। উনি বললেন, আপনি পনেরো দিন অন্তর-অন্তর আমার কাছে আসবেন, আপনার যাবতীয় প্রশ্ন করবেন। আমি তার উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব, বোঝানোর চেষ্টা করব। বই পড়বার উপদেশ দেব, এই বই পড়ুন। আমাদের গ্রন্থাগার থেকে আপনি বই নিতেও পারেন। অথবা আপনি কিনতে পারেন। এইটা শুরু হয়। এবং এক বছর টানা এটা চলে।
নির্মলবাবুর কাছে আমার নৃতত্ত্ব শিক্ষা। ওই এক বছর পরে আমাকে একদিন বললেন যে, দেখুন ফিল্ড ওয়ার্ক না করলে অ্যান্থ্রোপলজি শেখা যায় না। আমি বললাম, আমার তো কোনো যোগ্যতা নেই! কিছু পাশ-টাশ করিনি, জানি না, কে আমাকে ফিল্ড ওয়ার্ক করতে দেবে? বললেন যে, আমি একটা প্রকল্প হাতে নিয়েছি। কলকাতার একটা সামাজিক সমীক্ষা আমি করব, সেই সমীক্ষার জন্য আমি ন'জন জুনিয়র রিসার্চ ফেলো, অ্যান্থ্রোপলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার, এটা আমাকে সরকার থেকে অনুমতি দিয়েছে, আমি নিতে পারব। তার খরচ কেন্দ্রীয় সরকার বহন করবেন। আপনি তার জন্যে আবেদন করুন। বললাম, আমার তো কোনো যোগ্যতা নেই। বললেন, আমি আপনাকে ফর্ম-টা দেব, আপনি ফর্ম-টা পূরণ করে জমা দেবেন। এই নিয়োগ প্রক্রিয়ার সঙ্গে আমি কোনোভাবে যুক্ত থাকব না। আজকের নিয়োগ প্রক্রিয়াটা চারিদিকে যেমন সাড়া ফেলে দিয়েছে তার নিরিখে মহাপুরুষ বলব আমি নির্মলবাবুকে। আমি আপনার নাম কারো কাছে সুপারিশ করব না, উল্লেখ পর্যন্ত করব না। আমি শুধু ফর্ম-টা আপনাকে দেব, আপনি আবেদন করবেন। এক বিচারকমণ্ডলী থাকবেন, বাছাই করবেন তাঁরা। আমার ধারণা আপনি যতটা পড়াশোনা করেছেন, আমি যতটা বুঝেছি, তাতে আপনি উত্তীর্ণ হয়ে নিযুক্ত হবেন। দু'বছরের জন্যে। আর যদি না হয়, আমাদের এই পনেরো দিনে একবার করে বৈঠক, এটা চলবে। কারো কিছু এসে যাবে না। তিন জন খুবই বড়ো মাপের নৃতাত্ত্বিক, তাঁদের সামনে উপস্থিত হই, তাঁদের প্রশ্নের উত্তর দিই এবং তাঁরা আমাকে নিয়োগ করেন।
দক্ষিণ কলকাতার, নির্মলবাবু ওইটুকু আমার জন্যে ভেবেছিলেন, যে-অঞ্চলটায় আমি থাকি, কলকাতা শহরে তখন বোধ হয় আশিটা কর্পোরেশন ওয়ার্ড ছিল, ওই ওয়ার্ড হিসেবে ভাগ করে, একেকজন রিসার্চ ফেলোকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। চারটে কি ছ'টা কি আটটা, ওই ওয়ার্ডের, সেখানকার পুরোনো বাসিন্দাদের পূর্ব ইতিহাস, কোথা থেকে এলেন, এই পরিবারগুলোর ইতিহাস, এবং প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস। প্রতিষ্ঠান বলতে ইশকুল, কলেজ, মন্দির, মসজিদ, ক্লাব এইসব। প্রতিষ্ঠান আর পরিবার - এই দুটোর ইতিহাস ওইখান থেকে সমীক্ষা করে বের করা। আমরা এগুলো জমা দেব নির্মলবাবুর কাছে, নির্মলবাবু এইটাকে পুরো পরীক্ষা করবেন, করে একটা রিপোর্ট তৈরি করবেন। 'ক্যালকাটা 1964' নাম দিয়ে এটা প্রকাশিত হয়। খুব প্রামাণ্য একটা বই। বইটার ভূমিকাতে নির্মলবাবু লেখেন কে-কে কোন-কোন অঞ্চলের দায়িত্ব নিয়ে কাজ করেছেন, তাঁদের নাম এবং পরিচয়। কোন অবস্থার মধ্যে আমরা কাজ করেছিলাম, সেটা নির্দেশ করা আছে সেই বইতে।
এই কাজটা করতে গিয়ে আমি আমার অঞ্চলটা, আমার পাড়াটাকে, যেখানে আমি থাকতাম তাকে ভালো করে জানলাম। আমি তখন থাকি বালিগঞ্জ স্টেশনের খুব কাছে। একডালিয়া রোড তখন রাস্তাটার নাম ছিল, এখন রাস্তাটার নাম হয়েছে রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় সরণি। আমরা রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়ের ভাড়াটে ছিলাম। একডালিয়া রোড-এর ওপরে। আপনারা হয়তো জানেন, এর সঙ্গে, কোথাও ওই নির্মলবাবুর সঙ্গে কাজ করা, নৃতত্ত্ব - এইখান থেকে এইগুলো আমার কোথাও, কী বলব, স্বভাব, চরিত্র, ভাবনা-চিন্তার প্রক্রিয়ার মধ্যে এসে গেছে।
ওঁরা চার ভাই - রাধাকুমুদ, রাধাকমল, রাধাপ্রসাদ, রাধাগোবিন্দ - পাশাপাশি ওঁদের বাড়ি ছিল একডালিয়া রোড-এর ওপরে। এখন যেটা কসবা ফ্লাই ওভার, ফ্লাই ওভার-টা তখন ছিল না, ওখানে একডালিয়া পার্ক বলে একটা পার্ক ছিল। সেই পার্ক-টা, ট্রাম লাইন, ট্রাম লাইন-এর গায়ে আমাদের এই বাড়িগুলো। আর ওই পার্ক-এ নানারকম অনুষ্ঠান হত, অনেক কিছু আমরা দেখেছি। আর আমাদের বাড়িটা ছিল, সেটাও খুব মজার। বাড়িটার আকারটা, গঠনটা ছিল একটা ইংরেজি ক্যাপিটাল ই-র মতো। অর্থাৎ একটা দিক সোজা, তিনটে বাহু। দুটো বাহুতে দুটো বাড়ি, বাসস্থান আর রাস্তার ওপরে টানা এই অংশ একটা। মাঝখান থেকে একটা ভাগ করে ওপাড়টা দোতলা বাড়ি তার ওপরে ছাদ। ওপাড়টা হচ্ছে বাড়িওলার আর এপাড়টা হচ্ছে আমাদের, ভাড়াটেদের। আমরা দোতলাটা আর ছাদ পেয়েছিলাম। ছাদে একটা বড়ো চিলেকোঠার ঘর ছিল। চিলেকোঠার ঘরটা ছিল আমার পড়ার ঘর। আমি আর সুমন্ত একটা ঘরে থাকতাম, আমাদের দুটো খাট আর সুমন্তর পড়ার টেবিল। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠতাম। দোতলায় বাথরুম ছিল। হাত-মুখ ধুয়ে ছাদে আমার চিলেকোঠার ঘরে চলে যেতাম। ওইখানে আমার বইপত্র নিয়ে আমার আস্তানা। সারাদিন। একদিকে একটা চিলেকোঠা, তারপরে একটা ছোট্ট কলতলা। আর ঠিক সমান্তরাল, বাড়িওলার দিকে যেটা ছাদ, সেই ছাদে চিলেকোঠা নয়, সেখানে বেশ ভালো একটা ঘর। আলাদা, খুব বাহারে ঘর। দুটো সমান্তরাল ছাদ। ভোরে প্রায় সাড়ে চারটে-পাঁচটায় ওপরে চলে যেতাম। শীতকালটায় বিশেষ করে, অক্টোবরের শেষ থেকে ধরুন জানুয়ারি অব্দি সময়টায় রোজ সকালে একটা অভিজ্ঞতা হত - ওই পাড়ের ছাদটাতে একজন ভদ্রলোক, দীর্ঘাঙ্গ, খুব সুঠাম শরীর গুনগুন করে গান গাইতে-গাইতে পায়চারি করছেন। একদিক থেকে আরেক দিক। আর তারপরে পায়চারীটা হয়ে গেলে আমার চিলেকোঠার ঠিক উলটো দিকের ঘরটাতে বসে রেওয়াজ করেন। আমার বাড়িওলা রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়ের পুত্র প্রদ্যুম্ন মুখোপাধ্যায়। এবং তাঁর স্ত্রী পূরবী মুখোপাধ্যায়, এঁরা দুজনের আমীর খাঁ-র শিষ্য-শিষ্যা। ওঁরা গান শেখেন আর শীতকালটা, কলকাতার মিউজিক কনফারেন্স-এর মরসুম, ওই সময় আমীর খাঁ সাহেব কলকাতায় ওই বাড়িতে থাকেন। তাই এই স্বাদগুলো এসে যাচ্ছে। আর একটা মজার কথা বলি যে, আমরা দোতলায় আমাদের যে অংশটায় থাকি, তখন আমার মা, আমার বাবা, আমার বউদি করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় ওঁরা আছেন। আর সব সময় দেখতাম আমাদের কিছু আত্মীয়স্বজন, বিশেষ করে পূর্ব বাংলা থেকে আগত, তাঁরা কেউ কলকাতায় পড়তে আসছেন, কেউ ছোটোখাটো চাকরি পেয়েছেন, আমাদের বাড়িতে থাকতেন। এটা সব সময়ই। অন্ততঃ দু'জন তিনজন থাকতেন। আবার একটা জায়গায় পৌঁছে গেলে চলে গেলেন, আবার কেউ এলেন। আর আমাদের একতলাতে ভাড়াটে থাকতেন, চল্লিশের দশকের ওই সময়টায়, এখন খুব বিখ্যাত ইতিহাসবিদ, আমার বন্ধু পার্থ চট্টোপাধ্যায়। পার্থ আর আমার ভাইঝি, যাঁকে আপনারা সকলেই দেখেছেন, ‘পথের পাঁচালী’-র শুরুতেই যে ছোটো দুর্গা, বেড়াল নিয়ে যে খেলা করে, যাকে দিয়ে কার্যত ছবি শুরু হয়, রুরকি আর পার্থ, ওরা আমাদের বাড়ির ঠিক পেছনটাতে একটা ছোটো মাঠ ছিল, ওখানে শীতকালে নিয়মিত ক্রিকেট খেলত, ওই পাড়ার আরো কিছু ছোটো-ছোটো ছেলে-মেয়েদের নিয়ে। একদিকে আমীর খাঁ আর একদিকে এই বাড়িগুলো, যেমন ধরুন আমাদের ঠিক পাশের বাড়িটা, যেটা রাধাকমল মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি, আপনারা হয়তো জানেন যে, লখনৌ একটা সময়ে, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রায় মধ্যভাগ পর্যন্ত, তিরিশের দশক অবধি বলব, শিক্ষার একটা বিরাট কেন্দ্র ছিল এবং বাঙালি সংস্কৃতিরও একটা খুব বিরাট কেন্দ্র ছিল, অতুলপ্রসাদ ছিলেন, খুব প্রাচীন বেঙ্গলি ক্লাব, সেখানেও আমি পরে অনেকবার গেছি, এবং লখনৌ বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির অধ্যাপক ছিলেন রাধাকমল মুখোপাধ্যায়, ইতিহাসের অধ্যাপক ছিলেন রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় এবং ভারতবর্ষে প্রথম সমাজতত্ত্ব, সোশিওলজি-র বিভাগ হয় তার প্রধান অধ্যাপক ছিলেন ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। আর লখনৌতে সেই সময়, পরে আবিষ্কার করি যে, ললিতমোহন সেন, তিনি আমাদের কলকাতা আর্ট কলেজের প্রথম কিংবা দ্বিতীয় ব্যাচ-এর ছাত্র, সরাসরি অবনীন্দ্রনাথের ছাত্র, তিনি 'রয়্যাল অ্যাকাডেমি অফ আর্ট'-এ পড়তে যান এখান থেকে পাশ করে, তারপরে লখনৌতে সরকারি আর্ট কলেজ হয়, কলকাতা আর্ট কলেজের পরে, সেখানে শিক্ষাদান করেন। তাঁর কাজ পরে লখনৌতে দেখেছি। কোথাও লখনৌ-এর ওই বাঙালি, তাঁরা কলকাতায় ফিরে আসছেন একডালিয়া রোড-এর ওইখানে। আমাদের বাড়ি থেকে দেখা যেত পেছন দিকটা। দুটো-তিনটে মাঠ ছিল, বাড়ি হয়নি তখনও। ঠিক তার পরের বাড়িটা ছিল সুরেন্দ্রনাথ সেনের। ১৯৫৭ সালে, আমার মনে আছে, সেটা সিপাহি অভ্যুত্থান বা আমাদের প্রথম ভারতীয় স্বাধীনতার মহাসংগ্রামের শতবার্ষিকী যখন উদ্যাপন হচ্ছে, তখন জওহরলাল নেহরুর নিজস্ব উদ্যোগে, তার একটা সরকারি ইতিহাস লেখার কথা হয়। সিদ্ধান্ত হয়। এবং সেই দায়িত্ব অর্পিত হয় সুরেন্দ্রনাথ সেনের ওপর। সেটা প্রকাশিত হয়েছিল। '1857' বলে বিখ্যাত একটা প্রামাণ্য বই। সুরেন সেন ওখানে থাকেন। আমরা ইশকুল যেতাম, এখনকার মতো বড়ো ইশকুল খোঁজার প্রশ্নই উঠত না। ইংরেজি মিডিয়াম কোনো ইশকুলের কথাও আমাদের বাড়িতে আমরা ভাবতাম না। তার ফলে হাঁটাপথে সবচেয়ে কাছের যে ইশকুলে পৌঁছোনো যায়, তার নাম জগদ্বন্ধু ইন্সটিটিউশন, সেইখানে আমরা পড়তাম। এক্কেবারে হাঁটাপথ। আমার সাত মিনিট আট মিনিট লাগত পৌঁছোতে। একডালিয়া রোড থেকে বেরিয়ে পাশের ফার্ন প্লেস বলে একটা রাস্তা সেটা গিয়ে ফার্ন রোড-এ পড়ে। ফার্ন রোড-এ জগদ্বন্ধু ইন্সটিটিউশন। ফার্ন প্লেস-এর ওপরে বাস করেন ত্রিপুরারি চক্রবর্তী। তার ঠিক পরের বাড়িটাতে বাস করেন, পরে আমার সঙ্গে অসমবয়সী বন্ধুত্ব হয়, ‘দক্ষিণী’-র অসামান্য, সম্পূর্ণ অন্য জাতের রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সুনীলকুমার রায়। আমাকে বাড়িতে এসেও পরবর্তীকালে গান শুনিয়েছেন এবং মুগ্ধ হয়ে শুনেছি, ধন্য হয়েছি।
অজয় গুপ্তঃ আমাদের অধ্যাপক সুশীল মুখার্জির বাড়ি ছিল ওখানে।
শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ঃ হ্যাঁ-হ্যাঁ। সব ওই পাড়ায়। আর বাবা আমাদের নিয়ে সকালে উঠে হেঁটে লেকে বেড়াতে নিয়ে যেতেন। লেকে বাবার সঙ্গে দেখা হত, সেইসূত্রে দেখেছি যদুনাথ সরকারকে। ত্রিপুরারি চক্রবর্তীকে তো দেখতামই। শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়কে, মেঘনাদ সাহাকে - এঁরা লেকে বেড়াতে আসতেন সেই সময়টায়। এই মানুষগুলোকে দেখতে পাচ্ছি, বাবা চিনিয়ে দিচ্ছেন, দেখছি। আমাদের রাধাকমলবাবুর বাড়িতে ভাড়াটে থাকতেন অমরেন্দ্রপ্রসাদ মিত্র। পুরোনো ‘পরিচয়’ বা ‘নতুন সাহিত্য’ যদি দেখেন, নজরে আসবে সেখানে অমরেন্দ্রপ্রসাদ মিত্র লিখিত অর্থনৈতিক বিষয়ের প্ৰবন্ধ। সৌরিন ভট্টাচার্যদের পূর্বসূরী বলব। অর্থনীতিতে অসামান্য লেখা, এবং রসবোধসম্পন্ন লেখা অমরদার। এই পাড়াটার ইতিহাসটা, যে পাড়াতে আমি বড়ো হচ্ছি এবং এই মানুষগুলোকে ছোটোবেলা থেকে দেখছি সেইগুলোকে আরো চিহ্নিত করে জানার সুযোগটা আমাকে নির্মলবাবু করে দিলেন। এবং আমি আবিষ্কার করলাম, যেটা আমি অনেক সময় আজকাল সত্যজিৎ রায়ের ছবি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়েও, ওইখান থেকে, ওই শিক্ষা থেকে আমার চলে আসে, যে প্রথম মহাযুদ্ধের পরে কলকাতার বিস্তার এবং কলকাতার আরেকটা ইতিহাস শুরু হল। যেটা বাবু কলকাতার ইতিহাস নয়, যেটা উত্তর কলকাতার ইতিহাস নয়, অন্য একটা ইতিহাস। এবং এটা হচ্ছে বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থানের ইতিহাস। ঠিক প্রথম মহাযুদ্ধের আগে ১৯১২ কি ’১৩ সালে, কারণ ১৯১২ সালে কলকাতা থেকে রাজধানী চলে গেল দিল্লিতে, ওই সময় স্থির হয় যে, কলকাতা থেকেও অনেক লোক দিল্লি চলে যাবে এবার। কলকাতার একটা বিস্তার ঘটবে। এবং 'ক্যালকাটা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট' বা সিআইটি ঠিক প্রথম মহাযুদ্ধের আগে তৈরি হয় কিন্তু যুদ্ধ বেঁধে যাওয়ায় কোনো কাজকর্ম করা সম্ভব হয়নি। পূর্ব কলকাতা, পশ্চিম কলকাতা, দক্ষিণ কলকাতার পুরো বিবর্তনটা হয় প্রথম মহাযুদ্ধ শেষ হবার পরে। এবং তার সঙ্গে উল্লেখযোগ্য, ১৯১৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম কিন্তু সরাসরি পড়ানো শুরু করল। তার আগে অবধি কিন্তু 'সেনেট হল' এবং সেনেট হল-কে ঘিরে অনেকগুলো ছোটো-ছোটো দপ্তর, আপিস - এই ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। নতুন করে ক্লাসরুম তৈরি করে পড়ানো শুরু হয় সরাসরি, তার ফলে আশুতোষ বিল্ডিং, এটা স্যার আশুতোষ মুখার্জির আমলে হয় বলে পরবর্তীকালে ওটার নাম হয় আশুতোষ বিল্ডিং যেখানে আমি, অজয়, আমরা সবাই ক্লাস করেছি, পড়াশোনা করেছি। এই ইতিহাসটাকে আমি যখন আবিষ্কার করছি, মজার-মজার জিনিস পেয়ে যাই, নির্মলবাবুর ওই প্রকল্পে কাজ করতে গিয়ে।
আবিষ্কার করলাম যে, জগদ্বন্ধু ইন্সটিটিউশন, যে ইশকুলে আমি পড়েছি, নির্মলবাবুর নির্দেশে প্রতিষ্ঠানগুলোর ইতিহাস। জগদ্বন্ধু ইন্সটিটিউশন কী করে হল? জগদ্বন্ধু রায়ের খোঁজ পাওয়া গেল, তাঁর বংশধরদেরও খোঁজ পাওয়া গেল। জগদ্বন্ধু রায়ের পূর্বপুরুষ স্যার আশুতোষ মুখুজ্জেদের বাড়িতে পাচক ব্রাহ্মণ হয়ে ওডিশা থেকে এসেছিলেন। রায় পদবিটা তো খুব সর্বব্যাপী, তার সঙ্গে 'কোন দেশের' সেটার সম্পর্ক নেই। পাচক ব্রাহ্মণ হয়ে কাজ করতে থাকেন। জগদ্বন্ধু তাঁদের ছেলে। তিনি ইশকুলে যান। ম্যাট্রিক-টা পাশ করেন। স্যার আশুতোষদের পরিবারের ক্ষমতার কল্যাণ-প্রসাদে, নিয়োগ প্রক্রিয়ার কল্যাণে, তাঁকে উনি পোস্টাপিসে কাজ পাইয়ে দেন এবং উনি সাব-পোস্টমাস্টার অবধি হয়েছিলেন। ওঁর পরিবারের যাঁদের আমি সমীক্ষা করতে গিয়ে পেলাম, তাঁরা খুব সগর্বে বললেন যে, কেমন তুচ্ছতা থেকে উচ্চতায় উত্থান, তার রোমাঞ্চকর কাহিনি। আমি খুব খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করছি, নির্মলবাবু শিখিয়েছেন কী করে প্রশ্ন করতে হয়, কী করে খোঁচাতে হয়। আট বছরের একটা হিসেব আমি কিছুতেই পাচ্ছি না। কারণ সাব-পোস্টমাস্টার থেকে ক্রমে জগদ্বন্ধু রায় বিরাট ধনী ব্যক্তি হলেন, তাঁর বিরাট ব্যবসা, তিনি জগদ্বন্ধু ইন্সটিটিউশন-এর জন্য জমি দিচ্ছেন, টাকা দিচ্ছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। এবং খুবই প্রতিপত্তি তাঁর। টাকাটা কি ওডিশা থেকে এসেছে?
ওঁর পরিবারের লোকরা বললেন, ওই আট বছরের বিষয়ে আমরা কিছু জানি না। আমার একটা সুবিধা হয়েছিল, জগদ্বন্ধু ইন্সটিটিউশন-এ পড়েছি। হিরণ্ময় বন্দ্যোপাধ্যায় ওই পাড়ার খুব পুরোনো বাসিন্দা। উনি জগদ্বন্ধু ইন্সটিটিউশন-এর সেক্রেটারি ছিলেন এবং আমাকে স্নেহ করতেন। ইশকুলের অনেক অনুষ্ঠানে আবৃত্তি, ডিবেট ইত্যাদি করতাম, তাই। উনি আসতেন পুরস্কার বিতরণীতে। আপনারা জানেন যে হিরণ্ময় বন্দ্যোপাধ্যায় দেশভাগের পরে রিহ্যাবিলিটেশন কমিশনার ছিলেন এবং অসামান্য কাজ করেছিলেন বাস্তুহারাদের পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে। খুব ঠান্ডা মাথার চমৎকার মানুষ। পরে আমি যখন রবীন্দ্রভারতীতে কাজ করতে যাই, উপাচার্য হিসেবে হিরণ্ময়বাবুকে প্রথমে পেয়েছিলাম। হিরণ্ময়বাবুর কাছে গেছি পাড়ার পুরোনো ইতিহাস নিতে। আমি বললাম, স্যার এই আট বছরের হিসেবটা পাচ্ছি না। উনি একটু হাসলেন আর বললেন যে, টাকা তছরুপের জন্যে জগদ্বন্ধু রায়ের সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছিল। বলার পর একটু হেসে বললেন, শমীক জানোই তো, দেখেছ তো কাগজে, দেখোই তো ওই এইট ইয়ার্স রিগরাস ইমপ্রিজনমেন্ট - এই হুকুমগুলোতে আট বছরটা খেয়াল করেছ? বললাম, হ্যাঁ-হ্যাঁ। ওই আট বছর। আট বছরটা মিলে গেল না! আট বছরের রিগরাস ইমপ্রিজনমেন্ট - আরআই।
তারপরে জগদ্বন্ধু রায় ফিরে আসেন। ফিরে এসে আবার আশুতোষ মুখুজ্জেদের পরিবারে যান গিয়ে বলেন, যে খুব অন্যায় হয়ে গেছে। আমি আর এরকম করব না, আমাকে আর একটা সুযোগ দিন। তখন স্যার আশুতোষের ভাই রাধিকাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তিনি এবং এই পরিবারটাও, আমি তখনই আবিষ্কার করি, এঁরা কাঠ চালানের ব্যবসায়, মানে সুন্দরবনের গাছ কেটে, কারণ রেলওয়ে এসে গেছে তখন, এবং রেলওয়েটা লক্ষ্মীকান্তপুর পর্যন্ত যায়, বালিগঞ্জ স্টেশন-টা হচ্ছে কলকাতায় ঢোকার প্রথম স্টেশন, তারপরে শেয়ালদা যাবে। সুন্দরবনের গাছ কেটে নিয়ে এসে বালিগঞ্জ স্টেশন-এ নামানো হয়, ওইখানে কাঠ চেরাই কল - এইগুলো স্যার আশুতোষদের পরিবার ওখানে তৈরি করছেন। এবং সেইখানে কাজ পাচ্ছেন জগদ্বন্ধু, এবং ওইটা তাঁর ব্যবসা করে নিচ্ছেন। একটু আগেই অনুযোগ শুনেছি, আমি কখনও এক কথায় থাকি না, অন্য কথায় চলে যাই। তাই একটু অন্য কথায় যাচ্ছি। মজাটা দেখবেন কী করে সব মিলে যায়। আমি অনেক পরে, এই বছর সাত-আট আগে, একটা সম্পাদনার দায়িত্ব এল, আমার বন্ধু, প্রকাশক মহলের খুব প্রিয় পাত্র জয়ন্ত বাগচী, 'পি এম বাগচী কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড'-এর কাছ থেকে। উনি আমাকে একটা প্রস্তাব দিলেন যে, পি এম বাগচীর পঞ্জিকার সঙ্গে এক সময় যে ডাইরেক্টরি প্রতি বছর বেরোত সেগুলো নিয়ে একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ ডাইরেক্টরি আমরা ছেপে ফেলি। এই ডাইরেক্টরির খণ্ডগুলো আমাকে দেখালেন। আমি বলি, আসুন কাজ শুরু করা যাক। ১৯১৫ সালের ডাইরেক্টরি, অর্থাৎ কলকাতার সমস্ত রাস্তার নাম দিয়ে প্রত্যেকটা বাড়ির ঠিকানা দিয়ে, কে সেই বাড়িতে থাকেন তার সব খবরাখবর দিয়ে ১৯১৫-র ডাইরেক্টরিটা আমরা প্রকাশ করলাম, আমি সম্পাদনা করেছি। তাতে দেখা গেল ওই বালিগঞ্জ পাড়ায়, যেখানে আমি থাকতাম, সেখানে চারটে জমি, ১৯১৫-তে দেখা যাচ্ছে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের নামে। খালি জমি, কিন্তু মালিক আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। তো, এইগুলো মিলে যাচ্ছে। কারণ ১৯১৪ সালে জগদ্বন্ধু ইন্সটিটিউশন প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। তখনো কিন্তু ওই জমিগুলো ওখানে ওঁদের আছে। কাঠ চেরাই কলের ব্যবসা করছেন আশুতোষ মুখার্জি। ওই পাড়াটা আমার কাছে ভীষণ আরেকভাবে জীবন্ত হয়ে উঠল। আমি পাড়াটাকে চিনেছি এবং কে কোথায় থাকতেন জেনেছি।
আমি ওইখানেই আবিষ্কার করি, এখন ওটা সাউথ এন্ড রোড, গড়িয়াহাট থেকে গোলপার্ক-এর পাশ থেকে বেরিয়ে ওদিকে পড়ে, ঢাকুরিয়া ব্রিজের মুখটায়। ওখানে একটা পরিবারকে পেয়েছিলাম, তাঁরা আমাকে একটা দলিল দেখিয়েছিলেন, যেটা যখন গোবিন্দপুর গ্রাম, কলিকাতা সূতানুটি গোবিন্দপুর, সেই গোবিন্দপুর গ্রামকে ১৭৫৮ সালে সম্পূর্ণ ধূলিসাৎ করে দেওয়া হয় আক্ষরিক অর্থেই, মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয় একটা বর্ধিষ্ণু গ্রাম, কারণ, প্রথমবারে ফোর্ট উইলিয়াম-এ সিরাজউদৌল্লা যখন এসে ওটাকে অবরোধ করেন, তখন ওঁরা সূতানুটি কলকাতা গোবিন্দপুরের ভেতর দিয়ে, গলিঘুঁজি দিয়ে, মানুষ ওঁদের আশ্রয় দিয়েছিল, সমর্থন করেছিল, ফলে ওঁরা ঘেরাও করে ফেলতে পেরেছিলেন ফোর্ট উইলিয়াম, গঙ্গার ধারে তখন ফোর্ট উইলিয়াম। তার ফলে ইংরেজদের শিক্ষা হয়েছিল, তারা ওইখানে আর ফোর্ট উইলিয়াম না করে দ্বিতীয় ফোর্ট উইলিয়াম তৈরি করল এখন যেখানে সেটি অবস্থিত। আর আপনারা জানেন যে এখনো উত্তর ভারতে পুরোনো দুর্গ দেখলে দেখতে পাবেন যে দুর্গকে ঘিরে পরিখা থাকে। কিন্তু পরিখার ওপাড়ে অনেকটা খালি জমি থাকে। কারণ, যুদ্ধটা তখন কামানে হত, তাই কামানে যত দূর থেকে শত্রুদের দেখা যায় এবং খোলা জায়গা পাওয়া যায় নিশানা করে তাদের গোলা ছুড়ে শেষ করে দেওয়া যাবে। সেইজন্য ওটা খালি রাখতে হয়। আর ইংরেজি অভিধানে ওই যে অঞ্চলটা, যেটা পরিখার বাইরে ঘেরা ফাঁকা জায়গা, এটার ইংরেজি টার্ম হচ্ছে এসপ্ল্যানেড। অর্থাৎ, পুরো গোবিন্দপুর গ্রামটা ছিল এই নতুন ফোর্ট উইলিয়ামের এসপ্ল্যানেড, তার ফলে গোবিন্দপুর গ্রামটাকে সাফ করে দিতে হয়েছিল। সেই গোবিন্দপুর গ্রামে এখন ময়দান, ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ড, রেসকোর্স, রবীন্দ্রসদন, সেন্ট পলস্ ক্যাথিড্রাল, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল - এই পুরোটা। আর ওরই একটা দিকে ফোর্ট ঘিরে একটা পরিখা ছিল, সেটা একটা খাল ছিল, সেটা ভরাট হয়ে গেছে। দ্বিতীয় একটা খাল রাখা হয়েছিল প্রতিরক্ষার জন্যে, সেটা ছিল সার্কুলার রোড-টা, যেটা কলকাতার এখনও দীর্ঘতম সোজা রাস্তা। একেবারে দ্বিতীয় হুগলি ব্রিজ থেকে শুরু করে শ্যামবাজার পর্যন্ত - টানা একটা রাস্তা। এতখানি সোজা রাস্তা কিন্তু কলকাতায় আর নেই। কারণ ওটা পরিকল্পনামাফিক অনেক দূর পর্যন্ত এসেছিল, তারপরে ওটাকে ভরাট করে ফেলে টেনে নিয়ে যেতে বেশি অসুবিধা হয়নি। এই পরিবার আমাকে একটা দলিল দেখিয়েছিলেন, যেখানে সাধারণ মানুষদের একেবারে উৎখাত করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু যাঁরা ধনী, প্রতিপত্তিসম্পন্ন, তাঁদের সঙ্গে ব্যবস্থা হয়েছিল, চুক্তি হয়েছিল, তাঁদের বেলেঘাটা, মানিকতলা ইত্যাদি অঞ্চল, যেখানে তখন কোনো বসতি নেই, সেইখানে ওঁদের জমি দেওয়া হয়েছিল। এবং এই পরিবারকে সেখানে জমি দেওয়া হয়। সেই চুক্তিপত্র তাঁরা আমাকে দেখিয়েছিলেন। সেই দলিল আমি দেখেছি। এবং তাঁরা আমাকে বলেন, যে বিখ্যাত যাত্রাওলা, কলকাতার যাত্রা-ইতিহাসের অন্যতম প্রধান, প্রথম যাত্রাকার গোপাল উড়ে, যিনি রাস্তায় গান গেয়ে ঘুরছিলেন, এই পরিবার, বউবাজার অঞ্চলে ওঁদের বাড়ি ছিল, ওঁরা ওঁকে আশ্রয় দেন এবং ওইখানে উনি প্রথম যাত্রাদল তৈরি করেন। এই ইতিহাসটাকে কিন্তু আমি চিনতে-চিনতে, জানতে-জানতে বড়ো হয়েছি এবং নানাভাবে আমি অনেক কিছু দেখি যা এই ইতিহাসটার মধ্যে জড়িয়ে যায়। আমার ছোটোবেলার পারিবারিক বাসস্থানের এইটা একটা দিক।
আমি খুব সংক্ষেপে আরেকটা ছোটো ঘটনা, সেটাও এই বড়ো হয়ে ওঠার সময়টার, বলছি। আমার দাদা-বউদি, সুব্রত এবং করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়, আমার সঙ্গে একুশ বছরের তফাত। আমরা এখন যাঁদের শতবার্ষিকী পালন করছি, তাঁদের অনেকেই আমার দাদা-বউদি। আমার দাদা-বউদিরই বন্ধুবৃত্ত, তাঁদের আমি দাদা-বউদি বলেই জানতাম। সুভাষদা, গীতাদি, কামাক্ষ্যাদা, রিকুদি, দেবীদা, অলকাদি, চিনুদা, উমাদি, ক্ষিতিশদা - এঁদেরকে আমার দাদা-বউদি হিসেবেই কিন্তু চিনে এসেছি। এবং নানাভাবে আমার জীবনে এঁদের পেয়েছি। ’৪১ সালে দাদা-বউদি এম.এ পাশ করেন একসঙ্গে। দাদার সঙ্গে বউদির প্রেম হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি পড়তে-পড়তে। আর একটা সময় বউদি বিয়ের আগে, আমার বাবার কাছে ইংরেজি পড়তে আসতেন। আসা-যাওয়াটা শুরু হয়, প্রেমটাও ঘনীভূত হয় তার ফলে। বউদির পরিবারের দিক থেকে, আমরা ব্রাহ্মণ ওঁরা বৈদ্য, সেইজন্যে একটা অসুবিধার জায়গা ছিল। কিন্তু আমার মা এবং বউদির মা, এঁরা দুজনে কিন্তু খুব জোর করেই এই জায়গাটাকে ওঁরা শক্তপোক্ত করেন। আমার বাবার দিক থেকে কোনো অসুবিধা ছিল না। ফলে বিয়েটা সহজেই হয়ে যায়। দাদা তখনই কম্যুনিস্ট পার্টি-তে যোগ দেয়। ’৪১ সালে ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এবং ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠা ’৪৩ সালে। তার আগেই, ওই ’৪০-’৪১ সালেই ওয়াইসিআই, ইউথ কালচারাল ইন্সটিটিউট - এই নামে একটা সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরেই তৈরি হয়। তাতে জলি কল, আমার দাদা সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়, করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রশান্তকুমার সান্যাল, জ্যোতি বসু, স্নেহাংশু আচার্য, সুচিত্রা মিত্র, সুপ্রিয়া আচার্য (সুচিত্রা মিত্রের দিদি) - এঁরা সকলে সেটার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বলা যায় যে বামপন্থী সংস্কৃতির আন্দোলন গণনাট্য সঙ্ঘেরও আগে ওয়াইসিআই থেকে শুরু হয়। তার কিছু কিছু নাটক, স্মৃতি, সেগুলো রয়েছে। ’৪১ সালে আপনারা জানেন যে জার্মানি সোভিয়েট ইউনিয়ন আক্রমণ করে এবং তখন আন্তর্জাতিক কম্যুনিস্ট আন্দোলন সিদ্ধান্ত নেয়, যে বিভিন্ন উপনিবেশে যে-আন্দোলনগুলো চলছে সেগুলো আপাতত স্থগিত রেখে ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে সবাই নেমে পড়ুক। এবং কোথাও মূল জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক স্রোত থেকে বামপন্থীরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যান, কম্যুনিস্ট বামপন্থীরা বিশেষ করে, সেইটে ঘটে এবং কম্যুনিস্ট আন্তর্জাতিক থেকেই সিদ্ধান্ত ছিল যে যুদ্ধে যোগ দিয়ে কম্যুনিস্ট-রা ফ্যাসিবাদের সঙ্গে সরাসরি মোকাবিলা করবে। আমার দাদা পার্টির নির্দেশে যুদ্ধে যোগ দেন, সৈন্যবাহিনীতে নাম লেখান। এবং ওঁর প্রথম পোস্টিং হয় ভিয়েতনাম-এ। ভিয়েতনাম থেকে বার্মা অব্দি ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে দাদা আসেন। তার ফলে আমরা দাদাকে ছোটোবেলায় সেইসময় পাইনি। দাদা ফিরে আসেন যখন, যুদ্ধ শেষ হয়। তখনকার ওই টেকনিক্যাল টার্ম-টা ছিল ডিমবড্, অর্থাৎ আগে যেটা বলছিলাম যে জোর করে বাধ্য করাটা হচ্ছে মবিলাইজেশন, ডিমবলাইজড্-এর শর্ট ভার্শন হল ডিমবড্। এখন যেটা নিয়েও আবার আরেকরকমের রাজনীতি হচ্ছে, যে একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য চুক্তির মাধ্যমে সৈন্য নিয়োগ করা তারপরে তুমি খারিজ। সেই ব্যবস্থাটাই তখন ছিল। ফলে দাদা যখন যুদ্ধ শেষে ডিমবড্ হয়, কলকাতায় ফেরে না, বম্বেতে থেকে যায়, পার্টির তখন হোল টাইম সদস্য যাকে বলে এবং কম্যুনিস্ট পার্টির সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘পিপলস্ এজ’, ‘পিপলস্ ওয়ার’ আগে নাম ছিল, তাতে কাজ করতে থাকে। বউদি চলে যায় আমাদের কাছ থেকে ওই সময়টাতে, মানে ’৪৫ সালের পরে ’৪৬-এ বম্বে চলে যায় এবং বম্বেতে আপনারা পড়েছেন যে আইপিটিএ-র সেন্ট্রাল স্কোয়াড যাতে পণ্ডিত রবিশঙ্কর, শান্তি বর্ধন, প্রীতি বন্দ্যোপাধ্যায়, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, শান্তা গোখলে - এঁরা সবাই ছিলেন। সেইখানে বউদি শিল্পী বা অভিনেতা-অভিনেত্রী হিসেবে নন টাইপিস্ট-সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করেন। স্টেনোগ্রাফি শিখে নিয়েছিলেন তার মধ্যে। সেটা করে সেন্ট্রাল স্কোয়াডে কাজ করতেন। ‘পথের পাঁচালী’ করার পরে যখন সত্যজিৎবাবুকে আইপিটিএ থেকে বম্বেতে সংবর্ধনা জানানো হয়, সেখানে বলরাজ সাহানি খুব মজা করে বলেছিলেন যে, ‘মাই সারপ্রাইজ! আই নেভার নিউ দ্যাট আওয়ার ওয়ান্ডারফুল টাইপিস্ট ইজ্ অ্যান অ্যাকট্রেস।’ আমরা বউদিকে তখন পাচ্ছি না। বউদি ওখানে অন্তঃসত্ত্বা হন। ফিরে আসেন ’৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর, আমার ভাইঝি রুরকির জন্ম হয় স্বাধীনতার ঠিক একমাস পরে। তার অল্প পরেই ভারতীয় কম্যুনিস্ট পার্টি এবং ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ বেআইনি ঘোষিত হয়। বউদি বেআইনি গণনাট্য সঙ্ঘে যোগ দেন এবং বেআইনি গণনাট্য সঙ্ঘে বউদির অভিনয় জীবনের শুরু। আমি একেবারে ছোটোবেলায়, ন' বছর বয়সে, তখনও পার্টি বেআইনি, ’৪৯ সালে বেআইনি গণনাট্য সঙ্ঘের অনুষ্ঠানে ‘জনান্তিকে’ বলে একটা নাটক, সলিল চৌধুরীর লেখা, তার আগে সলিলদার নেতৃত্বেই গণনাট্য সঙ্ঘের শিল্পীরা গান করেন এবং এটা হিন্দুস্তান পার্ক-এ, ছোটো একটা মাঠ ছিল ‘আগুয়ান সঙ্ঘ’ বলে একটা ক্লাব, তাদের মাঠ, সেখানে অভিনীত হয়েছিল। এখন বিশাল-বিশাল বাড়ি হয়ে গেছে, আমি আর এখন চিনতে পারব না। কিন্তু এখনও হিন্দুস্তান পার্ক-এর রাস্তাটার অনেকগুলো উপরাস্তা উপপথ বেরিয়ে যায়, তাই ওই প্রত্যেকটা রাস্তার মুখে কম্যুনিস্ট স্বেচ্ছাসেবীরা পাহারা দিচ্ছিলেন, যাতে যদি পুলিশ আক্রমণ করে, আগে থেকেই ব্যবস্থা করা ছিল পাড়ার কোন বাড়িতে শিল্পীদের আশ্রয় দেওয়া হবে, লুকিয়ে রাখা হবে। আর স্বেচ্ছাসেবীরা আগাম জানান দেবেন, দর্শকরা উধাও হয়ে যাবেন। কিন্তু সেদিন কোনো কিছু ঘটেনি। অনুষ্ঠান আমরা দেখেছিলাম। বউদির অভিনয়। মনে আছে তাতে কালী বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন। ইন্দিরা কবিরাজ, এখন খুব বিখ্যাত ইতিহাসবিদ সুদীপ্তর মা, নরহরি কবিরাজের স্ত্রী, তিনি ছিলেন মনে আছে। এই আমার প্রথম নাটক দেখা। বেআইনি গণনাট্য সঙ্ঘে বউদির অভিনয় দেখা। বাড়িতে ফোন ছিল না। অনেক সময় হয়তো বউদি রাত্রে ফিরতে পারতেন না, ওইরকম কিছু একটা দুর্যোগ ঘটেছে, ঘেরাও হয়েছেন, পুলিশ এসে পড়েছে। আমরা কোনো খবরও পাচ্ছি না। বাড়িতে একটু দুশ্চিন্তা থাকে। পরের দিন সকালে বউদি ফিরে এসেছেন। যেটা দিয়ে শেষ করি, বললাম যে আমাদের দোতলা বাড়ি আর ছাদ আর চিলেকোঠা। একতলাতে আমাদের চিঠির বাক্সটা ছিল। চিঠির বাক্সের চাবিটা আমার কাছে থাকত, যেটা আমার খুব শ্লাঘার বস্তু ছিল যে আমাকে বিশ্বাস করে একটা চাবি দেওয়া হয়েছে যেটা আমার কাছেই থাকে। তাই ওই চিঠির বাক্সটা আমি খুলতাম রোজ। প্রায় দেড় মাস দু মাস অন্তর অন্তর দাদার চিঠি আসত, নাসিক রোড সেন্ট্রাল প্রিজন থেকে। চিঠির ওপর নানারকম ছাপ। আমার মনে আছে চিঠির আয়তন চার পৃষ্ঠা পাঁচ পৃষ্ঠা হত। আমরা পুরো পরিবার - বাবা, মা, আমি, বউদি, সুমন্ত আমার আরেক দাদা, সবাই মিলে পড়তাম। আর অনেক লাইন কুৎসিত, কালো, খর অক্ষরে চিহ্নিত হয়ে গেছে। সেই চিঠি আমরা পড়তাম। তার আড়ালে কী আছে, আমরা জানতেও পারতাম না। একটা ভয়, ত্রাস - এটা ছিল। বাবা দাদার এই রাজনৈতিক জীবন বেছে নেওয়াটাকে শুরুতে খুব পছন্দ করেননি। উনি চেয়েছিলেন যে পড়াশোনার জগতেই থাকবে, মাস্টারের ছেলে মাস্টার হবে। একটু আঘাত পেয়েছিলেন। কিন্তু কখনো কোনো বাধা দেননি বা বিরোধও হয়নি। দাদা কারারুদ্ধ হবার পরে বাবা-ই আমাদের বলেছিলেন, ‘আই ফেল্ট আই ওড টু মাই সান টু আন্ডারস্ট্যান্ড হোয়াই হি চোস্ দিস পাথ।’ ছেলের কাছে বাবা হিসেবে আমার দায় এটা বোঝার যে সে কেন এ পথ বেছে নিয়েছে। তার পরে উনি মার্ক্সবাদ পড়তে শুরু করেন। বাবা ভাবতেন পড়েই সবকিছু আয়ত্ত করবেন উনি। যা কিছু ইংরেজি অনুবাদে পাওয়া যায় উনি সংগ্রহ করতে থাকেন মার্ক্স-এর বই। আমি এবং সুমন্ত উত্তরাধিকার সূত্রে মার্ক্স-এর সমস্ত লেখা, মার্ক্সবাদ সম্পর্কে বিভিন্ন লেখার চমৎকার একটা গ্রন্থাগার লাভ করেছিলাম। তার মধ্যে দিয়ে আমাদের মার্ক্সবাদ পাঠের সূত্রপাত। বাবাকে দেখেছি, আমি যখন স্কুলে বা কলেজেও যখন যাচ্ছি, পঞ্চাশের দশকে এসে, বাবার তখন ভাবনা হয়েছে যে মার্ক্সবাদ-এর তত্ত্বের দিকটা বোঝা গেল কিন্তু প্রয়োগটা হচ্ছে সোভিয়েট ইউনিয়নে। সেটা আরো ভেতর থেকে বুঝতে হবে। এবং ইংরেজি অনুবাদ যেটা আসছে, সেটা অপ্রতুল। মার্ক্সবাদের প্রয়োগের ক্ষেত্রে যা-কিছু হচ্ছে তা জানতে গেলে রুশ ভাষাটা শেখা দরকার। বাবা ওই বয়সে রুশ ভাষা শিখতে শুরু করেন। বাবা বই আনাচ্ছেন, অভিধান আনাচ্ছেন, ব্যাকরণ আনাচ্ছেন, খুব দুরূহ ভাষা রুশ, শিখতে শুরু করেন, শেখেন। এবং কোথাও কোথাও যেখানে বাধছে, কোথাও পড়তে যেতে পারেন না তখন। বয়সও হয়ে গেছে বেশি, খুব ঘরোয়া মানুষ, মানে খুব একান্ত মানুষ ছিলেন, মিশতেন না বেশি বাইরে। মাকে ভর্তি করালেন রুশ শিক্ষার ইশকুলে, ধর্মতলা স্ট্রিট-এ একজন রুশ ভদ্রমহিলা, ভারতীয় বাঙালি বিবাহ করে এসেছিলেন, বিয়েটা ভেঙে গেছে, তিনি রুশ শেখান। মা পড়তে যান রুশ। আর আমরা প্রায়ই দেখি রাত্তিরে আমাদের খাইয়ে-দাইয়ে, মা আর বাবা রুশ নিয়ে বসেন। বাবার যা-কিছু প্রশ্ন, যে-কোনো দ্বিধা, সংশয়, আটকে গেছেন, উচ্চারণের সমস্যা বা কোনো বানানের সমস্যা, মাকে বলেছিলেন জেনে এসো মিসেস সাহার কাছ থেকে। মা পড়িয়ে দিচ্ছেন বাবাকে। দু'জন রাত্তিরে বসে পড়ছেন, রুশ ভাষা শিখছেন। এইরকম একটা পরিবেশ ছিল। এই সবগুলো কোথাও যেন কীভাবে আমার জীবনের মধ্যে ঢুকে গেছে। আর এই সব অভিজ্ঞতায় জারিয়ে গড়ে উঠেছে আমার জীবন।
সুধাংশুশেখর দেঃ শমীকদার দীর্ঘদিনের যে যাত্রা, তাকে আবার কিছু মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার প্রচেষ্টায় আমাদের এই ছোট্ট অনুষ্ঠান। আমি প্রকাশক হিসেবে বলতে চাই যে-মানুষটিকে নিয়ে দে’জ অনেক কাজ করেছে, এখনও অনেক কাজ বাকি, শমীকদাকে মনে করিয়ে দিই, বকেয়া সেই কাজগুলো আস্তে আস্তে সেরে নিন। সকলকে ধন্যবাদ। নমস্কার।
________________________________________
কৃতজ্ঞতাঃ দে'জ পাবলিশিং ও সুদেষ্ণা মজুমদার।