আরেক রকম ● দশম বর্ষ ঊনবিংশ-বিংশ সংখ্যা ● ১-৩১ অক্টোবর, ২০২২ ● ১৬ আশ্বিন - ১৫ কার্তিক, ১৪২৯

সম্পাদকীয়

উৎসব-এর আলো ও অন্ধকার


আরেকটি শারদোৎসব অতিবাহিত। বাংলার আকাশে সাদা মেঘের ভেলা, শুভ্র কাশফুল-শিউলির ডালি প্রকৃতির নিয়ম মেনে প্রতি বছর মানুষের মনে এক অদ্ভুত আনন্দের বীজ রোপন করে। মানুষ কটাদিন সেই আনন্দে মেতে থাকতে চায়, উৎসবমুখর পরিবেশে কিছুদিন যাবতীয় দৈনন্দিন গ্লানি, ক্ষোভ, হতাশা পেরিয়ে কিছু সময় আমরা সুখে-শান্তিতে কাটাতে চাই। বিশেষ করে করোনার প্রভাবে গত দুই বছর মানুষের উপর দিয়ে যেই বিপর্যয় গেছে তারপরে এই শারদোৎসব যেন কিছুটা বাড়তি উৎসাহ মানুষের মনে সঞ্চার করেছে। সেটাই স্বাভাবিক। 'আরেক রকম' পত্রিকার তরফ থেকে আমরা আমাদের সমস্ত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী, বন্ধুদের জানাই আন্তরিক শারদ শুভেচ্ছা।

তবু শারদোৎসবের দিনগুলিতে কিছু ঘটনা ঘটল যা প্রমাণ করে যে উৎসবের মধ্যেও অন্ধকারের জীবরা আলোর রোশনাইকে হারিয়ে তাদের উপস্থিতি জানান দেয়। বর্তমানে রাজনৈতিক নেতাদের বদান্যতায় উৎসবের যে সর্বজনীন রূপ থাকা উচিত তা পরিত্যক্ত হয়েছে। রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক ক্ষুদ্র স্বার্থ উৎসবকেও মানুষের স্বতঃস্ফূর্ততার পরিবর্তে রাজনীতির বোড়েতে পরিণত করতে উদ্যত হয়েছে। উৎসবের দিনগুলিতেও রাজনীতির নির্লজ্জ ছবিগুলি আমাদের চোখের সামনে ফুটে উঠেছে, যার কদর্যতা উৎসবের রোশনাইও ঢাকতে পারেনি।

মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী পুজোর উদ্বোধন শুরু করে দিলেন মহালয়ারও আগে থেকে। স্কুল-কলেজ-অফিস সর্বত্র খোলা রয়েছে, অথচ শহরের গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার হাল বেহাল করে পালিত হচ্ছে তৃণমূলের নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতায় বড় হয়ে ওঠা বিভিন্ন দুর্গাপুজোর প্যান্ডেল। প্রবল যানজট, বৃষ্টিতে শহরের নিকাশি ব্যবস্থার করুণ পরিণতি আমরা দেখেছি। কিন্তু রাজ্যের শাসকদলের তা নিয়ে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। মানুষের মধ্যে শুধু উৎসব নিয়ে উন্মাদনা তৈরি করতেই তাদের দেখা গেছে। যাদের আপামর জনসাধারণ হাত পেতে ঘুষ নিতে টিভিতে দেখেছে তাদের অনেকেই বিভিন্ন পুজো কমিটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে বহু বছর ধরে বসে রয়েছেন। আমরা অবশ্য উৎসবের নেশায় এই সমস্ত তুচ্ছ ঘটনাকে খুব বেশি পাত্তা দিতে নারাজ। কারণ ওই যে মিডিয়া এবং বিপণন সংস্থার আবেদন - পুজোর ক'টা দিন সব ভুলে থাকা দরকার - আমাদের মনকে অবশ করে দিয়েছে। ক্ষণিকের আনন্দে মাততে গিয়ে আমরা আমাদের সহনাগরিকদের অসুবিধার কথা ভাবছি না, দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের প্রশ্নচিহ্নযুক্ত টাকায় গড়ে তোলা প্যান্ডেল আমরা উপভোগ করছি কিন্তু টাকার উৎস নিয়ে আমাদের মনে কোনো প্রশ্ন নেই। যেই পুজো কমিটি প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীর বদান্যতায় কলকাতার অন্যতম আকর্ষণীয় স্থল হয়ে উঠেছিল, সেই প্যান্ডেল নিয়ে এই বছর খুব বেশি চর্চা নেই, মুখ্যমন্ত্রী বিগত বছরগুলির মতন তার উদ্বোধনেও যাননি, কারণ কোটি কোটি টাকা তছরুপের অভিযোগে সেই মন্ত্রী আপাতত জেলে। আগামীদিনে এইরকম আরো বেশ কিছু মন্ত্রীর জেলে যাওয়া এবং না যাওয়ার উপর নির্ভর করছে বিভিন্ন পুজো কমিটির ভাগ্য।

উৎসবের শেষলগ্নে উত্তরবঙ্গের মালবাজারে ঘটে গেল ভয়াবহ দুর্ঘটনা। হড়পা বানে প্রতিমা নিরঞ্জন করতে এসে ভেসে গেলেন বেশ কিছু মানুষ। আবারও দেখা গেল প্রশাসনের অপ্রতুল ব্যবস্থা, আগাম বিপদের সম্পর্কে কোনো ধারণা না থাকা, নদীপথ পরিবর্তন করে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাশুল গুনতে হল সাধারণ মানুষকে। প্রতিমা ভাসাতে এসে ভেসে গেল বেশ কিছু পরিবার। কিন্তু তাতে মাননীয়ার সাধের কার্নিভাল বন্ধ হলে চলবে কেন! অতএব উত্তরবঙ্গে যখন স্বজন হারানোর হাহাকার চলছে তখন কলকাতায় ঘটা করে পালিত হল কার্নিভাল। এই অনুষ্ঠানটিকে 'কার্নিভাল' বলাটাও ভুল। কার্নিভাল পৃথিবীর যেই যেই প্রান্তে অনুষ্ঠিত হয় তা হয় মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত উৎসবের মাধ্যমে। দেশ-রাজ্য-শহরের রাজনৈতিক প্রধানের সামনে এসে মাথা ঝুঁকিয়ে প্রণাম করে তার গুণগান করে কার্নিভাল পালিত হয় না। কলকাতার কার্নিভাল আসলে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর পর্বতপ্রমাণ ইগোকে সন্তুষ্ট করার এক সরকারী পরিকল্পনা। ১৫ আগস্ট বা ২৬ জানুয়ারি মুখ্যমন্ত্রীকে সেলাম জানায় তার অধীনস্থ পুলিশ বাহিনী। আর পুজোর কার্নিভালের নামে তাকে সেলাম জানায় বিভিন্ন পুজো কমিটি। দুর্ভাগ্য আমাদের যে এই কর্মকাণ্ডে স্বেচ্ছায় সামিল হয় কলকাতার বিভিন্ন পুজো কমিটি এবং বহু মানুষ। সরকারী দাক্ষিণ্য যদি পুজো কমিটিগুলি পায়, তাহলে সরকারী ফরমানকে না বলার নৈতিক জোর পাওয়ার কথাও না।

কার্নিভাল যেই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার কথা সেখানেই বিগত ৫৫০ দিন ধরে অবস্থান চালাচ্ছিলেন দুর্নীতির মাধ্যমে বঞ্চিত এসএসসি পরীক্ষার্থীরা। কিন্তু হীরক রাজ্যে ‘ভরসাফূর্তি’ উৎসব হলে এই সব প্রতিবাদীদের রাস্তায় ছেড়ে রাখলে মাননীয়ার অপমান হবে। তাই পুলিশ বিক্ষোভকারীদের অবস্থান করার অনুমতি বাতিল করে। কিন্তু তারপরেও কিছু জেদী প্রতিবাদী অকুস্থলে ফিরে এসে কার্নিভালের মজা নষ্ট করে দিতে পারে বলে অবস্থানস্থলকে ঘিরে ফেলা হয় সাদা কাপড় দিয়ে, যাতে তা দেখা না যায়। সত্যজিৎ রায় বেঁচে থাকলে একবিংশ শতাব্দীর প্রেক্ষিতে নতুন সিনেমা তৈরি করতেন, নাম রাখতেন ‘হীরক রানীর দেশে’।

বিরোধী কন্ঠকে রুদ্ধ করে দেওয়ার তৃণমূলী সংস্কৃতির কদর্য নমুনা দেখা গেল কলকাতায়। শারদোৎসবের দিনগুলিতে বামপন্থীরা বহু বছর ধরে 'মার্কসীয় প্রগতিশীল সাহিত্য বিক্রয় কেন্দ্র' গড়ে তোলেন গোটা রাজ্যজুড়ে। এইবারও তার অন্যথা হয়নি। কিন্তু প্রগতিশীল সাহিত্য বিক্রি তৃণমূলের মস্তানদের পছন্দ হয়নি। তাই বেশ কিছু জায়গায় বামপন্থীদের বিপণি ভেঙে দেওয়া হয়। বিশেষ করে কলকাতার রাসবিহারী অঞ্চলে স্টল ভেঙে দেওয়ার প্রতিবাদে যখন বামপন্থী কর্মীরা একত্র হয়ে স্টলটিকে পুনরায় চালু করতে যায় তখন পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে। ইউনেস্কোকে এই খবর দিলে মাননীয়ার পুলিশের সম্মানার্থে ইউনেস্কো ঘোষণা করতে পারে যে বই বিক্রি করার অপরাধে পৃথিবীতে একমাত্র তৃণমূলের পুলিশই পারে কাউকে গ্রেপ্তার করতে। বোঝাই যাচ্ছে উৎসবের আবহেও পশ্চিমবঙ্গের গণতান্ত্রিক পরিবেশের অধঃপতনের কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি।

অথচ এই শারদোৎসবের সর্বাধিক ঘৃণ্য যেই ঘটনাটি ঘটে তা নিয়ে পুলিশের তৎপরতা দেখা যায়নি, কাউকে গ্রেপ্তারও করতে হয়নি। 'হিন্দু মহাসভা' পরিচালিত একটি মণ্ডপে জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীকে অসুরের জায়গায় বসানো হয়। অর্থাৎ দুর্গা মহিষাসুর নয়, হত্যা করছেন গান্ধীজিকে। স্পষ্টত এই বার্তাই হিন্দু মহাসভা দেওয়ার চেষ্টা করে যে গান্ধীর হত্যাকারী নাথুরাম গডসে দুর্গার আশীর্বাদধন্য। হিন্দু ধর্মের এমন কদর্য ব্যবহার দেখে হিন্দুত্ববাদীদের তরফে বিশেষ কোনো প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়নি, কারণ তারাই গান্ধীর হত্যাকারী। কিন্তু যেই বীর পুঙ্গবেরা পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুত্ববাদীদের আটকানোর একচেটিয়া স্বত্ত্ব নিয়ে রেখেছে বলে দাবি করে, সেই তৃণমূলীদের কাউকে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে দেখা যায়নি। পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করেনি, শুধু গান্ধীবেশী অসুরের রূপ পরিবর্তন করিয়েছে। অর্থাৎ ২০২২ সালের শারদোৎসব আমাদের এই বার্তাই দিচ্ছে যে পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীরা বই বিক্রি করতে চাইলে তাদের উপর আক্রমণ হবে এবং পুলিশ তাদেরই গ্রেপ্তার করবে, কিন্তু হিন্দুত্ববাদী 'হিন্দু মহাসভা' মহাত্মা গান্ধীকে অবমাননা করলেও তার বিরুদ্ধে পুলিশ কোনো পদক্ষেপ নেবে না। এই কদর্যতারও সাক্ষী থেকে গেল এবারের শারদোৎসব!

শেষে 'আরেক রকম' পত্রিকার তরফ থেকে আমরা আপনাদের সবাইকে জানাই অভিনন্দন, আমাদের পাশে থাকার জন্য। 'আরেক রকম' সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীল, সাম্প্রদায়িক এবং স্বৈরাচারী প্রবণতার সর্বাত্মক বিরোধিতা করবে। এই অবস্থানে আমরা স্থিতধী হতে পারি আপনাদের সমর্থন এবং সহযোগিতায়। বহু বন্ধু আমাদের কাছে 'আরেক রকম' ছাপানোর দাবি জানাচ্ছেন। আপনাদের দাবির ন্যায্যতা মেনে নিয়েও আমরা সবিনয়ে এবং দুঃখের সঙ্গে জানাই যে, আপাতত আমাদের সাংগঠনিক পরিস্থিতি পত্রিকা ছাপানোর পক্ষে অনুকূল নয়। আমরা চেষ্টা করছি পত্রিকা ছাপিয়ে প্রকাশ করার। তবে তার জন্য আমাদের আরো কিছু সময় লাগবে। আমরা আশা করি আপনারা ‘আরেক রকম’-এর পাশে থাকবেন।