আরেক রকম ● দশম বর্ষ অষ্টাদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ● ১-১৫ আশ্বিন, ১৪২৯

প্রবন্ধ

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ - একটি পর্যালোচনা

সমীরণ সেনগুপ্ত ও ঋক চট্টোপাধ্যায়


২০২০ সালের ২৯শে জুলাই কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় 'জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০' অনুমোদিত হয়। এই শিক্ষানীতির তিনটি প্রধান বৈশিষ্ট্য - প্রথমত দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার কেন্দ্রীকরণ, দ্বিতীয়ত দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় যে বৈষম্য রয়েছে তাতে সরকারি অনুমোদন এবং আধুনিকীকরণের পরিবর্তে পশ্চাদপদতা। আমাদের দেশে শিক্ষানীতি, শিক্ষা সংক্রান্ত কমিশন গঠনের ইতিহাস আছে, জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ ঘোষণা করে বর্তমান সরকার নতুন কোনও কাজ করেনি। ১৯৪৮-৪৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কমিশন, ১৯৫২-৫৩ সালে উচ্চশিক্ষা কমিশন গড়ে তোলা হয়েছিল। ১৯৬৪ সালে বিজ্ঞানী এবং শিক্ষাবিদ দৌলত সিং কোঠারিকে সভাপতি করে গঠন করা হয় কোঠারি কমিশন, এই কমিশন সরকারের কাছে তাদের রিপোর্ট প্রদান করে ১৯৬৬ সালে। ১৯৬৮ সালে এই রিপোর্টের ভিত্তিতে ঘোষণা করা হয় দেশের শিক্ষানীতি। পরবর্তীতে ১৯৮৬ সালে লোকসভায় গৃহীত হয় নতুন শিক্ষানীতি - The Challange of Education - A Policy Perspective। ১৯৯২ সালে এই শিক্ষা নীতিটিকে আপডেট করা হয়েছিল। ২০০৯ সালে পাশ হয় রাইট অফ চিলড্রেন টু ফ্রি অ্যান্ড কমপালসারি এডুকেশন আ্যক্ট ২০০৯। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০-তে অতীতের শিক্ষানীতিগুলোর বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন থাকবে এমনটাই স্বাভাবিক, অথচ বর্তমান শিক্ষানীতিতে এসব কিছুই নেই। অতীতের শিক্ষানীতি সম্পর্কে এক লাইনে লেখা হয়েছে যে, এই নীতিসমূহ সমতা এবং শিক্ষার বিস্তারে প্রাধান্য দিয়েছিল। অর্থাৎ শিক্ষায় উৎকর্ষতার দিকটি যেন এতদিন অধরাই ছিল, বর্তমান সরকার এই কাজটাই করবে। শিক্ষায় সমতা এবং উচ্চমান যেন পরস্পরের প্রতিপক্ষ, এমনই এক ধারণা সরকার প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে।

ভারতের সংবিধান অনুযায়ী শিক্ষা, কেন্দ্র এবং রাজ্যের যুগ্ম তালিকায় রয়েছে অথচ রাজ্যগুলোর সাথে বিস্তারিত আলাপ আলোচনা না করে এমনকি লোকসভাতেও আলোচনা না করে, করোনা অতিমারীর দাপটে দেশের মানুষ যখন অক্সিজেন সিলিন্ডার, হাসপাতালে বেড পাওয়ার জন্যে হন্যে হয়ে ঘুরছেন দেশের সরকার সেই সময়ে সুষ্ঠু স্বাস্থ্যনীতির কথা না ভেবে শিক্ষানীতি প্রকাশ করে। লোকসভা, রাজ্যসভায় বিতর্ক এড়িয়ে গিয়ে ৬৬ পাতার যে দলিলটি কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায় গৃহীত হয়েছে তাতে দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোটিকেই অস্বীকার করা হয়েছে। 'জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০' এই দিক দিয়ে অবশ্যই স্বতন্ত্র। এই শিক্ষানীতির ১৭.৯ নম্বর ধারায় ন্যাশনাল রিসার্চ ফাউন্ডেশন (NFR) গঠন করার কথা বলা হয়েছে। ১৭.১০ এবং ১৭.১১ ধারায় NRF-এর কাজের পরিধি যা উল্লেখিত হয়েছে তাতে বোঝাই যাচ্ছে দেশের গবেষণাধর্মী যে কোনো কাজের ক্ষেত্রে এই সংস্থার অনুমোদনই প্রধান হয়ে উঠবে। NRF-এর খেয়ালখুশি মতো চলবে দেশের গবেষণার কাজ। ১৮.২ ধারায় বলা হয়েছে হায়ার এডুকেশন কমিশন অফ ইন্ডিয়া (HECI) গঠন করার কথা। এই HECI-এর আন্ডারে থাকবে চারটি ভার্টিকাল সংস্থা তার মধ্যে একটি হল ন্যাশনাল হায়ার এডুকেশন রেগুলেটরি অথোরিটি (NHERA)। বর্তমানে লোকসভা অথবা রাজ্য বিধানসভা উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান স্থাপনের অনুমতি দিয়ে থাকে, নতুন নীতি অনুযায়ী NHERA-এর স্বীকৃতি এক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক। বোঝাই যাচ্ছে বর্তমান শিক্ষানীতিতে রাজ্যগুলোর ভূমিকা খর্ব করে ছড়ি ঘোড়াবে HECI। শিক্ষানীতির ৪.৩.১ নং ধারায় পাঠ্যক্রমের বিষয়বস্তুকে নমনীয় করতে কী নিদান দেওয়া হয়েছে? লেখা হয়েছে জাতীয় পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে বিবেচিত মূল উপাদানগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তবে স্থানীয় স্তরে প্রেক্ষাপট এবং প্রয়োজন অনুসারে পছন্দসই সংক্ষিপ্ত সার ও পরিপূরক উপাদান যোগ করতে হবে। জাতীয় স্তরে গুরুত্বপূর্ণ অথচ স্থানীয় স্তরে প্রয়োজন অনুযায়ী পছন্দসই? অর্থাৎ রাজ্যের সাংবিধানিক অধিকারকেই কেবল খর্ব করা হচ্ছে না, আঞ্চলিক সংস্কৃতি, ইতিহাসের উপর নির্ভর করে শিক্ষার বহুমুখীনতার যে ধারনা তাকেও খর্ব করার এক প্রচেষ্টা এই শিক্ষানীতির অন্যতম অনুপ্রেরণা।


চিত্র ১. বিগত শিক্ষানীতি এবং বর্তমান শিক্ষানীতির তুলনামূলক প্রভেদ। (চিত্রসুত্রঃ জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০)

চিত্র ১ অনুযায়ী নতুন শিক্ষা নীতিতে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের দিয়ে প্রাক-বিদ্যালয় শিক্ষা প্রদানের কথা বলা হয়েছে। এই কর্মীদের নাকি অনলাইন প্রশিক্ষণ দিয়ে বর্তমান কাজের পাশাপাশি নতুন কাজের জন্য প্রস্তুত করা হবে। এমনিতেই অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের স্বল্প ভাতা দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়া হয়, এঁনাদের উপর এই ধরণের চাপ দিয়ে সকলের জন্য নাকি উন্নত শিক্ষার ব্যবস্থা হবে! আর্থিকভাবে তুলনায় সচ্ছল পরিবারের কেউই অঙ্গনওয়াড়ি স্কুলগুলোতে পড়ে না, তারা পড়ে বেসরকারি স্কুলগুলোতেই, এই নতুন নিয়মে সরকারি ব্যবস্থায় উন্নত শিক্ষার বদলে চালু প্রথাতেই আসলে সরকারের শিলমোহর পড়ে গেল। তুলনায় অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে-মেয়েরা পড়বে বেসরকারি স্কুলে আর গরীবের সন্তানের জন্য বরাদ্দ সরকারি স্কুল, অথবা তারা পড়বে না।

এতদিন পর্যন্ত দেশের প্রতিটা গ্রামে একটা স্কুল ছিল। অন্তত খাতায় কলমে ছিল, খানিক লেখাপড়ার সুযোগ ছিল সকলেরই। নতুন নীতিতে সরকার বলছে প্রতি গ্রামে বা পাড়ায় আর স্কুলের দরকার নেই। বহু স্কুলে এমন আছে যেখানে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ৩০-এরও কম। এই ধরণের স্কুলগুলো নাকি অর্থের অপচয়। তাই এসব তুলে দিয়ে স্কুল ক্লাস্টার-এর ধারণা নিয়ে আসা হয়েছে। নতুন নীতিতে (৭.৬ ধারা) বলা হচ্ছে ৫ থেকে ১০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে একটা সেকেন্ডারি স্কুল বাড়ি তৈরি করা হবে যার মধ্যেই নিচের স্তরের ক্লাসও করানো হবে অঙ্গনওয়াড়ি সহ। শিক্ষা ব্যবস্থাটাকে যে সরকার এক করুণ পরিহাসে পর্যবসিত করেছে তা বোধহয় এই একটা সিদ্ধান্তেই বোঝা যায়। সরকারি স্কুল থাকা স্বত্ত্বেও ছেলে-মেয়েরা কেন সেই স্কুলে পড়তে যাচ্ছে না তা যথাযথভাবে অনুসন্ধান না করে তারা পাড়া বা গ্রাম থেকে স্কুলটাই তুলে দিতে চায়! বাড়ি থেকে এক দু' কিলোমিটার দূরে যে ছেলে-মেয়েরা পড়তে যাচ্ছে না সেই ছেলে-মেয়েরাই ১০ কিলোমিটার দূরে প্রতিদিন পড়তে যাবে? এভাবেই ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের সব শিশুর বিদ্যালয় শিক্ষা সুনিশ্চিত হবে?

বর্তমানে দেশে এক লক্ষ দশ হাজার নয়শো একাত্তরটি স্কুল আছে যেখানে শিক্ষকের সংখ্যা মাত্র একজন (স্টেট অফ এডুকেশন রিপোর্ট ফর ইন্ডিয়া ২০২১, ইউনেস্কো), এই স্কুলগুলোর ৮৯% গ্রামে অবস্থিত। শিক্ষক ছাত্রের অনুপাত ৩৫:১ হিসাবে গ্রামীণ এলাকার স্কুলগুলোয় ৬৯% শিক্ষক/শিক্ষিকার পদ খালি পড়ে রয়েছে। শিক্ষানীতিতে শিক্ষায় কাঠামোগত পরিবর্তন সংক্রান্ত গালভরা কিছু শব্দের ব্যবহার থাকলেও শিক্ষক নিয়োগের আশু প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনও কথা লেখা নেই। নতুন শিক্ষানীতির মাধ্যমে দেশের সরকার আসলে দুই ধরণের সমান্তরাল শিক্ষা ব্যবস্থায় সরকারি অনুমোদন দিতে চাইছে। এক ব্যবস্থায় উচ্চবর্গের অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে-মেয়েদের জন্য অন্য ব্যবস্থায় পড়ে থাকবে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে থাকা পরিবারের ছেলে-মেয়েরা।

দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় একটা বড়ো সমস্যা ড্রপ আউট বা স্কুলছুট ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যা। প্রাথমিক স্তর থেকে যত উপরের দিকে ওঠা যায় গ্রস এনরোলমেন্ট রেশিও (GER) তত কমতে থাকে। অর্থনৈতিক এবং নানা ধরণের সামাজিক প্রতিবন্ধকতাই মাঝপথে স্কুল ছেড়ে দেওয়ার প্রধান কারণ হওয়ায় তপশিলী সম্প্রদায়, আদিবাসী, ওবিসি অংশের ছেলেমেয়েদের উচ্চবর্ণের ছেলেমেয়েদের তুলনায় স্কুলছুটের সংখ্যাও বেশি। পাশাপাশি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েরা, মাইগ্রেশন ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে মাঝপথে পড়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় অনেকেই। মূল শিক্ষা ব্যবস্থায় এদেরকে যুক্ত করার বদলে নতুন শিক্ষানীতিতে বলা হচ্ছে সশরীরে স্কুলে গিয়ে পড়ায় যখন এদের অসুবিধে হচ্ছে সেক্ষেত্রে ওপেন ডিসটান্স লার্নিং (ODL)-এর মাধ্যমে এদের বিকল্প সার্টিফিকেট (A, B, C) দেওয়া হবে। ভোকেশানাল ট্রেনিং বা বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে এক্ষেত্রে গণ্য করা হবে। একদল প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ডাক্তার, ব্যারিস্টার, ইঞ্জিনিয়ার সরকারি আমলা হবে, অন্য একদল এদের বাড়িতে কলের মিস্ত্রী কিংম্বা ইলেকট্রিক ফিটিংসের কাজ করবে। এই বিভাজন যে বর্তমান সমাজে নেই তা নয় কিন্তু পুর্বতন শিক্ষানীতিতে অন্তত এই সমস্যাকে মেনে নিয়ে তা সমাধানের উপায় খোঁজার প্রয়োজনীয়তাকে সরকারি দায়বদ্ধতা হিসাবে দেখার সুযোগ ছিল। কিন্তু এই নতুন শিক্ষানীতির প্রণয়ন করে সরকার বিভাজন তুলে দেওয়ার বদলে বিভাজনকে সরকারি অনুমোদনই দিয়ে দিচ্ছে। এরা ধরেই নিয়েছে শিক্ষার ক্ষেত্র থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা যত দূরে সরে যাবে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ততোই উন্নত থেকে উন্নততর হয়ে উঠবে। বিজেপি-আরএসএস-এর এই ব্রাহ্মণ্যবাদী মানসিকতার প্রতিফলনই এই শিক্ষানীতির ছত্রে ছত্রে। এই কারণেই স্নাতক স্তরেও যারা মাঝপথে ছেড়ে দেবে তাদের সার্টিফিকেট হাতে ধরিয়ে বিদায় জানানো হবে। এই অদ্ভুত শিক্ষানীতিতে লাভ কাদের হবে? খেয়াল করে দেখুন মাঝপথে পড়া ছেড়ে দিয়ে সার্টিফিকেট পেয়ে যাওয়া শিশু/কিশোর/যুবকদের ফেলোশিপ আ্যাপ্রেনটিস ইত্যাদির আড়ালে কম মাইনে দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়া যাবে একই সাথে শ্রম আইনও লঙ্ঘন হবে না।

নতুন শিক্ষানীতিতে প্রাক-প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত প্রতিটি স্তরেই প্রযুক্তির ব্যবহার ইন্টারনেট সংযোগে জোর দেওয়া হচ্ছে। চিত্র ২-তে দেশের স্কুলগুলোতে রাজ্যভিত্তিক মোট স্কুল সংখ্যার পরিপ্রেক্ষিতে ইন্টারনেটের সংযোগ শতাংশে দেখা যাচ্ছে। নতুন জাতীয় শিক্ষানীতিতে কোঠারি কমিশনের কোনও উল্লেখ না থাকলেও ১৯৬৮ সালেই প্রস্তাবিত সেই জিডিপির ৬ শতাংশে শিক্ষা খাতে ব্যয় করার কথাই বলা হয়েছে। বস্তুত শিক্ষা ব্যবস্থায় জিডিপির ৬ শতাংশ ব্যয় করার দাবি দীর্ঘদিন ধরেই দেশের গণতান্ত্রিক ছাত্র শিক্ষক সংগঠনগুলো করে এসেছে। অথচ ২০২২-২৩ অর্থবর্ষের বাজেটেও শিক্ষায় ব্যয়বরাদ্দ হয়েছে জিডিপির ৩.২ শতাংশ। স্কুল থেকে ড্রপ আউট কমানোর লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে জাতীয় শিক্ষানীতি ঘোষণা করেছে যে, সরকার সেই সরকারেরই বাজেটে স্কুল শিক্ষা দপ্তরের বরাদ্দ ৫৯,৮৪৫ কোটি থেকে ৫,০০০ কোটি কমে বর্তমান অর্থবর্ষে বরাদ্দ হয়েছে ৫৪,৮৭৩ কোটি (বাজেট সংক্রান্ত আলোচনা, সপ্তদশ লোকসভা, ০৯/০৭/২২)। ২০০৯ সালে আইনসভায় পাশ হওয়া শিক্ষার অধিকার আইন দেশের সকল ৬ থেকে ১৪ বছর বয়সী ছেলে-মেয়েদের জন্য বিনা ব্যয়ে বাধ্যতামূলক সমমানের উন্নত শিক্ষার কথা বলেছে। অথচ নতুন শিক্ষানীতি এই আইনকে বৃদ্ধাঙ্গষ্ঠু দেখিয়ে প্রাক-প্রাথমিক স্তর থেকেই শিক্ষায় অসমতাকে সরকারি অনুমোদন দিয়ে শুধুমাত্র অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল এবং উচ্চবর্নের ক্ষুদ্র এক অংশের কথা বিবেচনায় রেখে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ তৈরি করেছে।


চিত্র ২. দেশের ইন্টারনেট সুবিধাযুক্ত বিদ্যালয়ের সংখ্যা। (চিত্রসুত্রঃ জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০)

নতুন শিক্ষানীতির ভাষা সংক্রান্ত ২২ নম্বর ধারাটি বোধহয় সর্বাধিক স্ববিরোধীতায় ঠাসা। মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা প্রদানের কথা বলা হয়েছে, ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাকেও চালিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে আবার বহু ভাষাকে মাতৃভাষার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। হিন্দি ভাষায় গুরুত্ব দিয়ে সংস্কৃত, পারসি, পালি ইত্যাদি ভাষাকে ঐতিহ্যবাহী আখ্যা দিয়েছে অথচ উর্দু ভাষা সম্পর্কে কোনও কথা বলেনি। মাতৃভাষাতেও শিক্ষাদান চলবে, ইংরেজি ভাষাতেও চলবে, আবার সমতাও বজায় থাকবে? এই ধারাতে বলা হচ্ছে, এই জাতীয় শিক্ষানীতি আদতে ভারতবর্ষের নিজস্বতা এবং তার বৈচিত্র্য যাতে যথার্থভাবে শিক্ষায় প্রতিফলিত হয় তার জন্যই এই শিক্ষানীতি। ২২.১ থেকে ২২.১৪ নম্বর ধারায় রচয়িতারা অনেক কথা বলতে চেয়েছেন, কিন্তু বাস্তবে কি করতে চাইছেন তা কোনোভাবেই পরিষ্কার হয়না। একবার তাঁরা জোর দিচ্ছেন দেশের নিজের ভাষাগত, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যের বৈচিত্রকে পাঠ্যের অন্তর্ভুক্ত করতে, আবার পরক্ষণেই তারা জোর দিচ্ছেন এক বিশেষ ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর। আমাদের এই ভারতবর্ষ যে একাধিক সংস্কৃতি, একাধিক জনজাতির একটি যূথ তা হয় রচয়িতারা মানেন না, অথবা কিভাবে এমন বৃহৎ যূথকে নিজের মত চলতে দিতে হয় সে সম্পর্কে ধারণাবিহীন। আসলে বর্তমান কেন্দ্রের শাসকদল যে ভারতীয় ঐতিহ্য বলতে কেবল উত্তর ভারতীয়, বিশেষত হিন্দী সংস্কৃতিকেই বোঝেন তা এই ধারার ছত্রে ছত্রে প্রকৃষ্ট। প্রথাগত শিক্ষার পাঠক্রমে তারা ভারতীয় সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্তি বলতে বোঝেন কেবল ভাষাগত শিক্ষা এবং স্থানীয় শিল্পের চর্চা। তাই একদিকে বলা হচ্ছে সমস্ত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন ভাষাশিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, এবং তার জন্য উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে, অন্যদিকে স্থানীয় শিল্পচর্চাকে অন্তর্ভুক্ত করতে তারা স্থানীয় কারিগরী শিল্পীদের প্রতিষ্ঠানে নিয়ে এসে ছাত্র-ছাত্রীদের সেইসব হাতের কাজ শেখানোর নিদান দিচ্ছেন।

আর এর যুক্তি হিসাবে যে কাজের বাজারের কথা উল্লেখ করেছেন তা আরও হাস্যকর। রচয়িতারা দাবি করেছেন পর্যটকদের কাছে এইসব স্থানীয় পণ্যের বিরাট চাহিদা এবং সেই সাথে গোটা দেশ জুড়ে দোভাষীকের কাজের নাকি প্রভূত চাহিদা। ফলে পাঠক্রমে এই বিষয়গুলো যুক্ত হলে ভারতীয় ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার শিক্ষায় বাহিত হবে। যে কোনো বিচক্ষণ মানুষই জানেন যে এই স্থানীয় শিল্পের পরম্পরা প্রথাগত শিক্ষার হাত না ধরেই বহুকাল ধরে প্রজমান্তরে বহমান থেকেছে। আর 'ভাষা বলতে শেখা' মানুষ নিজের তাগিদেই করে নেন। আমাদের প্রত্যেকের এরকম একাধিক পরিচিত আছেন যারা কর্মসূত্রে ভিন রাজ্য বা দেশে থাকার সুবাদে সেখানকার ভাষা বলতে শিখে নিয়েছেন। এমনকি প্রথাগত শিক্ষার সুযোগ না পাওয়া একজন পরিযায়ী শ্রমিক ও ভিন রাজ্যে কাজে গেলে সেখানকার ভাষা মোটামুটি বোঝার মত নিজেকে শিক্ষিত করে নেন। এছাড়া, আমাদের দেশের কম বেশি সমস্ত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই ভাষা নিয়ে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পাঠক্রম থাকে। তাতে ছাত্র-ছাত্রীরা ভর্ত্তি হন এবং ডিগ্রি নিয়ে পাশও করেন। যদিও তাদের সবাই বহুভাষীকের কাজ পান কিনা তা সন্দেহের। কার্যক্ষেত্রে অনেককেই অন্য পেশায় যেতে হয়। ফলে নতুন করে আরও বহুভাষিক সৃষ্টি করে দেশের বেকারত্বের ছবি কতটা পাল্টাবে তা বোঝা যায় না।

তাহলে প্রশ্ন হল ভারতীয় ঐতিহ্য নিয়ে জাতীয় শিক্ষানীতিতে এতগুলো পাতা খরচ করতে হল কেন? প্রশ্নের উত্তর মেলে ২২.১৫ ধারায় গিয়ে। সেখানে নীতির প্রণেতারা বলছেন সংস্কৃত পাঠশালা বা বিশ্ববিদ্যালয় গঠন করতে হবে, কারণ ভারতীয় সংস্কৃতির সিংহভাগের ধারক বাহক হল সংস্কৃত ভাষা। তাই দেশজুড়ে সংস্কৃত চর্চাকে উৎসাহিত করতে হবে যাতে প্রাচীন ভারতীয় পুঁথিগুলোর জ্ঞানকে সবার ভিতর ছড়িয়ে দেওয়া যায়। ভারতীয় ঐতিহ্যের ধারক কি কেবল সংস্কৃত ভাষা এবং দেবনাগরীতে লিখিত বেদ, উপনিষদ বা পুরাণ? দ্রাবিড়িয় সভ্যতা বা দেশের আদিবাসী বা মূলনিবাসী মানুষদের ইতিহাস, সংস্কৃতি তো তার চেয়েও প্রাচীন। তাহলে এইসব ভাষা বা সংস্কৃতি নিয়ে কোন আলোচনা এই শিক্ষানীতিতে নেই কেন? কেবল বেদ বা পুরাণ নিয়ে এত মাথাব্যথা কেন? আসলে এই শিক্ষানীতির অন্যতম উদ্দেশ্যই হল শিক্ষার ঐতিহাসিক বিবর্তনকে অস্বীকার করা এবং ঐতিহ্যের নাম করে ইতিহাস বিবর্জিত এক উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা যা বাস্তব বিচ্ছিন্ন এবং একমাত্রিক। যেখানে ইতিহাসের নামে, ঐতিহ্যের নামে, বিজ্ঞানের নামে কিছু ভ্রান্ত তথ্য সরবরাহ করা হবে এবং তাকেই সত্য হিসাবে গেলানো হবে। প্রথাগত শিক্ষা যা মানুষকে প্রশ্ন করতে শেখায় তা বিজেপি-আরএসএস-এর কাছে খুবই সমস্যার। তাই এই শিক্ষার নিহিত নির্যাসটাকেই এরা নস্যাৎ করতে চায়। এরা চায় এমন এক শিক্ষা ব্যবস্থা যেখানে ইতিহাসের নামে শেখানো হবে যে কোন এক বীর পুরুষ জেল থেকে বুলবুলি পাখির পিঠে চেপে স্বদেশ ভ্রমণে আসতেন, বিজ্ঞানের নামে শেখানো হবে রামায়ণের পুষ্পক রথ হল প্রাচীন ভারতীয় বিমান, বলা হবে আধুনিক বিজ্ঞানের সব সূত্রই 'ব্যাদে আছে', যেখানে পড়ানো হবে ভারতবর্ষ মানে কেবল হিন্দিভাষী এক দেশ যার জাতীয় ধর্ম হল হিন্দুত্ববাদ। আর সেই লক্ষ্যেই এই জাতীয় শিক্ষানীতির অবতারণা। এখানে পূর্ববর্তী সমস্ত জাতীয় শিক্ষানীতিকে অস্বীকার করা হয়েছে, শিক্ষায় রাজ্যের সাংবিধানিক অধিকারকে যারপরণাই খর্ব করা হয়েছে এবং এই প্রবল কেন্দ্রিকরণের মাধ্যমে শিক্ষার নামে অপশিক্ষার রাস্তা তৈরী করা হয়েছে। আর অন্যদিকে এই শিক্ষানীতি একাধারে সামাজিক বৈষম্যকে কেবল মেনেই নেয়নি, শিক্ষায় সেই বৈষম্যের প্রভাবকে প্রাতিষ্ঠানিক মান্যতা দিয়েছে এবং বৃহৎ পুঁজির জন্য সস্তার শ্রমিক জোগানোর পদ্ধতিকে আইন সম্মত করেছে। এরকম আদ্যন্ত বৈষম্যমূলক ভ্রান্ত শিক্ষানীতি অবিলম্বে ছুঁড়ে ফেলতে হবে। অবিলম্বে প্রয়োজন শিক্ষার সাথে যুক্ত সমস্ত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে নিয়ে এর বিরুদ্ধে এক জোরালো প্রতিবাদ গড়ে তোলা।