আরেক রকম ● দশম বর্ষ অষ্টাদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ● ১-১৫ আশ্বিন, ১৪২৯

প্রবন্ধ

বিশ্ববিদ্যালয় Ranking-এর নেপথ্যে

স্বাতী মৈত্র


গত মাসের শুরুর দিকে আমার সামাজিক মাধ্যমের বৃত্তে একটি সুন্দর দৃশ্য চোখে পড়ে। কলেজে ক্লাস শেষ করে দরজা খুলে একজন অধ্যাপক বেরিয়ে আসছেন। ওদিকে ক্লাসের বাইরে তাঁরই অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন সারি সারি প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী। অধ্যাপককে দেখেই শুরু হল তাঁদের হাততালি, চলল প্রায় ১০ মিনিট ধরে! সেটাই আসলে তাঁর শেষ ক্লাস, তাই সংবর্ধনা দেওয়ার জন্য কাজ ফেলে ছুটে এসেছিলেন প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরাও।

দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু সময় কাটানোর সুবাদে এই অধ্যাপক আমার স্বল্প পরিচিত। কিরোরিমল কলেজের ইংরেজি বিভাগের (অধুনা প্রাক্তন) অধ্যাপক কেবল অরোরা যে সুশিক্ষক ও লেখক-সমালোচক তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই, কিন্তু ‘কেবল’ নামে সর্বত্র পরিচিত এই অধ্যাপকের খ্যাতি তাঁর ক্লাসরুমের বাইরের পরিসরে কিছু কর্মকান্ডের সুবাদে। কিরোরিমল কলেজের ছাত্র-পরিচালিত ড্রামাটিক্স সোসাইটি ‘দা প্লেয়ার্স’-এর শিক্ষক-কর্ণধার ছিলেন কেবল। ১৯৫৭ সালে ফ্র্যাঙ্ক ঠাকুরদাসের হাতে গঠিত এই থিয়েটার গ্রুপটি অমিতাভ বচ্চন থেকে হালের সুশান্ত সিং রাজপুত অথবা জীশান আয়ুবদের তৈরি করেছে। দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের জনপ্রিয় অ্যামেচার থিয়েটার কম্পিটিশনগুলিতে আজকেও ‘দা প্লেয়ার্সের’ দাপট কম নয়। নেহাতই অবানিজ্যিক এই ছাত্র-পরিচালিত ‘সোসাইটিগুলি’ (অনুষ্ঠানে স্পন্সররা থাকেন অবশ্য) দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পদ বললেও কম বলা হয়। লেখাপড়ার বাইরে মানুষ তৈরির কারখানা থেকে বিনোদন, প্রেম-বন্ধুত্ব, অনেক কিছুর মূলে দা প্লেয়ার্সের মতন একেকটি সমিতি। তার কর্ণধারকে অবসরের মুহূর্তে সংবর্ধনা দিতে যে প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরা এগিয়ে আসবেন, তা হয়তো প্রত্যাশিত।

কেবলের সুদীর্ঘ চার দশকের কর্মজীবন ও অবসর প্রসঙ্গে ভাবতে ভাবতে কিরোরিমল কলেজের ওয়েবসাইটটাও ঘুরে এসেছিলাম সেদিন, অলস কৌতূহলে। ২০২২ সালে ন্যাশনাল ইন্সটিটিউশনাল Ranking ফ্রেমওয়ার্কের (এনআইআরএফ) মাপকাঠিতে তাঁরা সর্বভারতীয় দশম হয়েছেন, এও নিঃসন্দেহে বড় ব্যাপার। এর আগে তাঁরা ন্যাশনাল অ্যাসেসমেন্ট অ্যান্ড অ্যাক্রেডিশন কাউন্সিলের (ন্যাক) পঞ্চবর্ষীয় মাপদন্ডে A+ গ্রেড পেয়েছিলেন। ন্যাক, এনআইআরএফ সমূহ Ranking-এর মাপকাঠির সাথে কর্মসূত্রে পরিচিত হতে হয়েছে অনেকদিন। আপন মনে ভাবছিলাম, প্লেয়ার্স, মিউসোক বা পরিবর্তনের মতন প্রাণবন্ত ছাত্র সমিতির স্থান এনআইআরএফের কোন সরকারি প্যারামিটারে হয়ে থাকে সাধারণত? আউটরিচ অ্যান্ড ইনক্লুসিভিটি (ওআই) বিভাগে ‘পার্সেপশন’ Ranking (পিআর), নাকি পিয়ার পার্সেপশন নামক আলাদা বিভাগে অ্যাকাডেমিক পিয়ার্স অ্যান্ড এমপ্লয়ার্সের মাপদন্ডে? সফল অভিনেতা অথবা সঙ্গীতকারেরা প্রাক্তন ছাত্র হলে সেটা এমপ্লয়ার্স পার্সেপশনে কতটা জায়গা পায়? ন্যাকের মূল্যায়নের সময় অমিতাভ বচ্চন স্বয়ং এসে কথা বললে A+ গ্রেডটা A++ হতে পারতো কি? একজন অধ্যাপকের ক্লাসে লেখাপড়ার প্রতি দায়িত্বের বাইরেও একটি অবৈতনিক, অবাণিজ্যিক ছাত্র সমিতির প্রতি যে অঙ্গীকার, তার মান নির্ধারণের মাপকাঠি কোনটা?

এ সবই এলোমেলো চিন্তা। তবে, শিক্ষাজগতের - বিশেষত উচ্চশিক্ষা জগতের - বর্তমান অভিমুখের প্রেক্ষিতে এ সমস্ত বিষয় হয়তো পুরোপুরি অপ্রাসঙ্গিক নয়। আমার এই আলোচনার মূল অভিমুখ কোন একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা জনৈক অধ্যাপক নন। গত কয়েক বছরের মতন এ বছরও ১৫ জুলাই কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রকের দ্বারা এনআইআরএফ তালিকা প্রকাশিত হয়। প্রকাশ করেন স্বয়ং কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী, শ্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান। সে তালিকা প্রকাশ পাওয়ার পর থেকে সামাজিক মাধ্যম ভরে যায় প্রাক্তন-প্রাক্তনীদের উল্লাস-উচ্ছাস তথা ‘প্রাতিষ্ঠানিক জাতীয়তাবাদের’ প্রকাশে। সংবাদ মাধ্যমে মুহুর্মুহু ধারা বিবরণী প্রকাশিত হতে থাকে, সঙ্গে শিরোনাম, “রাজ্যের মধ্যে সেরা যাদবপুর, দ্বিতীয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, শুভেচ্ছা মুখ্যমন্ত্রীর” (আনন্দবাজার পত্রিকা অনলাইন, ১৫/৭/২২)।

এই ধরণের শিরোনাম যে নতুন কিছু, তা নয়। বরং গত কয়েক বছরে দেশের নানা সংবাদপত্রের শিরোনাম পর্যালোচনা করে দেখলে দেখা যায় এনআইআরএফ-কেন্দ্রিক শিরোনামের ধাঁচ এরকমই। উদাহরণ স্বরূপ, পূর্বোক্ত সংবাদপত্রটি থেকেঃ “সেরা কুড়িতে এ রাজ্যের তিন বিশ্ববিদ্যালয়, ১০০তেও নেই প্রেসিডেন্সি” (আনন্দবাজার পত্রিকা অনলাইন, ১২/৬/২০); “৩১ থেকে পিছিয়ে হল ৩৭, কেন কমল Ranking, চর্চা বিশ্বভারতীতে” (আনন্দবাজার পত্রিকা অনলাইন, ১০/৪/১৯); “প্রেসিডেন্সি ১০০তেই নেই, এগলো কলকাতা” (আনন্দবাজার পত্রিকা অনলাইন, ৮/৪/১৮)। সাধারণ পাঠক যদি এই শিরোনামের সাথে আইপিএল-কেন্দ্রিক কোন শিরোনাম গুলিয়ে ফেলেন (“পর পর পাঁচ ম্যাচ খেলে পয়েন্ট তালিকায় কোথায় থাকল কলকাতা”, আনন্দবাজার পত্রিকা অনলাইন, ২৯/৪/২২), তাহলে হয়তো তাঁকে খুব বেশি দোষ দেওয়া যায়না। শিরোনামের ভাষায় তীব্র প্রতিযোগিতার আঁচ। জীবনমরণ বাজি রেখে মাঠে নামবার ইঙ্গিত। মরণবাঁচন লড়াইয়ের ভাষা প্রতিবেদনের মূল বয়ানেও। যেমন, পূর্বোক্ত একটি প্রতিবেদনে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে বলতে শোনা যায়, ‘‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় নতুন। তা ছাড়া এমন সব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমাদের প্রতিযোগিতায় নামতে হয়েছে, যেখানে মূলত প্রযুক্তি সংক্রান্ত বিষয়ে পঠনপাঠন হয়। আশা করব, পরবর্তী পর্যায়ে বিষয় অনুযায়ী প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা হবে।” (আনন্দবাজার পত্রিকা অনলাইন, ৮/৪/১৮) কন্ঠে তাঁর যেন জবাবদিহির সুর। সেই একই প্রতিবেদনে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুরঞ্জন দাস জানান যে, “যাদবপুরের মান যে কিছুটা নেমেছে, (ওই বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে) ‘পাবলিক পারসেপশন’ বা ‘সাধারণের মধ্যে ধারণা’ বিভাগে কম নম্বর ওঠাটাই তার কারণ। শীর্ষ তালিকায় থাকা আইআইএসসি বেঙ্গালুরু এই বিভাগে ১০১৩ পেলেও যাদবপুরের প্রাপ্তি মাত্র ১৩৬!” এ যেন এশিয়া কাপে ভারতীয় পুরুষ দল হেরে যাওয়ার পর রাহুল দ্রাবিড়ের প্রেস কনফারেন্স! এনআইআরএফ তালিকার এতটাই গুরুত্ব যে উপাচার্যদের সংবাদমাধ্যমের সামনে জবাবদিহি করতে হয়? ২০১৬ সালে জন্মগ্রহণ করেই মরণবাঁচন লড়াই হয়ে উঠলো এনআইআরএফ, এটা কেমন করে সম্ভব? এর প্রাথমিক উত্তর খুব সহজঃ এনআইআরএফ তৈরি হয়েছিল মরণবাঁচন লড়াই হিসেবে গণ্য হওয়ার জন্য, তাই উপাচার্যদের সংবাদমাধ্যমের সামনে জবাবদিহি করতে হয়। আজকে আমার লেখার মূল বিষয় এই তালিকা ও তাকে কেন্দ্র করে বাৎসরিক উত্তেজনা, বিশেষত সংবাদমাধ্যমে।

* * * * * *

এনআইআরএফ কী, এই প্রশ্নের উত্তর পেতে আমরা প্রথমেই যেতে পারি সরকারি ওয়েবসাইটে। সেখানে বলা হয়েছে,

The National Institutional Ranking Framework (NIRF) was approved by the MHRD and launched by [the] Honourable Minister of Human Resource Development on 29th September 2015.

This framework outlines a methodology to rank institutions across the country. The methodology draws from the overall recommendations broad understanding arrived at by a Core Committee set up by MHRD, to identify the broad parameters for ranking various universities and institutions.

যদিও ভারতবর্ষে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের Ranking একটি জনপ্রিয় ইংরেজি পত্রিকার হাত ধরে শুরু হয়, ওয়েবসাইটের বয়ান খুব পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেয় যে এটি সরকারি পরিসংখ্যান। ‘অফিসিয়াল’ ব্যাপার, কোন হেলাফেলার বিষয় নয়। সরকারের কেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের Ranking তালিকা তৈরি করার প্রয়োজন মনে হল, সে আলোচনা আপাতত কিছুক্ষণের জন্য মুলতুবি থাক। কিন্তু যে কোন পরিসংখ্যান পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা হলে পদ্ধতি সম্পর্কে প্রশ্ন অবশ্যই ওঠা উচিত। এনআইআরএফের প্যারামিটার হিসেবে শিক্ষা মন্ত্রকের কোর কমিটি বেছে নিয়েছেন ‘টিচিং, লার্নিং অ্যান্ড রিসোর্সেস’, ‘রিসার্চ অ্যান্ড প্রফেশনাল প্র্যাকটিস’, ‘গ্র্যাজুয়েশন আউটকাম’, ‘আউটরিচ অ্যান্ড ইনক্লুসিভিটি’, এবং ‘পার্সেপশান’। প্রথম কয়েক বছরের পর প্যারামিটারে কিছু পরিবর্তনও এসেছে, তালিকায় যুক্ত হয়েছে কিছু আলাদা আলাদা ক্যাটেগরি। আগামি দিনেও হয়তো প্রয়োজন মাফিক রদবদল হবে। বর্তমান প্যারামিটারগুলি কেমন, তা বুঝতে আমরা আরেকবার পূর্ব-উদ্ধৃত দুই উপাচার্যের বক্তব্যের দিকে নজর দিতে পারি। ২০১৮ সালের এই বক্তব্যে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সংবাদ মাধ্যমকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন যে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় নতুন, ২০১০ সালে স্থাপিত। এটা কিন্তু নেহাত অজুহাত নয়। ‘ফ্যাকাল্টি-স্টুডেন্ট রেশিও’ অথবা ‘কম্বাইন্ড মেট্রিক ফর ফ্যাকাল্টি উইথ পিএইচডি অ্যান্ড এক্সপিরিয়েন্সের’ মতন সাব-ক্যাটেগরিতে যে একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় আর একটি প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কোরের যোগফল একরকম হবেনা, তা বলাই বাহুল্য।

উত্তর ভারতের চারটে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও আধিকারিকেরা সম্প্রতি এ বিষয়ে একটি গবেষণামূলক লেখায় তাঁদের অসন্তোষ প্রকাশ করেন। সেখানে তাঁদের বক্তব্য এই যে এনআইআরএফের Ranking পদ্ধতি সুপ্রতিষ্ঠিত, বৃহৎ (এবং মুলতঃ সরকারি) বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে কম্পিটিটিভ অ্যাডভ্যান্টেজ দিতে বাধ্য, যার ফলে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বাধা পড়তে পারে, “The NIRF appears to favour relatively older and larger universities on all the five parameters as explored above, the pertinent question is whether it would act as an impediment to the establishment and development of small and innovation focused new universities in the country?” (রাও এট অল, ২০২১) বেসরকারি পুঁজির চিরাচরিত মুনাফার চিন্তা মাথাও রেখেও তাঁদের প্রশ্ন এবং আশঙ্কা যে খুব অমূলক, তা বলা যায়না। সৌদি আরবের কিং আবদুল্লাজিজ বিশ্ববিদ্যালয় যে ভাবে এককালে সাইটেশন মেট্রিক্সে এগিয়ে থাকা অভিজ্ঞ অধ্যাপকদের লোভনীয় ‘ভিজিটিং’ চুক্তি প্রদান করে বিশ্ব Ranking-এ নিজেদের উন্নতিসাধন করে ফেলে, সেভাবে এ দেশের কিছু ধনী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও তাদের ক্রয়ক্ষমতা প্রসঙ্গে যথেষ্ট সচেতন। আবার ‘ফ্যাকাল্টি স্টুডেন্ট রেশিও উইথ এম্ফ্যাসিস অন পার্মানেন্ট ফ্যাকাল্টি’ নামক প্যারামিটার শুধু প্রেসিডেন্সি কেন, যে কোন সরকারি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়কেই ঝামেলায় ফেলতে পারে। সরকারি শিক্ষাক্ষেত্রে স্থায়ী পদে নিয়োগের পরিস্থিতি রাজনীতি-নির্ভর ও শোচনীয়, দীর্ঘ দিন পদের পর পদ খালি থেকে যায় সারা দেশে।

আবার যদি আমরা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পূর্ব-উদ্ধৃত বয়ানে নজর দিই, তাহলে দেখা যায় যে, ‘পার্সেপশান’ অর্থাৎ অন্যরা আপনাকে নিয়ে কী ভাবছে, সেই প্যারামিটারে সে বছর পিছিয়ে ছিল যাদবপুর। ‘পার্সেপশানের’ এই সমস্যা কেন, তা আন্দাজ করবার জন্য প্রাক্তন আমলা শৈলজা চন্দ্রের একটি বয়ান শোনা যাক। এটাও মাথায় রাখা যাক যে নানা রঙের ছাত্র রাজনীতি ছাড়াও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মী সংগঠনগুলি সুপ্রতিষ্ঠিত। শৈলজা চন্দ্র তাঁর বক্তব্যে বলছেন যে, এককালে দিল্লীর দয়াল সিং কলেজের গভর্নিং বডির চেয়ারপার্সন থাকাকালীন তিনি বার বার ছাত্র-শিক্ষক ইউনিয়নের সাথে অধ্যক্ষের বচসা প্রত্যক্ষ করেছেন। তাঁর ভাষায়, “A volley of complaints would ensue if demands for ignoring non-exis­tent attendance and fail marks were refused. Today (many years later), Dyal Singh ranks 25th in the list of top 100 colleges. Says principal I.S. Bakshi, ‘Somewhere, the realisation dawned that rank counts'." (টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ২/৬/১৮)। এ যেন উত্তরণের কাহিনি। অন্ধকার থেকে আলোতে আসার কাহিনি। ‘Rank Counts’। খেয়াল রাখা প্রয়োজন যে শৈলজা চন্দ্র টি. এস. আর. সুব্র্যমণিয়াণ কমিটির সদস্য ছিলেন, ভারতবর্ষে শিক্ষানীতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর কণ্ঠে যখন উত্তরণের এ হেন কাহিনি শোনা যায়, তখন সন্দেহ জাগে, ‘পার্সেপশান’ নামক প্যারামিটারটি কি আসলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে ট্রেড ইউনিয়ন-মুক্ত করবার একটি প্রাতিষ্ঠানিক মেকানিজম মাত্র? সেই জন্যই কি ‘দেশদ্রোহী’ জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের Ranking ভালো হলে অনেকের মনে বিস্ময় জাগে?

এর সাথে অভিযোগ এসেছে তথ্য বিকৃতির। রাজীব গান্ধী ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ ল’র উপাচার্য জি. এস. বাজপায়ী যেমন অভিযোগ করেছেন যে এনআইআরএফের তথ্য যাচাই করবার পদ্ধতি সঠিক নয়। এর ফলে, তাঁর মতে, কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় একই অধ্যাপককে দুটি বিভাগে দেখিয়ে ‘ফ্যাকাল্টি-স্টুডেন্ট রেশিও’র খাতায় কলমে উন্নতি করে ফেলেছে। তিনি তথ্য বিকৃতি খুঁজে পেয়েছেন আরও কিছু খাতে, যেমন ল্যাবরেটরির খরচ অথবা লাইব্রেরীর বই। এক বিভাগের রিসার্চ গ্রান্ট অন্য বিভাগে দেখানো হয়েছে বলে তিনি অভিযোগ করেছেন। এ কথা উল্লেখযোগ্য যে বাজপায়ীর অভিযোগ ‘দা হিন্দু’ পত্রিকায় অপ-এড বিভাগে প্রকাশিত হয়েছিল, সেখানে তিনি এনআইআরএফের নানা মাপদন্ডের সমালোচনা করে থাকলেও তালিকাটির উপযোগিতা সম্পর্কে কোন প্রশ্ন তোলেননি।

এখানে আমরা দুটো জিনিস লক্ষ করতে পারি। প্রথমত, আমরা লক্ষ করি যে পদ্ধতিগত সমালোচনা থাকলেও শিক্ষাজগতের উপরমহলে এর সরাসরি বিরোধিতা সেরকম নেই। অভিজ্ঞ অধ্যক্ষ-উপাচার্যদের সমালোচনা থাকলেও তাঁরা মোটের উপরে বিশ্ববিদ্যালয়ের Ranking টেবিল থাকা না থাকা নিয়ে সেরকম চিন্তিত নন। দ্বিতীয়ত, এটা চোখে পড়তে বাধ্য যে দুই-একটি ব্যতিক্রমী যুক্তিসহ লেখা ছাপলেও সংবাদ মাধ্যমের ভূমিকা এখানে মুলতঃ চিয়ারলিডারের। রুদ্ধশ্বাসে আইপিএল কভারেজের সাথে এনআইআরএফের লীগ টেবিল কভারেজের বিশেষ ফারাক নেই, বরঞ্চ রয়েছে প্রচ্ছন্ন চাপ সৃষ্টির উদ্যোগ। ‘ভালো’ এনআইআরআফ Rank-এর চাহিদা তৈরির দায়িত্ব যেন সরকারের সাথে সংবাদ মাধ্যমও তুলে নিজের কাঁধে নিয়েছে। তা কেন, এটা বোঝা প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়ের Ranking তালিকা থাকার প্রয়োজন কোন অঙ্কে? সংবাদ মাধ্যমের চোখে তা এত মুখরোচক কেন? এটা বুঝতে গেলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় Ranking-এর ইতিহাস ও তার অন্তর্নিহিত যুক্তি বুঝতে হবে।

* * *

আজকের দিনে সংবাদ মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় Ranking-এর ধারা বিবরণী জলভাত হয়ে যাওয়ার ফলে হয়তো অনেকেরই খেয়াল নেই যে এক প্রজন্ম আগেও এসবের বিশেষ চল ছিল না। তা না থাকবার ফলে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নীচে ছিল, তাও নয়। Ranking-এর চল সর্বপ্রথম হয় চীনে। ২০০৩ সালে সাংহাইয়ের জিয়াও টং বিশ্ববিদ্যালয় চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির জন্য একটি Ranking পদ্ধতি তৈরি করে, যার উদ্দেশ্য ছিল বাজারি ধাঁচে চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি। একবিংশ শতকের শুরুতে চীনের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির সাথে সাথে ‘সফট পাওয়ার’ বৃদ্ধির আকাঙ্ক্ষা তখন প্রচুর। বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেও যে আর পাঁচটা পণ্য বিক্রেতার মতন প্রতিযোগিতা হতে পারে, এই চিন্তার পিছনে চীনের অবদান প্রচুর। ওদিকে ২০০৪ সালে ইউ.কে. সরকারের কমিশন করা একটি উচ্চশিখা-শিল্প জগতের মেলবন্ধন প্রসঙ্গে রিপোর্টে স্যার রিচার্ড ল্যাম্বার্ট বলেন যে, বিশ্বের সেরা গবেষণাকেন্দ্রিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলির একটি লীগ টেবিল তৈরি হওয়া প্রয়োজন, অনেকটা ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগের ধাঁচে। তবে সেই কাজ সরকার করবে না, করবে বেসরকারি সংস্থান। যেমন কথা, তেমন কাজ। কোয়াকারেল্লি সিমন্ডস নামের কেরিয়ার সার্ভিসেস সংস্থান ও টাইমস হায়ার এডুকেশন সাপ্লিমেন্ট পত্রিকার হাত ধরে তৈরি হয় কিউএস-টিএইচই Ranking। এরপর ২০০৯ সাল থেকে টিএইচই তাদের নিজস্ব Ranking প্রকাশ করা শুরু করে। কিউএস, টিএইচই, এবং সাংহাই Ranking পদ্ধতি এই মুহূর্তে বিশ্বে সবথেকে পরিচিত Ranking পদ্ধতি। এই পদ্ধতি আজ এতটাই পরিচিত যে ভারতের মতন উন্নয়নশীল দেশগুলিতে ‘World Ranking'-এ স্থান পাওয়ার জন্য শিক্ষানীতির দিক পরিবর্তন করতে হয়। ২০১৬ সালে ভারত এনআইআরএফ Ranking পদ্ধতি তৈরি করা ছাড়াও একটি নতুন আইন নিয়ে আসে, যার নাম ইউজিসি (ওয়ার্ল্ড-ক্লাস ইন্সটিটিউশন্স ডিমড টু বি ইউনিভার্সিটিস) রেগুলেশন্স। ২০১৭ সালে ‘ওয়ার্ল্ড-ক্লাস ইন্সটিটিউশন্স’ থেকে নাম বদল করে নাম দেওয়া হয় ‘ইন্সটিটিউশন্স অফ এমিনেন্স’। কিছু সম্ভাবনাময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে বেছে নিয়ে তাদের ‘ওয়ার্ল্ড-ক্লাস’, অর্থাৎ বিশ্ব Ranking-এ স্থান পেয়ে দেশকে সম্মানিত করতে পারে, হওয়ার পথে ফাস্টট্র্যাক করে দেওয়াটা উদ্দেশ্য। এর সাথে এনআইআরএফের হাত ধরে বাকি সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে প্রতিযোগিতায় অভ্যস্থ করা।

এখানে কিছু বিষয় আছে, যা সংবাদ মাধ্যমে বিশেষ আলোচিত হয়না, অতএব জনমানসেও বিশেষ দাগ কাটেনি। এর প্রথম বিষয়টি হচ্ছে ‘ওয়ার্ল্ড-ক্লাস’ হওয়ার দাম। ইন্সটিটিউশন্স অফ এমিনেন্সগুলির পক্ষে যে পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন, তা সরকারের ১০০০ কোটি টাকা কর্পাস ফান্ডেও কুলাবে না, এই ভেবে তাঁদের সরাসরি অর্থনৈতিক স্বশাসন দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তাঁরা সরকার বাদে যে কোন অন্য সূত্র থেকে টাকা তুলতে পারেন। এই সূত্রের মধ্যে যে ভবিষ্যতের ছাত্রছাত্রীদের টিউশন ফিও আছে, তা বলাই বাহুল্য। ২০১৬ সালের টি. এস. আর. সুব্র্যমণিয়াণ কমিটি রিপোর্টও বলা হয়েছে যে ‘সেরা’ অ্যাক্রেডিটেড বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে পূর্ণ অর্থনৈতিক স্বরাজ দেওয়া হবে। উৎকর্ষের পথে বাধা ভারত সরকার। অতএব যার উৎকর্ষ যত বেশি, তার তত স্বাধীনতা। টাকা তোলবার, টাকা খরচ করবার। এই খরচের অন্তত কিছুটা আসবে ভবিষ্যতের উপভোক্তা, অর্থাৎ ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে। সাবসিডাইজড টিউশন ফীজ নয়, জোর দেওয়া হবে ‘নিড-বেসড’ বৃত্তি ও শিক্ষা লোনের উপর। সরকারি-বেসরকারি যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বার খরচ বাড়বে।

দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে কিউএস-টিএইচইর মতন সংস্থানের মালিকানা। Ranking যারা করেন, তাঁরা কারা? তাঁরা কেন Ranking আদৌ করেন? এতে তাঁদের লাভ কী? হয়তো অনেকেই জানেন না যে থমসন রয়টার্সের মতন মিডিয়া কনগ্লোমারেট ও মার্কিন প্রাইভেট ইকুইটির অর্থে পুষ্ট Ranking ইন্ডাস্ট্রির পিছনে আজকের দিনে প্রায় কয়েকশো মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হয়। এর কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের অবাণিজ্যিক দিকগুলির বাণিজ্যকরণ করে তাঁরা বিশ্বব্যাপী নতুন একটি বাজার তৈরি করতে পেরেছেন। Rank যেহেতু ভালো করতেই হবে, অতএব নানা প্যারামিটারের উন্নতি সাধন করতে কোটি কোটি টাকা খরচ করতে বাধ্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলি। কোথায় টাকা খরচ করতে হবে, কোথায় না করলেও চলবে, সেটাও বলে দেবে বৃহৎ পুঁজি-নির্ধারিত Ranking ইন্ডাস্ট্রি। সেই টাকা কখনো আসবে সরকারি গ্রান্ট থেকে, কখনো বা ছাত্রের লোন থেকে। তবে এর বেনিফিসিয়ারি অবশ্যই সেই সংস্থানগুলি যারা অ্যানালিটিক্স, বেঞ্চমার্কিং টুলস, এডটেক সফটওঅ্যার ইত্যাদি বিক্রি করে থাকে। এই ব্যবসায়িক দিকগুলো সংবাদ মাধ্যমে আলোচিত না হওয়ার ফলে বিশ্ববিদ্যালয় Ranking পদ্ধতি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের জানা ও বোঝার অভাব রয়েছে। Ranking-এর হিসেব যে সাধারণের উপকারের জন্য নয়, মুনাফার হিসেবমাফিক হয়ে থাকে, এ কথা জনমানসে আদৌ আঁচড় কাটতে পারেনি। প্রেস্টিজ ইকনমির উন্মাদনায় ‘সেরা’ হওয়ার চাহিদা তাঁদের কাছ থেকেও আসে, সে খরচ যতই বাড়ুক না কেন। অতএব চিয়ারলিডার-রূপী সংবাদ মাধ্যমের কাছে কাঁচুমাচু হয়ে জবাবদিহি করেন উপাচার্যরা আর অধ্যাপকরা নিত্যনতুন প্যারামিটারের হিসেব কষেন।

* * *

শুরুর কাহিনিতে ফেরত আসি আবার। অধ্যাপক কেবল অরোরার অবসরগ্রহণ প্রসঙ্গে ভেবেছিলাম, ক্লাসে লেখাপড়ার প্রতি দায়িত্বের বাইরেও একটি অবৈতনিক, অবানিজ্যিক ছাত্র সমিতির প্রতি যে একজন অধ্যাপকের অঙ্গীকার, তার মান নির্ধারণের মাপকাঠি কোনটা? এ কথা বলাই বাহুল্য যে এনআইআরএফ Ranking পদ্ধতি-নির্ধারকদের কাছ থেকে এ সমস্ত প্রশ্নের উত্তর পাওয়া সম্ভব নয়। শিক্ষায় বিশ্বায়নের যুগে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে একে অপরের সাথে কেন প্রতিযোগিতায় নামতে হবে, কোন পণ্য তারা বিক্রি করে যে তার ‘সেরার’ তালিকা আদৌ প্রয়োজন, তার উত্তরও আজকের দিনে হয়তো আর আশা করা উচিত নয়। নব্যউদারীকরণের যুক্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠনপাঠন পণ্য মাত্র, পাবলিক গুড নয়।