আরেক রকম ● দশম বর্ষ অষ্টাদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ● ১-১৫ আশ্বিন, ১৪২৯

প্রবন্ধ

সঞ্জয় উবাচঃ শিক্ষায় নিয়োগ-বিনিয়োগ


মহারাজ, সম্প্রতি ভারতের অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গে কী এক কুনাট্য অভিনীত হয়ে চলেছে, তা আপনি জানেন কি? এবং ইডি, সিবিআই প্রভৃতির সূত্র উদ্ধৃত করে গণসংবাদ মাধ্যম যা জানাচ্ছে তাতে পরিষ্কার বলা হচ্ছে যে এ নাট্য নাকি মোটেই অলীক নয়।

না, আমি কয়েকদিন এসবের কোনো খবর রাখতে পারিনি। আমি স্বীকার করছি এই না-পারাকে আমার রাজকর্মের স্খলন হিসেবেই বিবেচনা করতে হবে। বলো আমাকে সঞ্জয়, কী ঘটেছে সেখানে।

সেখানে রাষ্ট্রীয় স্তরে গণতান্ত্রিক আচার আচরণ প্রতিষ্ঠার এক সুবর্ণ সুযোগ হেলায় হারানো হল।

আমার এই সাময়িক অমনোযোগের মধ্যে কী এমন ঘটল সেখানে যে তুমি এমন এক সোনালী সুযোগের কথা তুলছ?

দুর্নীতি, মহারাজ। দীর্ঘদিন ধরেই সে রাজ্যে বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগের ক্ষেত্রে নানারকম আইনি বেআইনি পথে, সেখানকার আধুনিক চালু বুলিতে যাকে বলে 'দু-নম্বরি কাজ' তাই নাকি চলছিল। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষক নিয়োগের জন্য রাজ্য সরকারের গঠিত পর্ষদ নিয়োজিত আছে। এই পর্ষদের দায়িত্ব যোগ্যতা নির্ণায়ক পরীক্ষা গ্রহণ করে যোগ্য প্রার্থীদের তালিকা তৈরি করা। তারপর সেই তালিকা থেকে আবার প্রার্থীদের সাক্ষাৎকার গ্রহণের মাধ্যমে উপযুক্ত বিদ্যালয়ে উপযুক্ত শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগ করা হয়ে থাকে। এবং এই শিক্ষকদের বেতন প্রদানের দায়িত্ব বর্তমানে সম্পূর্ণভাবে সরকার পালন করে।

আর ছাত্র-ছাত্রীরা বিদ্যালয়ে পঠন পাঠনের জন্য যে বেতন বিদ্যালয়কে দিয়ে থাকে তার কী হয়?

সে রাজ্যে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত বিদ্যালয় শিক্ষা অবৈতনিক, মহারাজ।

বা সে তো খুব উত্তম ব্যবস্থা। তাহলে সমস্যা কোথায়?

সম্প্রতি এই ব্যবস্থার বাস্তব প্রয়োগের ক্ষেত্রে নাকি দারুণ দুর্নীতি চক্রের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। এ বিষয়ে বর্তমানে খোলামেলা কোনো কথা বলা সংগত কিনা সে আর এক সমস্যা। যা আমি বলতে চাইব তার অনেক বিষয়ই আদালতের বিচারাধীন। তাই ভয় হয় মহারাজ, এসব কথা আলোচনা করতে গিয়ে আবার আদালত অবমাননার দায়ে না দোষী সাব্যস্ত হতে হয়।

তোমার সে আশঙ্কা নেই। তুমি দিব্যদৃষ্টির অধিকারী। সে অধিকারের শর্তের মধ্যেই আছে যে তুমি দেশের অন্যান্য প্রচলিত সাধারণ আইনের বশ নও। তা ছাড়া আমাকে সব কিছু জানানো তোমার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। তোমার ক্ষেত্রে ইমিউনিটির ধারণা খুব ব্যাপকভাবে প্রযোজ্য। ভয় পেয়ো না সঞ্জয়। তুমি নির্ভয়ে বলো। রাজ্যের সুশাসনের স্বার্থেই এসব কথা আমার জানা প্রয়োজন।

(সংকোচে মুখ নীচের দিকে নামিয়ে) সঞ্জয় - মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী, থুড়ি, প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী গ্রেফতার। সঙ্গে তাঁর একজন নর্ম সহচরী, তিনিও গ্রেফতার।

কেন? কী এমন ঘটল যে এরা সব এরকম রাতারাতি গ্রেফতার হয়ে গেলেন। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।

ঠিক যাকে বলে আচমকা তা বোধহয় নয়, মহারাজ। বেশ কয়েকদিন ধরেই গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগে বড়সড় দুর্নীতির গন্ধ পাওয়া গেছে। এবং প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী নাকি সরাসরি তাতে জড়িত। এবং এই যে বলছি প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী সে কিন্তু শুধু এই কারণে নয় যে গ্রেফতার হওয়ার কারণে তিনি শিক্ষা মন্ত্রকের দায়িত্ব থেকে অপসারিত তাই প্রাক্তন।

তাহলে?

না, গ্রেফতার হওয়ার অনেক আগেই তাকে শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে সরিয়ে শিল্প মন্ত্রকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এবং লক্ষণীয় এই যে, সম্ভাব্য দুর্নীতির কাহিনী গণমাধ্যমে গুঞ্জনধ্বনির আকারে প্রচারিত হওয়া মাত্রই বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী তৎপরতার সঙ্গে বলেছিলেন "আমি তখন শিক্ষামন্ত্রকের দায়িত্বে ছিলাম না"। ধৃষ্টতা মার্জনা করবেন, মহারাজ, এ কথাটা তখনই নাকি অনেকের কানে এই প্রাকৃত প্রবচনের মতো শুনতে লেগেছিল। ঠাকুরঘরে কে? আমি তো কলা খাইনি। ওই কথা বলে তদানীন্তন শিক্ষামন্ত্রী কি একই সঙ্গে দুটো কাজ করে ফেললেন না? একটা হল নিজের সম্ভাব্য দোষ ক্ষালনের চেষ্টা। আর আর একটা হল প্রকারান্তরে দুর্নীতির গুঞ্জনকে প্রায় প্রচ্ছন্ন স্বীকৃতি জোগানো। এই দ্বিতীয় কথায় যদি লেশমাত্র সত্যের আভাস থাকে তাহলে আরো একটা কথা বলতেই হয়। যদি দুর্নীতি হয়ে থাকে তাহলে তার দায়িত্ব গোটা সরকারের উপরে বর্তায়। যিনি বা যাঁরাই সেই সরকারের অঙ্গী তাঁদের সকলের উপরেই সেই সম্ভাব্য অপকর্মের নৈতিক দায়িত্ব বর্তাবে। কেননা সরকার এক গোটা একক হিসেবে দেশের মানুষের কাছে দায়বদ্ধ। সেটাই সরকারের সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা। সরকারের সব অঙ্গ হয়তো ফৌজদারি অপরাধে অপরাধী হবেন না। ফৌজদারি অপরাধ আর নৈতিক দায়িত্বের ফারাক ভুললে গণতান্ত্রিক কাঠামোর ক্ষতি হয়।

সুবর্ণ সুযোগের কথা আমি ঠিক এই প্রসঙ্গে তুলেছিলাম। আমি আপনার দৃষ্টিতে এ কথা আনতে চাই যে, এই সঙ্ঘবদ্ধ নৈতিক সাংবিধানিক দায়িত্বের প্রসঙ্গ যদি আমরা মাথায় রাখি তাহলে তদানীন্তন শিক্ষামন্ত্রীর কথার খেই ধরে আমরা একেবারে মুখ্যমন্ত্রী পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারি।

কেন তুমি বলছ এ কথা আমায় উপযুক্ত ব্যাখ্যা সহকারে বোঝাও সঞ্জয়।

প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী ও তাঁর নর্ম সহচরীর গ্রেফতারের খবর যেদিন গণমাধ্যমে প্রচারিত হল সেদিনই মুখ্যমন্ত্রীর যে প্রতিক্রিয়া পাওয়া গিয়েছিল তা এইরকমঃ যে দোষী তার যাবজ্জীবন হোক আমার কিছু যায় আসে না। আমার গায়ে যদি কেউ কালি দেয় তাহলে যেন মনে থাকে আমার হাতেও আলকাতরা আছে। এই আলকাতরা মন্তব্য নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। এমনকি সংবাদপত্রে সম্পাদকীয় নিবন্ধেও এ প্রসঙ্গ এসেছে। আমি সেদিকে যাচ্ছি না। মুখ্যমন্ত্রীর হাতে আলকাতরা থাকা ভালো কিনা, সে আলকাতরা কোথা থেকে পাওয়া গেল, তা কি সরকারের পূর্ত বিভাগের থেকে সংগৃহীত সরকারি আলকাতরা, সরকারি উপকরণ ব্যবহার করে মুখ্যমন্ত্রীর গায়ের কালির ছিটের প্রতিকার করা সংগত কিনা সে প্রশ্নও এখন তুলছি না। আর মুখ্যমন্ত্রী যদি নিজের ব্যক্তিগত কালির কথা না বলে তাঁর সরকারের কালিমার কথা বলে থাকেন, তাহলে যে-কথা আমি নিবেদন করতে চাই সেটা আরো জোরালো হবে, মহারাজ। তার জন্যেই আমাদের ক্যাবিনেট চরিত্রের সরকারের মন্ত্রীসভার যৌথ দায়িত্বের কথা তুলতেই হবে।

প্রথম দফায় মুখ্যমন্ত্রীর তরফে সে যৌথ দায়িত্বের ধারণার কোনো স্বীকৃতি পাওয়া গেল না। তিনি সম্ভাব্য অপরাধকে ব্যক্তির অপরাধ বলে নিজের সরকারের মালিন্য বাঁচাবার চেষ্টা করলেন। তার সঙ্গে এটাও বললেন যে, যতক্ষণ না দোষ প্রমাণিত হচ্ছে ততক্ষণ নির্দোষ বলে মনে করতে হবে। সে যুক্তির আশ্রয়ে প্রথমেই অভিযুক্ত মন্ত্রীকে মন্ত্রীসভা থেকে বরখাস্ত করাও হয়নি। দু-একদিন বাদেই হল। কেন? তখনো তো অপরাধ প্রমাণিত হয়নি। নাকি অপরাধের অভিযোগ উনি মেনে নিলেন। তা যদি হয় তাহলে মুখ্যমন্ত্রীর ক্যাবিনেট তখনই কলঙ্কিত হল। শুধু মন্ত্রিত্ব থেকে বরখাস্ত নয়, প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী দলেরও যত দায়িত্বপূর্ণ পদে ছিলেন তার সবকিছু থেকে তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হল। কেন? এমনিতে দলের আভ্যন্তরিক ব্যাপারে বাইরের নাগরিকদের খুব কিছু বলার থাকে না। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে এ প্রশ্ন উঠবেই যে আদালতের পাশাপাশি তবে কি মুখ্যমন্ত্রী নিজের মতো একটা বিচার প্রক্রিয়া সেরে ফেললেন। যদি তাই হয় তাহলে অভিযুক্ত শিক্ষামন্ত্রীর ব্যক্তিস্বাধীনতার হানি হল কিনা সে প্রশ্ন ওঠে। অথচ এদিকে হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির সকাশে মুখ্যমন্ত্রী আদালতের বাইরে ‘মিডিয়া ট্রায়াল’-এর যৌক্তিকতা সম্বন্ধে প্রশ্ন তুলেছেন। তখন কিন্তু উনি খেয়াল করছেন না যে, মিডিয়া ফৌজদারি বিচার করছে না, তা সে করতে পারেও না। মিডিয়া যা করছে তা হচ্ছে নৈতিক ও রাজনৈতিক বিচার।

বুঝলাম সঞ্জয়, তোমার দীর্ঘ সওয়াল জবাবের মর্মার্থ আমি গ্রহণ করলাম। এখন বলো, গণতান্ত্রিকতার দিক থেকে কাকে তুমি বলছ সুবর্ণ সুযোগ হেলায় হারানো।

এ দেশের রাষ্ট্রীয় জীবনে সাংবিধানিক বিবর্তনের প্রসঙ্গে কতকটা স্বাস্থ্যকর একটা প্রথার প্রবর্তন করা যেত যদি অভিযোগ দানা বাঁধার মুহূর্তে মুখ্যমন্ত্রী পদত্যাগ করতেন। তাঁর সরকারের পতন হতো। রাজ্যপাল স্বাভাবিকভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রীর দলকেই সরকার গঠন করার জন্য আহ্বান করতেন। জনগণের রায় তো এখনো সে দলের থেকে সরে যায়নি। যতদিন না নতুন ব্যবস্থা কিছু হচ্ছে ততদিন তিনিই কাজ চালিয়ে যাবেন অস্থায়ী মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে। রাজ্যপালের আহ্বান পেয়ে শাসক দল নিজেদের সংসদীয় দলের বৈঠকে নতুন নেতা/নেত্রী নির্বাচন করবেন। রাজ্যপাল তাঁকেই মুখমন্ত্রী নিয়োগ করে সরকার গঠন করতে বলবেন।

বুঝতে পারছি সঞ্জয়, তুমি তোমার সাংবিধানিক ইউটোপিয়া নিয়ে মশগুল হয়ে আছ। দেশের বাস্তব পরিস্থিতি নিয়ে কিছু ভাবনি। নাই বা ভাবলে।


(সৌরীন ভট্টাচার্য)