আরেক রকম ● দশম বর্ষ অষ্টাদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ● ১-১৫ আশ্বিন, ১৪২৯
প্রবন্ধ
বারাণসীঃ শান্ত বহিরঙ্গের অন্দরে রয়েছে উত্তেজনার চোরাস্রোত
গৌতম হোড়
বারাণসীর চক থানার উল্টোদিকে শাড়ির পাইকারি বাজারকে পাশে রেখে একটা সরু গলি চলে গেছে রামঘাটের দিকে। বারাণসীর সব গলিই গোলকধাঁধা। একটা গলি থেকে অনেক গলি বেরিয়েছে। সেই গলির গলি তস্য গলিই হলো বারাণসীর পরিচয়, তার ঐতিহ্য, তার আকর্ষণ। এখন আগের মতো গলির ভিতর ষাঁড় পথ আটকে বসে থাকে না। বস্তুত বারাণসীতে আর আগের মতো নন্দীদের দেখা যায়না। তাদের সংখ্যা হয় কমেছে বা তারা অন্যত্র বিচরণ করে।
সেই গলিতে জিজ্ঞাসা করতে করতে গেলাম রামঘাটের দিকে। ঘাটে নামার সিঁড়ি যেখানে শুরু হয়েছে, তার ঠিক আগে বাঁদিকে একটা বিউটি পার্লার। উল্টোদিকে একসময় জৈন মন্দির ছিল। এখন পুরোটা ভেঙে পড়েছে। জৈন মন্দির চলে গেছে অন্য জায়গায়। পুরনো মন্দিরটা খন্ডহরের চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেই পুরনো দিনের সরু সরু ইঁট যত্রতত্র পড়ে আছে। চারপাশের বাড়িগুলোর বয়সের গাছ-পাথর নেই। ঘাটের সিঁড়ি দিয়ে উঁকি মারলেই দেখা যায় বহমান গঙ্গা। গঙ্গাতীরে বারাণসীর অসংখ্য ঘাটের একটি। তবে পর্যটক আকর্ষক ঘাট নয় বলে এদিকটা একেবারে ফাঁকা।
এই জায়গায় আসার কারণ হলো মঞ্জু বেদ-এর সঙ্গে কথা বলা। কারণ, যে পাঁচ জন মহিলা জ্ঞানবাপী মসজিদ নিয়ে মামলা করেছেন, তাঁদের মধ্যে মঞ্জু অন্যতম। তিনিই থাকেন এখানে। যে বিউটি পার্লারের কথা বললাম, সেটি চালান মঞ্জু। পেশায় তিনি বিউটিশিয়ান। জ্ঞানবাপী মসজিদ নিয়ে মামলা করার পর মঞ্জু এখন একজন প্রায় সেলিব্রেটি। এই বিতর্ক উঠলেই টিভির সাংবাদিক ও চিত্রসাংবাদিকরা ভিড় করেন এই পার্লারের সামনে, মঞ্জু বেদের বাইট নেয়ার জন্য।
আর বাইট দিতে দিতে সাবলীল মঞ্জু প্রশ্ন আসতেই তাঁর কথা বলতে শুরু করেন। জানান, কেন তিনি এই মামলা করেছেন? কিছুদিন হলো এই মামলা স্থানীয় জেলা আদালতে চলছে। ইতিমধ্যে মঞ্জু এবং আরো চার মামলাকারীর কথা জেনে গেছে গোটা দেশ। তাও খুব সংক্ষেপে এখানে ম়ঞ্জুর কথাটা তুলে ধরা জরুরি। মঞ্জুর বক্তব্য, “আমরা শৃঙ্গার গৌরীর দর্শন করতে মন্দির যেতাম। কিন্তু মূর্তির দর্শন করতে পারতাম না। দরজার বাইরে থেকে প্রণাম করে চলে আসতে হত। বারাণসীতে সব মন্দির দর্শন করা যায়। তো শৃঙ্গার গৌরীর মন্দির কেন দর্শন করতে পারব না? সেই ভাবনা থেকে মামলা করা”। তাঁর দাবি, “আমাদের মন্দির আমাদের ফিরিয়ে দিতে হবে”।
মঞ্জু তাঁর অবস্থান থেকে মামলা করেছেন, মামলা এখন বিচারাধীন। সব পক্ষ তাদের কথা বলছেন। ফলে আদালত কী রায় দেয়, তার দিকে তাকিয়ে সারা দেশ। তারপর সেই রায় নিয়ে নিশ্চিতভাবেই উচ্চ আদালতে আবেদন জানানো হবে। ফলে লম্বা আইনি লড়াই চলতে থাকবে। সেই লড়াইয়ের ফল কী হবে, তা এখন থেকে অনুমান করা শুধু অনুচিতই নয়, অন্যায্য।
এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য তা নয়। উদ্দেশ্য হলো, এই নতুন বিতর্ককে ঘিরে বারাণসী কতটা বদলেছে বা আদৌ বদলেছে কি না, তা দেখানো। মঞ্জুর কথাই ধরুন। বিতর্ক শুরু হওয়ার পর তাঁকে নিরাপত্তা দিয়েছিল প্রশাসন। পুলিশ তাঁর বাড়ির বাইরে মোতায়েন থাকত। কিন্তু তাতে মেয়েরা তাঁর পার্লারে আসতে অস্বস্তি বোধ করতেন। বিতর্ক ওঠার পর তাই মঞ্জুর জীবনও বদলেছে।
তবে বিতর্ক যখন তুঙ্গে উঠেছিল, তখন তার আঁচ পড়েছিল অনেকের জীবনে। ঘরপোড়া গরু যেমন সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায়, তেমনই ভয় পেয়েছিলেন শাড়ি তৈরির সঙ্গে জড়িত কর্মীরা। এই কর্মীরা সিংহভাগই বাইরে থেকে আসেন। পূর্ব উত্তরপ্রদেশ ও বিহার থেকে। বারাণসীর বাইরে থেকে আসা এই কর্মীদের অনেকে ভয় পেয়ে চলে গিয়েছিলেন নিজেদের গ্রামে। কার্ফিউ, সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার চোরাস্রোত দেখে তাদের থাকার সাহস হয়নি।
বারাণসীর অনেক মানুষই কোনো না কোনোভাবে শাড়ির ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। পঞ্চগঙ্গা ঘাটের নৌকার মাঝি অনিল থেকে পুরুষামুক্রমে শাড়ির ব্যবসা করা ইউসুফ ফৈজি পর্যন্ত অনেকের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি তাদের এই অবস্থার কথা।
ইউসুফ ফৈজির ঠাকুর্দার ঠাকুর্দা বারাণসীতে শাড়ির ব্যবসা শুরু করেছিলেন। মদনপুরায় তাঁর বড় দোকান। ভারতের বিভিন্ন জায়গায় শাড়ি পাঠান তিনি। ইউসুফের বক্তব্য, তাঁর শাড়ি তৈরির সঙ্গে যুক্ত কর্মীরা ভয় পেয়ে গেছেন। তাঁদের আশঙ্কা, যদি কার্ফিউ হয়, পরিস্থিতি খারাপ হয়, তাহলে বাড়ি ফিরতে পারবেন না। তাই কিছু কর্মী চলে গেছেন। কিছু কর্মী যাব যাব করছেন। ফলে ব্যবসায় তার প্রভাব পড়ছে। তাঁর মতে, রাজনীতি তার জায়গায়, ব্যবসা তার নিজের জায়গায়। বছরের পর বছর ৩৬৫ দিন তাদের ব্যবসা করে খেতে হয়। সেই ব্যবসার উপর প্রভাব পড়া মানে রুটি-রুজির উপরে প্রভাব পড়া। আর সেখানেই অশনি সঙ্কেত দেখছেন তাঁরা।
বারাণসীর গঙ্গার ঘাট আগের তুলনায় অনেকটা পরিস্কার হয়েছে। কথায় বলে, বারাণসীর গঙ্গার ঘাট কখনো ঘুমায় না। ভোররাত থেকে সেখানে মানুষের গতিবিধি বেড়ে যায়। ঘাটের সেই ছবির কোনো পরিবর্তন হয়নি। দর্শনার্থীদের ঢল নেমেছে বারাণসীতে। তার মধ্যে একটা বড় অংশ দক্ষিণ ভারতীয়। একটু পরপরই আগের মতো বাংলায় কথা শোনা যাচ্ছে। গদৌলিয়া মোড় থেকে দশাশ্বমেধ ঘাট পর্যন্ত যাওয়ার রাস্তায় এগোলেই স্কুটার, মোটর সাইকেলের তীব্র হর্ন, দুই পাশ থেকে দোকানদারদের ডাকাডাকি, মানুষের অন্তহীন স্রোত থেকে উঠে আসা শব্দ ও কথা মিলিয়ে আগের মতোই বধির হওয়ার অবস্থা। তার উপর পুরসভার তরফে মাইকিং করা হচ্ছে, দুই পাশে বেআইনিভাবে পার্কিং করা দ্বিচক্রযান না সরালে তুলে নিয়ে যাওয়া হবে। সকাল থেকে গদৌলিয়ার রাস্তায়, বাঙালিটোলার গলিতে কচুরি ও জিলিপি ভাজার গন্ধে চারপাশ আমোদিত।
এই ছবি দেখলে মনে হবে বারাণসী আছে সেই বারাণসীতেই। মন্দির-মসজিদ বিতর্ক তার জীবনযাপনে কোনো প্রভাব ফেলেনি। সত্যিই কি তাই? এই অতি পরিচিত বহিরঙ্গের ছবিটা কিন্তু আসল পরিস্থিতির কথা জানাচ্ছে না। আসল কথাটা জানতে একটু গলির অন্দরে ঘুরতে হবে। কথা বলতে হবে মানুষের সঙ্গে। তাহলেই টের পাওয়া যায় একটা উত্তেজনা, ভয়ের চোরাস্রোত বয়ে চলেছে সেখানে। বিতর্ক জোরদার হতেই কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরে যাওয়ার সব রাস্তার মুখে ও ভিতরে পুলিশের উপস্থিতি অনেকটাই বেড়ে গেছে। তার উপর আদালত থেকে পরিস্থিতি যাতে ঠিক থাকে তার জন্য প্রশাসনকে বিশেষ নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। ফলে প্রচুর পুলিশ। নরেন্দ্র মোদী এখন গঙ্গার ঘাট থেকে শুরু করে অপর প্রান্তে জ্ঞানবাপী মসজিদের পাশ পর্যন্ত যে বাবা বিশ্বনাথ করিডোর বানিয়েছেন, তার মুখেও পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ।
গলির ভিতরের মহল্লায় ঢুকলে একটু কান পাতলেই শোনা যায়, আলোচনার বিষয় সেই মন্দির-মসজিদ। ইউসুফ মির্জা বলছিলেন, “আগে জ্ঞানবাপীতে কত গেছি। বাবার হাত ধরেও গেছি। রমজানের সময় গেলে মন্দিরের পুরোহিতরা লাড্ডু দিতেন। সেই লাড্ডু নিতে তাদের কাছে ছুটে যেতাম। এখন তো ওদিকে যেতেই ভয় করে”। ইউসুফ তো তাও সোজাসাপটা কথাগুলো বললেন, কিন্তু মুসলিম মহল্লায় ঘুরে কাউকে এই বিতর্কের কথা জিজ্ঞাসা করলেই তাঁরা বলেন, মাফ করবেন। এনিয়ে কোনো কথা বলতে পারব না। বয়স্ক থেকে যুবা সকলেই মুখে কুলুপ দিয়ে বসে আছেন। এমনকী মুসলিম সংগঠনের নেতারাও প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করছেন না। এক নেতা কথা বলবেন বলেও পরে আর কিছুতেই সময় দিলেন না। জানালেন, যা বলার আইনজীবীই বলবেন। হিন্দু মহল্লায়, বাঙালিটোলায় মানুষের একটাই কথা, শান্তিতে থাকতে চাই।
হিন্দু ও মুসলিম দুই পক্ষের আইনজীবীই যাদব। মুসলিম পক্ষের আইনজীবীর নাম অভয় যাদব। মামলা জেতার ব্যাপারে খুবই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন তিনি। বলছিলেন, “আইন আমার পক্ষে আছে। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর আইন করে বলা হয়েছে, দেশের সর্বত্র মন্দির-মসজিদ বিতর্কের ক্ষেত্রে স্থিতাবস্থা বজায় থাকবে। এমনকী বাবরি নিয়ে রায় দিতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্ট অযোধ্যায় রামমন্দির তৈরির অনুমতি দেওয়ার পর বলেছিল, এটা ব্যতিক্রম মাত্র। বাকি বিতর্কের উপর এই রায়ের কোনো প্রভাব পড়বে না। সেখানে স্থিতাবস্থা বজায় থাকবে। এটাই আমি আদালতে বলেছি”।
দুঃখের কথা, অভয় যাদব এখন আর নেই। কিছুদিন আগে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। ফলে বারাণসীর আদালতে মামলার শুনানি করলেও রায় তিনি জেনে যেতে পারেননি।
আদালতের বিচারাধীন হওয়ার পর আপাতত মন্দির-মসজিদ বিতর্ক এখন আবার কিছুটা স্তিমিত। সকলে আদালতের রায়ের জন্য অপেক্ষা করছেন। বারাণসী আবার তার নিজের ছন্দে চলছে। কিন্তু এই বিতর্ক হলো ছাইচাপা আগুনের মতো। আবার তা যে কোনো সময় প্রবল হতে পারে। শান্ত গঙ্গা, তার প্রাণচঞ্চল ঘাট, তার দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যবাহী ছাতা, শাড়ি আর প্রবাদ নিয়ে বারণসীর জীবনও বয়ে চলেছে নিরন্তর। প্রবাদ হলো, বারাণসীতে কেউ না খেয়ে থাকেন না। বারাণসীর জন্য বাবা বিশ্বনাথ যেমন সর্বক্ষণ চোখ চেয়ে থাকেন, তেমনই মা অন্নপূর্ণার ভান্ডার কখনো শেষ হয় না। সকলেই এখানে দুবেলা খেতে পান। এভাবেই থাক বারাণসী। উত্তেজনার আগুন নিভে যাক। বরাবরের মতো। মানুষ তার নিজের মতো করে বেঁচে থাক।