আরেক রকম ● দশম বর্ষ অষ্টাদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ● ১-১৫ আশ্বিন, ১৪২৯

সম্পাদকীয়

তৃণমূল ও বিজেপির বিকল্প


রাজ্য রাজনীতি এমন একটি পূতিগন্ধময় গলিতে এসে পড়েছে যেখানে সকালের খবরের কাগজ খুলতে বাঙালির আপাতত লজ্জা এবং শঙ্কা হচ্ছে কারণ রাজ্যের শাসক দলের কোন নেতার বিছানার নিচে অথবা আলমারিতে সারি সারি নোট সাজিয়ে রাখা আছে তা প্রায় প্রতিনিয়ত ধরা পড়ছে। রাজ্যের শাসক দলের তোলাবাজি, গুণ্ডামি, দুর্নীতি, সমস্ত সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছে। অন্যদিকে, রাজ্যে কর্মসংস্থান হচ্ছে না। ট্রেনের পর ট্রেনে চেপে রাজ্যের বেকার যুবকেরা পাড়ি দিচ্ছে অন্য রাজ্যে কর্মসংস্থান এবং অধিক মজুরির সন্ধানে। পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছিয়েছে যে রাজ্য সরকারের অধিকাংশ কলেজে স্নাতক স্তরের পড়ুয়া পাওয়া যাচ্ছে না। তরুণ যুবক-যুবতীরা বোধহয় ভাবছেন যে এই রাজ্যের আর কোনো ভবিষ্যৎ নেই। অতএব চাকরির সন্ধানে অথবা উচ্চশিক্ষার জন্য তারা রওয়ানা দিচ্ছেন ভিন রাজ্যে।

এই পরিস্থিতিতে রাজ্যের বিরোধী শক্তি-সমূহ যে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করবে তা অবশ্যম্ভাবী। দুর্ভাগ্যবশত রাজ্যের মূল বিরোধী শক্তির ভূমিকায় আপাতত রয়েছে কেন্দ্রের শাসক দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। বিগত সপ্তাহে বিজেপি-র নবান্ন অভিযান আন্দোলনের চিত্র আমরা দেখলাম। কোন দাবিতে তাদের এই অভিযান তা বোধহয় তাদের কর্মী-সমর্থকরাও ভালো করে জানতে পারেননি। সপ্তাহের মাঝখানে নবান্ন অভিযানের মতন একটি বড় রাজনৈতিক কর্মসূচী গ্রহণ করার ফলে একমাত্র সাধারণ মানুষের হয়রানি বাদ দিয়ে আর কোনো লাভ হয়নি। দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা খুব বেশি কষ্ট না করে পুলিশের কাছে খুশি মনে গ্রেপ্তারি বরণ করেছেন। রাজ্যের বিরোধী দলের নেতা প্রাক্তন তৃণমূলী মহিলা পুলিশ কেন তাঁকে গ্রেপ্তার করবে এই নিয়ে মিডিয়ার সামনে বচসা করে পুলিশের গাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। অন্যদিকে বিজেপি-র মদতপুষ্ট সমাজবিরোধীদের একটি অংশ পুলিশের উপর ভয়াবহ আক্রমণ নামিয়ে এনেছে। অনেক পুলিশকর্মী আহত, রক্তাক্ত হয়েছেন, পুলিশের গাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। কলকাতা ও হাওড়া শহরে উত্তেজনা সৃষ্টি করা বাদ দিয়ে বিজেপি-র আন্দোলনের অন্য কী উদ্দেশ্য ছিল তা সাধারণ মানুষ বুঝতে পারেননি।

আসলে গণতান্ত্রিকভাবে মানুষের দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করার কোনো অভিজ্ঞতা বিজেপি-র নেতাদের নেই। তাদের রাজনীতির মৌলিক আধার সাম্প্রদায়িকতা। মুসলমানদের বিরুদ্ধে, তাদের আঘাত করতে বিজেপি নেতাদের যেই তৎপরতা দেখা যায়, সাধারণ মানুষের দাবি দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করতে গিয়ে আসলে তারা বাক্যহারা হয়ে পড়েন - মন্দির গড়ো অথবা মসজিদ ভাঙো অথবা গদ্দারদের গুলি করো জাতীয় স্লোগান দিতে না পারলে, বিজেপির নেতাদের আন্দোলন বালখিল্যতায় পর্যবসিত হয় এবং তাদের সমর্থকরাও কোনো অনুপ্রেরণা পায় না এই মিছিলে যাওয়ার। অতএব এটি অস্বাভাবিক নয় যে বিজেপির নবান্ন অভিযান রাজনৈতিকভাবে কোনো সাড়া জাগাতে পারেনি।

এখানেই এই অন্ধকার সময়েও কিছুটা আশার আলো দেখলে আমাদের দোষ দেওয়া যায় না। বিজেপি ভারতের প্রগতিবাদী আন্দোলনের মূল শত্রু। কিন্তু তাই বলে যারা মনে করেন যে বিজেপিকে আটকাতে তৃণমূলকেই রাজ্যের গদিতে আসীন রাখতে হবে তারা পশ্চিমবঙ্গের মানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছেন। বিজেপি-র বিকল্প হিসেবে একটি দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজবিরোধীদের আশ্রয়স্থল দলকে যদি মান্যতা দেওয়া হয়, তবে তা আখেরে বিজেপির পক্ষেই যাবে। অতএব আমাদের ভরসা রাখতেই হবে বাম শক্তির উপর।

একদিকে যেখানে বিজেপি-র নবান্ন অভিযানে মানুষের জমায়েত এবং রাজনৈতিক বার্তা কোনোটাই মানুষের মনে দাগ কাটতে পারেনি, সেখানে বামপন্থীদের সমাবেশ, তাদের আন্দোলন প্রগতিশীল শিবিরে একটি সদর্থক বার্তা দিয়েছে। কলকাতায় বাম ছাত্রদের সমাবেশ, বর্ধমানে বামফ্রন্টের সাহসী আন্দোলন ও জমায়েত এবং লাগাতার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বামপন্থীরা রাজ্যের শাসক দল এবং সরকারের বিরুদ্ধে লাগাতার রাস্তায় থেকেছেন যা বাম প্রতিস্পর্ধার রাজনীতির বার্তা দিচ্ছে। এই বার্তা আরো বেশি করে ছড়িয়ে পড়ুক, বাম প্রগতিশীল শক্তিরা বিজেপির মতন সাম্প্রদায়িক শক্তির থেকে বেশি শক্তি অর্জন করে তৃণমূলের বিরোধিতা করুক এটি প্রত্যেক বাম মনস্ক মানুষের আকাঙ্ক্ষা। আমরা আশা করি বামপন্থীরা তাদের গুরুদায়িত্ব উপলব্ধি করে তৃণমূল এবং বিজেপির মতন দুটি স্বৈরাচারী এবং প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরুদ্ধে লাগাতার আন্দোলন সংগ্রামে থাকবেন।

তবু কিছু কথা থেকে যায়। প্রথমত, গোটা পৃথিবী তথা আমাদের দেশে বাম মতাদর্শ নানান প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে বিশেষ করে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে। বামপন্থীরা যেহেতু সমাজতন্ত্র নির্মাণে বিশ্বাসী তাই একবিংশ শতাব্দীর সমাজতন্ত্র বিংশ শতাব্দীর সমাজতন্ত্রের মতনই হবে নাকি নতুন উপাদান তাতে যুক্ত হবে সেই প্রশ্নের মীমাংসা করা প্রয়োজন। বিশেষত ভারতের মতন একটি সুমহান দেশ, যেখানে জাতিপ্রথা মানুষকে যুগের পর যুগ অবদমিত করে রেখেছে, যেখানে সংখ্যালঘুদের উপরে অত্যাচার লাগাতার বেড়ে চলেছে সেখানে দলিত-আদিবাসী-সংখ্যালঘুদের আন্দোলন, তাদের প্রতিনিধিত্বের দাবিকে নিছক পরিচিতি সত্ত্বার রাজনীতি বলে দাগিয়ে দিয়ে, শুধুমাত্র বিশুদ্ধ শ্রেণি রাজনীতির চর্চা কতটা ফলপ্রসু হতে পারে তা নিয়ে যথেষ্ট ভাবার অবকাশ রয়েছে। এই প্রশ্ন বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষিতে। একদিকে বিজেপি হিন্দুত্বের রাজনীতির মাধ্যমে, হিন্দুদের এক করার স্লোগান দিয়ে, বিভিন্ন তফশিলী জাতি ও জনজাতির সমর্থন আদায়ে সমর্থ হয়েছে। মতুয়াদের মধ্যে বিজেপির উত্থান, পশ্চিমবঙ্গের আদিবাসী অধ্যুষিত জেলাগুলিতে বিজেপি-র উত্থান এই কথাই প্রমাণ করে যে বিজেপি সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা মানুষের সমর্থন আদায়ে অনেকটাই সক্ষম হয়েছে। বামপন্থী শক্তি এই রাজ্যের বুকে দীর্ঘদিন এই বর্গের মানুষের সমর্থন পেয়েছেন। কিন্তু এখন তারা বামপন্থীদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। অন্যদিকে, তৃণমূল যেহেতু একটি মতাদর্শহীন দল, তারা এই সমস্ত মতাদর্শগত বা রণকৌশলগত প্রশ্নে কোনো অবস্থান নেবে না। তাদের নেতা ও কর্মীদের পকেট যেই রাজনীতিতে ভরবে তারা তাই করবে। বিজেপি আবারো শক্তিশালী হয়ে উঠলে তাদের একটা বড় অংশ আবার বিজেপিতেই ফিরে যাবে। এই পরিস্থিতিতে একদিকে বামপন্থীদের যেমন রাস্তার আন্দোলনে লাগাতার অংশগ্রহণ করতে হবে তেমনি মতাদর্শ এবং রণনীতিগত বিতর্ক চালিয়ে সর্বজনগ্রাহ্য একটি অবস্থানে বামপন্থীদের আসতে হবে। যেই স্বচ্ছ রাজনৈতিক অবস্থানের ভিত্তিতে সমাজের বৃহদাংশের সমর্থন তারা অর্জন করতে পারেন।

বামপন্থীদের মূল কর্তব্য তৃণমূল ও বিজেপির বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়াই-আন্দোলন পরিচালিত করা। কেন্দ্র ও রাজ্যের উভয় শাসকদলের বিরুদ্ধে আপসহীন এবং নিরন্তর সংগ্রাম, যা বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপট উপযোগী মতাদর্শের ভিত্তিতে তৈরি হবে, একমাত্র তাই-ই পশ্চিমবঙ্গকে এই গভীর তমসার হাত থেকে পরিত্রাণ দিতে পারে। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায় যে বামপন্থীরা আন্দোলনের থেকেও বেশি গুরুত্ব দিয়ে ফেলেন নির্বাচনী জোটের উপর। এই পত্রিকার সম্পাদকীয় কলামে আমরা আগেও লিখেছি আন্দোলনের মাধ্যমেই বন্ধু জুটবে। বামপন্থীরা আপসহীনভাবে দুই স্বৈরাচারী শক্তির বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রাম করলে অনেক বন্ধু তাদের সঙ্গে জুড়বেন। মতের অমিল থাকলেও নতুন বন্ধুদের সঙ্গে ন্যূনতম কর্মসূচীর ভিত্তিতে তৃণমূল এবং বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মাধ্যমেই পশ্চিমবঙ্গকে গভীর গহন অন্ধকার থেকে মুক্ত করা সম্ভব হবে।