আরেক রকম ● দশম বর্ষ অষ্টাদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ● ১-১৫ আশ্বিন, ১৪২৯
সম্পাদকীয়
অর্থব্যবস্থার অর্ধসত্য
অর্ধসত্য এবং মিথ্যার মাধ্যমে লাগাতার জনগণকে বিভ্রান্ত করা ভারতের শাসক দল বিজেপি এবং আরএসএস-এর একটি বৈশিষ্ট্য। অতএব ভারতের অর্থব্যবস্থা নিয়ে বিগত কয়েক দিনে মোদীর পোষ্য মিডিয়া এবং হোয়াটসঅ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয়ে তীব্র জাতীয়তাবাদী আলোচনা চলছে যে ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বছরে ভারতের অর্থব্যবস্থা তৎকালীন ঔপনিবেশিক প্রভু ব্রিটেনকে ছাপিয়ে এগিয়ে গিয়েছে। ভারত (মোট জিডিপি-র নিরিখে) ব্রিটেনকে পিছনে ফেলে বিশ্বের পঞ্চম বৃহৎ অর্থব্যবস্থা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। স্বাভাবিকভাবেই এই বিপুল সাফল্যের নেপথ্যে রয়েছে আমাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর অক্লান্ত পরিশ্রম - এমন আলোচনায় ছেয়ে গেছে সোস্যাল মিডিয়া।
সোনার উপরে সোহাগা হিসেবে আগস্ট মাসের শেষে আরো একটি খবরে মোদী-ভক্তকূল যারপরনাই আনন্দিত। ২০২২-২৩ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকে (এপ্রিল-জুন ২০২২) ভারতের জিডিপি বৃদ্ধির হার হয়েছে ১৩.৫ শতাংশ। এহেন বিপুল বৃদ্ধির হার প্রমাণ করে যে অতিমারির ফলে ভারতের আর্থিক বৃদ্ধিতে যেই শ্লথতা দেখা দিয়েছিল, তা এখন অতীত। আবারো মোদীজির অসাধারণ নেতৃত্বে ভারতের অর্থব্যবস্থা দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে, প্রচার চলছে হোয়াটসঅ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয়ে!
উপরের দুটি প্যারাগ্রাফে যেই তথ্য দেওয়া হয়েছে তা নির্ভুল। কিন্তু সেই তথ্যের যে ব্যাখ্যা বিজেপি-আরএসএস-মিডিয়া মানুষকে দিচ্ছে তা অর্ধসত্য এবং মিথ্যার মিশ্রণে তৈরি এক মাদকদ্রব্য যা মোদী-ভক্তদের লাগাতার নেশাতুর করে রাখলেও দেশের অর্থব্যবস্থার প্রধান সমস্যাগুলির কোনো দীর্ঘমেয়াদী সমাধান দিতে পারে না।
প্রথমেই তাকানো যাক ভারতের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপির আকারের দিকে। এই কথা ঠিক যে ভারতের মোট জিডিপি ব্রিটেনকে ছাড়িয়ে গিয়ে বিশ্বে পঞ্চম স্থান অধিকার করেছে। এই কথাও ঠিক যে শুধুমাত্র জিডিপি-র মাপকাঠিতে যদি অর্থব্যবস্থার উন্নয়ন মাপা হয়, তবে ভারতের এই সাফল্যর জন্য গর্ব হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু মোট জিডিপির পরিমাপ দিয়ে কোনো দেশের অগ্রগতির বিচার হয় না। তাই যদি হয়, তাহলে আমাদের ভেবে নিতে হবে যে ভারতের তুলনায় ইংল্যাণ্ড একটি পশ্চাদপদ দেশ। কথাটি ভুল বলেই অত্যন্ত হাস্যকর।
আসলে কোনো দেশের অগ্রগতি মাপতে হলে মাথা পিছু আয়ের হিসেব কষা জরুরি, মোট আয়ের নয়। যদি আমরা মাথা পিছু আয়ের নিরিখে ভারতের অগ্রগতিকে পরিমাপ করার চেষ্টা করি তাহলে দেখা যাবে যে, বর্তমানে ভারতের মাথা পিছু আয় বাংলাদেশের থেকেও কম। ২০২১-২২ সালে ভারতের মাথা পিছু আয় ছিল ১৯৩৫ ডলার, যেখানে বাংলাদেশের মাথা পিছু আয়ের পরিমাণ ১৯৬২ ডলার। ব্রিটেনের মাথাপিছু আয় ৪৩০০০ ডলারের বেশি। জি-২০ দেশগুলির মধ্যে ভারতের মাথাপিছু আয় সর্বনিম্ন। গোটা পৃথিবীর সর্বাধিক গরীব মানুষের বাস ভারতবর্ষে। অতএব আমাদের অর্থব্যবস্থার মধ্যে অধিকাংশ মানুষের জীবন ভালভাবে চলছে না। কারণ মাথা পিছু আয়ের হিসেবটি আর্থিক বৈষম্যকে আড়াল করে রাখে। মাথাপিছু আয়ের পরিসংখ্যানের মধ্যেই নিহিত রয়েছে এই ধারণাটি যে মোট আয়কে যদি সমানভাবে ভাগ করা হয়, তাহলে প্রত্যেক ব্যক্তি কত টাকা পাবে। কিন্তু ভারতের সবার আয় সমান নয়, রয়েছে ব্যাপক বৈষম্য। অর্থনীতিবিদ থমাস পিকেটি গণনা করে দেখিয়েছেন যে, ভারতের ধনীতম ১ শতাংশ মানুষ মোট আয়ের ২২ শতাংশের মালিক। এই পরিস্থিতিতে ভারতের গরীব অংশের মানুষের আয় অত্যন্ত কম। সেই হিসেবে না গিয়ে আমরা যদি উত্তরপ্রদেশের মতন বৃহৎ রাজ্যের মাথাপিছু আয়ের দিকে তাকাই তাহলে দেখা যাবে যে তা নেপাল বা তানজানিয়ার মতন গরীব দেশের থেকেও কম। অতএব ভারত ব্রিটেনকে মোট আয়ের নিরিখে ছাপিয়ে গেলেও ভারতের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা ব্রিটেনের সাধারণ মানুষের সঙ্গে তুলনীয় নয়। অথচ মিডিয়া তথা বিজেপি এমনভাবে প্রচার করছে যেন ভারত গ্রেট ব্রিটেনের তুলনায় বেশি ধনী হয়ে গিয়েছে। এই প্রচারটি অন্তঃসারশূন্য এবং সর্বৈব মিথ্যা।
অমর্ত্য সেন অবশ্য আমাদের অন্য একটি পাঠ দিয়েছেন যা ভারতের মিডিয়াকূল সম্পূর্ণভাবে ভুলে গিয়েছে। পাঠটি হল এই যে কোনো দেশের অর্থব্যবস্থার উন্নয়ন শুধুমাত্র মাথাপিছু আয়ের নিরিখে মাপার পদ্ধতিটি ত্রুটিপূর্ণ, কারণ উন্নয়নের যে বহুমুখী দিক রয়েছে তা শুধু আয়ের হিসেবে ধরা পড়ে না। বিশেষ করে স্বাস্থ্য এবং শিক্ষার মতন বিষয়গুলি দেখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই ধারণার ভিত্তিতে তৈরি করা হয় মানবোন্নয়ন সূচক। মানবোন্নয়ন সূচকের নিরিখে ভারতের স্থান ২০২১ সালের হিসেবে ১৯১টি দেশের মধ্যে ১৩২। এই সূচকে বাংলাদেশের স্থান ভারতের উপরে - ১২৯। ইরাক, বলিভিয়া, মরোক্কো, ভূটানের মতন দেশগুলি এই সূচকের নিরিখে ভারতের থেকে অনেকটাই এগিয়ে। অর্থাৎ মোট আয়ের নিরিখে ভারতের স্থান পঞ্চম হলেও মাথা পিছু আয় এবং মানবোন্নয়ন সূচকের নিরিখে অনেকটাই নীচে। তাই পঞ্চম হওয়ার আনন্দে গর্বিত না হয়ে ভারত সরকারের উচিত দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় এবং মানবোন্নয়নের উন্নতি করা। এই নিয়ে আলোচনা না করে শুধুমাত্র দেশপ্রেমের জিগির তুলে ভারতের অর্থব্যবস্থার সমস্যাগুলি আড়াল করা হচ্ছে।
এবারে আসা যাক আর্থিক বৃদ্ধির হারের প্রসঙ্গে। আবারো তথ্যে কোনো ভুল নেই। ভারতের বৃদ্ধির হার ২০২২-২৩ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকে ১৩.৫ শতাংশ। কিন্তু এই তথ্যের আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে কিছু নির্মম সত্য যা অত্যন্ত সচেতনভাবে বলা হচ্ছে না। যেমন ২০২০ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকে লকডাউনের ফলে ভারতের অর্থব্যবস্থায় এক ভয়াবহ মন্দা থাবা বসিয়েছিল। জিডিপি প্রায় ২৪ শতাংশ সংকুচিত হয়ে যায়। এমনকি ২০২১-২২ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকে জিডিপি ৮ শতাংশের বেশি সংকুচিত হয়। অতএব বর্তমান ত্রৈমাসিকে এই বিপুল বৃদ্ধির নেপথ্যে রয়েছে আগের বছরগুলির সংকোচন। যেমন ধরুন আপনার আয় যদি ২০২০ সালে ১০০ টাকা থেকে কমে ২০২১ সালে ৯০ টাকা হয়, তাহলে আপনার আয় ১০ শতাংশ হ্রাস পেল। আবার ২০২২ সালে আপনার আয় যদি বেড়ে ১০১ টাকা হয়, তাহলে ২০২১ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে আপনার আয়ের বৃদ্ধির হার হবে ১২ শতাংশের সামান্য বেশি, যদিও ২০২০ সালের নিরিখে আপনার আয়ের বৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ১ শতাংশ। ঠিক তেমনভাবেই আমরা যদি ২০১৯-২০ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকের সঙ্গে ২০২২-২৩ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকের তুলনা করি তাহলে দেখা যাবে যে এই তিন বছরে ভারতের আয় বেড়েছে মাত্র সাড়ে ৪ শতাংশ। অতএব আরএসএস-বিজেপি-মিডিয়া যেই দাবি করছে যে তাদের নেতৃত্বে ভারতের অর্থব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে অতিমারি এবং লকডাউনের প্রকোপে থেকে মুক্ত হয়ে গেছে তা ভ্রান্ত। অন্যদিকে ভারতের সর্বাধিক অকৃষি কর্মসংস্থান হয় খুচরো ও পাইকারি ব্যবসা, হোটেল রেস্টুরেন্ট, যোগাযোগ ব্যবস্থা - এই ক্ষেত্রগুলিতে। ২০২২-২৩ সালের ত্রৈমাসিকের হিসেবে দেখা যাচ্ছে যে এই ক্ষেত্রগুলি ২০১৯ সালের তুলনায় এখনো মন্দাবস্থায় রয়েছে। আর্থিক বৃদ্ধির পরিবর্তে এই ক্ষেত্রগুলিতে আর্থিক সংকোচন হয়েছে। অতএব ভারতের বেকারত্বের সমস্যার কোনো সুরাহা করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই শুধুমাত্র ২০২২-২৩ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকের বৃদ্ধির হারের চিত্রের মধ্য দিয়ে ভারতের সার্বিক অর্থব্যবস্থার হাল বোঝা সম্ভব নয়।
অর্থব্যবস্থার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক যা সাধারণ মানুষের জীবনে সর্বাধিক প্রভাব ফেলে তা হল মূল্যবৃদ্ধির হার। আগস্ট ২০২২ সালে পাইকারি দামের নিরিখে মূল্যবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশ। এর মধ্যে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হার ৭.৫৭ শতাংশ। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের নীতি অনুযায়ী ৬ শতাংশের বেশি মূল্যবৃদ্ধি অর্থব্যবস্থার পক্ষে মঙ্গলজনক নয়। অতএব একদিকে অতিমারির পরে আর্থিক বৃদ্ধির হার খুব বেশি বাড়েনি, অন্যদিকে মূল্যবৃদ্ধির হার বেশ কিছু মাস ধরে বাড়ছে। কর্মসংস্থানের অবস্থা তথৈবচ। সাধারণ মানুষের জন্য চাকুরি নেই, চাকুরি থাকলেও মূল্যবৃদ্ধির প্রকোপে প্রকৃত আয় নিম্নগামী। এই পরিস্থিতিতে যেই সরকার এবং শাসক দল অর্থব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি হয়েছে দাবি করে নিজেদের ঢাক নিজেরাই পেটায় তারা দেশের মানুষের নয় নিজের দলের এবং নেতার মঙ্গল চায়। অর্ধসত্য ও মিথ্যার এই রাজনীতির মাধ্যমে দেশের মানুষকে আর কতদিন বোকা বানিয়ে রাখা যায় প্রশ্ন এটাই।