আরেক রকম ● দশম বর্ষ সপ্তদশ সংখ্যা ● ১-১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ● ১৬-৩০ ভাদ্র, ১৪২৯

প্রবন্ধ

বাংলার নিরীক্ষা (অডিট) তরজা

সুখবিলাস বর্মা


বাংলার সংস্কৃতির অন্যতম ধারা তরজা ও কবিগান। গত বছর তিনেক বাংলার মানুষ নানা বিষয়ের উপর রাজ্যপাল বনাম রাজ্য সরকারের তরজা শুনে আসছে। ইতিমধ্যে প্রধান কবিয়াল 'kicked up' theory-তে প্রমোশন পেয়ে দিল্লী চলে গেছেন। অন্য পক্ষের প্রধান প্রেসিডেন্সী জেলে, 'দুয়ারে ইডি/সিবিআই' প্রকল্পের প্রথম শহীদ রূপে। দিল্লী পাড়ি দেওয়ার আগে তরজা প্রধান ধুয়া গাইলেন যে পশ্চিমবঙ্গে গত দশ বছরে এজি'র অডিট হয়নি। বাংলার সুধিজনেরা নড়েচড়ে বসলেন। কাগজে কাগজে এই নিয়ে লেখা বেরোলো, দুই একটি চ্যানেল তর্ক সভা (এটাও এক ধরণের তরজা) বসালো। ভাসা ভাসা আলোচনায় পর্বটি শেষ হোল। আমি জানি, সরকারী কাজের অডিটের পদ্ধতিগত খুঁটিনাটি বাংলার বিদ্বজ্জনদের বড় অংশেরই জানা নেই। তাই বিষয়টি নিয়ে একটু চর্চা অবান্তর হবে না।

সংবিধান অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারগুলির আয়-ব্যয়ের হিসাব পরীক্ষার দায়িত্ব Comptroller and Auditor General of India বা সিএজি'র। সংবিধানের ১৫১ নং ধারা অনুসারে মহাহিসাব-নিয়ামক ও নিরীক্ষক (সিএজি) রাজ্য সরকারের হিসাব ও আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত নিরীক্ষা সংক্রান্ত প্রতিবেদনসমুহ রাজ্যপালের মাধ্যমে বিধানসভায় পেশ করেন। এরপর রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থা সংক্রান্ত প্রতিবেদন যায় বিধানসভার কমিটি অন পাবলিক আন্ডারটেকিংস (সিওপিইউ)-এর কাছে, বাকিগুলো পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির (পিএসি'র) কাছে। প্রতিবেদন পাওয়ার পর সিওপিউ/পিএসি সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলির সাক্ষ্য (evidence) গ্রহণ করে কমিটির মতামত সহ প্রতিবেদন বিধানসভায় উপস্থাপিত করে।

বিগত কয়েক বছর থেকে Principal Accountant General (West Bengal) নানা অসুবিধার মধ্যেও রাজ্যের আর্থিক পরিস্থিতি এবং কিছু অর্থনৈতিক, সাধারণ ও সামাজিক বিষয় নিয়ে ইংরাজী ও বাংলা পুস্তকে প্রতিবেদন পেশ করেছে। গত ২৫/০৩/২০২২ তারিখেও ১৮টি প্রতিবেদন পেশ হয়েছে। সুতরাং অডিট হয়নি এই ধুয়া মোটেই সত্য নয়।

অডিট না করলে এজি (পশ্চিমবঙ্গ) এত বিশাল সাংগঠনিক পরিকাঠামো নিয়ে কি ভেরেণ্ডা ভাজছে? না তা নয়, অডিট করে চলেছেন তারা এবং তারই ফলশ্রুতি, একেবারে হাল আমল পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অডিট পর্যবেক্ষণের অসংখ্য রিপোর্ট বিধানসভায় পেশ করা হয়েছে।

তবে একথা ঠিক যে, সরকারের স্বগৌরব গাঁথার তথাকথিত 'Flagship Programme' যথা - সবুজ সাথী, খাদ্য সাথী/খাদ্য সুরক্ষা, স্বাস্থ্য সাথী, এক'শ দিনের কাজ, ইন্দিরা আবাস যোজনা, বাংলার বাড়ী, এসজেডিএ, বিলাসবহুল গেস্ট হাউস সহ উত্তরকন্যা নির্মাণ, ক্লাবকে অনুদান, পূজা কমিটিকে অনুদান, পুরোহিতদেরকে অনুদান, জেলায় জেলায় সরকারী টাকা খরচ করে তথাকথিত প্রশাসনিক মিটিং-এর নামে দলের মিটিং করা, প্রতিবার জেলা সফরের আগে পরে কাড়ি কাড়ি টাকা ব্যয়ে খবরের কাগজগুলোয় পাতাভর্তি বিজ্ঞাপন, বার্ষিক বাণিজ্য সম্মেলন, কন্যাশ্রী প্রমুখ 'শ্রী' সম্বলিত অসংখ্য নামের প্রোগ্রামের অডিট রিপোর্ট দিনের আলো দেখতে পায়নি, কারণ রাজ্য সরকার অডিট করতে দেয়নি। পিএসি'র প্রশ্নের মুখে এজির আধিকারিকরা স্বীকার করেছেন যে অর্থ বিভাগের নির্দেশে সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলি উল্লিখিত প্রোগ্রামগুলির তথ্য ও নথিপত্র অডিটকে দিতে অস্বীকার করেছে, যার জন্য অডিট করা সম্ভব হয়নি। অডিট করার প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেওয়ার জন্য প্রিন্সিপাল এজি'র অনুরোধ অর্থ বিভাগ কর্তৃক বার বার প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।

বাজেট ভাষণে সততার প্রতীকের প্রধান সাগরেদ অর্থমন্ত্রী মিত্র মশাই-এর দাবি যে 'বাংলার বাড়ী' প্রোগ্রামে চার বছরে ২৭ লক্ষ বাড়ী তৈরি হয়েছে, যদিও এই প্রোগ্রামের জন্য উক্ত বছরগুলিতে প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ তিনি দেখাতে পারেননি। অর্থমন্ত্রী মিথ্যাচারে বিধানসভাকে বিভ্রান্ত করছিলেন, তাই তাঁর বিরূদ্ধে প্রিভিলেজ কেস করতে হয়েছে। এতদিনে কেন্দ্রীয় টিমের পরিদর্শনের আগে জেলায় জেলায় ইন্দিরা আবাস প্রকল্পের টাকায় তৈরি বাড়ীগুলোর 'বাংলার বাড়ী' নামে প্ল্যাকার্ড খুলে ফেলা হল। বোঝা গেল, এ রকম মিথ্যা দিয়ে বাংলার মানুষকে, সাথে সাথে কেন্দ্রীয় সরকারকে, ঠকিয়ে চলেছেন মমতা। এমন জালিয়াতির ঘটনা দেখা যাচ্ছে রেশন বাবদ প্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সাহায্য, একশো দিনের কাজে কেন্দ্রীয় সহায়তা, শিক্ষা সংক্রান্ত অর্থ সাহায্য, খাদ্য সুরক্ষার টাকায় খাদ্যসাথী ইত্যাদি নানা খাতে। অডিট না হওয়ার জন্য সঙ্গত কারণেই কেন্দ্রীয় সরকার অনেক প্রকল্পের টাকা আটকে দিয়েছে। একশ দিনের কাজে গরীব মানুষের কোটি কোটি টাকার মজুরী বাকি আছে।

যতটুকু অডিট হয়েছে তাতেই প্রভূত আর্থিক অনিয়ম ও তছরুপের ঘটনার প্রকাশ। অ্যাবস্ট্রাক্ট কন্টিনজেন্ট বিলে (এ সি বিল) তোলা টাকার ডিটেল্ড কন্টিনজেন্ট বিল (ডি সি বিল) ৬০ দিনের মধ্যে সিএজি'র কাছে পেশ করার কথা। সিএজি'র রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১২-১৩ থেকে ২০১৮-১৯-এর আগস্ট পর্যন্ত বকেয়া এ সি বিলের পরিমাণ কোটি টাকার অঙ্কে যথাক্রমে ৮০০, ৯১০, ১,৫৮৭, ৩,০৭৫, ২,৩৫৭ এবং ২,১৭২। এই টাকা কিভাবে কোথায় খরচ হয়েছে সরকারের জানা নেই।

স্বাস্থ্য পরিষেবায় জেলা হাসপাতাল ও প্রাইমারী হেল্থ সেন্টারে ডাক্তার, নার্স ও প্যারামেডিক্স-এর সংখ্যার ঘাটতি যথাক্রমে শতকরা ৪৬, ৩৫ ও ৬৯। অপরিহার্য ওষুধের যোগানে ঘাটতি জেলার ক্ষেত্রে ৬০-৬৬%, প্রাইমারী ক্ষেত্রে ৪৫-৯৫%। প্রাইমারী হেল্থ সেন্টার ও স্টাফ কোয়ারটারসের অবস্থা প্রায় সর্বত্র জীর্ণ দশাগ্রস্ত।

শিক্ষা বিভাগের সেকেণ্ডারি স্তরের স্কুলগুলির পরিকাঠামোগত অবস্থা যথা, শ্রেণীকক্ষ-ছাত্র অনুপাত, শিক্ষক-ছাত্র অনুপাত, ল্যাবরেটরি, লাইব্রেরী, কম্পিউটার রুম, টয়লেট ব্যবস্থা ইত্যাদি সবেতেই খারাপ অবস্থা।সিএজি'র মতে, বিভাগের দেওয়া তথ্য বিশ্বাসযোগ্য নয় কারণ বিভিন্ন প্রকল্পের তথ্যে মিল নেই। Retention-এর কি অবস্থা? রাজ্যের গ্রাম্য স্কুলে ২০১২-১৩-তে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হওয়া ৯,৮৪,৪৯৯ সংখ্যা ২০১৫-১৬-তে দ্বাদশ শ্রেণীতে দাঁড়িয়েছে ৫,২৩,৭১৫।

সেপ্টেম্বর ২০১৯ পর্যন্ত প্রধানত কেন্দ্রীয় সাহায্য ও রাজ্য অর্থের খরচের ২,০০,৭৭২ কোটি টাকার Utilisation Certificate পাওয়া যায়নি, ১৯৩টি স্বশাসিত সংস্থা ৭৬৯টি বার্ষিক হিসাব দেয়নি। কার টাকা কোথায় গেছে জানা নেই। যেমন, ২০১৯-এর জানুয়ারিতে কৃষক বন্ধু প্রকল্পে দেওয়া ৪,০০০ কোটি টাকার মধ্যে অর্থমন্ত্রীর অনুমোদন ক্রমে ৩,৫০০ কোটি রাখা হয় West Bengal State Seed Corporation-এর Term Deposit এবং ৩৭৯.৪৭ কোটি Current Account-এ। ৪,০০০ কোটির মধ্যে কৃষক পেয়েছে ১২০ কোটি। কৃষক দরদের অপূর্ব নিদর্শন। অডিট রিপোর্টে রাজ্য সরকারের ঋণের বিষয়ে মন্তব্য দেখলে মাথা খারাপ হয়ে যায়।

অডিটের পর রিপোর্টের উপর প্রধান কাজ পিএসি কর্তৃক সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলির সাক্ষ্য গ্রহণ। এই সাক্ষ্য গ্রহণের সময়েই খানিকটা হলেও প্রকাশ্যে আসে 'ঝুলি থেকে বেড়াল'। সিএজির অডিট এবং সংশ্লিষ্ট সব কিছুর প্রধান উদ্দেশ্য সংবিধানের ধারা অনুযায়ী বিধানসভার কাছে সরকারের দায়বদ্ধতা (Accountability) পালন করা। সেই জন্যই পার্লামেন্ট সহ সমস্ত রাজ্যে পিএসির চেয়ারম্যান হন বিরোধীদল মনোনীত কোন সাংসদ/বিধায়ক। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভাতেও ২০১৫-১৬ বছর পর্যন্ত একই নিয়ম চলেছে। কিন্তু ২০১৬-তে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়াকে মার্ডার কেসে জড়িয়ে তৃণমূলে যোগদান করালেন এবং বিরোধী দলের বিরোধিতা সত্বেও ভুঁইয়াকে পিএসি'র চেয়ারম্যান করলেন। ভুঁইয়া তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্যসভার সদস্য হওয়ার পরে পিএসির চেয়ারম্যান হলেন কংগ্রেস থেকে তৃণমূলে যোগ দেওয়া শঙ্কর সিংহ। দু' বছরে কমিটির performance এতই খারাপ যে ২০১৮-১৯-এ বাধ্য হয়ে বিরোধীদের দাবী মেনে চেয়ারম্যান করা হল আমাকে, ডঃ সুখবিলাস বর্মাকে। আট বছরের বেশী বাজেট নিয়ে কাজ করা এবং অতীতে পিএসি'র সম্মুখীন হয়ে সাক্ষ্য দেওয়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে কাজ করে লকডাউনের পিরিয়ড বাদ দিয়ে সীমিত সময়ে রিপোর্ট পেশ করেছি ১২ খানা। ২০২১-এ আবার বিজেপি থেকে তৃণমূলে আসা প্রথমে মুকুল রায় এবং পরে কৃষ্ণ কল্যাণীকে চেয়ারম্যান করা হয়েছে। পিএসির চেয়ারম্যানের পদটিতে নিজের লোক রাখার পাকা ব্যবস্থা করছেন সততার প্রতীক মমতা বন্দোপাধ্যায়। কোন সদুদ্দেশ্যে?

সংবিধান অনুযায়ী বিধানসভার অনুমোদন ছাড়া সরকার এক কপর্দকও ব্যয় করতে পারে না - তাই পিএসি'র প্রথম ও প্রধান কাজ বাজেট অতিরিক্ত ব্যয় নিয়মিতকরণ। সিএজি'র রিপোর্ট স্ক্রুটিনি করে সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলির সাক্ষ্য ভিত্তি করে পিএসি বিধানসভার কাছে প্রতিবেদন পেশ করলে অর্থ বিভাগ বিধানসভায় বিল পেশ করে ব্যয়গুলির নিয়মিতকরণ করে। বহু বছরের নিয়মিতকরণ বাকি ছিল। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে অর্থ বিভাগকে দিয়ে ২০০৮ পর্যন্ত ব্যয়ের নিয়মিতকরণ সম্ভব হোল। পরবর্তী অনেকগুলো বছরের নিয়মিতকরণ রিপোর্ট পিএসি কর্তৃক পেশ করা হলেও, বিষয়টি বার বার বিধানসভার অধ্যক্ষ, পরিষদীয় মন্ত্রী, অর্থমন্ত্রীর দৃষ্টিগোচর করা সত্বেও অর্থ বিভাগ এই সংক্রান্ত বিল পেশ করতে পারল না। সিএজির ২০২০ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী ২০০৯ থেকে ২০১৮ সময়কালে ২৬,৬৯৫ কোটি টাকার অতিরিক্ত ব্যয় নিয়মিতকরণ বাকি আছে। মুখ্যমন্ত্রীর অনুমোদন বা অনুপ্রেরণার অভাবে অধ্যক্ষ বা অর্থমন্ত্রী এই সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। সংবিধানের বাধ্যবাধকতা সত্বেও বিধানসভার অধ্যক্ষ সহ দলের ২নং, ৩নং নেতাদের অসহায়তা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করেছি এবং তৃণমূল সরকার ও দলে মমতার অনুপ্রেরণা ছাড়া কিছুই নড়েনা সেটা আরেকবার বিশেষভাবে উপলব্ধি করেছি।

অথচ সেই মমতাই না জানার ভান করে বলছেন যে, বাংলায় চাকরি প্রার্থীদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া কাণ্ডে অর্পিতা-পার্থ (অপা)-র লীলার তিনি কিছুই জানেন না। এই রাজ্যে শিক্ষা বিভাগ সহ সব চাকরির জন্য লাখ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয় তা নিয়ে কত প্রতিবেদন বেরিয়েছে, বিধানসভায় কতবার বিরোধীরা সরব হয়েছে, হাইকোর্টে কত কেস হয়েছে, কত শিক্ষকের চাকরি গেছে, তিনি নিজেই বিভিন্ন সভা সমিতিতে চাকরির জন্য ঘুষ, সিণ্ডিকেটবাজি, কাটমানি ইত্যদি নিয়ে সাবধান করে দিয়ে বলেছেন যে, কালিঘাটকে ভাগ না দিয়ে এসব কাজ চলবে না। অনুব্রত মণ্ডল প্রমুখ নেতানেত্রীদের কাছ থেকে কয়লা, গরু, চাকরি ইত্যাদি বাবদ কোটি কোটি টাকার আমদানি, সোনা স্মাগলিং-এ জড়িত ব্যক্তিকে পুলিশ পাঠিয়ে কাস্টমস থেকে ছিনিয়ে আনা ইত্যাদি সবই ভুলে গেছেন আমাদের বাংলার গর্ব। যে কথা বাংলার আপামর জনগণ জানেন সেটা দল ও সরকারের সর্বময় কর্ত্রী, যিনি প্রকাশ্য জনসভায় ডিএম, এসপি, বিডিও, ওসিদের নাম ধরে ডাকেন, তিনি জানেন না। অর্থাৎ তিনি স্বীকার করছেন যে তিনি এক অপদার্থতম প্রশাসক। স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে তিনি সব দোষ বিরোধী ও কেন্দ্রীয় সরকারের উপর চাপিয়ে, বাঙালীর গরিমায় সুড়সুড়ি দিয়ে পার পেতে চাইছেন। জানি না, বাঙালিরা এত বোকা কি না!

পার্থকে বলির পাঁঠা করা হয়েছে; কিন্তু সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারী তো মমতার স্বরাষ্ট্র বিভাগের সিভিক ভলাণ্টিয়ার (পুলিশ) নিয়োগে। এই রাজ্যে গত কয়েক বছরে পুলিশ, ফায়ার ব্রিগেড, কৃষি, শিল্প যে বিভাগেই নিয়োগ হোক না কেন, সবেতেই টাকার খেলা। সবটাই হয়েছে মমতার মদতে। অন্যদিকে রাজ্যে বড় কেলেঙ্কারিগুলির অন্যতম কেলেঙ্কারি হয়েছে গ্রন্থাগার বিভাগে। ত্যাগ ও মহত্ব প্রকাশের জন্য মমতা বন্দোপাধ্যায় সুযোগ পেলেই ঘোষণা করেন যে তিনি সরকার থেকে বেতন নেন না, সংসার ও দল চালান ছবি বিক্রী করে এবং এখন বই বিক্রীর রয়্যালটি থেকে। তাঁর ছবির ইতিহাস তো বাংলার মানুষ জানে - এক কোটি ছিয়াত্তর লক্ষ টাকায় একটি ছবি সারদা, রোজভ্যালি বা অন্য কোন কোম্পানি কিনেছে সে উত্তর তিনি আজও দিতে পারেননি। ছবি ছেড়ে কবি হয়েছেন - ইতিমধ্যে তিনি ১২০ খানা বই লিখেছেন এবং সেগুলির রয়্যালটিই নাকি তাঁর আয়ের মূল উৎস। বইগুলির গুণগত মান কেমন, ক্রেতা কারা? গ্রন্থাগার বিভাগকে জিজ্ঞেস করুন। বাংলার গ্রামীন থেকে স্টেট লাইব্রেরী সব জায়গাতে পাবেন মুখ্যমন্ত্রীর গাদাগাদা বই। সরকারী অর্থ মুখ্যমন্ত্রীর পকেটে (আঁচলে) পাঠানোর, অর্থ তছরুপের অপূর্ব কৌশল। এই প্রোগ্রামে লাইব্রেরী মন্ত্রীর কোন ভূমিকা আছে বলে জানি না। আর এমন প্রোগ্রামের অডিট করতে সরকার কি সম্মতি দিতে পারে?

মমতার প্রশাসনে প্রথমবার প্রাইভেট সেক্টর থেকে পিএসসির চেয়ারম্যান হয়েছে - মহামান্য হাইকোর্টে বিসিএস নিয়োগের মহা কেলেঙ্কারীর কেস হয়েছে। আর সব নিয়োগে অনিয়ম বেনিয়মের শিকার হয়েছে প্রধানত বাংলার তফসিলী জাতি, জনজাতি এবং ওবিসিরা।সংরক্ষণ আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে চলছে মহান নেত্রীর ধোঁকাবাজি ও পাহাড় প্রমাণ ভ্রষ্টাচার।

অপা কাণ্ডে অভিষেক বন্দোপাধ্যায় বলেছে যে, উদ্ধার হওয়া টাকা তৃণমূলের নয় বা তাদের নয়। তাহলে এ টাকা তো প্রধানত পার্থর ভাগের টাকা। তাপস রায়ের ভাষায় 'ষড়যন্ত্রে' পারদর্শী পার্থ মমতার নির্দেশ মতো ঠিক ঠিক জায়গায় ভেট পাঠানোর পর তাঁর ভাগের টাকা যেমন ইচ্ছে খরচ করেছেন - প্রচুর সম্পত্তি কিনেছেন, আত্মীয়স্বজনকে দান করেছেন, একাধিক বান্ধবীদের হেফাজতে ক্যাশ রেখেছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। তাহলে এই কাণ্ডে অর্থ-সম্পত্তির বড় অংশটির নাগাল পেতে গেলে ইডিকে যেতে হবে তৃণমূল ভবনে, বন্দোপাধ্যায় পরিবার ও অনুব্রত প্রমুখের গোপন কুঠুরিগুলোতে, হয়ত সুইজারল্যান্ড পর্যন্ত যেতে হতে পারে। ইডিকে খুঁজে বের করতে হবে যে গত কয়েক বছরে সুন্দরবন, পাহাড় ও ডুয়ার্স, জঙ্গলমহল, সমুদ্রসৈকত এলাকায় গড়ে ওঠা বিলাসবহুল রিসোর্টগুলির মালিক কোন অপা, অম, অঅ বা অগৌ, অসৌ। ইতিমধ্যে গরু পাচার কাণ্ডে অনুব্রত ইডির হেফাজতে এবং তারও অঢেল অর্থ সম্পত্তির হদিস মিলেছে। অভিষেক এখনো বলেনি যে ঐ অর্থ সম্পত্তিতে তাদের ভাগ নেই।

গোটা কাণ্ডে বাংলার গর্ব ক্ষুব্ধ হয়েছেন এই জন্য যে ইডি পার্থ ও অর্পিতার বাড়ীতে হানা দিয়েছে মধ্যরাতে এবং মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীকে না জানিয়ে। এতে বাংলাকে, বাংলার গর্বকে অপমান করা হয়েছে। তাঁকে জানিয়ে অপারেশন করলে তিনি টাকা ও নথিপত্র সরানোর ব্যবস্থা করতে পারতেন, যেমনটি করেছেন বারুইপুর বাগানবাড়ি থেকে টাকা নথিপত্র ভর্তি বস্তা/থলি চুরি করিয়ে, এবং টাকা সোনা হীরায় ভরা অর্পিতার চার খানা বিলাসবহুল গাড়ি হাপিস করে দিয়ে। বাংলার তথাকথিত সুদক্ষ পুলিশ প্রশাসনে এমন নির্লজ্জ ঘটনা মমতার মদত ছাড়া সম্ভব? তেমনি দিনের বেলা অপারেশন করলে দলের লোক সমাবেশ করে অপারেশন ভণ্ডুল করতে পারতেন। কয়েক দিন আগে বেহালায় এক সভায় তিনি এমনই উস্কানি দিয়ে বলেছেন যে, তাঁর বাড়িতে যেদিন ইডি বা সিবিআই হানা দেবে সেদিন যেন মানুষ রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানায়। হায়রে বাঙালি!

ইডি অন্যায় করেছে, হয়ত তাঁর এই ক্ষোভের কথা বলতেই তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে গেছেন ভাইপোকে সঙ্গে নিয়ে। বলতে গেছেন, ইডি কাণ্ড যেন আর বেশীদূর না এগোয় - যেমনটি হয়েছে সারদা, নারদা, রোজভ্যালির ক্ষেত্রে। বাংলায় এখন ১৮ জন বিজেপি সাংসদ এবং ৭০ জনের বেশী বিধায়ক, তার জন্য মমতার প্রতি মোদী শাহের কৃতজ্ঞ থাকার কথা, সেটা আর একবার মনে করাতে গেছেন আমাদের মুখ্যমন্ত্রী। নীতি আয়োগের সভায় যোগদান করা বা বকেয়া টাকার দাবী নিয়ে দরবার অজুহাত মাত্র। প্রথমটির ব্যাপারে তিনি কোনও দিনই সিরিয়াস ছিলেন না, দ্বিতীয়টি সম্পর্কেও তিনি ভালোভাবেই জানেন যে কেন্দ্রীয় করের ভাগের টাকা তিনি দরবার ছাড়া এমনিতেই পাবেন (ইতিমধ্যে পেয়েও গেছেন), কিন্তু অডিট করতে না দিয়ে দুর্নীতির চারণভূমি 'শিক্ষা'র অন্তর্গত সমগ্র শিক্ষা মিশন বাবদ ১৫,৮৬৪ কোটি, একশ দিনের কাজে ৬,৫৬১ কোটি, খাদ্য ভর্তুকির ১,২৬৩ কোটি, এবং সীমাহীন চুরির ক্ষেত্র বুলবুল, আমপান ও ইয়াস-এর ক্ষতিপূরণ বাবদ ৪২,৮৬৬ কোটি টাকার বকেয়া দাবির কোনও সারবত্তা নেই। বুলবুল ও ইয়াস-এ তেমন কিছু হয়নি আমরা সবাই জানি। Economic Review ২০২০-২১-এর রিপোর্ট অনুযায়ী ২০২০ সালের আমপানের জন্য মোট খরচ হয়েছে ১,৯৬৯ কোটি টাকা। অথচ রাজ্য সরকার আমপান বাবদ দাবি করছে ৩২,৩১০ কোটি। প্রধানমন্ত্রী তাঁর প্রাথমিক সফরেই নাকি ১,০০০ কোটি মঞ্জুর করেছিলেন! আসলে, মমতাকে এসব করতে হচ্ছে বাংলার মানুষের নজর ঘুরিয়ে ধোঁকা দেওয়ার জন্য।

সব দেখেশুনে লালনের সুরে দু' কলি লিখতে ইচ্ছে করছে,
ধন্য ধন্য বাংলার গর্ব তুমি
কী দিয়ে গড়েছেন তোমায় অন্তর্যামী
।।