আরেক রকম ● দশম বর্ষ সপ্তদশ সংখ্যা ● ১-১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ● ১৬-৩০ ভাদ্র, ১৪২৯

প্রবন্ধ

পাড়াগাঁয়ের ভবিষ্যৎ

অশোক সরকার


প্রথম খটকা লেগেছিল কোভিডকালে দেশের অর্থনৈতিক বিকাশের তথ্য দেখে। কৃষির বিকাশ ৩.৬%, আর দেশের অন্যান্য সব কটি উৎপাদন ক্ষেত্রের বিকাশ -৬% বা তারও নিচে। মানেটা কী? দেশের উন্নতির যে সব দিক নিয়ে সারাক্ষণ বুক ফুলিয়ে গলা কাঁপিয়ে গর্ব করা হয়, সেই তথ্য প্রযুক্তি, নির্মাণ, রপ্তানি, পরিষেবা, স্টার্ট আপ, সব ফেল, পাশ একমাত্র কৃষি? খটকার আরও কারণ ছিল। একাধিক সার্ভে দেখাচ্ছিল যে ধারাবাহিকভাবে কৃষিতে শ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু খটকার সব থেকে বড় কারণ ছিল কিষাণ আন্দোলন। কবে শুনেছেন শহুরে কোন পেশার ব্যক্তিরা একটানা ঘরবাড়ি, কাজকর্ম ছেড়ে চরম ঠাণ্ডা গরমের মধ্যে রাস্তায় বসে এক বছর চার মাস ধরে আন্দোলন করতে পেরেছে? এত শক্তি কোথা থেকে আসে? কিষাণ আন্দোলন শুরু হবার কয়েক মাস আগেই সারা দেশ দেখেছে কয়েক কোটি শহুরে শ্রমিকের পলায়ন। এঁরা ছিলেন সেই শ্রমিক, যারা গত কুড়ি বছর ধরে গ্রাম ছেড়ে শহরে খুঁজেছিলেন তাঁদের ভবিষ্যৎ। তাঁরা দেখেছিলেন গ্রামে তাঁদের কোন ভবিষ্যৎ নেই, যা আছে, তা একমাত্র শহরেই।

খটকাটা এই যে আমাদের জাতীয় ও স্থানীয় কথোপকথনে বিভিন্ন সময়ে স্ববিরোধী ছবি আঁকা হয়েছে। গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ স্পষ্টতই গ্রামজীবনের মধ্যে শুধু বেঁচে থাকার নয়, পূর্ণ বিকাশের প্রাণশক্তি দেখেছিলেন, মহাত্মা তো দেশের ভবিষ্যৎ কল্পনায় শহরসভ্যতাকেই ত্যাগ করেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ তা না করলেও শহরের পাশাপাশি গ্রামীণ জীবনকেও তার নিজস্ব শক্তিতে পুনর্গঠনের ডাক দিয়েছিলেন। কিষাণ আন্দোলনের সময় বারবার রবীন্দ্রনাথের আত্মশক্তির ধারণার কথা মনে পড়ছিল। অন্যদিকে আম্বেদকর গ্রামীণ জীবনকে দুর্গন্ধময় পঙ্কিল আখ্যা দিয়ে এক অর্থে গ্রামের বিনাশ দেখতে চেয়েছিলেন। বাংলা সাহিত্যেও এই পরস্পর বিরোধী ভাবনার প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় গ্রামীণ জীবনের শোষণ ও বঞ্চনার কাহিনি শুনিয়েছেন, বিভূতিভূষণ শুনিয়েছিলেন ক্ষয়িষ্ণু গ্রাম সমাজ ও গ্রাম থেকে শহরে আসার কাহিনি, আর তারাশঙ্করের লেখনীতে আমরা পেয়েছিলাম, গ্রামীণ জীবনের নানা পাঁকের কথা। সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, ৫০-এর দশকের পরে বাংলা সাহিত্যের মূল উপাদানগুলি আর গ্রামে রইল না, শহুরে হয়ে গেল। গত চল্লিশ বছরে একটাও বাংলা চলচ্চিত্র খুঁজে পাওয়া যাবে না, যার মূল চরিত্রে আছে এক জন চাষি।

সাহিত্য ছেড়ে দেশের নীতির দিকে তাকালে দেখি ৫০-এর দশকে গ্রামোন্নয়ন (তখন বলা হত কম্যুনিটি ডেভেলপমেন্ট) নামে এক বিশাল কর্মকাণ্ড শুরু হচ্ছে, ৭০ বছর পরেও দেশের ও রাজ্যের বাজেটে সবচেয়ে বেশি টাকা এই খাতেই খরচা হচ্ছে। পাশাপাশি ৬০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে কৃষি ও অন্যান্য গ্রামীণ ক্ষেত্রে আধুনিকীকরণের নানা পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলে একটা স্ববিরোধী চিত্র সামনে আসে। শহরকে ধরেই নেওয়া হচ্ছে উন্নত, আর গ্রামের ক্ষেত্রে উন্নয়নের প্রয়োজন আছে। গ্রাম হল পিছিয়ে পড়া, শহর আছে এগিয়ে। এই দ্বিভাগিতা (বাইনারি) মূলত ভারতের উপনিবেশিক উত্তরাধিকার। কিন্তু গ্রামোন্নয়ন মানে এই নয়, গ্রামও শহরের মতই অর্থনীতির কেন্দ্র হবে। গ্রামোন্নয়ন মানে ধরে নেওয়া হল ফসলের উদ্বৃত্ত উৎপাদন, আর তার সঙ্গে গ্রামের মানুষের জীবিকার সুরক্ষা, আর একেবারে ন্যূনতম পরিকাঠামোর ব্যবস্থা। গ্রাম হবে শহরের খাদ্য সরবরাহকারী আর লেবার সাপ্লাইকারী। কৃষি সংক্রান্ত সবচেয়ে বড় নীতি ছিল সবুজ বিপ্লব। সবুজ বিপ্লবের ফলে দেশের খাদ্য উৎপাদন অনেক বাড়ল, খাদ্য সঙ্কট থামানো গেল, কিন্তু গ্রামে অনাহার রয়েই গেল। এর সঙ্গে ভূমি সংস্কারকে ভুললে চলবে না। গ্রামকে শিকড় থেকে বদলাতে হলে ভূমি সংস্কারের কোন বিকল্প ছিল না। ভূমি সংস্কার আইন হল, বক্তৃতা হল, কিন্তু দেশের অধিকাংশ রাজ্যে ভূমি সংস্কার হল না। কিন্তু গ্রামীণ জনসংখ্যা বাড়তে থাকায়, ব্যক্তিপিছু জমি কমতে লাগল, আর তার থেকে উৎপন্ন হল উদ্বৃত্ত শ্রমিক, যারা শহরে এসে ভিড় জমালো। গত ১০০ বছরে দেশের জনসংখ্যার মধ্যে শহরবাসীর অনুপাত ১০% থেকে ৩২% হয়েছে, কিন্তু তার বড় অংশ আসলে গ্রাম থেকে আসা পরিযায়ী শ্রমিক। ৯০-এর দশকে এসে খাদ্য উৎপাদন আর বাড়ল না, কৃষকের আত্মহত্যা বাড়ল। ৫০ বছর পার করেও গ্রামোন্নয়নের মূল লক্ষ্য রয়ে গেল গ্রামীণ মানুষের জীবিকার সুরক্ষা, যে লক্ষ্যের ইংরেজি নাম livelihoods security, পাশাপাশি দেশের জন্য খাদ্য সুরক্ষা। গ্রামের সামাজিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং গণতন্ত্রের শিকড় সমাজের গভীরে নিয়ে যেতে ৯০-এর দশকে নিয়ে আসা হল রাজনৈতিক ও শাসন-কাঠামোর সংস্কারের প্রয়াস, যার অন্য নাম গ্রামীণ বিকেন্দ্রীকরণ বা পঞ্চায়েতি রাজ। সেই সংস্কারেরও একই হাল হল, দেশের বেশির ভাগ অংশে তা রয়ে গেল খাতায় কলমে।

নতুন শতাব্দীতে এসে গ্রামের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। একাধিক তথ্য দেখাচ্ছিল চাষি-র ছেলে আর চাষি হতে চাইছে না, অল্প বয়স্ক চাষি নেই বললেই চলে, ভারতীয় চাষির গড় বয়স ইতিমধ্যেই ৪৭ ছাড়িয়েছে। চাষের রোজগারে সংসার চলছে না, এবং গ্রামেও যাদের অবস্থা একটু ভালো তারা মূলত ব্যবসাদার, চাকুরে, দোকানি, কারখানার মালিক ইত্যাদি। সমাজতাত্ত্বিকদের মধ্যে কেউ কেউ বললেন গ্রাম সমাজ বলতে আমরা যা বুঝতাম, গ্রাম সমাজের বিবর্তনের উপর প্রায় পাঁচ ডজন বিখ্যাত গবেষণা গ্রাম সমাজের যে ছবি আমাদের সামনে রেখেছিল তা লুপ্তপ্রায়। সেই সামুহিক বন্ধন নেই, স্থানীয় অর্থনীতি-স্থানীয় জীবিকার উপর নির্ভরতা গেছে কমে, জাতি ও পেশার পারস্পরিক কঠিন বাঁধনও আর নেই, গ্রামীণ সংস্কৃতিও আর গ্রামীণ নেই। গ্রামের মানুষের মনের জগতেও আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে।

আঞ্চলিকভাবে ডিগ্রির তারতম্য থাকলেও এই ধারণার অন্তর্নিহিত সুরটি বুঝতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু সত্যিই কি আমরা বুঝেছিলাম? তা পরীক্ষা করতে গেলে শহরের উন্নয়নের কাহিনিটা আগে একটু বলে নিতে হয়। শহরের উন্নয়ন বিষয়টা আশির দশক থেকে প্রাধান্য পেতে শুরু করে। অদ্ভুতভাবে শহুরে উন্নয়নের কল্পনার কাঠামোয় শুধুমাত্র মেট্রোপলিটান শহরগুলি স্থান পেল, আমাদের দেশে যে ৭০০-র বেশি জেলা শহর আছে, আরও কয়েকশ পর্যটন শহর, শিল্প শহর আছে, সেগুলি স্থান পেল না। ৬০০০-র উপর ব্লক-টাউন আছে, তার কথা ছেড়েই দিলাম। অর্থাৎ শহর বলতে দেশের এলিট শুধুমাত্র দিল্লী, মুম্বাই, কলকাতা, বাঙ্গালোর ইত্যাদি কয়েকটা শহর বুঝল, তার বাইরে নয়, এবং শহরের উন্নয়নের সঙ্গে গ্রামের উন্নয়নের যে অন্তর্নিহিত সম্পর্ক আছে সেটা কোন কল্পনাতেই এলো না - না গ্রামের ভবিষ্যতের কল্পনায়, না শহরের।

চারটি মূল ধারণা আমাদের উন্নয়ন কল্পনাগুলিকে আকার দিয়েছে। এক, শহর হল অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভিত্তি, সেখানে যা করা হবে, তা মূলত অর্থনৈতিক উন্নয়নকে মাথায় রেখে; দুই, গ্রাম হল মূলত দেশের খাদ্য নিরাপত্তার ভিত্তি, তাই সেখানে যা করা হবে, তা মূলত উৎপাদককূলকে সুস্থভাবে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এবং তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য; তিন, শহরের উন্নয়নের সঙ্গে গ্রামের উন্নয়নের কোন সম্পর্ক নেই, আর চার, শহরের উন্নয়ন মানে মেট্রোপলিসের উন্নয়ন। আমাদের চোখ খোলার জন্য উল্টো করে বলা দরকার - শহরে সমাজ উন্নয়নের কোন দরকার নেই, গ্রাম অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্র নয়, মেট্রোপলিসের উন্নয়ন দরকার, মিউনিসিপালিটির উন্নয়ন দরকার নেই।

গ্রামকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সামগ্রিক দৃষ্টিতে দেখা হলে গ্রাম ও মফস্বল শহরগুলিকে এক সূত্রে গেঁথে উন্নয়নের কথা ভাবতে হত। একটা ছোট্ট কাহিনি শোনালে ব্যাপারটা স্পষ্ট হবে।

ঝাড়গ্রাম জেলার নয়াগ্রাম ব্লকে মহিলা চাষিদের এক চাষি কোম্পানি কাজ করছে। ২০০২ সালের প্রডিউসার কোম্পানি আইন অনুসারে চাষিরা সংঘবদ্ধ হয়ে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি তৈরি করতে পারে। সেই অনুযায়ী এখন সারা দেশে ১২,০০০-এর বেশি চাষি কোম্পানি তৈরি হয়েছে, এই চাষি কোম্পানিটি তারই একটি। এই কোম্পানির প্রায় ২,৭০০ জন শেয়ার হোল্ডার সবাই মহিলা, এবং তারা মাহাতো, মুর্মু, সোরেন, বাস্কে পরিবারের সদস্য। এই কোম্পানির শেয়ার হোল্ডাররা ছাড়াও আরও ৫,০০০, অর্থাৎ প্রায় ৭,৭০০ জন মহিলা চাষি কালো চাল, বাদামী চাল, বাদশাভোগ চাল, শালপাতার থালা, বাটি, কাঁচা হলুদ উৎপাদন করেন এবং চাষি কোম্পানিকে বিক্রি করেন। চাষি কোম্পানি সেগুলি স্থানীয় বাজারে এবং অন্য রাজ্যের ব্যবসায়িক সংস্থাকে বিক্রি করে। চাষ হয় সম্পূর্ণ জৈব পদ্ধতিতে; গত তিন বছর ধরে এই কোম্পানির অরগানিক সার্টিফিকেট আছে। কোম্পানির নিজস্ব চালকল আছে, শালপাতার থালা বাটি তৈরির কারখানা আছে, এখন কাঁচা হলুদ থেকে হলুদ পাউডার তৈরির কারখানা বসাচ্ছে। কারখানাগুলি মহিলারাই চালান। বছরে ৩ থেকে ৪ কোটি টাকার ব্যবসা করে এই কোম্পানি।

তারা যে যে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে, তার কয়েকটি উল্লেখ করলেই ছবিটা পরিষ্কার হবে। থালা, বাটি তৈরির মেশিন কলকাতা থেকে এসেছে, সেগুলি হাইড্রলিক হটপ্রেস মেশিন, অতি সাধারণ কারিগরিতে তৈরি। মেশিন মাঝে মাঝেই বিগড়ায়, তখন কলকাতা থেকে মেকানিক আনতে হয়। চাল কলের মেশিনগুলিও জটিল কিছু নয়, কিন্তু খারাপ হলে কলকাতার মেকানিক নির্ভর। থালা বাটি তৈরির কারখানায় ৪৪০ ভোল্ট চালিত চারটি মেশিন আছে, সব কটা একসঙ্গে চললে এলাকায় ভোল্টেজ কমে যায়, তখন লোকে ঝামেলা করে। পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির হিসাব নিকাশ, সরকারি নিয়ম পালন সাধারণ দোকানের হালখাতার চেয়ে অনেক জটিল। তার জন্য নির্দিষ্ট সফটওয়ার জানা শিক্ষিত হিসাবরক্ষক রাখতে হয়েছে, যাকে পেতে দেড় বছর সময় লেগেছে। এই ৭,৭০০ মহিলা চাষি নয়াগ্রাম ব্লকের ৬টা গ্রাম পঞ্চায়েতের ৯২টা গ্রামে ছড়িয়ে আছেন, প্রতি শুক্রবার এই গ্রামগুলি থেকে শালপাতা সংগ্রহ করতে একটা ছোট পিক আপ ট্রাক (চলতি কথায় বলে ছোট হাতি - টাটা ২০৭) বেরোয়। সব গ্রামে সেই গাড়ী ঢুকতে পারে না, মহিলারা মাথায় করে শালাপাতার বান্ডিল নিয়ে আসেন এক একটা রাস্তার মোড়ে। মরশুমি ধানও সেইভাবেই নিয়ে আসেন মহিলারা। অরগানিক সার্টিফিকেট পাবার জন্য চাষের জমি, বীজ, সার, ওষুধ, চাষ পদ্ধতি সংক্রান্ত বহু তথ্য রাখতে হয়, ও বহু ফর্ম ভর্তি করতে হয়, তার ইন্সপেকশন হয়। এছাড়া জৈব চাষ, জৈব সার, জৈব ওষুধ, বিশেষ প্যাকেজিং, শালপাতা গুদামজাত করা, তার হিসাব রাখা ইত্যাদি অনেক কিছু শিখতে হয়েছে এই মহিলাদের। এই সবেতেই তাঁদের পাশে আছে দাতা সংস্থার দান নির্ভর এক এনজিও। এই গ্রামগুলির কাছের মফস্বল শহর হল কেশিয়াড়ি, সেখান থেকে এই পুরো কর্মকাণ্ডে এক কণাও কিছু পাওয়া যায়নি, এমনকি ট্যালি (সবচেয়ে প্রচলিত আকাউন্টস সফটওয়ার) জানা বি.কম. পাস ছেলে বা মেয়েও নয়। সরকারি কোন প্রকল্প থেকেও কিছু পাওয়া যায়নি।

আমাদের কল্পনায় যদি গ্রাম ও মফস্বল শহর এক সূত্রে গেঁথে উন্নয়নের কথা ভাবা হত, তাহলে প্রতিটা গ্রামে ছোট হাতি ঢোকার মত পাকা রাস্তা থাকত, নির্ভরযোগ্য ৪৪০ ভোল্ট লাইন টানা থাকত। কেশিয়াড়ি শহরে এই সব মেশিন সারাবার মেকানিক পাওয়া যেত, কাজ জানা হিসাবরক্ষক পাওয়া যেত, জৈব চাষ শেখার জন্য কৃষি ট্রেনিং সেন্টার থাকত, এই ধরনের ব্যবসার ম্যানেজমেন্ট শেখার জন্য বিজনেস স্কুল খড়গপুরে থাকত (নয়াগ্রাম ব্লক থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে)।

এই প্রসঙ্গে মনে রাখবেন, সংগঠিত ক্ষেত্রে মাত্র ৫% সংস্থা আছে, এবং দেশের মোট কর্মীকুলের ২০% কর্মী সংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করে, কিন্তু সেই সংস্থাগুলি চালানোর জন্য ২৩টি বিজনেস স্কুল আছে। অন্যদিকে ৯৫% সংস্থাই অসংগঠিত ক্ষেত্রের অন্তর্গত, আর সেখানে ৮০% কর্মী কাজ করে। অসংগঠিত ক্ষেত্রের জন্য একটাও বিজনেস স্কুল নেই। যেমন একই ভাবে আমাদের চাষি তৈরির কলেজ নেই, আছে কৃষি দপ্তরে আর চাষবাস সংক্রান্ত কোম্পানিগুলিতে চাকরিতে ঢোকার জন্য কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।

এই একই যুক্তি অন্য ক্ষেত্রেও খাটে। তথ্য বলে দুধ, চাল, কলা, আলু, গম, আখ, সবজি, এবং কাপাস উৎপাদনে ভারত পৃথিবীর মধ্যে ১ থেকে ৩ নম্বর স্থানে আছে। কিন্তু এর পরের স্তরে অর্থাৎ গুদামজাত করা, ফসল সংরক্ষণ, সারা দেশে তার পরিবহন, চাষিদের কাছে সারা দেশের বাজার খুলে দেওয়া, প্রসেসিং, গুনমান উন্নত করা, প্যাকেজিং, চাষিদের অনুকূলে বাজার তৈরি - দুধকে বাদ দিলে বাকি সব কটিতে এই সমস্ত বিষয়ে আমরা ফেল। অর্থাৎ দুধে যা করা গেছিল, তার থেকে আমরা কোন শিক্ষা নিইনি।

শহর উন্নয়নের ক্ষেত্রেও একই কাহিনি। প্রায় ১,৫০০টি মিউনিসিপ্যাল টাউন আছে, যার অনেকগুলিই মেট্রোপলিসগুলি থেকে পুরনো। অথচ আমাদের শহুরে উন্নয়ন কল্পনায় তাদের কোন স্থান হয়নি, এই টাউনগুলির কোন ভবিষ্যৎমুখী ভিশন নেই। মিউনিসিপ্যালিটিগুলি মূলত রক্ষণাবেক্ষণের মানসিকতায় চলে। মেট্রোপলিটান অথরিটির মত কোন ম্যুনিসিপ্যাল ডেভেলপমেন্ট অথরিটি তৈরি হয়নি। একটা উদাহরণ দিই -

ওরচা মধ্যপ্রদেশের অন্যতম পর্যটন শহর, খাজুরাহোর পরেই তার স্থান। সেখানে আছে জাহাঙ্গীরের দুর্গ, ৮০০ বছরের পুরনো মসজিদ মন্দির, পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে পাহাড়ি নদী বেতোয়া, আরও অনেকগুলি ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান। অপূর্ব সুন্দর এই ছোট্ট শহর। শহরে বছরে তিনবার উৎসব হয়, কয়েক হাজার টন ফুল ব্যবহার হয়। ওরচা শহরের চারপাশে আছে ৬টি গ্রাম, ৬টি গ্রাম পঞ্চায়েত। একটি গ্রামেও ফুলের চাষ হয় না। ফুল আসে ১৫ কিলোমিটার দূরে ঝাঁসি শহরের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। ওরচা শহরের জঞ্জাল দুটি গ্রামের খালি জমিতে ফেলা হয়, তাই নিয়ে মিউনিসিপ্যালিটির সঙ্গে দুটি গ্রাম পঞ্চায়েতের মনোমালিন্য। ৬টি গ্রাম পঞ্চায়েতে ঘুরে ঘুরে মানুষকে জিগ্যেস করেছিলাম, এত বড় পর্যটক টাউন তাদের জীবনকে কি দিয়েছে? অল্প কিছু হকার বলেছিল তারা উৎসবের সময় রোজগার পায়। তাছাড়া বিশেষ কিছু নয়। মিউনিসিপ্যালিটির প্রশাসককেও একই প্রশ্ন করেছিলাম, উত্তরও একই ছিল। মিউনিসিপালিটি ও গ্রাম পঞ্চায়েতগুলি কোনদিন একসঙ্গে কোন মিটিঙে বসেনি। শুধু একবার জঞ্জালের দুর্গন্ধ নিয়ে গ্রামের লোকেরা প্রতিবাদ করেছিল তখন একবার মিউনিসিপালিটির চেয়ারম্যান গ্রামে এসেছিল।

ভারতের প্রায় ১,৫০০টি মিউনিসিপালিটির মধ্যে এমন কোন মিউনিসিপালিটি খুঁজে পাওয়া যাবে কি যারা তাদের চার পাশের গ্রাম পঞ্চায়েত বা পঞ্চায়েত সমিতিকে নিয়ে একসঙ্গে আগামী ৩০ বছরের পরিকল্পনা করেছে? এমন কোন সরকারি বা বেসরকারি নগর উন্নয়ন গবেষণা বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কি আছে যারা এই ধরনের ভবিষ্যতমুখী উন্নয়ন ভাবনা কি করে ভাবতে হয় তা শিখিয়েছে? উত্তরটা আমাদের সকলেরই জানা।

এই প্রসঙ্গে স্মার্ট সিটির কথা ওঠে। স্মার্ট সিটির ভাবনা কি রকম, তা নিয়ে যে এক ডজন উপস্থাপনা দেখেছি, তার সবই নগর উন্নয়ন কন্সাল্টান্ট কোম্পানির তৈরি - ফ্লাইওভার, হাইওয়ে, ওয়াই-ফাই, বিনোদন পার্ক, শপিং মল, কিছু আলংকারিক আলোকসজ্জা ছাড়া তার অন্য কোনো ছবি পাইনি। এই রকম একটা স্মার্ট সিটি উপস্থাপনা হয়েছিল অন্ধ্রপ্রদেশের কুরনুল শহরে। ঘটনাচক্রে সেখানে আমি উপস্থিত ছিলাম। কুরনুল শহরের দু'পাশ দিয়েই তুঙ্গভদ্রা নদী, কিন্তু শহরে জলকষ্ট। স্মার্ট সিটির উপস্থাপনা শুনে কোট-টাই পরা কন্সাল্টান্টগুলিকে জিগ্যেস করা হল, যে শহরের দু'পাশ দিয়েই নদী, সেই শহরে জলকষ্ট দূর করার কি পরিকল্পনা আছে তোমাদের? আগামী পঞ্চাশ বছরে এই শহর কতটা বাড়বে, কত লোক আসবে, তাতে আশেপাশের গ্রামগুলিতে কি প্রভাব পড়বে? উত্তর জানা নেই, কারণ প্রশ্নটাই সিলেবাসের বাইরে।

স্মার্ট সিটির পাশাপাশি, এবং কিছুটা বিপরীতে আরেকটি ধারণা উঠে আসছে। তাকে বলা হচ্ছে সমর্থ জেলা। ১,৫০০ মিউনিসিপ্যালিটি, আড়াই লক্ষ গ্রাম, ৬,০০০ ব্লক টাউন, সবই এই জেলার খাঁচার মধ্যে পড়ে। উন্নয়নের মুল কাঠামো যদি রাজ্যের রাজধানী আর মেট্রোপলিস না হয়ে জেলা হয়, তাহলে গ্রাম আর শহরকে এক সূত্রে গেঁথে উন্নয়নের কথা ভাবা যেতে পারে। তার জন্য বিশেষ বিজনেস স্কুল লাগবে, বিশেষ টেকনিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, বিশেষ ধরনের টেকনোলজি ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট, এবং গ্রাম-নগর উন্নয়নের সামগ্রিক শিক্ষা, গবেষণা, সরকারি কর্মসূচি লাগবে। কোনটাই রকেট সায়েন্স নয়।


তথ্যঋণঃ

1) https://rbi.org.in/scripts/AnnualReportPublications.aspx?Id=1315, Table II.1.3 Real GVA Growth.
2) IBID
3) https://economictimes.indiatimes.com/news/economy/indicators/share-of-agriculture-sector-in-employment-sees-steady-increase-cmie/articleshow/85266073.cms?from=mdr
4) Whither Indian Village, Dipankar Gupta, EPW, Volume 40, Issue 08, 19th February 2005.
5) Author’s interview with members of Aamon Mahila Cashi Producer’s Company Limited and PRADAN NGO on 5th August 2022.
6) https://www.rba.gov.au/publications/bulletin/2011/jun/3.html, Table-1.
7) Samarth Zilla, a framework for holistic governance and development, Vijay Mahajan, Yubraj Kalia, Rajiv Gandhi Institute of Contemporary Studies, 2019.