আরেক রকম ● দশম বর্ষ সপ্তদশ সংখ্যা ● ১-১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ● ১৬-৩০ ভাদ্র, ১৪২৯

সমসাময়িক

হঠাৎ উল্টো পথে...


আজাদি কা অমৃত মহোৎসব। হর ঘর তিরঙ্গা। সত্যি সত্যিই তো আনন্দের মরশুম। উৎসব উদযাপনের এই শুভ লগ্নে এল এক নতুন উপহার, যা একেবারেই অপরিচিত।

কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি (CCEA) গত ২৭শে জুলাই ব্রাজিলে BM-SEAL-11 প্রকল্পের উন্নয়নের জন্য ভারত পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন লিমিটেডের (বিপিসিএল) সম্পূর্ণ মালিকানাধীন সহযোগী সংস্থা ভারত পেট্রোরিসোর্সেস্ লিমিটেডের (বিপিআরএল) জন্য অতিরিক্ত ১,৬০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (প্রায় ১২,০০০ কোটি টাকা) বিনিয়োগের প্রস্তাব অনুমোদন করেছে।

এর ফলে ভারতের শক্তি নিরাপত্তা শক্তিশালী হবে বলে জানানো হয়েছে। ভারতের অপরিশোধিত তেল আমদানির ক্ষেত্রে নতুন সরবরাহকারীর সন্ধান মেলায় ব্যারেল প্রতি তেলের দাম এবং পরিমাণ (মিলিয়ন টন) নিয়ে দরাদরির সুযোগ পাওয়ার আশায় দেশের তেল কোম্পানিগুলি ব্রাজিল থেকে আরও অপরিশোধিত তেল সংগ্রহে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। প্রস্তাবে অন্ততঃ এমনটাই বলা হয়েছে। এবং স্বভাবতই এর জন্য দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও জোরদার করা সম্ভব হবে।

প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য বিপিআরএল ২০০৮ থেকে ব্রাজিলের এই প্রকল্পের অনুসন্ধান ও উন্নয়নের সাথে যুক্ত রয়েছে। এবং প্রকল্পের ৪০ শতাংশ বিপিআরএল-এর নিয়ন্ত্রণাধীন। তবে এই প্রকল্প থেকে গত এক দশকে বিপিআরএল লাভবান হয়েছে কিনা তার কোনো হদিস নেই।

বিপিসিএল বি-রাষ্ট্রীয়করণের জন্য অনেকদিন ধরেই চেষ্টা চলছে। ক্রেতা আগ্রহ না দেখানোয় বি-রাষ্ট্রীয়করণ প্রক্রিয়া আপাততঃ স্থগিত রয়েছে। সেই বিপিসিএল-এর মালিকানাধীন বিপিআরএল-এর জন্য এত দরদ কেন? বিশেষ করে যখন বিদেশি মুদ্রার ভান্ডার ক্রমশঃ সঙ্কুচিত হচ্ছে তখন একলপ্তে ১,৬০০ মিলিয়ন ডলার কম কথা নয়। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে। সরকারি বিবৃতি এই প্রসঙ্গে নীরব।

বিপিআরএলকে চাঙ্গা করে তোলার লক্ষ্যে কোনো গোপন পরিকল্পনা আছে কিনা তা বলা না গেলেও একটা কথা নিশ্চয়ই বলা যায় যে, প্রতিযোগিতার মাধ্যমে অপরিশোধিত তেলের আমদানি বাড়লে এবং দাম কমলে সাধারণ মানুষের কিছু সাশ্রয় হবে কি? আবার এমনও হতে পারে সরকারি অর্থে পুরো ব্যবস্থা সক্রিয় ও লাভজনক করে তোলার পর আবার বিপিসিএল-কে পূর্ব নির্ধারিত কোনো মিত্র সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া হবে। সত্যি সত্যিই কী হবে তা বলা মুশকিল। তবে নিঃসন্দেহে সিদ্ধান্তটি বেশ সন্দেহজনক।

একই দিনে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত বৈঠকের অব্যবহিত পরই মন্ত্রিসভার বৈঠকে ভারত সঞ্চার নিগম লিমিটেড (বিএসএনএল)-এর পুনরুজ্জীবনের জন্য ১ লক্ষ ৬৪ হাজার কোটি টাকার আর্থিক প্যাকেজের অনুমোদন দেওয়া হয়। এর মধ্যে নগদ সাহায্যের অঙ্ক প্রায় ৪৪ হাজার কোটি টাকা, আর বাকি ১ লক্ষ ২০ হাজার কোটি টাকার নগদ-বহির্ভূত সাহায্য মিলবে চার বছরে। তা ছাড়া, গ্রামাঞ্চলে ব্রডব্যান্ড পরিষেবা প্রদানের লক্ষ্যে গড়ে তোলা ভারত ব্রডব্যান্ড নেটওয়ার্ক লিমিটেড (বিবিএনএল)-এর সঙ্গে বিএসএনএল-এর সংযুক্তির কেন্দ্রীয় পরিকল্পনাতেও পড়েছে সিলমোহর। পরিষেবার মান বাড়াতে ও দেশজুড়ে বিএসএনএল-এর ফাইবার ভিত্তিক পরিষেবা বিস্তারেও সাহায্য করতে চাইছে কেন্দ্র। প্রশ্ন হল, সরকার যেখানে বারংবার বলে এসেছে যে, সরকারের ‘ব্যবসা করা’র কোনও কারণ ও প্রয়োজন নেই, সেখানে এ-হেন পদক্ষেপের কারণ কী? প্রশ্ন জাগে, বিএসএনএল-এর মতো একটা লোকসানে চলা সংস্থায় এত সরকারি টাকা ঢেলে কোন জনস্বার্থ পূরণের কথা ভাবা হচ্ছে?

পরিষেবার উন্নতি, বা আরও বেশি সংখ্যক মানুষের সাধ্যের মধ্যে টেলিকম ও ব্রডব্যান্ড পরিষেবা নিয়ে আসা - এ ক্ষেত্রে কোনও যুক্তিই খাটে না। এ বছর মার্চের শেষে দেশে তারযুক্ত এবং তারবিহীন টেলিফোন পরিষেবার মোট গ্রাহকের সংখ্যা ছিল ১১০ কোটির কাছাকাছি। তার মধ্যে বিএসএনএল-এর মোট গ্রাহক সংখ্যা ১২ কোটি - সেই উপভোক্তাদের মাত্র ৩.৮ কোটি রয়েছেন গ্রামাঞ্চলে। দেশের মোট গ্রামাঞ্চলের গ্রাহকদের সাপেক্ষে যার ভাগ ৮ শতাংশেরও কম। এ ক্ষেত্রে সিংহভাগ দখল করে আছে বেসরকারি টেলিকম সংস্থাগুলি। বিশ্বে যে সব দেশে টেলিফোন ও মোবাইল ডেটার শুল্ক সবচেয়ে কম, তাদের একটি ভারত। ফলে, এই পরিষেবাকে সাধারণ মানুষের নাগালে আনার জন্য বাড়তি কোনও উদ্যোগের প্রয়োজন নেই। তিন বছর আগেও সংস্থার পুনরুজ্জীবনের জন্য প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা ঢেলেছিল কেন্দ্র। কিন্তু লাভ হয়নি। সে বছর ফোর-জি পরিষেবা চালু করার জন্য সরকার থেকে মিলেছিল ২৪ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু সংস্থার প্রযুক্তি সে ভাবে উন্নত না হওয়ায় আয় নিম্নগামী হয়। এবং এমনও অভিযোগ উঠেছে, ২০১৯ থেকে ফোর-জি স্পেকট্রামের আশ্বাস দিলেও পরিষেবা শুরুর পথে বাধা তৈরি করেছে খোদ সরকারই। ফলে, এখনও সারা দেশে বিএসএনএল ফোর-জি পরিষেবাই চালু করতে পারল না। অথচ, বেসরকারি টেলিকম সংস্থাগুলি ফাইভ-জি পরিষেবার জন্য প্রতিযোগিতায় নেমেছে। এমনকি গত বছর সংস্থা ৯০০ এবং ১৮০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ডে তার অব্যবহৃত টু-জি স্পেকট্রাম আত্মসমর্পণ করে। অথচ এই ক্ষেত্রে অন্যান্য টেলিকম সংস্থার গ্রাহক সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।

ফলে লাভের মুখ দেখতে হলে সংস্থাকে বেশ কিছু ‘অসাধ্য’ সাধন করতে হবে - গ্রাহক সংখ্যা বহুগুণ বৃদ্ধির পাশাপাশি আয় বাড়াতে এবং ব্যয় কমাতে হবে। বর্তমান তীব্র প্রতিযোগিতার বাজারে যা রীতিমতো কঠিন কাজ। ২০১৯-২০ অর্থবর্ষের তুলনায় ২০২০-২১ অর্থবর্ষে সংস্থার ক্ষতি ১৫,৫০০ কোটি থেকে ৭,৪৪১ কোটিতে নামলেও, আয় কিন্তু বাড়েনি। ফলে আশঙ্কা থেকেই যায়।

গত কয়েক বছর ধরে বিএসএনএলের কর্মী কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভিআরএস্ দিয়ে বহু কর্মীকে বিদায় করা হয়েছে। এখানেই প্রশ্ন ওঠে প্রস্তাবিত নতুন কর্মযজ্ঞে কাদের সামিল করা হবে? প্রচলিত দৃষ্টান্ত চুক্তি ভিত্তিক অস্থায়ী কর্মী নিয়োগ। তারপর? আবারও প্রশ্ন। চুক্তি ভিত্তিক অস্থায়ী কর্মীদের পক্ষে এত বিরাট ব্যবস্থা সক্রিয় রাখা সম্ভব? ঠিকা সৈন্য দিয়ে কোনো যুদ্ধে জয়লাভ সম্ভব? যুদ্ধের ইতিহাসে প্রচুর দৃষ্টান্ত রয়েছে। কোনও বিপর্যয় হলে দায়িত্ব নেওয়ার জন্য কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না।

এই প্রসঙ্গে অতীত অভিজ্ঞতা মোটেও সুখকর নয়। ১৯৮০-র দশকে সারা দেশে টেলিফোন যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিপ্লব আনার লক্ষ্যে বসানো হয় অপটিক্যাল ফাইবার। তখন বিএসএনএল এবং এমটিএনএল-এর জন্ম হয়নি। পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছিল ভারত সরকারের টেলি যোগাযোগ মন্ত্রক। এর ফলে নিঃসন্দেহে দেশের টেলি-যোগাযোগ পরিষেবা উন্নত হয়েছিল। স্থানীয় তো বটেই দেশের মধ্যে এসটিডি আর বিদেশের জন্য আইএসডি যোগাযোগ ব্যবস্থা যথেষ্ট উন্নত হয়। এবং তা জনপ্রিয়তা অর্জন করে। মোবাইলের যুগ তখন কল্পনার বাইরে। টেলিফোন ডায়াল করার পর দীর্ঘ প্রতীক্ষার যুগের অবসান ঘটে। একটা টেলিফোন মারফত এক নিমেষে দেশ-বিদেশের পরিচিত-পরিজনদের সঙ্গে সামান্য কয়েক মুহূর্তের কথা বলার সহজ সুযোগ পাওয়ায় চতুর্দিকে ধন্যিধন্যি রব উঠেছিল।

তারপর কী হল তাও মানুষ ভুলে যায়নি। ১৯৯৯-২০০০ নাগাদ প্রথমে তৈরি হল বিএসএনএল এবং এমটিএনএল। অপটিক্যাল ফাইবার ভিত্তিক আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা মালিকানা পেল সদ্যজাত দুই সরকারি সংস্থা। এবং কিছু দিনের মধ্যেই পুরো পরিষেবা চলে গেল শাসকদলের কোনো এক মিত্র সংস্থার হাতে।

ঘরপোড়া গোরু সিঁদুরে মেঘকে ভয় পায় - প্রাচীন প্রবাদ। বিএসএনএল পুনরুজ্জীবিত হয়ে যাওয়ার পর পুরো পরিষেবা আবার নতুন কোনো মিত্রের প্রস্তাবিত সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া হবে কিনা ভাবলেই আশঙ্কা জাগে। বছর কুড়ি পরে আবার কি ফিরে আসতে চলেছে সেই লোক ঠকানোর খেলা? কী হবে তা ভবিষ্যতে জানা যাবে।

তবে আশার কথা এখন লোকের হাতের মুঠোয় রয়েছে টাটকা তাজা খবর পাওয়া ও দেওয়ার যন্ত্র। মোবাইল বাহিত সংবাদ মাধ্যম সম্প্রতি তার দাপট দেখিয়েছে। রেলের টিকিট কেনার সময় সংগৃহীত ব্যক্তিগত তথ্য (ডেটা) বিক্রি করে অর্থ উপার্জনের প্রস্তাব বাতিল করতে হয়েছে। প্রয়োজনে মানুষ যে আবার সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠবে না তা কে বলতে পারে। মুষ্টিমেয় স্বৈরাচারী সবসময়ই জনতার ঐক্যকে ভয় পায়। আর সেই ভয়ই গণতন্ত্র রক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।