আরেক রকম ● দশম বর্ষ সপ্তদশ সংখ্যা ● ১-১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ● ১৬-৩০ ভাদ্র, ১৪২৯

সম্পাদকীয়

এনডিটিভি বনাম আদানি


সংবাদ মাধ্যম সংবাদের শিরোনাম অলঙ্কৃত করলে বিষয়টি চিন্তার হয়। বিগত কয়েক দিন ধরে সংবাদ মাধ্যমের শিরোনামে এনডিটিভি, ভারতের একটি প্রধান টিভি চ্যানেল। আদানি গোষ্ঠী এনডিটিভি চ্যানেলটি কিনে নেওয়ার জন্য দাবি জানিয়েছে। নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পর থেকে গৌতম আদানির সম্পত্তির পরিমাণ বিদ্যুৎ গতিতে বেড়েছে, তিনি এখন ভারতের ধনীতম ব্যক্তি। যেহেতু বর্তমানে এনডিটিভি ভারতের বলা যেতে পারে একমাত্র টিভি চ্যানেল যা নির্লজ্জভাবে বিজেপির জুতো পরিষ্কার করার কাজ করে না, তাই অনেকেই মনে করছেন যে, আদানির হাতে এনডিটিভি চলে যাওয়া মানে দেশের সংবাদমাধ্যমে শেষ যে স্বরটি ভিন্ন সুরে বাজত, তার ভবিষ্যৎও অন্ধকার হয়ে গেল। আদানি এনডিটিভি কিনে নিলে সব চ্যানেল জুড়েই চলবে মোদী প্রশস্তি, কর্পোরেটদের গুণগান এবং গরীব তথা প্রতিবাদীদের বিরুদ্ধে বিষাক্ত আক্রমণ। এনডিটিভি যেখানে একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল, সেই ব্যতিক্রমী কন্ঠ বিক্রি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় দেশের প্রগতিশীল বর্গের উৎকন্ঠা বাড়ছে। দেশের গণতন্ত্র কি এভাবেই ধনী কর্পোরেট, মোদী ও মিডিয়ার ষড়যন্ত্রে জড়পদার্থে পরিণত হবে?

প্রশ্নটি অমূলক নয়। প্রগতিশীল মহলের উৎকন্ঠা এবং আশঙ্কারও যথেষ্ট কারণ রয়েছে। আদানি যেই গতিতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজের প্রতিপত্তি কায়েম করার চেষ্টা করছে, যেভাবে আম্বানিরাও তাদের প্রতিপত্তি বাড়াচ্ছে তাতে দেশে একচেটিয়া পুঁজির তাণ্ডব নৃত্য আমাদের প্রত্যক্ষ করতে হবে এই আশঙ্কা একেবারেই অমূলক নয়। এনডিটিভি আদানির হাতে বিক্রি হয়ে গেলে দেশের সংবাদ মাধ্যমের একটি ব্যতিক্রমী কন্ঠ যে স্তব্ধ হয়ে যাবে তা নিয়েও কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এই প্রশ্নের ঊর্ধ্বেও একটি প্রশ্ন থেকে যায়। জনমুখী গণমাধ্যম কীভাবে গড়ে তোলা সম্ভব? কর্পোরেটদের হাত ধরে অথবা শেয়ার মার্কেটের মাধ্যমে বিনিয়োগ তুলে কী জনমুখী গণমাধ্যম গড়ে তোলা যায়? যদি যায়, তবে তার আয়ু কতদিন?

এনডিটিভি তার যাত্রা শুরু করেছিল দূরদর্শনের জন্য বিভিন্ন খবরের অনুষ্ঠান প্রযোজনা করে যার মধ্যে ‘ওয়ার্ল্ড দিস উইক’ এবং তাদের নির্বাচনী বিশ্লেষণ বিশেষভাবে উল্লেখ্য। ১৯৯৮ সালে স্টার ইন্ডিয়ার সঙ্গে যৌথভাবে প্রণয় এবং রাধিকা রায় এনডিটিভিকে একটি ২৪ ঘন্টার নিউজ চ্যানেল হিসেবে প্রস্তুত করেন। সেই যুগে এনডিটিভি’র প্রায় একচেটিয়া আধিপত্য ছিল ইংরেজি টিভি নিউজের মধ্যে। কিন্তু ধীরে ধীরে প্রতিযোগিতা বাড়তে থাকে। এই প্রতিযোগিতার সঙ্গে তাল মেলাতে এনডিটিভি বাধ্য হয় আরো কিছু ২৪ ঘন্টার চ্যানেল খুলতে (এনডিটিভি ইন্ডিয়া, এনডিটিভি প্রফিট ইত্যাদি)। যেহেতু একটি টিভি চ্যানেল চালানোর খরচ বিপুল, তাই এনডিটিভিকে বাজার থেকে ধার নিতে হয়। প্রথমে মরগ্যান স্টানলি এবং পরে ২০০৮ সালে ইন্ডিয়া বুলস-এর কাছ থেকে ৫০১ কোটি টাকা ধার নেয়, যা শোধ করতে আবার আইসিআইসিআই থেকে ধার নিতে হয় ৩৭৫ কোটি টাকা। তদুপরি ভিপিসিএল নামক একটি অখ্যাত কোম্পানি যা বকলমে মুকেশ আম্বানির অধীন তাদের থেকে এনডিটিভি ৪০৩ কোটি টাকা ধার নেয়। এই ধার নেওয়ার সময় শর্ত দেওয়া হয় যে ভিপিসিএল এনডিটিভির ২৯% শেয়ারের মালিকানা পাবে কিন্তু তা তারা দাবি করবে না। এইভাবে ১০ বছরের বেশি চলে গিয়েছে। কিন্তু এখন ভিপিসিএল কোম্পানিটি কিনে নিয়েছে আদানি। শুধু তাই নয় ২৫%-এর বেশি শেয়ার আদানির অধীনে চলে যাওয়ায় দেশের আইন অনুযায়ী আদানি এনডিটিভির ২৬ শতাংশ শেয়ার কেনার প্রস্তাব করেছে, যেখানে তারা বাজার দরের থেকে ২০% কম দামে এনডিটিভি-র শেয়ার কেনার আকাঙ্খা প্রকাশ করেছে। আপাতত এনডিটিভি বলেছে যে তারা এই অধিগ্রহণে রাজি নয় এবং বিশেষজ্ঞদের মতে বিষয়টি সেবি, আদালত ইত্যাদির মধ্য দিয়ে যেতে দীর্ঘ সময় লাগতে পারে।

কিন্তু গণমাধ্যম টাকা ছাড়া চলতে পারে না। টাকা আছে কর্পোরেটদের কাছে। আবার টিভি চ্যানেল চালাতে হলে বিজ্ঞাপনের প্রয়োজন যা কর্পোরেটরাই দেয়। এমতাবস্থায় চ্যানেলের শেয়ার বিক্রি করে কোম্পানি চালালে এই সম্ভাবনা সব সময়েই থাকে যে সেই শেয়ার অন্য কেউ কিনে নিয়ে মালিককে ক্ষমতাচ্যুত করবে। সেই ঘটনাই এনডিটিভির সঙ্গে ঘটছে।

নোয়াম চমস্কির বিখ্যাত বই, 'সম্মতির নির্মাণ' (Manufacturing Consent)-এ চমস্কি একটি অনবদ্য কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, গণমাধ্যমের মাধ্যমে সম্মতি নির্মাণ করতে হলে তাকে খোলা বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়াই শ্রেষ্ঠ পন্থা। খোলা বাজারে যদি সংবাদ মাধ্যমকে কাজ করতে হয় তবে তাকে বিজ্ঞাপনের জন্য ধনীদের কাছে হাত পাততেই হবে। সেই সুযোগে ধনী কর্পোরেটরা তাদের ভাবনা চ্যানেলের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে প্রোথিত করবে যা কর্পোরেট তন্ত্রের প্রতি সম্মতির নির্মাণ ঘটাবে। এর মধ্যে সম্পাদকরা খবরের ক্ষেত্রে কিছু ছাকনি ব্যবহার করতে বাধ্য হবে, যার মাধ্যমে কর্পোরেটদের বিরোধী খুব বেশি খবর, গরীব মানুষ সংক্রান্ত খুব বেশি খবর সংবাদ মাধ্যম জনগণের সামনে প্রকাশ করবে না। চমস্কি প্রচুর তথ্য সহযোগে এই তত্ত্বের সারবত্তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে প্রমাণ করেছেন।

আমাদের দেশের জন্য এহেন গবেষণা খুব বেশি না হলেও বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে একই প্রক্রিয়া আমাদের দেশেও ঘটে। তাই কৃষকদের কথা, তাদের আত্মহত্যার কথা কোনো চ্যানেল দেখায় না। কিন্তু গণেশ দুধ খেলে বা করিণা কাপুরের সন্তান হলে সব চ্যানেল দিবারাত্রি তাই দেখায়। আরো বলা যেতে পারে যে, মিডিয়া চালানোতে বিনিয়োগ যত বেশি থাকবে ততই এই প্রবণতা বাড়বে। তাই টিভি মিডিয়া অনেক বেশি কর্পোরেটপন্থী এবং গরীব বিরোধী সংবাদপত্রের থেকে, আবার ছোট সংবাদপত্র বড়র তুলনায় অনেক বেশি জনমুখী। এই তারতম্যের নেপথ্যে শুধুমাত্র মতাদর্শ নয়, অর্থনীতি কাজ করে।

এতদসত্ত্বেও এনডিটিভি একটি প্রগতিশীল ভূমিকা পালন করছিল তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এনডিটিভি নব-উদারবাদী অর্থনীতিতে বিশ্বাসী হলেও কিছু মানবিকতা, ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি তার দায়বদ্ধতা আছে এবং ছিল। এহেন একটি প্রতিষ্ঠান শেয়ার বাজার থেকে টাকা নিয়ে, বিভিন্নভাবে ঋণগ্রস্থ হয়েও খোলা বাজারের প্রেক্ষাপটে স্বতন্ত্রভাবে কাজ করে যেতে পারবে না, তা বিচক্ষণ পর্যবেক্ষকদের বোঝা উচিত ছিল। কারণ সংবাদ যদি পণ্য হয় তবে যার ক্রয়ক্ষমতা অধিক সেই তা কিনবে। অতএব আজ আদানি এনডিটিভি কিনতে চাইছে এতে অর্থনীতির দিক থেকে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

তাহলে উপায়? প্রশ্নটি কঠিন। অনেকে ভেবেছিলেন যে সমাজ মাধ্যম যথা ফেসবুক, টুইটার ইত্যাদি হয়তো এই সমস্যার সমাধান করতে পারবে যেখানে সবাই নিজের কথা বলতে পারবে। আজ গোটা দুনিয়ায় এই কথা প্রমাণিত যে সমাজ মাধ্যমও ধনী ও কর্পোরেট এবং শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তির অধীনে অনেকটাই চলে গেছে। তাই স্বতন্ত্র সংবাদ মাধ্যমের জন্য সমাজ মাধ্যমের দিকে তাকানো বোকামো।

এই প্রশ্নের দুটি আপাতগ্রাহ্য উত্তর রয়েছে। প্রথমত, জনগণের অধীন একটি সংবাদ মাধ্যম যা রাষ্ট্র থেকে স্বতন্ত্র তার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কথাটি সোনার পাথরবাটির মত শোনালেও বিবিসি অথবা দূরদর্শনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, যেখানে সংস্থা চালানোর অর্থ জনগণের করের টাকা থেকে আসবে। কিন্তু তা নিয়ন্ত্রণ করবে না সরকার। অবশ্যই সরকার তা করতে চাইবে এবং করে। কিন্তু জনগণেরও একটা দাবি থাকবে। সেই দাবি নিয়ে রাজনৈতিক চাপ তৈরি করা সম্ভব যার মাধ্যমে কিছুটা হলেও সংবাদ মাধ্যমের নিরপেক্ষতা তথা স্বাতন্ত্র সুরক্ষিত রাখা যায়। বর্তমানে দূরদর্শনের দিকে তাকালে এই কথাটি অলীক মনে হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু দেশে বিজেপি-র বাড়বাড়ন্ত এবং বিরোধীদের অপদার্থতার বাইরে এই প্রক্রিয়া নয়। সার্বিক গণতান্ত্রিকরণের লড়াইয়ের মধ্যেই এই লড়াইকে প্রোথিত করার প্রয়োজন রয়েছে।

দ্বিতীয়ত, অনুষ্ঠান দেখার মাসুল সংগ্রহের মাধ্যমে বা সাবস্ক্রিপশনের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে সংবাদ মাধ্যম চালাতে হবে। তার জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তির কথা ভাবতে হবে। এই কথার অর্থ এটা নয় যে টিভি চ্যানেল বন্ধ করে ইউটিউব চ্যানেল খুলতে হবে। কিন্তু টিভি চ্যানেল চালানোর জন্য গ্রাহকদের থেকে সরাসরি টাকা সংগ্রহ করে অন্তত কিছুটা ভারসাম্য আনা যেতে পারে।

এমন নয় যে এই কাজটি করা খুব সোজা। বরং বলা যেতে পারে অত্যন্ত কঠিন। কিন্তু যারা বড় বড় সংবাদ মাধ্যম চালাচ্ছে এই চিন্তা তাদের। কিন্তু আমরা যারা সংবাদের গ্রাহক আমরা অনায়াসেই স্বতন্ত্র সংবাদ মাধ্যম যেমন ওয়ার, নিউজক্লিক ইত্যাদিকে প্রোৎসাহিত করতে পারি, এনডিটিভি বা অন্যান্য টিভি চ্যানেল ছেড়ে এদের খবর দেখতে বা পড়তে পারি। তাহলে ছোট অথচ স্বতন্ত্র পেশাদার সংবাদ মাধ্যম হালে পানি পাবে, আমরাও আদানি-আম্বানি নিয়ন্ত্রিত সংবাদ মাধ্যম থেকে মুক্তি পেয়ে জনমুখী সংবাদ মাধ্যমের স্বাদ পাব।