আরেক রকম ● দশম বর্ষ ষোড়শ সংখ্যা ● ১৬-৩১ আগস্ট, ২০২২ ● ১-১৫ ভাদ্র, ১৪২৯

প্রবন্ধ

আত্মজীবনী আলোচনা

রঞ্জন পরামাণিক


জগতে সমালোচনার ঊর্ধ্বে কেউ নেই, কিছু নেই। কারণ বাস্তবে ‘নিখুঁত’ বলে কিছু হয় না। খুঁত থাকে বলেই সমালোচনা হয়। সমালোচনা হয় বলেই কিছু খুঁত বেরিয়ে আসে। তবু সমালোচনাকে সর্বদা সদর্থেই গ্রহণ করা উচিত। গঠনমূলক সমালোচনা সৃষ্টিকে সমৃদ্ধ করে।

‘ছাপাখানার গলি’ পত্রিকার আলোচ্য সংখ্যায় (দুই খণ্ডে) বেশ কিছু আত্মজীবনী গ্রন্থ নিয়ে সমালোচনামূলক একগুচ্ছ লেখা সংকলিত হয়েছে। প্রতিটা প্রবন্ধই ভিন্ন স্বাদের, ভিন্ন অনুভবের। ব্রিটিশ লেখক Aldus Huxley-র এক বিখ্যাত উক্তি ছিল, ‘Every man’s memory is his private literature.’ আত্মীজীবনীর ক্ষেত্রে সেই ব্যক্তিগত গণ্ডীটা ছাপিয়ে সাহিত্যকে বৃহত্তর ইতিহাসের উপাদান হয়ে উঠতে দেখা যায়। একজন জ্ঞানীগুণী মানুষ যখন আত্মজীবনী লেখেন, তখন সেই গ্রন্থে কেবল তাঁর জীবনের উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনাবলি লিপিবদ্ধ হয়, তাইই নয়; সেইসঙ্গে যে সময়টা ধরে তিনি বেঁচেছেন, সেই ধারাবাহিক সময়ের একটা স্বাক্ষরও মুদ্রিত থাকে আত্মকথার আড়ালে।

আলোচ্য সংখ্যায় আত্মজীবনী লেখকের তালিকায় রয়েছেন বিভিন্ন প্রজন্মের লেখক, কবি, সমাজ সংস্কারক থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদ, অভিনেতা-অভিনেত্রী, সঙ্গীতশিল্পী, ক্রীড়াবিদ সকলেই।

প্রথম খণ্ডটি মূলত সাহিত্যিকদের আত্মজীবনী নিয়ে। এপার বাংলা, ওপার বাংলা মিলিয়ে নামকরা বহু লেখকেরই রচনা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বলা বাহুল্য, স্বনামধন্য মানুষদের আত্মজীবনীও স্বনামধন্য হয়। রবীন্দ্রনাথ, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, বনফুল এঁদের আত্মজীবনী অনেকেরই পড়া। কাজেই সেই পরিচিত বইগুলির উপর আলোচনা পড়তে ভালোই লাগে। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের আত্মজীবনী নিয়ে লিখেছেন অমর মিত্র। বহু অজানা কাহিনি ধরা রয়েছে এ'লেখায়। চার দশকের চার কবির আত্মজীবনী নিয়ে অলিভিয়া বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখাটি পড়তে বেশ লাগে। স্মৃতিচারণামূলক লেখার জন্য বিখ্যাত ছিলেন রবীন্দ্র স্নেহধন্যা রাণী চন্দ। তাঁর বেশ কয়েকটি বইয়েরই কথা বলা হয়েছে একাধিক লেখকের আলোচনায়। তবে ‘সব হতে আপন’ বা ‘জেনানা ফাটক’ বইগুলোর উল্লেখ চোখে পড়ল না। আলোকবরণ সরকার এক লেখায় বেঁধেছেন লেখক দম্পতি বুদ্ধদেব এবং প্রতিভা বসুকে। জীবনের এক সীমিত পরিসর নিয়ে অনুলিখনের মাধ্যমে আত্মজীবনী লিখেছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তা নিয়ে তথ্যসমৃদ্ধ আলোচনা করেছেন আশিস খাস্তগীর। মণীন্দ্র গুপ্তের ‘অক্ষয় মালবেরি’ যেন আত্মজীবনীর ছাঁচে লেখা এক কবিতা। যারা পড়েছেন, তারা জানেন। এখানে অধ্যায় ভেঙে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেছেন আলোকপর্ণা।বাদল বসুর ‘পিওন থেকে প্রকাশক’ বইটা নিয়ে নরেশ মণ্ডলের লেখটিও সুখপাঠ্য। ‘পদাতিক’ কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের প্রায় সব গদ্যতেই আত্মজীবনীর গন্ধ পাওয়া যায়। এমনকি তাঁর কিছু কবিতাও যেন তাই। ‘ঢোলগোবিন্দ’ সিরিজ ধরে আলোচনা করেছেন বোধিস্বত্ত্ব ভট্টাচার্য। বিভূতিভূষণের ‘স্মৃতির রেখা’ এক অসামান্য আত্মজীবনী। কিন্তু এখন বোধহয় আর ছাপা হয় না। এমন অনেকগুলো বইয়ের কথা এখানে উল্লেখ আছে, যেগুলো এখন ছাপা বন্ধ হয়ে গেছে। পাঠক চাইলেও আর সেসব বইয়ের হদিস পাবেন না। একমাত্র পুরনো লাইব্রেরি বা অনলাইন পি.ডি.এফ. যদি কিছু ভরসা দিতে পারে।

আমরা জানি, রবীন্দ্রনাথের পরিবার পরিজনেদের মধ্যে অনেকেই আত্মজীবনী লিখেছিলেন। তার মধ্যে সরলা দেবীর ‘জীবনের ঝরাপাতা’ এবং ইন্দিরা দেবীর ‘স্মৃতি সম্পুট’ নিয়ে এখানে আলোচনা করা হয়েছে। ‘স্মৃতি সম্পুট’ সম্পর্কে লেখিকা স্বপ্না রায় বলেছেন, ‘অপটু হাতে গাঁথা এক অমূল্য গজমতির মালা’। কবিকন্যা মীরা দেবীর লেখা ‘স্মৃতি কথা’ সম্পর্কেও খানিকটা একই কথা খাটে। শিবরাম চক্রবর্তীর মত মানুষ যখন আত্মজীবনী লেখেন তখন তা বাউন্ডুলেপনার জীবনালেখ্য হতে বাধ্য। ‘ঈশ্বর পৃথিবী ভালবাসা’ নিয়ে সার্থক আলোচনা করেছেন সার্থক দাস।

খুব পরিচিত লেখকের বাইরে বেশ কিছু স্বল্প আলোচিত লেখকের আত্মকথা নিয়েও আলোচনা হয়েছে এখানে। আলোচনাগুলো পড়লে হয়তো আত্মজীবনীগুলো সংগ্রহ করার জন্য তৎপর হয়ে উঠবেন পাঠকরা।

আলোচনা করা হয়েছে বেশ কয়েকটি ইংরাজি আত্মজীবনী নিয়ে। তার মধ্যে Nirad C. Chaudhuri-র ‘Autobiography of an Unknown Indian’ এবং Ruskin Bond-এর ‘Lone Fox Dancing’ উল্লেখযোগ্য। বলা বাহুল্য, দুটি বইই বহুলচর্চিত। প্রথমটি আবার বহু বিতর্কিতও বটে। সে সম্পর্কে পর্যালোচক শ্রুত্যানন্দ ডাকুয়া সঠিক বলেছেন, ‘নীরদচন্দ্রের থিসিস বিশ্বের পণ্ডিত মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। কেউ তাঁর মত গ্রহণ করেছেন, কেউ বর্জন। কিন্তু তাঁর মতটিকে কেউ একেবারে উড়িয়ে দিতে পারেননি।’

উল্লেখযোগ্যভাবে বাদ পড়েছে মনে হল, বিদ্যাসাগরের ‘আত্মচরিত’। লীলা মজুমদারের ‘পাকদণ্ডী’। বুদ্ধদেব গুহ’র ‘সারস্বত’। সুকুমার সেনের ‘দিনের পরে দিন যে গেল’ এমন কিছু জনপ্রিয় গ্রন্থ।

তবে প্রথম খণ্ডের শেষ রচনাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি গবেষণা। ‘বাংলা লিটিল ম্যাগাজিনে আত্মজীবনীচর্চা’। যেভাবে বিস্তারিত তথ্যসহযোগে সন্দীপ দত্ত লেখাটি সাজিয়েছেন, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসাযোগ্য।

দ্বিতীয় খণ্ডে আলোচনা করা হয়েছে বিশিষ্ট কিছু রাজনীতিবিদ, সমাজকর্মী, চিত্রকর, ভাস্কর, অভিনয়শিল্পী, পরিচালক, ক্রীড়াবিদের আত্মজীবনী নিয়ে। সেখানে মুঘল সম্রাট বাবর থেকে চার্লি চ্যাপলিন, শচীনদেব বর্মন থেকে সত্যজিৎ রায় - পর্যালোচনার পরিসর প্রসারিত বিস্তারিত এলাকাজুড়ে।

প্রথমেই রয়েছে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের ‘আত্মচরিতে’র কথা। যতদূর জানি, মূল লেখাটি রায়সাহেব লিখেছিলেন ইংরাজিতে। দে’জ পাবলিশিং থেকে প্রকাশিত বইটা তার অনুবাদ। অবশ্যই সার্থক অনুবাদ। একজন রসায়নবিদের সাহিত্য সৃষ্টির মুন্সিয়ানা নিয়ে যদি কথা হয়, এই বইটিকে তার নমুনা হিসেবে উপস্থাপন করা যেতে পারে অনায়াসে।দে’জ পাবলিশিং থেকে প্রকাশিত শিবনাথ শাস্ত্রীর ‘আত্মচরিত’ পড়েও একইরকম তৃপ্তি হয়। রাজদীপ দত্ত আলোচনা করেছেন সেই বই নিয়ে। মালালা’র সাহসী জীবনকথা ‘I Am Malala’ নিয়েও সুন্দর একটি আলোচনা রয়েছে শ্রাবনী দাশগুপ্তের কলমে। বিদগ্ধ ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারের ‘জীবনের স্মৃতিদীপে’ বই নিয়ে আলোচনা করেছেন সুব্রত দাস। বারীন্দ্র ঘোষের আত্মকাহিনি নিয়ে আলোচনা রয়েছে। কিন্তু অরবিন্দ ঘোষের‘ কারাকাহিনী’ নিয়েও কিছু আলোচনা থাকলে ভাল হত। অতুল্য ঘোষের ‘কষ্ট কল্পিত’ না পুরোপুরি আত্মজীবনী, না স্মৃতিকথা। দুইয়ের মিলমিশ এক অত্যন্ত সুখাপাঠ্য রচনা, যা সত্যিই পড়তে এতটুকু কষ্ট হয়না। কিন্তু ছাপা নেই। পি.ডি.এফ. ভরসা।

সঙ্গীতের এক নিজস্ব জগত আছে। সেখানকার পরিমণ্ডলের হাওয়া বাতাস কেমন তার কিছু আলো আঁধারের কথা ফুটেছে সঙ্গীত শিল্পীদের আত্মজীবনীতে। এখানে সেরকম বেশ কিছু আত্মজীবনী আলোচিত হয়েছে।কৃষ্ণজিৎ সেনগুপ্ত আলোচনা করেছেন কিছু শিল্পীদের আত্মকথন নিয়ে। উঠে এসেছে ‘ঘরোয়া’, ‘আলাপচারি রবীন্দ্রনাথ’ প্রভৃতি বেশ কিছু অনুলিখনের প্রসঙ্গ। প্রকাশ কর্মকারের ‘আমি’ নিয়ে তিনিও আলোচনা করেছেন; আবার আলাদাভাবে দেবতোষ দাশও বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। দুটো দু'রকম। রবি ঘোষের মত রসিক মানুষ যদি আত্মজীবনী লেখেন, তা কেমন হতে পারে বলার অপেক্ষা রাখে না। ‘আপনমনে’ নিয়ে অভীক ভট্টাচার্যের লেখাটি তথ্যসমৃদ্ধ। বিকাশ রায়ের ‘কিছু ছায়া কিছু ছবি’ নিয়ে আলোচনা রয়েছে। তপন সিংহের ‘চলচ্চিত্র আজীবন’ নিয়েও একটা আলোচনা থাকলে ভাল হত। ঠিক যেমন সত্যজিৎ রায়ের ‘যখন ছোট ছিলাম’ নিয়ে আলোচনা আছে। বিজয়া রায়ের ‘আমাদের কথা’ নিয়ে আলোচনা দেখলাম না।

বিনোদন জগতের তিন রত্নকে (নটি বিনোদিনী, কানন দেবী ও মিস শেফালি) এক লেখায় বেঁধেছেন নীলরতন সরকার। সদ্যপ্রয়াত চলচ্চিত্রকার তরুণ মজুমদারের ‘সিনেমাপাড়া দিয়ে’ কিছুদিন আগে প্রকাশিত হয়ে ইতিমধ্যেই জনপ্রিয়তার শীর্ষে। তা নিয়ে আলোচনা করেছেন শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়। জনপ্রিয় ফুটবলার চুনী গোস্বামীর ‘খেলতে খেলতে’ নিয়ে লেখা পারমিতা রায়ের লেখাটি পাঠককে নস্টালজিয়ায় আচ্ছন্ন করবে। পক্ষীবিশারদ সেলিম আলি’র আত্মজীবনী অনুবাদ করেছিলেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। সেই গ্রন্থ ‘চড়াই উতরাই’-এর উপর আলোচনা করেছেন সুমিত কুমার সিনহা। সেই লেখাটি দিয়েই শেষ হয়েছে দ্বিতীয় খণ্ড।

উল্লেখযোগ্য ভাবে বাদ পড়েছে মনে হল, বিপিন চন্দ্র পালের ‘সত্তর বছর’। গান্ধীজীর ‘An Autobiography or The Story of My Experiment with Truth’। সুভাষচন্দ্র বসুর আত্মকথা। এছাড়া দুটো খণ্ডের কোনটাতেই আধ্যাত্মিক জগতের কোনও মনীষীর আত্মকথা নিয়ে আলোচনা করা হয়নি। রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের দর্শনে বিশ্বাসী অনেক সাধুসন্তই ছিলেন, যাঁরা এক বা একাধিক আত্মজীবনী বা স্মৃতিকথা লিখেছিলেন। সেগুলো পাঠকমহলে যথেষ্টই সমাদৃত। এছাড়া পরমহংস যোগানন্দের ‘Autobiography of a Yogi’ বইটিরও যথেষ্ট চর্চা আছে। যেকোনও কারণেই হোক, এই বিশেষ দিকটায় আলোচনার আলো পড়েনি। ভবিষ্যতে আবার যদি কোনও নতুন সংখ্যা প্রকাশিত হয়, আশা করা যায়, তাতে এই সমস্ত খামতিগুলো পূরণ হয়ে যাবে।

তবে সম্ভ্রান্ত সংকলন হিসেবে ‘ছাপাখানার গলি’ পত্রিকার ‘আত্মজীবনী’ সংখ্যার দুটো খণ্ডই সংগ্রহে রাখার মত। আত্মজীবনী যারা পড়তে ভালবাসেন, তারা জানেন সাহিত্যের এই বিশেষ শাখার আলাদা একরকম মেজাজ আছে। কেবল কিছু ঘটনা দিয়ে পাতা ভরালেই তা সার্থক আত্মজীবনী হয়না। যেকোনও আত্মজীবনীকে কালজয়ী হতে গেলে আদতে তাকে সময়ের দলিল হয়ে উঠতে হয়; তবেই তা সম্যকভাবে বৃহত্তর ইতিহাসের উপাদান হবার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে।


পত্রিকাঃ ছাপাখানার গলি
সংখ্যাঃ ‘আত্মজীবনী’ আলোচনা (দুই খণ্ডে)
সম্পাদনাঃ দেবাশিস সাহা
প্রকাশঃ মে, ২০২২