আরেক রকম ● দশম বর্ষ ষোড়শ সংখ্যা ● ১৬-৩১ আগস্ট, ২০২২ ● ১-১৫ ভাদ্র, ১৪২৯

প্রবন্ধ

সত্তরের স্মৃতি সতত সুখের

তপোময় ঘোষ


গত শতকের বিখ্যাত সেই সত্তরের দশকে আমারও শৈশব কেটেছে শহর থেকে বহুদূরে, কেতুগ্রামের এক গ্রামে। বড় শহর বা মেগাসিটি থেকে বহুদূরে হলেও, মহকুমা শহর কাটোয়ার বেশ কাছাকাছি। আমারও জন্ম যেহেতু ১৯৬২-তে, তাই সত্তরের দিনগুলিতে আমি নিতান্তই শিশু অথবা বালক। তবে শৈশবস্মৃতি খরতর হওয়ায় এখনো মনে পড়ে।

ক্লাস ফোরেই বিত্তি বোনা

যেহেতু আমাদের শিবলুন গ্রামখানি কেতুগ্রাম থানা সেই দক্ষিণপূর্বের শেষ প্রান্তের নিচু এলাকায়, যেখানে অজয় আর কান্দর প্রায় এক বিন্দুতে ভাগীরথীর সঙ্গে মিশেছে, সেইহেতু প্রায় প্রতি বছর সামান্য অতি বর্ষণেও প্লাবিত হয়।তখনো হতো এখনো হয়। তবে যেবারের কথা বলছি, সেবারের বান ছিল ব্যতিক্রম।

আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র - এই তিন মাস জুড়ে সমগ্র এলাকার সব জমি ডুবেছিল। তবে মাঠেই বান বা রত কমত। গাঁয়ে ঢুকতো না। অজয় গঙ্গা কান্দরে সাদা কিংবা ঘোলা জলের তলায় আমাদের সব জমি থাকায়, বাবা কাকারা কোন জমিতে চাষ করতে পারেনি। সব ধানের বীজতলা পচে গোবর হয়ে গেছিল।

কিন্তু সেই বানের জলে এত বেশি চিংড়ি মাছ জন্মেছিল যে, মানুষ তাই খেয়েই বেঁচে ছিল বলা যেতে পারে। কারণ তখন দেশে এমনিতেই খাদ্যাভাব, তার ওপর তিন মাস বান! শুধু গরিব কেন, মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্তদেরও কোনও কাজ নেই। খাবারও নেই। বাঁশের বিত্তি বা ঘুনসি (এক ধরনের মাছ ধরার খাঁচা) বুনে তাই মাঠে বানের জলে পেতে গাদা গাদা চিংড়ি মাছ ছেঁকে আনার যেটুকু আনন্দ, তাই চলল।

গ্রামের প্রায় সবাই তখন চাঁড়ালদের মতো বিত্তি বানানোর কারিগর, শিল্পী। এমনকি ক্লাস ফোরের আমি নিজেও। আমি তখন আদর খেতে গাঁয়েরই আরেক পাড়ায়, মামাবাড়ীতে থাকি। তো ছোটমামা এ ধরনের বানানোর কাজের ওস্তাদ শিল্পী। তিনি তালপাতা দিয়ে বরষার 'পেকো ' (টোকা), বাঁশের কঁচির ঝুড়ি - ঝাঁঝরি - পালুই - বিত্তি সব বুনতে পারতেন। বাঙালির ছায়ের অনুকরণপ্রিয়তার ঐতিহ্যগুণে আমিই বা কম থাকি কেন? মামার আদর্শ, কিম্বা 'নরানাং মাতুলক্রম' মেনে বিত্তি বুনে ফেললাম শুধু নয়, সেই বিদ্যে আমাদের এই বাড়িতে এসে জাহির করে বাবাকেও শেখালাম। এ পাড়াতেও তৈরি হয়ে গেল মাছ ধরার বাঁশ কাঠির ফাঁদ!

ছোটলাইনের সাতটার ট্রেনে গম ভাঙাতে কাটোয়া

তিন মাস বন্যা! করো ঘরে আর কোন খাবার নেই। একমাত্র ভরসা জি.আর. মানে সরকারী ত্রাণ। রেশন ডিলারদের মারফত সেই 'গভর্নমেন্ট রিলিফ' আসত। জি.আর. মানেই গম। সেই গম ভাঙানোর কল গাঁয়ে ছিল না। বাধ্য হয়ে যেতে হতো পাশের শহর কাটোয়া। যাওয়ার মাধ্যম 'আহমদপুর - কাটোয়া' ছোট লাইনের ট্রেন।

সকল সাতটার ট্রেনে গিয়ে স্টেশন বাজারের রসময় ঘোষের আটা চাকী বা ফ্লাওয়ার মিলে গমের থলেকে লাইনে রেখে, আর সব আলাদা বাজার করে আনা। সে বাজার ছিল, মামাদের জন্য বিড়ির পাতা মসলা আর মোষের জন্য খোল। তারপর আটটার আপ ট্রেন ধরে বাড়ি। সেই আটার রুটি গড়ে তবে মাঠে পাঠাতো মা এবং মামীরা। বাবা, মামাদের জলখাবার আর কি!

মামারা একান্নবর্তী বড় গেরস্থ। যত প্রয়োজন তত গম জি.আর.-এ পাওয়া যেত না। গ্রামে ডিলার দিত না। মামা তখন তার এক বন্ধু, যিনি আবার পাশের গ্রামের ডিলার, সেই মধুসূদন মন্ডলের কাছে আবেদন নিবেদন করে আরও বাড়তি কিছু গম জোগাড় করত। সেই গম আনতে হতো পাশের বেলুন গ্রামের এক ব্যবসায়ীর দোকান থেকে।

গোটা গ্রামে তখন প্রায় তিনশো পরিবার। তাদের মধ্যে দু' দশ ঘর বাবু ভদ্রলোক বাদ দিয়ে কারো ঘরে ভাত ছিল না। সবাইকেই রুটি খেয়ে থাকতে হতো। এই আটা পাশের জেলার কির্নাহারে দশ/কুড়ি পয়সা সস্তা ছিল। আমরা ওই ফোরে পড়তে পড়তেই, সেখান থেকে ময়দা নয়, আটাটা কিনে আনতাম। আমার এক মামা এই সময়ে অকালে মারা যান। তার মেয়ে মানে আমার মামাতো দিদি তো একটু বেশি করে এনে বিক্রি করত। দশ কেজি আনতে পারলে এক কেজি লাভ থাকতো। ওতেই ওদের সংসার চালাতে হত।

ওদিকে তখন আকাশে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিমান। তার গোলাগুলির প্রভাবে চোখে কনজাংটিভাইটিস। লোকে বলতে লাগলো "জয় বাংলা"। আমাদের চোখ লাল হতো। তিন দিনের মধ্যে সেরে যেত। তবে বোলান গানের পুরোনো খাতায় আছে থাকবেও।

বাজারদরের কথা মনে পড়ছে। তখন পাঁচ টাকা কেজি সরষের তেল এবং খাসির মাংস। টাকায় চারটে হাঁসের ডিম। গাওয়া ঘি দশ টাকা কেজি। মায়ের খুড়তুতো ভাই, আমাদের প্রভাস মামা, রাইটার্সে চাকরি করতেন। গোটা গাঁয়ের লোকের ঘি তাকে সেখানে বেচে আসার আবদার চলত। নিজেরা কেউ ঘি খেতে পেত না। হাঁসের ডিমও। সব বেচেবুচে কিনতে হতো গম।

চলে এলো তাইচুন, আই.আর.এইট. ধান

অভাব দুমুঠো ভাতের আর মুড়ির। দেশে সেই খাদ্যাভাবের দিনে চলে এলো নতুন চাষের ধারা। বোরো ধান চাষ। মাঘ মাসের জাড়ে রুইতে হবে শুনে, গরিবপাড়ার মুনিশ-মান্দাররাও অবাক। তবুও এ গাঁয়ের কুমুদ ঘোষ, শান্তিরাম বিশ্বাস, পুরঞ্জন চ্যাটার্জীরা তাদের লপ্ত জমির কোনে শ্যালো পাম্প বসিয়ে ফেলল। ব্লক অফিসের বাবুরা বীজের সন্ধান আর পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করলেন। একে একে রোয়া হতে থাকলো তাইচুং, কালিম্পং, আই.আর.এইট. নামের গ্যাঁড়া জাতের, উন্নত ফলনশীল ধান। আর সোনালিকা, কল্যানসোনা জাতের গম। সবই দেশি লম্বা জাতের চেয়ে বেশি ফলন দিয়ে তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করলো।

প্রথম প্রথম পাম্প মেশিনকে 'দমকল' বলে গাঁয়ের লোক দেখতে ভিড় করলো। গ্রামের বড় চাষী, গেরস্থরা, বিশেষ করে যাদের একলপ্তে বেশ কয়েক বিঘা জমি ছিল, তারাই আরম্ভ করলো। ক্ষেতমজুরদের একটু লাভ হল। কারণ ওই চাষে বেশি মজুর লাগে। আর মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত চাষিরা নতুন ধান চাল পেতে থাকল।

পরে জেনেছি, সেই চাষই দেশের 'সবুজ বিপ্লব'। এখন বলা হচ্ছে, তা নাকি ছিল 'প্রথম সবুজ বিপ্লব'। এখন দ্বিতীয়, তৃতীয়, 'রামধনু বিপ্লব', 'চির সবুজ বিপ্লব' দরকার। সে কথা আলাদা। আমরা দীর্ঘদিন ভাত না পেয়ে ওই খরার ধান পেয়ে, অনেকদিন পর ভাত খেয়েছিলাম।

হিসাব বোধহয় মিলছে যে, আমি আর দেশের ওই প্রথম সবুজ বিপ্লব প্রায় সমসাময়িক। প্রথম সবুজ বিপ্লব নাকি পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করেছে। প্রাকৃতিক উৎসগুলিকে ফুরিয়ে দিয়েছে। জল মাটি বাতাসকে দূষিত করেছে। তবুও আমাদের ক্ষুধার্ত মুখে দু'মুঠো অন্ন তুলে দিয়েছে। এখনও তো সময় আছে, আবারও দ্বিতীয় তৃতীয় সবুজ বিপ্লব করে নেওয়া হোক না। সময়ের প্রয়োজন অনুযায়ীই হোক। কে বারণ করেছে?

আটাত্তরে মাধ্যমিক, ইলেভেন, বান...

তখন এপ্রিলে মাধ্যমিক পরীক্ষা হতো। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ মানে বাংলার চৈত্রের শেষ সাত দিন। আমাদের গাঁয়ের নাম শিবলুন। বোঝাই যায় শিব অনুষঙ্গেই এই নামকরণ। আর সেটা বুঝি চৈত্রের এই শেষ সপ্তাহে গাজনের উদোম ধুমে। সারা বছর মানুষ, বিশেষত গরিব মানুষ মুখিয়ে থাকে কখন এই গাজন উৎসব আসবে।

আমাদের জন্য বেনো। তাই আশ্বিনের বড় পুজোয় বেশিরভাগ বছর মাঠে বান কিংবা বানের রেশ থাকে। পুরনো ফসল ফুরিয়ে যায়। নতুন ফসল তখনও ওঠেনা। ফলে আমাদের মত চাষাবাড়ির ছেলেমেয়েদের নতুন জামা জুতো ওই পুজোয় জোটেনা। কার্তিক/রবিচাষের খন্দকুটো ওঠে এই ফাগুন চোতে। সে ফসল বিক্রিবাটা করে আসে ছেলেমেয়েদের জামা প্যান্ট। খুব আনন্দ তাই সেই শিব ওঠায়, বোলানে, ভক্ত সন্ন্যাসীদের খুলি আর বেতের লাঠি নাচানোর অদ্ভুত ভঙ্গিমায়।

সারা বছরে গ্রামে ঘটে যাওয়া বড় ঘটনা, শাসকের দুর্নীতি, বড়লোকদের ব্যভিচার ইত্যাদিকে নিয়ে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ, বিদ্রূপের বোলান গান বাঁধা হয়। শুনতে কৌতুহলী গ্রামজনতা। প্রভাকর কোনাই বা আস্তিক ঘোষের রংপাঁচালির জন্য লোকের সেকি অসীম আগ্রহ!

আর যারা মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দি' বা এখনো দেয়, সে বছরের গাজন যেন তাদের। তাদের উৎসাহ উদ্দীপনা কিশোর-কিশোরীসুলভ চপলতা, উচ্ছলতায় ভরে যায় গাজনতলার চারপাশ। সেই 'ছল করে দেখা অনুখন' আর কি! গাজন তলার চাতাল যেন এক আনন্দ ভূমি। ছেলেটি তিন মাস পড়ে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে, হালে পড়াশোনা থেকে খানিক মুক্তি পেয়েছে, সে তো একটু এক্সট্রা নাচবেই! আর লোভ থাকবেই বোলানের দলের খাতাটি ধরে প্রম্পটার সাজবার!

তো সেবার ছিল এই গাজনের ঠিক মাঝামাঝি সময়ে আমাদের মাধ্যমিক পরীক্ষা। শেষ দিন যতদূর মনে পড়ে ১২ এপ্রিল। অংক পরীক্ষা। আর গাজন উৎসবের পরম্পরা মতে সেদিনই বোধহয় হোমের পুজো। আমার তো অ্যাডিশনাল ছিল 'ইকোনমিকস এন্ড সিভিকস'। বিকেলে, মানে ২-৫টায় পরীক্ষা। পুরোপুরি ভাবে বাবা মহাদেবের হোম যজ্ঞির সময়। বাবার টানে সে পরীক্ষা আজও বসা হলো না, অতিরিক্তই থেকে গেল।। জীবনে ওই একটি পরীক্ষাই দিইনি। বাকি সব আজও দিয়ে যাচ্ছি।

তখন তিন মাসের আগে রেজাল্ট বের হতো না। পরীক্ষার পর সেবার পাড়ার রবীন্দ্র জয়ন্তী, নজরুল জয়ন্তী, হরিনাম সংকীর্তন, ধুলোট সবই প্রবল উৎসাহে করেছি। ততদিনে পাড়ায় প্রায় হাফনেতা!

গরিব চাষার ছেলে হিসাবে সমানে মাঠে চাষ করা ক'বছর আগে থেকেই চলেছিল। সেভেন এইট নাইন তিন বছর চাষের তিন মাস স্কুলে যেতে পেতাম না। এবার অবশ্য স্কুলটা নেই। তো আষাঢ় মাসের যেদিন রেজাল্ট বেরোলো, সেদিন পশ্চিম মাঠে বিষ্ণুপুকুরের জমিটা রুইছি। সঙ্গে আছে বাবা আর মটা মামা। এই মটা মামা বাবার কাজের সহায়ক শুধু নয়, নেশা ভাং-এরও সঙ্গী ছিল। মাঠে ভাত নিয়ে যেত বোনেরা। তরকারির যুত না থাকলে, কাছেপিঠে চরতে থাকা খাসি দেখিয়ে মটা মামা বলতো, "ওটা দেখ, আর ভাত খা..."

তো সেদিনও মটা মামা আমাদের কাজে এসেছে। আর বড় বোনটাও মাঠে ভাত নিয়ে এসেছে। ভাতের বাটি নামিয়ে দিয়ে বলল, "দাদা তুমি পাশ করেছ।"

- কে বলল?

- মিস্ত্রি দাদু মাকে বলে গেল, "বৌমা, তোমার ছেলে, আমার ছেলে পাস করেছে।"

সেই মৃত্যুঞ্জয় মিশ্র এবার, এই দুই হাজার কুড়ি সালের এই মার্চ মাসে ৯৫ বছর বয়সে মারা গেলেন। জানিনা আনন্দে কিংবা বেদনায়, সেদিন বিষ্ণুপুকুরের পারে, সংবাদ বয়ে আনা বোনটাকে আক্রমণ করে বলেছিলাম, "না জেনেশুনে..."

তারপর সচেতনভাবেই, কাটোয়া কলেজে নয়, কাটোয়া 'কে. ডি. আই.'তে। সায়েন্স নিয়ে ইলেভেনে ভর্তি হলাম। ঠিক মাস দেড়েকের মধ্যেই তেরই আশ্বিন, ২৭ সেপ্টেম্বর, শতাব্দীর ভয়ংকরতম বন্যা। আমাদের অনেক ধ্বংসকথা, স্মৃতিকথার কারণ হয়ে থাকলো। আমাদের বাড়ি ভাঙলো, স্কুলের লাইব্রেরির বই পচলো। আমরা আরো গরিব হলাম।