আরেক রকম ● দশম বর্ষ ষোড়শ সংখ্যা ● ১৬-৩১ আগস্ট, ২০২২ ● ১-১৫ ভাদ্র, ১৪২৯

প্রবন্ধ

‘আমার পৃথিবী নয় এইসব ছাতিম শিরীষ’

প্রবুদ্ধ বাগচী


আশির দশকের মাঝামাঝি বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছিলেন শ্রদ্ধেয় নিমাই সাধন বসু। পণ্ডিত মানুষ হলেও আদপে কংগ্রেসি ঘরানার সঙ্গে সংযুক্ত। তাঁর এই পদ প্রাপ্তির পেছনে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর উদ্যোগ ছিল বলে শোনা যায়। তবে উপাচার্য হিসেবে তিনি অযোগ্য প্রার্থী ছিলেন এমন বলার উপায় নেই। কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হিসেবে কাজ করার সূত্রে তিনি বিশ্বভারতীকে আরো ভিতর থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। সেই অভিজ্ঞতা নিয়েই তিনি একটা বই লিখেছিলেন যার নাম ‘ভগ্ননীড় বিশ্বভারতী’। বুঝতে অসুবিধে নেই এতে তাঁর আশাভঙ্গের বেদনা ও আক্ষেপই ধরা পড়েছে।

কার্যত রবীন্দ্রনাথের অনুপস্থিতির পর থেকেই বিশ্বভারতী তার অভিপ্রেত অবস্থান থেকে একটু একটু করে সরে আসতে থাকে। সত্যের খাতিরে বলতে হবে, রবীন্দ্রনাথের শেষ জীবনের ধারাবাহিক অসুস্থতা নিজের গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠানের ওপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ কিছুটা শিথিল করে দেয়। তাছাড়া তাঁর জীবিতকালে গোটা প্রতিষ্ঠানটাই দাঁড়িয়ে ছিল তাঁকে নির্ভর করে। প্রশাসনিক কোনো সুঠাম কাঠামো তৈরি হয়ে উঠতে পারেনি, হতে পারেনি বিকেন্দ্রীকৃত ব্যবস্থা। ফলে তাঁর মৃত্যু সমগ্র ব্যবস্থাটার মধ্যে ডেকে আনে শূন্যতা। আর বিশ্বখ্যাত এক মহতী প্রতিভার ছায়ায় যারা জড়ো হয়েছিলেন, তাঁরা প্রত্যেকেই তাঁর মাপের ব্রতী পুরুষ ছিলেন এমন নয়। তাঁদের মধ্যে ঈর্ষা অসূয়া ক্ষমতার মোহ বেশ চড়া মাত্রাতেই ছিল। রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় যা চাপা পড়ে থাকলেও তাঁর প্রয়াণে সেগুলি কিছু ক্ষেত্রে খুব কদর্যভাবে প্রকাশ পেতে থাকে। স্বাধীনতার পরে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার সূত্রে রবীন্দ্রনাথের নামটুকু সামনে রেখে দিল্লির নতুন আমলাতন্ত্র একদা বিশ্ববিদ্যার এই অঙ্গনকে আরো বেঁধে ফেলে। ব্যক্তিগত পছন্দের সূত্রে নেহেরুজির কিছু পক্ষপাত থাকলেও বিশ্বভারতীর কৌলীন্য সেইভাবে আর ফিরে আসেনি।

একটু ফিরে দেখলেই দেখা যাবে গত সাত দশকে সারা দেশের নানা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেভাবে নতুনভাবে উঠে এসে নিজেদের খ্যাতি ও যোগ্যতাকে উঁচুতে নিয়ে গেছে, সেই তুলনায় বিশ্বভারতী নিতান্তই নিষ্প্রভ। শিল্পকলা বা সংগীত বিভাগের যে দেশজোড়া সুনাম তার সঙ্গে যুক্ত আছে পুরোনো শান্তিনিকেতনের শিক্ষকমণ্ডলীর ঐতিহ্য, যারা আর কেউই আজ নেই। তুলনায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বা ভাষা সাহিত্যে পঠনপাঠনে বিশ্বভারতী বেশ পিছিয়েই থেকেছে। এক সময় কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের পদার্থবিদ্যা অর্থনীতি বা ইংরিজি, ইতিহাস বিভাগের দেশজোড়া নামডাক ছিল। সেরকম কোনো বিভাগ আজও বিশ্বভারতীতে নেই যার জন্য সারা দেশের পড়ুয়ারা ভিড় করেন।

এখানে একটা ভাসা ভাসা অভিযোগের নিষ্পত্তি করা দরকার। বলা হয়, এই রাজ্যে বামপন্থী সরকারের সাড়ে তিন দশকের আমলে রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থা নাকি দলের কুক্ষিগত হয়ে পড়ায় আদপে পিছিয়ে পড়েছিল। এইসব বক্তব্যের পক্ষে কোনো প্রমাণ ও তথ্য সেইভাবে দেওয়া হয় না। আর কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অবস্থানের গ্রেডেশন প্রথা যা ‘ন্যাক’ নামক প্রতিষ্ঠান ইদানিং করে থাকেন তারও কোনো সূচক সেইভাবে তখন চালু হয়নি। ফলে একথা সঠিক বা বেঠিক তার কোনো প্রামাণ্য মাপকাঠি নেই। অবশ্যই একটা দীর্ঘ সময়কালে সব কিছুই শুদ্ধাচারে ঘটে গেছে এমন বক্তব্য কেউ বিশ্বাসই করবে না। কিন্তু বিশ্বভারতীর প্রসঙ্গে এই কথা উঠল এই কারণে যে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনে কখনো কোনো বামপন্থী সরকারের প্রভাব ছিল না। এমনকি সেখানকার কর্মচারী সংগঠন, শিক্ষক সংগঠন বা ছাত্র সংসদেও বামেদের তেমন উপস্থিতি চোখে পড়েনি। তবু বিশ্বভারতী রয়ে গেছে সেই তিমিরেই।

ভুরি ভুরি দুর্নীতি, প্রশাসনে স্বজন-পোষণ এগুলো প্রায় একাকার হয়ে গেছে রবীন্দ্রনাথের সাধের এই শিক্ষাসত্রের সঙ্গে। এমনকি আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বভারতীর এক প্রাক্তন উপাচার্য, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের নামী গণিতের অধ্যাপক ডঃ দিলীপ কুমার সিনহাকে বেশ কিছুদিন কারাবাস অবধি করতে হয়। রাজ্যের আর কোনো উপাচার্যের ক্ষেত্রে এতদূর অবনমন আমাদের মনে পড়ে না। এছাড়া সব্যসাচী ভট্টাচার্য বা রজতকান্ত রায়ের মতো নামী শিক্ষাবিদ ও গুণী মানুষরা নিজেরা যখন উপাচার্য হিসেবে কাজ করেছেন তাঁরাও একান্তে বুঝতে পেরেছেন ঠিক কোথায় তাঁরা এসে পড়েছেন। নানা ফোরামে বলেও ফেলেছেন তাঁদের নিরাশার কথা এবং মেয়াদ শেষে প্রায় পালিয়ে বেঁচেছেন।

যদিও আজকের দিনে বিশ্বভারতীর অবস্থা আগের পরিস্থিতির সঙ্গে মাত্রাগত বিচারে সেইভাবে তুলনীয় নয়। গত আট বছরে সমস্ত কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানের মাথায় বসিয়ে দেওয়া হয়েছে সঙ্ঘ পরিবারের গোঁড়া সমর্থকদের, বিশ্বভারতীই বা বাদ যায় কেন? বর্তমান উপাচার্যের শিক্ষাগত উৎকর্ষ, যাকে আমরা আকাডেমিক এক্সেলেন্স বলি, সেটা তার ক্ষেত্রে কী ও কতটা তার জানার কোনো উপায় নেই। মনে রাখতে হবে একসময় অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসু অবধি ওই চেয়ারে বসেছেন। কিন্তু আজকের ইনি শিরোনামে থেকেছেন তার চরম স্বৈরী মনোভাব ও কাজকর্মের সূত্রে। তা কখনো শিক্ষকদের বেআইনি সাস্পেন্সন, কারোর প্রোমোশন আটকে দেওয়া, ছাত্রছাত্রীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে বাধা দেওয়া, বিশেষ কোনো ছাত্র সংগঠনকে তোল্লাই দেওয়া, তার খুশিমতো একেবারে দলীয় রাজনৈতিক বিষয়ের সেমিনারে শিক্ষকদের জবরদস্তি অংশগ্রহণ করানো, সমাবর্তনে প্রধানমন্ত্রীকে ডেকে তাকে রাজনৈতিক স্লোগান প্রচারের মঞ্চ তৈরি করে দেওয়া এবং বহুল প্রচারিত সংবাদপত্রের পাতায় উত্তর-সম্পাদকীয় লিখে সাভারকরের ‘দেশপ্রেম’-এর সপক্ষে কলম ধরা। এর প্রত্যেকটিই নজিরবিহীন। এবং এইসব স্মরণীয় ‘কুকীর্তি’র পরেও সদ্য প্রকাশিত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির তুলনামূলক অবস্থান সূচক রিপোর্টে বিশ্বভারতীর অবস্থান শোচনীয়ভাবে নেমে গেছে। এর দায় কিছুটা হলেও তো উপাচার্যের ওপর বর্তায়। তবে ‘ব্রেকিং নিউজ’ হল, এসব উপেক্ষা করে ও শান্তিনিকতনের বিধিবদ্ধ অপৌত্তলিক রীতিনীতিকে তোয়াক্কা না করে উপাচার্য এখন ‘কালী’ বিষয়ক সেমিনারের আয়োজনে ব্যস্ত।

কিন্তু এই বিষয়ে আর বেশি কিছু আমরা বলতে চাই না। শঙ্খ ঘোষ এক সময় শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রভবনের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্বভার পালন করেছিলেন। সেই সময়ে তাঁর শান্তিনিকেতন যাপনের মধ্যে তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন এক পথভ্রষ্ট স্বপ্নের ছবি। সেই যে ছেলেটি যে গ্রাম থেকে পড়তে এসে শহুরে সহপাঠীদের মানসিক নির্যাতনের শিকার হয় এবং পঁচিশে বৈশাখের ভোরে নিজের হোস্টেলে আত্মঘাতী হয়, তাকে নিয়ে কবি শঙ্খ লিখেছিলেন এক আশ্চর্য কবিতা - ‘এখানে আমাকে তুমি কীসের দীক্ষায় রেখে গেছো?/ এ কোন জগৎ আজ গড়ে দিতে চাও চারিদিকে?’ বিশ্বভারতীর আদর্শ জগৎ থেকে ভ্রষ্ট হওয়ার নিরন্তর উদাহরণ তৈরি হয়েছে দশকের পর দশক। ছাতিমতলার খোলা মাঠে পাওয়া গেছে জন্ম নিরোধকের প্যাকেট, হস্টেলে খুন হয়ে গেছে ছাত্রী। এইসবই সেই দীক্ষা হারিয়ে ফেলার উদভ্রান্ত ছবি। মানতেই হবে এইসব অসতর্ক মুহূর্ত থেকেই আজ বিশ্বভারতীতে বাসা বেঁধেছে পচন আর আগ্রাসী মৌলবাদী স্বৈরাচার। ষোলো কলা পূর্ণ হয়েছে।

২.

এবার আমাদের ফিরতে হবে একটু অতীতে। রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের পর থেকেই বিশ্বভারতী তার কৌলীন্য খোয়াতে আরম্ভ করেনি? এর সব থেকে বড় উদাহরণ, কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতী থেকে পাকাপাকি নির্বাসন (১৯৫৩)। এই সরে যাওয়া তাঁর স্বেচ্ছা নির্বাচন ছিল না, তিক্ত পরিস্থিতি তাঁকে বাধ্য করে বিশ্বখ্যাত পিতার স্বপ্নের এই প্রতিষ্ঠান থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে। একটা সময় তাঁর বিরুদ্ধে ‘তহবিল তছরুপ’-এর মতো অবিশ্বাস্য অভিযোগ পর্যন্ত তোলা হয়েছিল। দেরাদুনের নিজস্ব জগৎ থেকে আর কোনোদিন তিনি ফিরে আসেননি। অথচ শান্তিনিকেতন আশ্রমের প্রথম গুটিকয় ছাত্রের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। তার পরের ইতিহাস শুধুই পিছু হঠার ইতিহাস। নানা ফাঁক ফোঁকরে একটা প্রতিষ্ঠান কতদূর খেলো হয়ে যেতে পারে সেটা বিশ্বভারতীকে দেখলে বোঝা যায়। বারে বারে অভিযোগ উঠেছে রবীন্দ্রভবন থেকে রবীন্দ্রনাথের ছবির অরিজিনাল কপি উধাও হয়ে গেছে, অনেক ছবির কোনো রেকর্ড অবধি নেই - কাকস্য পরিবেদনা! কারোর কানে জল ঢোকেনি। আর সব শেষে যখন খোদ নোবেলটাই চুরি গেল তখন বিশ্বের দরবারে দেশের মাথা যেভাবে হেঁট হয়ে গেছে তার তুলনীয় আর কিছুই হতে পারে না। কী আশ্চর্য সমাপতন, ২০০৩-র মার্চে যখন এই চুরির ঘটনা প্রকাশ্যে আসে তখন এই দলটাই কেন্দ্রের সরকারে ক্ষমতায় ছিল আজ যারা বিশ্বভারতীকে অধঃপতনের শেষ সীমায় নিয়ে এসেছে।

অথচ পুরোনো পাপ ঢাকার জন্য শোনা যাচ্ছে রথীন্দ্রনাথের স্মরণে বিশ্ববিদ্যালয় দেরাদুনে তার নতুন ক্যাম্পাস খুলবে। যদিও বর্তমান আর্থিক বছরের কেন্দ্রীয় বাজেটে সেই বাবদ যে অর্থ বরাদ্দ হয়েছে তাতে বিশ্ববিদ্যালয় কেন একটা পর্ণকুটিরও তৈরি হবে কি না সন্দেহ। তাছাড়া রথীন্দ্রনাথকে নিয়ে এই উদ্যোগ নেওয়ার নৈতিক জোর বিশ্বভারতীর আছে কি? ঠিক যেমন আজকাল দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দির কর্তৃপক্ষ রামকৃষ্ণদেবকে নিয়ে একটু বেশি রকম আদিখ্যেতা করে ব্যাপারটা কি তেমন দাঁড়াচ্ছে না কারণ দক্ষিণেশ্বর মন্দির থেকে তারাই তো একদিন রামকৃষ্ণকে উচ্ছেদ করেছিলেন! ঠিক যেমন রামকৃষ্ণ মিশন নিবেদিতাকে বাধ্য করতে চেষ্টা করেছিলেন বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্রব ছিন্ন করার মুচলেকা দিতে। তা না দেওয়ায় তাঁকে মিশনের কাজে আর অংশ নিতে দেওয়া হয়নি। অথচ ইদানিং সিস্টার নিবেদিতাকে নিয়েও মিশনের গদগদ ভাবের অন্ত নেই। মনে পড়ে, রথীন্দ্রনাথের শেষ জীবনের নানা টানাপোড়েন ও মীরা চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের একটি তথ্যনিষ্ঠ অনুসন্ধান করে রবীন্দ্রভবনের প্রাক্তন প্রাধিকারিক নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় একটি গ্রন্থ রচনা করেন কয়েক বছর আগে (শিরোনামঃ আপনি তুমি রইলে দূরে)। সেই বইয়ের মুখবন্ধ লিখেছিলেন তৎকালীন উপাচার্য রজতকান্ত রায়। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই সেই বই প্রকাশ করার জন্য বিশ্বভারতী লেখককে শো কজ করেন ও তিনি এর সূত্রে রবীন্দ্রভবনের সংগৃহীত তথ্য অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করেছেন বলে অভিযোগ করা হয়। এ সবই আজ ইতিহাসের অন্তর্গত। তবু, কথায় কথা বাড়ে।

৩.

কিন্তু বিশ্বভারতীর ঐতিহ্য ও খ্যাতির মূল যে জায়গাটা অর্থাৎ সংগীত ও শিল্পকলা, সেই ক্ষেত্রটাও কি খুব কলুষমুক্ত? এই প্রসঙ্গে প্রথমেই আমাদের মনে পড়ে 'বিশ্বভারতী সংগীত সমিতি'র কথা। এটা ঠিক যে রবীন্দ্রনাথের গানের গায়নগত শুদ্ধতার কথা মাথায় রেখে এমন একটা বিধিবদ্ধ নিয়ন্ত্রক সংস্থা প্রয়োজন ছিল। বিশেষ করে ১৯৪১-এ রবীন্দ্র প্রয়াণের পরের বছরেই (১৯৪২) কলকাতায় ‘গীতবিতান’ প্রতিষ্ঠান তৈরি হয় যার ফলে রবীন্দ্রনাথের গান ধারাবাহিকভাবে শান্তিনিকতনের সীমিত চৌহদ্দি ছেড়ে বৃহত্তর নাগরিক সমাজের মধ্যে ছড়িয়ে যেতে থাকে। তাই তাঁর গান সঠিকভাবে গাওয়া ও রেকর্ড করা হচ্ছে কি না তার ওপর একটা নজরদারি দরকার ছিল। কিন্তু আজ বিশ বছর সংগীত সমিতি ব্যাপারটা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেলেও তাঁদের চলার পথ সমালোচনার বাইরে কোনোদিনই ছিল না।

গায়নের প্রামাণ্যতা বিষয়ে তাঁরা নানা সময় এমন সব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যা নিয়ে প্রচুর প্রচুর অভিযোগ। বিশেষ করে সাহানা দেবী, অমলা দাশ, অমিয়া ঠাকুর প্রমুখ যারা সরাসরি রবীন্দ্রনাথের কাছে গান শিখেছেন ও রেকর্ড করেছেন তাঁর অনুমোদনেই। পরে সেই একই গান যখন অন্য কেউ গ্রামোফোনে রেকর্ড করেছেন সংগীত সমিতির অনুমোদিত সেই বয়ানে সুরের পরিবর্তন আছে। একটা উদাহরণ দিতে পারি। সাহানা দেবীর গাওয়া ‘কেন যামিনী না যেতে জাগালে না’ পুরনো রেকর্ডের ভার্সন আর পরের কোনো শিল্পীর গাওয়া ওই একই গানের ভার্সন আলাদা। মালতী ঘোষাল তাঁর রেকর্ডে ‘এ পরবাসে রবে কে’ যেভাবে গেয়েছেন তা মূলত গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘরানায় গাওয়া, এই গায়ন রবীন্দ্রনাথ অনুমোদন করেছিলেন কি না সেই তথ্য স্পষ্ট নয়। অথচ ওই একই গানের কিছুটা আলাদা গায়কীও সংগীত সমিতি অনুমোদন করেছেন। অনেক গানের দুটি করে স্বরলিপি আছে, তাঁর মধ্যে কোনটি প্রামাণ্য অথবা দুটিই প্রামাণ্য কি না সেই বিষয়ে সংগীত সমিতির অবস্থান স্পষ্ট নয়। যার একটা উদাহরণ, ‘বসন্তে বসন্তে তোমার কবিরে দাও ডাক’ - এই গান সচারচর যে সুরে গাওয়া ও রেকর্ড করা হয় সেটি অনাদি কুমার দস্তিদারের করা, কিন্তু শৈলজা রঞ্জন মজুমদারও এর অন্য একটি স্বরলিপি করেছিলেন যা একমাত্র একবারই রেকর্ড করেছেন রেণুকা দাশগুপ্ত। ‘হৃদয় আমার প্রকাশ হল’ মূলত ৪+২ ছন্দের গান কিন্তু তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গাওয়া হয় তালহীনভাবে, একমাত্র কমলা বসু এটিকে তালে গেয়েছেন। সংগীত সমিতি এই বিষয়ে কোনো পথ নির্দেশ করতে ব্যর্থ।

এ তো গেল টেকনিক্যাল বিষয়। কিন্তু বেশ কিছু সংগীত সমিতি অনুমোদিত রেকর্ডিং-এ খুঁজে পাওয়া যায় ভুল, একদম ডাঁহা ভুল। খ্যাত শিল্পী জগন্ময় মিত্র তাঁর সমিতি অনুমোদিত রেকর্ডে ‘ভেঙেছ দুয়ার এসেছো জ্যোতির্ময়’ গানে স্পষ্টভাবে গেয়েছেন ‘ভেঙেছে দুয়ার’ - এই গান অনুমোদন পেল কীভাবে? এই গানের কোনো পাঠান্তর নেই যেখানে ‘ভেঙেছে দুয়ার’ ছাপা হয়েছে। জগন্ময় মিত্র সেইভাবে রবীন্দ্রনাথের গানের জগতের মানুষ ছিলেন না। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে ও শিল্পীদের প্রতি পূর্ণ সম্মান জানিয়েও বলতে বাধ্য হচ্ছি নীলিমা সেন ও সুবিনয় রায়ের গানেও এরকম কথার হেরফের বা কথা বাদ দিয়ে চলে যাওয়ার উদাহরণ পেয়েছি, যা গীতবিতানের গানের ভাষ্যের সঙ্গে মেলেনি। অনুমোদক হিসেবে সংগীত সমিতি কি এর দায় এড়াতে পারেন?

স্বরলিপিমান্য সুরের সামান্য হেরফের ধরা পড়েছে অনেক খ্যাত শিল্পীর গায়নে। যদি ধরেও নিই সামান্য এইসব ত্রুটি বিশ্বভারতী কিছুটা উপেক্ষা করে গেছেন বা খুব প্রশিক্ষিত মানুষ ছাড়া এইসব সামান্য বিচলন খেয়াল করা সম্ভব নয় তাহলেও অন্তত দুটি ক্ষেত্রে বিশ্বভারতীর ওই ঔদার্য ব্যাখ্যার দাবি রাখে। জনপ্রিয় শিল্পী কিশোরকুমার রবীন্দ্রনাথের গানের ক্ষেত্রে সুরের প্রতি সুবিচার করেননি। তাঁর গলায় ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’ রীতিমতো ভুল সুরে গীত। আবার উচ্চারণের ক্ষেত্রে আশা ভোঁসলে-র অনাচার। ‘জগতে আনন্দযজ্ঞে’ গানে তাঁর উচ্চারণ হয়ে গেছে ‘জোগোতে’ - এটা কি মেনে নেওয়া যায়? অথচ অবাঙালি হিসেবে রাজেশ্বরী দত্ত এমন উচ্চারণ বিভ্রাটের শরিক হননি। কে. এল. সায়গল-এর ক্ষেত্রেও এমন অভিযোগ করা যাবে না। তাহলে বিশ্বভারতী সংগীত সমিতি এগুলিকে মান্যতা দিলেন কেন?

অথচ দেবব্রত বিশ্বাসের ক্ষেত্রে তাঁদের নিরীক্ষণ যে সঠিক ছিল না, এটা আজ ঐতিহাসিক সত্য। প্রথমবার 'বিশ্বভারতী সংগীত সমিতি' তাঁর গান নিয়ে যে আপত্তি তুলেছিলেন তা মূলত তাঁর গানের যন্ত্রানুষঙ্গ নিয়ে। এই বিষয়ে আপত্তি জানানোর কোনো নৈতিক অধিকার সংগীত সমিতির ছিল না, কারণ রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে যন্ত্রানুষঙ্গ নিয়ে কোনো লিখিত নির্দেশ দিয়ে যাননি। ফলে অধিকারের বাইরে গিয়ে এক্ষেত্রে ক্ষমতা দেখানোর বাহাদুরিই প্রাধান্য পেয়েছে। স্বয়ং দেবব্রত বিশ্বাস নিজে লিখে গেছেন, তাঁর ‘এসেছিলে তবু আসো নাই’ গানের যে অংশ নিয়ে সংগীত সমিতির বিরোধ ছিল সেই অংশের গায়ন বিশুদ্ধ বলে শান্তিদেব ঘোষ নিজে লিখে দিয়েছিলেন। দেবব্রতের গাওয়া ‘তুমি রবে নীরবে’ গানের একটি কথা - ‘সকল স্বপন’ না ‘সফল স্বপন’ নিয়ে যে বিতর্ক তার পক্ষেও কিন্তু গায়কের তথ্য সাবুদ অভ্রান্ত ছিল অথচ পরে ওই কথা গানে গেয়ে ওঠার কেউ সাহস করেননি। যদি বলি সেটা সংগীত সমিতির দাপটের কথা ভেবে।

অনেক পরে, যখন সত্যজিৎ রায় তাঁর ‘আগন্তুক’ ছবিতে ‘বাজিল কাহার বীণা’ গানটি ব্যবহার করেন ও সেই গানের রেকর্ডিং সংগীত সমিতির অনুমোদনের জন্য পাঠান, তাঁরা প্রাথমিকভাবে তা দিতে সম্মত হননি। সমিতির বক্তব্য ছিল গানের সুর ঠিকভাবে মেনে চলা হয়নি। কিন্তু শান্তিনিকতনের প্রাক্তনী ও ব্রাহ্ম সমাজের পরিধিতে বড় হওয়া সত্যজিৎ জানান, যে সুরে ওই গান তিনি রেকর্ডিং করিয়েছেন তার সুর ও স্বরলিপি আছে। শ্রীমতী বিজয়া রায়ও দাবি করেন ছোটবেলায় ওই সুরেই তিনি গানটি শিখেছিলেন। এইসব বিতর্কের আবহে ওই ছবির গান ওই সুরেই ছাড়পত্র পায়। কার্যত যা প্রকাশ্য করে দেয় সমিতির নড়বড়ে অবস্থান ও অনিরপেক্ষ চেহারা। এরপরে পীযুষকান্তি সরকারের রেকর্ডিং-এর অনুমোদন নিয়ে কিছু গোলমাল হলেও শেষ অবধি তা আটকায়নি। আবার এটাও বলার কথা, সংগীত সমিতির জমানার শেষের দিকে, সম্ভবত আটানব্বই সাল নাগাদ তাঁরা সুমন চট্টোপাধ্যায়কে নজিরবিহীনভাবে একটি মাত্র গীটার সহযোগে দশটি গান রেকর্ডিং-এর অনুমতি দেন। তবে এটাকে ব্যতিক্রম হিসেবে ভাবলেও তার উল্লেখ না করা সমুচিত নয়।

৪.

'বিশ্বভারতী সংগীত সমিতি' একটা প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠার পরে এমন অগণিত বিতর্ক তাঁদের তাড়া করে ফিরেছে। রবীন্দ্র সংগীত শিক্ষার জগতে শান্তিনিকতন সংগীত ভবনের দুনিয়াজোড়া নাম নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই কিন্তু কখনো একটি প্রতিষ্ঠান তার কৌলীন্য হারিয়ে এমন কিছু অনভিপ্রেত কাজে নিজেদের জড়িয়ে পড়ে যা আমাদের বিস্ময়ের উদ্রেক করে। কম বেশি সব প্রতিষ্ঠানই এই দোষে কলঙ্কিত, রবীন্দ্রনাথের নামের সঙ্গে যুক্ত বিশ্বভারতীও তার ব্যতিক্রম নয়।

তবে যে প্রসঙ্গ দিয়ে এই প্রতিবেদনের শুরু সেই সূত্রে আবার ফিরে আসি। রবীন্দ্রনাথের অনুপস্থিতিতে তৎকালীন শান্তিনিকতনের কর্তাব্যক্তিরা যে খুব খোলা মনের মানুষ ছিলেন না তার খুব স্পষ্ট দৃষ্টান্ত আমাদের হাতের সামনেই আছে। সলিল চৌধুরী একবার শান্তিনিকতনবাসী সুকন্ঠী কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিয়ে দুটি গান রেকর্ড করানোর পরিকল্পনা করেন। এর একটি হল ‘প্রান্তরের গান আমার’ আর অন্যটি ‘আমার কিছু মনের আশা’। কণিকাকে গান শেখানো, মিউজিকাল অ্যারেঞ্জমেন্ট, রেকর্ডিং সব হয়ে যাওয়ার পর যখন এইচ. এম. ভি. থেকে রেকর্ডের টেস্ট কপি পর্যন্ত তৈরি ঠিক তখনই শান্তিনিকেতন থেকে তাঁর মোহরদির এক অশ্রুসিক্ত চিঠি হাতে আসে সলিল চৌধুরীর। তাতে তিনি লিখছেন, ‘কর্তৃপক্ষ বলেছেন তোমার গান গাইলে আমাকে শান্তিনিকতন ছাড়তে হবে। কাজেই আমাকে ক্ষমা কোরো ভাই।’ অগত্যা ওই গান দুটি পরে উৎপলা সেনকে দিয়ে গাওয়ানো হয়।

এর থেকেও কুৎসিত ব্যবহার করা হয়েছিল, আরেক কিম্বদন্তী শিল্পী সুচিত্রা মিত্রের সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথের ‘কৃষ্ণকলি’ গানটির একটি অন্য ভাষ্য তৈরি করেছিলেন সলিল চৌধুরী যার নাম ‘সেই মেয়ে’ - দুটি গান আলাদা তবে তাদের মধ্যে একটা ভাবনাগত মিল আছে। ঘটনাচক্রে সুচিত্রা মিত্র রবীন্দ্রনাথের ‘কৃষ্ণকলি’ ও সলিলের ‘সেই মেয়ে’ রেকর্ড করেন। এই রেকর্ডিং-এর পরে সুচিত্রাকে শান্তিনিকতনে ডেকে পাঠিয়ে ‘গুরুদেবের গানের প্যারডি’ গাওয়ার জন্য তাঁকে চূড়ান্ত তিরস্কার করা হয় তাঁকে সামনে দাঁড় করিয়ে রেখে ‘সেই মেয়ে’ রেকর্ডটির একটি কপি পায়ে মাড়িয়ে ভেঙে ফেলা হয়। স্বৈরাচারের এমন কদর্য উদাহরণ কটা পাওয়া যাবে?

এই প্রসঙ্গে সুচিত্রা মিত্র পরে তাঁর আত্মকথায় লিখছেন, " ‘সেই মেয়ে’ গাওয়ার পর চারিদিকে শোরগোল পড়ে গেল। রবীন্দ্রভক্তরা প্রচন্ড ক্ষুব্ধ। আমাকে আক্রমণ করলেন, অপমান করলেন, আমাকে দেখিয়ে আমার ডিস্কটা ভাঙলেন। আমি কেন এক দাগী কমিউনিস্টের পাল্লায় পড়ে রবীন্দ্রনাথের কৃষ্ণকলির প্যারডি গাইলাম। আমি সেদিনও বলেছি, আজও বলছি - ‘সেই মেয়ে’ কৃষ্ণকলির প্যারডি নয়। সলিলের প্রতিভাকে আমি ঠিকই চিনেছিলাম।"

এখানে আর একটা খবর না জানিয়ে উপায় নেই। হয়তো অনেকেই জানেন না রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরে সলিল চৌধুরী অশৌচ পালন করেছিলেন, নিজের ইচ্ছায়। তখনো তাঁর মা বাবা দুজনেই জীবিত। ‘গুরুদেব ভক্ত’ স্বৈরী ব্যক্তিত্বরা হয়তো এই খবর রাখেননি। এদের হাতেই আসলে বিশ্বভারতীর শেষের শুরু।

‘আমার পৃথিবী নয় এইসব ছাতিম শিরীষ’। সত্যিই তো নয়।