আরেক রকম ● দশম বর্ষ ষোড়শ সংখ্যা ● ১৬-৩১ আগস্ট, ২০২২ ● ১-১৫ ভাদ্র, ১৪২৯

সম্পাদকীয়

না চাহিলে যারে পাওয়া যায়


জোর খবর। মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন সাতটা নতুন জেলা হবে। ছটা জেলার নাম জানা গেছে - বহরমপুর, কান্দি, রানাঘাট, ইছামতী, সুন্দরবন, বিষ্ণুপুর। এছাড়া বসিরহাটে একটা জেলা হবে যার নাম ঘোষণা করা হয়নি। বলা হয়েছে প্রশাসনের কাজে গতি আনতে প্রশাসনকে জনমুখী করতে এই উদ্যোগ। এর আগে আমরা একই কথা শুনেছি 'দুয়ারে সরকার' প্রকল্পের বেলায়। তাহলে কি সেই প্রকল্প ব্যর্থ? সরকার কারও দুয়ারে পৌঁছতে পারেনি? মানুষই ঘুরে বেড়াচ্ছে বিডিও, এসডিও, ডিএম-এর দুয়ারে দুয়ারে? কখনও তফসিলি জাতির প্রমাণপত্র কখনও রেশন কার্ড কখনও আবাসনের খোঁজে? সবই যদি দোরগোড়ায় চলে আসে তাহলে ডিএম অফিস দূরে হলেও বা ক্ষতি কি?

কার্যত 'দুয়ারে সরকারের' ব্যর্থতা স্বীকার করে নতুন জেলার ঘোষণায় তাড়া ছিল না। চলছিল ভালই। বাধ সাধলেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়। পলিটিক্সে জঘন্যতম অপরাধ হল চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়া। তাই করলেন তিনি। তাঁর বান্ধবীর ফ্ল্যাটে তল্লাশি চালিয়ে ইডি এখনও পর্যন্ত পঞ্চাশ কোটি টাকা, প্রচুর গয়না এবং বিদেশি মুদ্রা উদ্ধার করেছে। মুখ্যমন্ত্রী দৃশ্যতই বিচলিত। প্রথমে বললেন দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত পার্থ নির্দোষ। পরের দিনই পার্থর বিরুদ্ধে অ্যাকশন নিতে বাধ্য হলেন। এও বললেন তিনি নাকি কিছুই জানতেন না। এতদিন তেইশটা জেলায় ঘুরে ঘুরে প্রশাসনিক মিটিং করেছেন। মুগ্ধ শ্রোতাদের বলেছেন তিনি সব জানেন। সব খবর থাকে তাঁর কাছে। এবার সুযোগ ছিল তিরিশটা জেলায় সে কথা বলার। তা আর সম্ভব নয়।

জেলার সংখ্যা কি বাড়ানো উচিত নয়? নিশ্চয়ই উচিত। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে কারণ এ রাজ্যের জেলাগুলি অন্য রাজ্যের তুলনায় বরাবরই বড়। বড় জেলা ভেঙ্গে ছোট জেলা তৈরি করা বা কোনও জেলার সীমা নতুন করে নির্ধারণ করা প্রশাসনিক সংস্কারের অঙ্গ। তাই পশ্চিমবঙ্গে ১৯৮২ সালে গঠিত প্রশাসনিক সংস্কার কমিটিকে দায়িত্ব দেওয়া হয় বিষয়টি খতিয়ে দেখার। প্রসঙ্গত সেই কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন এই পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ডঃ অশোক মিত্র। সংস্কার এক দিনে হয়না। কমিটি দুই বছর ধরে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা চালায় বিশেষজ্ঞদের এবং সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলির সঙ্গে। কমিটির রিপোর্ট পাওয়া যায় ১৯৮৪ সালে।

জেলা ভাগ করা ব্যয়সাধ্য কাজ। তাই এ কাজের গুরুত্ব বুঝেও কমিটি এই ব্যাপারে ধীরে চলার পক্ষে মত দেয়। কমিটি বলে ২৪-পরগনাকে দুই ভাগ করার সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হোক। সেইসঙ্গে আগামী পাঁচ বছরে মেদিনীপুর আর বর্ধমান জেলাকেও ভাগ করা যায় কিনা দেখা হোক। পশ্চিম দিনাজপুরকে ভাগ করার কথা না বলে কমিটি বলে ডিএমের অফিস বালুরঘাট থেকে রায়গঞ্জে সরিয়ে আনা হোক। এছাড়া বেশ কয়েকটি নতুন সাব-ডিভিশনের সুপারিশ করা হয় যেমন হলদিয়া, খড়গপুর, কাকদ্বীপ ইত্যাদি। কমিটির মত ছিল ভবিষ্যতে জেলা-ভাগ সম্ভব হলে জেলা-প্রতি ১৫-২০ লক্ষ জনসংখ্যার টার্গেট রাখা যেতে পারে। ১৯৮০-র দশকের আর্থিক সমস্যা এখন নেই। কিন্তু রাজ্য চলছে ধারের টাকায়। তাই অযথা খরচ বাড়ানো এখনও বিপদজনক। অবশ্য যে সরকার প্রতিটি পুজো কমিটিকে পঞ্চাশ হাজার টাকা অনুদান দেয় তাকে আর্থিক অনুশাসনের কথা বলা বৃথা।

প্রশাসনিক সংস্কার কমিটি শুধু জেলার বাঞ্ছিত জনসংখ্যা নির্ধারণ করেনি। কমিটি সুপারিশ করে প্রতি জেলায় প্ল্যানিং কমিটি তৈরি করে তাদের জেলাস্তরে প্ল্যানিং-এর কাজে যুক্ত করতে হবে। তার আগে কোন জেলায় কি কাজ হবে তা ঠিক হত রাজ্যস্তরে। পরিকল্পনার কাজ জেলাস্তরে নেমে আসাতে পঞ্চায়েতও যুক্ত হল সে কাজে। সাধারণ মানুষকে প্ল্যানিং-এর কাজে যুক্ত করার দিকে একটা বড় ধাপ এগোনো গেল। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশাসনে পঞ্চায়েতের কোনও গুরুত্ব নেই। কোথায় কি হবে তা তিনি একাই ঠিক করেন। তাঁর একটাই শর্ত। যা দেবার তিনি খুশি হয়ে দেবেন। কেউ কিছু চাইতে পারবে না। চাইলেই বিপদ। এ এক অন্য ধরনের গভর্ন্যান্স মডেল।

এই মডেলে অনেকগুলি বাতি একসঙ্গে জ্বালিয়ে চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া হয়। একটা একটা করে বাতি যখন নিভে যায় তা মানুষ টের পায়না, কারণ নতুন দিনে এসে যায় নতুন হুজুগ। তাই নতুন জেলাও হয় একসঙ্গে সাতটা। বীরভূম জেলাকে ভাঙ্গা হল না কেন? নিশ্চয়ই মুখ্যমন্ত্রী মনে করেন তার প্রয়োজন নেই, কারণ জেলা প্রশাসন যথেষ্ট তৎপর। তাহলে আনারুল সময় মতো পুলিশ পাঠায়নি বলে কেন একটা পরিবারকে পুড়ে মরতে হয়?

জেলা ছোট হলেই হয় না। আনুষঙ্গিক কিছু পদক্ষেপও করতে হয়। অতো সাধের 'কন্যাশ্রী' প্রকল্পের কি হল? মেয়েদের ইশকুলে রাখা বা আঠারো বছর বয়সের আগে বিয়ে না দেবার উদ্দেশ্য কি সফল? সাফল্য নিশ্চয়ই আসতো যদি সাধারণ মানুষকে উৎসাহিত করে তাকে যোগ করা হতো প্রকল্পে। জেলা ভাঙ্গার উদ্যোগও কতদূর সফল হবে বলা কঠিন।

ইদানীং সব রাজ্যই জেলা ভেঙ্গে ছোট করেছে। ১৯৮০-র দশকে দেশে জেলার সংখ্যা ছিল ৪১২। এখন তা ৭২০ ছাড়িয়েছে। প্রতি রাজ্যেই এ কাজ করা হয়েছে বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশ মতো। জেলার গড় জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২০ লক্ষের কাছাকাছি। এরিয়া প্রায় ৪,৩০০ বর্গ কিলোমিটার। সেই নিরিখে বাংলায় এখনও দশটা জেলাকে ভেঙ্গে ছোট করা যায়। গড় জনসংখ্যা এখন ৪৩ লক্ষ। একেও কমিয়ে আনতে হবে। প্রশাসনের মান কিন্তু এই গড় দিয়ে বোঝা যাবেনা। বুঝতে হবে সাক্ষরতা, পুষ্টি, শিশু মৃত্যুর হার, পানীয় জল, নিকাশি ব্যবস্থা, আইন শৃঙ্খলা ইত্যাদি দেখে। একসময়ে এই হিসেবে নিশ্চিতভাবে এগিয়ে ছিল অবিভক্ত মেদিনীপুর আর বর্ধমান। মুখ্যমন্ত্রী জানেন সে কথা?

অন্য রাজ্যের অভিজ্ঞতাও তাই। একইসময়ে ছোট বড় জেলায় সমীক্ষা চালানো হয়েছে। তাতে প্রমাণিত হয়নি যে ছোট জেলার প্রশাসন বড় জেলার তুলনায় ভাল। আবার জেলা ভাগের আগে পরে সমীক্ষা চালিয়ে দেখা হয়েছে। সব জেলাতেই যে উন্নতি দেখা গিয়েছে তা নয়। ছোট পরিবার সুখী পরিবার। এ কথা সরকারিভাবে স্বীকৃত। কিন্তু ছোট জেলা সুখী জেলা তা বলার উপায় নেই। এর পিছনে একাধিক কারণ রয়েছে। একটা কারণ খুবই স্পষ্ট। বেশিরভাগ রাজ্যেই ছোট জেলায় ডিএম করে পাঠানো হয় ৪-৬ বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন অফিসারদের। বড় জেলায় অফিসার যান ১০-১২ বছর চাকরির পরে। অভিজ্ঞতার সঙ্গে পরিচিতিও বাড়ে। একজন ডিএম রাজ্য সচিবালয়ের যে কোনো সচিবের ঘরে ঢুকে যান নির্ভয়ে। কাজ আদায় করে নেন। অন্যজন ইতস্থত করেন। একজন বন্যাত্রাণে অনেক চেষ্টায় এক কোটি টাকা পান। অন্যজন পেয়ে যান চার কোটি। বড় জেলায় দেখবেন অফিসারের পোস্ট বেশি ভেকেন্সিও কম। ছোট জেলার ডিএম অফিসার চেয়েও পান না। সব জেলা যেদিন মোটামুটি এক সাইজের হবে সেদিন এই বাস্তব অসুবিধাগুলি হয়তো থাকবে না। কিন্তু সেদিন এখনও দূরে।

মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণায় রাজ্যের মানুষ আপ্লুত তা বলার উপায় নেই। সংবাদ মাধ্যম একে সময়োচিত বা মূল্যবান পদক্ষেপ আখ্যা দিয়ে স্বাগত জানায়নি। বরং পার্থ-অর্পিতা কাণ্ড থেকে মানুষের নজর ঘোরাবার চেষ্টা হিসেবেই দেখেছে। রাজ্য কংগ্রেস পথে নেমেছে জেলার নাম পরিবর্তনের বিরুদ্ধে। মুর্শিদাবাদ শুধু জেলা নয়। একসময়ে এ ছিল সুবা বাংলার রাজধানী। নদিয়ার নাম এক হয়ে গেছে শ্রীচৈতন্যের নামের সঙ্গে। স্থানীয় মানুষের ভাবাবেগে আঘাত না দিয়ে কি করা যেত না কাজটা?