আরেক রকম ● দশম বর্ষ পঞ্চদশ সংখ্যা ● ১-১৫ আগস্ট, ২০২২ ● ১৬-৩১ শ্রাবণ, ১৪২৯

প্রবন্ধ

কমছে গবেষণায় বরাদ্দ টাকা, বাড়ছে অবিজ্ঞান

পারভেজ খান


টুকরো কিছু প্রতিবাদ দেখছি হঠাৎ করে। কারণ হঠাৎ করেই কেভিপিওয়াই-এর পরীক্ষা এ বছর থেকে বন্ধ করে দিতে চলেছে ডিএসটি। অবশ্যই উদ্বেগের খবর। আমরা যখন উচ্চমাধ্যমিক দিয়েছি, গ্রাজুয়েশন পড়েছি তখন এ ব্যাপারে জানতাম না, পরে যখন জেনেছি, অল্প অল্প আক্ষেপও করেছি কেন জানতাম না! যাই হোক, যখন স্কুলে পড়াতাম দেখতাম অনেকেই এই পরীক্ষাটি দেওয়ার জন্য বেশ সিরিয়াস ছিলো, তারা বিজ্ঞানে কেরিয়ার করতে চাইতো, স্বপ্ন দেখতো আগামীর জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, অশোক সেন হওয়ার। ভালো গবেষণা কেন্দ্রে পড়ার ও কিছু সময় কাজ করার সুযোগ আর সাথে বৃত্তিও পাওয়া যেত এই পরীক্ষার কৃতীদের। কিন্তু হঠাৎ করেই সেটি বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। আচমকাই!

কিন্তু সত্যি কি আচমকাই? না কি আজ হঠাৎ ঘুম ভাঙাতে ইচ্ছে করছে! না কি তাও না? এ শুধু ব্যথার দিন, এ লগন স্ট্যাটাস দেবার! ২০২১-২২ অর্থবছর আর ২০২২-২৩ অর্থবছরের একটা তুলনা করা যাক। ভারতবর্ষের বিভিন্ন বিজ্ঞান প্রকল্পের গবেষণার জন্য যারা মূলত টাকা পয়সা (ভালো ভাষায় বললে গ্রান্ট) দেয় তারা হল DBT (Department of Biotechnology), DST (Department of Science and Technology), DSIR (Department of Science and Industrial Research) ইত্যাদি। এই তিনটিই ভারতবর্ষের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীনে। এক অর্থবছরের মধ্যেই ৫৭৬ কোটি টাকা বাজেট থেকে কাটা পড়েছে এগুলির। (হয়তো খুব বেশি না, কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পেতে যথেষ্ট।) আবার এগুলির অধীনে কিছু সংস্থা আছে যারাও ওই টাকা পয়সা মানে, বিভিন্ন গ্রান্ট দিয়ে বিজ্ঞান গবেষণায় সাহায্য করতো - যেমন DST-এর অধীনে SERB (Science and Engineering Research Board), DBT-এর অধীনে BTD (Bio Tech Research and Development) ইত্যাদি, এদের প্রত্যেকের থেকেও স্বভাবতই বাজেট কাটা পড়েছে!

এবার যদি অন্যান্য দেশগুলোর সাথে একটা তুলনামূলক আলোচনায় আসি, তবে দেখা যাবে - দু দুটো বিশ্বযুদ্ধের ঋণের বোঝা কয়েকদিন আগে চুকিয়ে ওঠা জার্মানি ও টানা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণার ক্ষেত্রে টাকা ঢালার পরিমাণ প্রত্যেক বছর বাড়িয়েই গিয়েছে (জিডিপির শতাংশ হিসেবে), দক্ষিণ কোরিয়া (জিডিপির প্রায় ৫%), চীন, আমেরিকা এমনকি নিম্ন ও মধ্য আয়ের রাষ্ট্রগুলির বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে খরচা আমাদের (জিডিপির প্রায় ০.৭%) থেকে বেশি। আরও বড়ো বিষয় বাকি রাষ্ট্রগুলি যখন বরাদ্দ প্রত্যেক বছর বাড়াচ্ছে আমাদের চালকরা কমাচ্ছেন, ২০১০ থেকেই কমেছে, এ সরকার আসার পর আরও বর্ধিত হারে কমেছে! হয়তো এমনি করেই হবে বিশ্বগুরু। একটু বিস্তারিত ভাবে দেখা যাক, ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের তথ্যগুলোর দিকে যদি নজর রাখি, তাহলে দেখব ১৯৯৬ সালে আমাদের GDP-র ০.৬৬% বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হতো। এবং তারপর থেকে পরবর্তী চার বছরে মানে ২০০০ সালে সেটি গিয়ে দাঁড়ায় ০.৭৬%। লক্ষ্যনীয় যে তার পরবর্তী ২০০০ থেকে ২০০৩-এ সেটি আবার নেমে যায় ০.৭২%, এবং আরও মজার বিষয় সেই সময় কেন্দ্রে এনডিএ সরকার, কিছুদিন আগে কারগিল-এর যুদ্ধ শেষ হয়েছে। ২০০৪-এ ইউপিএ সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বেশ ঝোড়ো গতিতেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বরাদ্দ বাড়তে থাকে, ২০০৮-এ গিয়ে দাঁড়ায় ০.৮৬%, নিশ্চিতভাবে বলা যায় এই বৃদ্ধি ভারতের অগ্রগতির পক্ষে সহায়ক হয়েছিল। তারপর ২০০৯ থেকে আবার কিছুটা পড়া শুরু এবং ২০১৩-তে তা নেমে দাঁড়ায় ০.৭১%, এই সময়ের মধ্যে কি কি হয়েছে যদি খেয়াল করে দেখা যায় - বামেরা পরমাণু চুক্তির বিরোধীতা করে ইউপিএ থেকে সমর্থন তুলে নেয়, একের পর এক কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ আসতে থাকে, আন্না হাজারে যন্তর মন্তরে অবস্থান শুরু করেন। একটা টালমাটাল অবস্থাতেও বরাদ্দ ০.৭%-এর নীচে নামেনি।

কিন্তু আচ্ছে দিনের ফেরিওয়ালা এসে এখান থেকে ভালো অবস্থানে নিয়ে যাওয়া তো দূর, দিন দিন বরাদ্দ কমাতেই থেকেছে। আগেই বলেছি ১৯৯৬-তে GDP-র ০.৬৬% ব্যবহার হত আর ২০১৮-তে এসেও দাঁড়ালো সেই ০.৬৬%! দেশে প্রায় প্রতিদিনই এমন বহুকিছুই ঘটছে যা লজ্জার, আর এই তথ্য পরিসংখ্যানও আরও একটা লজ্জার। ১৯৯৬ ও ২০১৮, মাঝে ২২ বছর, কিন্তু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণার ক্ষেত্রে আমাদের বরাদ্দ সেই একই জায়গায় আটকে গেছে! এখান থেকে টেনে তোলার ভার যাদের হাতে তারা প্রতিনিয়ত যে সমস্ত অবৈজ্ঞানিক বক্তব্য রাখছেন, সাধারণ মানুষ ক্ষেপাচ্ছেন তাতে আশা রাখা মুসকিল হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তাতে সার্বিক অবস্থার অবক্ষয় হচ্ছে - যাদের কাছে সুযোগ আছে তারা বাইরে পাড়ি দিচ্ছেন, যারা বাইরে আছেন তারা দেশের অবস্থা দেখে ফেরার ইচ্ছে হারাচ্ছেন।

কী করে এত দৃঢ়তার সঙ্গে বলছি? লোকসভাতে খুব সম্প্রতি কেন্দ্রের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে, ২০২১-এ ১.৬ লক্ষ ভারতীয় তাদের নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছেন, সেখানে রিনিউ করেছেন ৮৫,০০০-এর কাছাকাছি। যাই হোক আমরা উন্নয়নশীল রাষ্ট্র, আমাদের সাথে একই গোষ্ঠীতে ফেলা দেশগুলিকে নিয়ে তৈরি হয়েছিল BRICS মানে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা। একটু তাদের সাথে তুলনামূলক আলোচনায় (ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের ২০১৮ অবধি তথ্য) যদি যাই তাহলে দেখবো ব্রাজিল ১.২১%, রাশিয়া ১.১০% বরাদ্দ রেখেছে তাদের GDP-র, চীনের কথা আর বললাম না। ভারত এর বরাদ্দকৃত শতাংশের পরিমাণ শুধু দক্ষিণ আফ্রিকার থেকে বেশি (০.৬২%) এই ব্রিকস দেশগুলির মধ্যে। এশিয়ার উন্নত দেশগুলি বলতে যাদের গণ্য করা হয় চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান - তাদের সবারই বিজ্ঞান গবেষণায় ব্যয় ভারতের তুলনায় বহুগুণে বেশি। এবার আমি মহাভারতে রামায়ণে বিজ্ঞান খুঁজে খুঁজে হন্যে হবো, গর্বিত হবো, বিজ্ঞান গবেষণায় ফান্ড দেবো না তারপর বলবো আত্মনির্ভর হবো, এরকম ধারণাগুলোও তো চুড়ান্ত অবৈজ্ঞানিক। এয়সে ক্যায়সে চলেগা!

আবার বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাজেটের বিন্যাস ভীষণরকম অসম। যেমন প্রতিরক্ষা, মহাকাশ, ও পারমাণবিক শক্তি - মাত্র এই তিন ক্ষেত্রের গবেষণায় মোট বরাদ্দের প্রায় ৬০% দেওয়া। তার মধ্যে একা প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রেই শুধু ৩০%-এর উপরে, মহাকাশে ১৯% ও পারমাণবিক শক্তিতে প্রায় ১১%, আর বাকি সবক্ষেত্র মিলিয়ে ৪০%! যার মধ্যে কৃষি, চিকিৎসা ইত্যাদি পড়ছে। তাত্বিক বিজ্ঞানের কথা ছেড়েই দিলাম - ও খায় না মাথায় দেয় সে নিয়ে ভাবার সময় নেই কারোর! সারাক্ষণ যুদ্ধ যুদ্ধ আবহ করে রাখতে চাইলে প্রতিরক্ষায় বরাদ্দ তো বেশি হতেই হবে! কিন্তু আসল যুদ্ধ যে খাদ্য, স্বাস্থ্য নিয়ে সেসব আমরা ভুলতে বসেছি। সব রকম বিজ্ঞানকে সমান গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না এবং বেশ অনেকদিন ধরেই এটা প্রচার করে দেওয়া হচ্ছে একরকম যে, যার ইন্ডাস্ট্রিয়াল মূল্য নেই, সরাসরি এবং তাড়াতাড়ি প্রযুক্তির সঙ্গে যোগ নেই, বিশেষ করে মৌলিক বিজ্ঞানের গবেষণা, তাত্বিক বিজ্ঞানের গবেষণা ইত্যাদি, সেসব গবেষণা আসলে অকাজের গবেষণা। এরকম একটা ধারণা তৈরি করে দিয়ে সে সমস্ত কাজ থেকে বরাদ্দ অর্থ কমানো, সে সমস্ত প্রজেক্টকে এপ্রুভাল না দেওয়া সহজ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মৌলিক গবেষণা ছাড়া প্রযুক্তির উন্নয়ন সম্ভব না। উভয়কে পায়ে পা মিলিয়ে চলতে হয় শিল্পের বিকাশের জন্য। নইলে বিকাশের জায়গায় বিনাশ অবশ্যম্ভাবী।

গোমূত্রে ক্যানসার সারে কিনা, রামসেতু কোথায় ছিলো, তা দিয়ে কে কে পার হয়েছিলো সেইসবে অর্থ বরাদ্দ হচ্ছে, মানুষ মরছে একদিকে আর একদিকে গোমন্ত্রণালয় হচ্ছে। মহাভারতের যুগে অন্তর্জাল ছিলো কিনা, গনেশ ঠাকুর প্রথম প্লাস্টিক সার্জারীর উদাহরণ কিনা এসবকেই বিজ্ঞান হিসেবে দেখানোর বোঝানোর হিড়িক পড়ছে! আমরাই শ্রেষ্ঠ ছিলাম, আমাদের মহাভারত আসলে সাহিত্য নয় বিজ্ঞান - এমন প্রচার চলছে, সমস্ত ফ্যাসিবাদী শক্তির যে বৈশিষ্ট্যগুলো থাকে, এটিও সেরকম একটি!

যাই হোক আজ কেভিপিওয়াই-তে হাত পড়েছে দেখে অনেকেই কথা বলছেন দেখে ভালো লাগছে, যদিও বেশিরভাগের এতে কিচ্ছু যায় আসে না, তবু এটা জানা ও বোঝা দরকার এর পিছনের রাজনীতির হাত, বিগত কয়েক বছরের আমাদের রাষ্ট্রচালকদের দৃষ্টিভঙ্গি। কোন রাজনীতি এই জায়গায় নিয়ে এসেছে, এটা না বুঝলে এই আলোচনা ও কান্নাকাটি অর্থহীন। পিএমআরএফ-এর নামে একটা বৈষম্যমূলক ফেলোশিপ চালু হয়েছে এই আমলে, সেটি কতোদিন চলবে সে নিয়েও আমার সন্দেহ আছে। এদিকে শেষ - জেআরএফ, এসআরএফ ফেলোশিপ ইনক্রিমেন্ট হয়েছিলো তার আবার চার বছর হয়ে গেছে। ডলারের তুলনায় টাকার মূল্য পড়েই চলেছে। মুদ্রাস্ফীতি চরমে। চার বছরে বাপুজি কেকের দামও ৫০% বেড়ে গেছে।

যাই হোক এসবের ঊর্ধ্বেও আজব কারখানা আছে। NIRF এখন রাঙ্কিং করে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলির। তাতে প্রথম ১০০-তে যারা থাকে তারা কিছু অতিরিক্ত অর্থসাহায্য পায় একটা মোটামুটি রকমের, আর যারা তার মধ্যে থাকে না তারা সেটি থেকে বঞ্চিত হয়। বঞ্চিতরা বঞ্চিত থেকে আর কতো কি করেই বা প্রথম ১০০-তে আসবে, ফলে তারা অবহেলিত রয়ে যায়, পড়ে থাকে তেলা মাথায় তেল দেওয়া, যাদের ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইতিমধ্যেই ভালো, তারাই প্রথমে আসে, তারাই সাহায্য পেতে থাকে, এবং এ চলতেই থাকে। এবং এই রাঙ্কিং নিয়ে এক অদ্ভুত উন্মাদনা সবার মধ্যে। ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থাই নানারকম রাঙ্কিং জর্জরিত!

তো, আচমকাই? একেবারেই নয়, বহুদিন ধরে হয়ে আসছে, চোখ পড়েনি হয়তো। বা আমাদের রাজনীতি বিমুখ হওয়ার সুযোগ নিচ্ছে রাষ্ট্রপক্ষ। এ কোপ পড়া অনিবার্য ছিলো।


তথ্যসূত্রঃ

1. https://www.newindianexpress.com/nation/2022/feb/02/research-and-development-budget-of-crucial-institutions-downsized-2414188.html

2. https://indianexpress.com/article/opinion/columns/unesco-stats-on-global-expenditure-on-r-d-7775626/

3. https://data.worldbank.org/indicator/GB.XPD.RSDV.GD.ZS?locations=IN