আরেক রকম ● দশম বর্ষ পঞ্চদশ সংখ্যা ● ১-১৫ আগস্ট, ২০২২ ● ১৬-৩১ শ্রাবণ, ১৪২৯

প্রবন্ধ

পাভলভ ও 'ধর্মবিযুক্ত' সোভিয়েত রাষ্ট্র

আশিস লাহিড়ী



ইভান পেত্রোভিচ পাভলভ


১৯২০-র দশকের গোড়ার দিকে পাভলভকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তিনি কি ধর্মবিশ্বাসী? উত্তরে মৃদু হেসে তিনি বলেছিলেনঃ
"শোনো ভাই, আমার ধার্মিকতা, আমার ঈশ্বরবিশ্বাস, আমার চার্চে যাওয়া এসব নিয়ে অনেকে অনেক রকম কথা বলে। এর মধ্যে কোনো সত্য নেই, সবটাই বিকল্পনা। আমি লেখাপড়া করেছিলাম ধর্মীয় বিদ্যালয়ে (সেমিনারিতে)। ধর্মীয় ইস্কুলের বেশিরভাগ ছাত্রর মতো আমিও ইস্কুলে থাকতেই ধর্মে বিশ্বাস হারিয়ে নিরীশ্বরবাদী হয়ে উঠেছিলাম।"

এই শেষ বাক্যটি খুব কৌতূহলজনকঃ ধর্মীয় ইস্কুলে পড়েছিলেন বলেই তিনি 'নিরীশ্বরবাদী' হয়ে উঠেছিলেন। সংশয়হীন আপ্তবাক্যকে মেনে নিতে পারেননি তিনি; তাঁর সংশয়ী মন বিচারশীল ভাবনাকে প্রাধান্য দিত। পরবর্তীকালে তিনি দেখিয়েছিলেন, মস্তিষ্কের বিভিন্ন টাইপ হয়; তারই ওপর অনেকখানি নির্ভর করে ব্যক্তির মনের প্রবণতা; কেউ আপ্তবাক্যে বিশ্বাসপ্রবণ; কেউ সংশয়ী, যুক্তিবাদী। যারা তাঁর কথায় এক ধরনের 'দৃঢ়' মস্তিষ্কের অধিকারী তারা ঈশ্বরের ধারণাটিকে যুক্তির আলোকে বাজিয়ে নিয়ে পরিত্যাগ করতে পারে, তার জন্য তাদের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে হয় না। অন্য কোনো একটা উৎস থেকে, হয়তো বিজ্ঞান বা সামাজিক আন্দোলন থেকে, তারা নিরাপত্তা খুঁজে পায়। কিন্তু বেশিরভাগ লোকেরই মস্তিষ্ক তাঁর কথায় 'দুর্বল', তারা আপ্তবাক্যের ওপর বেশি নির্ভরশীল, তাই সবার উপরে সর্বশক্তিমান কোনো মুশকিল-আসানের কাল্পনিক অভিভাবন ছাড়া তাদের ভয় কাটে না।সেটা সত্য না মিথ্যা, সেটা বিবেচ্য নয়; সেটা স্বস্তি দেয়, ভয় কাটায়, এটাই বড়ো কথা। মিথ্যা অভিভাবনের মধ্যে থেকে মানুষের স্বস্তির বোধ খুঁজে নেওয়ার এই প্রক্রিয়াটাও বিবর্তনের পথেই বিকশিত হয়েছে। এটা বাস্তব। সুতরাং তিনি নিজে আকৈশোর ঈশ্বরকে অস্বীকার করলেও, ঈশ্বরভিত্তিক ধর্ম যে ব্যাপক মানুষের কাছে মৌলিক অর্থে একটা প্রয়োজনীয়, এমনকী অপরিহার্য জিনিস, এটা তিনি মানতেন।

১৯৩১ সালে ম্যাক্সিম গোর্কি তাঁকে সোজাসুজি জিজ্ঞেস করেছিলেন তিনি ধর্মবিশ্বাসী কি না? উত্তরে পাভলভ বলেছিলেন,
"অবশ্যই আমি ছেলেবেলাতেই ধর্মবিশ্বাস হারিয়েছিলাম। কী করে সেটা ঘটল, ব্যাখ্যা করা শক্ত। ভগ্‌ট আর মোলেস্কট-এর লেখায়, তারপর প্রকৃতি বিষয়ক বিজ্ঞানে আমি বুঁদ হয়ে থাকতাম। সারা জীবন তো এই ক্ষেত্রেই কাজ করলাম; আমার কারবার বস্তু নিয়ে।"

১৯৩৫ সালে ৮৬ বছর বয়সে পাভলভ বলেছিলেনঃ
"আমার বাবা ছিলেন যাজক, আমি বড়ো হয়েছিলাম ধর্মীয় পরিবেশে, কিন্তু বছর পনেরো-ষোলো বছর বয়সে আমি হরেক রকম বই পড়ে আমার মত বদলে ফেলি।"

এই ‘হরেক রকম’ বইয়ের কিছু পরিচয় দেওয়া যাতে পারে। পাভলভের কিশোরকালের প্রিয় ওলন্দাজ লেখক জেকব মোলেস্কট (১৮২২-১৮৯৩)-এর 'জীবনচক্র' বইটি উনিশ শতকের বস্তুবাদকে জোর মদত জুগিয়েছিল। হল্যান্ডের এই চিকিৎসক ও শারীরতত্ত্ববিদ এ বইতে 'বৈজ্ঞানিক প্রশ্নের বৈজ্ঞানিক উত্তর' খোঁজার দাবি তোলেন। রক্ত আর বিপাকক্রিয়া (মেটাবলিজ্‌ম) নিয়ে তাঁর গবেষণা শারীরবৃত্তীয় রসায়নের বিকাশে অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল। আবেগ আর চিন্তারও শারীরবৃত্তীয় বনেদ আছে, এই মতে বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। “ফসফরাস নেই তো চিন্তাও নেই” - এই ছিল তাঁর বিশেষ প্রিয় একটি বিবৃতি।

১৮৬০ থেকে ১৮৭০ পর্যন্ত যে-সময়টা পাভলভ চার্চের বিদ্যালয়ে পড়তেন, সেটা রাশিয়াতে মস্ত পরিবর্তনের কাল।ওই সময়েই জার আলেকজান্ডার ভূমিদাস প্রথা রদ করেছিলেন। রাশিয়ার ভবিষ্যত নিয়ে তুমুল তর্কবিতর্ক বাধে। পশ্চিমাগত ধ্যানধারণার দ্রুত প্রসার ঘটে। ডি. আই. পিসারেভ (১৮৪০-১৮৬৮) বিজ্ঞানের পাণ্ডিত্যপূর্ণ বইগুলির সহজ ও জনপ্রিয় রুশ ভাষ্য রচনা করতেন।

ডারউইনের 'অরিজিন' বেরোবার পাঁচ বছর পর পিসারেভ অবিশেষজ্ঞ মানুষের জন্য ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বের এক সহজবোধ্য ভাষ্য হাজির করেন। রাজনৈতিকভাবে তিনি ছিলেন নিহিলিস্ট মতাবলম্বী। অর্থোডক্স চার্চের সংস্রব তিনি ত্যাগ করেছিলেন। রাষ্ট্রবিরোধী, চার্চবিরোধী কথাবার্তার জন্য জেল খেটেছিলেন কয়েক বছর। শুধু পাভলভ নয়, লেনিনের প্রজন্মেরও বহু মানুষ এই অতি স্বল্পায়ু লেখকের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। এখান থেকে তরুণ পাভলভের মনের গতিপ্রকৃতি পরিষ্কার হয়ে ওঠে।

বুঝতে অসুবিধে হয় না, ধর্মতত্ত্ব আর মানবিকী বিদ্যার ছাত্র ইভান পাভলভ-এর মনে এইসব লেখকদের জীববৈজ্ঞানিক যুক্তিসমৃদ্ধ ব্যাখ্যা গভীর ছাপ ফেলেছিল। বিজ্ঞানকে তিনি মানুষের মননের মহত্তম বহিঃপ্রকাশ মনে করতেনঃ
"আমি বিশ্বাস করি বিজ্ঞানের প্রগতি মানুষকে সুখ দেবে। আমি বিশ্বাস করি মানুষের মনন আর তার মহত্তম বহিঃপ্রকাশ - বিজ্ঞান - মানবপ্রজাতিকে রোগভোগ, বুভুক্ষা, বৈরিতা থেকে মুক্তি দেবে, মানুষের দুঃখ কষ্ট কমাবে। এই বিশ্বাসই আমাকে কাজ চালিয়ে যাবার শক্তি জুগিয়েছে, এখনও জোগায়।"

বলশেভিক বিপ্লবের পর সোভিয়েত রাষ্ট্রর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক বেশ ওঠাপড়ার মধ্য দিয়ে যায়। বিপ্লবের ঠিক পরেই রশিয়ার দুঃসহ পরিস্থিতি দেখে তিনি লেনিনের কাছে অনুরোধ করেছিলেন বিদেশে কোথাও তাঁর ল্যাবরেটরি স্থানান্তরিত করে দেওয়া হোক। সকলেই জানেন, লেনিন রাজি হননি; কিন্তু পাভলভের বিজ্ঞান গবেষণাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে সেই দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতিতেও সমস্তরকম সুযোগ সুবিধার এবং বিশেষ 'রেশন'-এর ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। কমিউনিজমকে খুব প্রসন্ন মনে নিতে পারেননি পাভলভ; তবু সোভিয়েত রাশিয়াতেই নিশ্চিন্তে তাঁর কাজ চালিয়ে যান।

জোসেফ স্ট্যালিনের সঙ্গে ১৯২৪ সালে তাঁর তীব্র মতবিরোধ হয় কয়েকজন যাজকপুত্রকে বরখাস্ত করা নিয়ে। লেনিনগ্রাডের যে-সামরিক অ্যাকাডেমিতে তিনি একদা ছাত্র ছিলেন, সেই অ্যাকাডেমি থেকে কয়েকজন পাদ্রীপুত্রকে বহিষ্কার করা হয়। তিনি তখন সেখানে শারীরতত্ত্বর প্রোফেসর। প্রতিবাদে পদত্যাগ করেন পাভলভ। সেই উপলক্ষে তাঁর বিখ্যাত উক্তি অনেকেরই জানাঃ "আমার বাবাও যাজক ছিলেন। অন্যদের যদি বহিষ্কার করেন, আমিও পদত্যাগ করব।" কিন্তু এত দ্বিধা সত্ত্বেও জীবনের শেষ দিকে তিনি সোভিয়েত রাষ্ট্র এবং কমিউনিজম সম্পর্কে বেশ নরম মনোভাব পোষণ করতেন। তাঁর নিজের দেশের প্রতি ভালোবাসা আর বিজ্ঞানের প্রতি সোভিয়েত রাষ্ট্রের অকুণ্ঠ সমর্থন তাঁর মতবদল ঘটিয়েছিল।

তবে ধর্মনীতি নিয়ে সোভিয়েত রাষ্ট্রর সঙ্গে তাঁর মত কোনোদিনই মেলেনি। না-মেলার পেছনে শুধু মানবিকতা নয়, ছিল বিজ্ঞানও। মানুষের উচ্চতর স্নায়ুতন্ত্র বিষয়ে পাভলভের গবেষণা তাঁর মানবিক মূল্যবোধের সঙ্গে সংগত ছিল। ধর্মের প্রতি সার্বিক অসহিষ্ণুতা ধর্মান্ধতার জন্ম দেবে, এই ছিল তাঁর বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত। প্রতিটি সমাজেই থাকে এবং থাকবে এমন বেশ কিছু 'দৃঢ়' স্বভাবের লোক যারা যুক্তিবাদী বিশ্বদর্শনকে আপন করে নিয়ে প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করেও স্বচ্ছন্দে জীবন কাটাতে সক্ষম; কিন্তু গোটা মানবপ্রজাতি সম্বন্ধে তা খাটে না - যারা 'দুর্বল' স্বভাবের লোক তারা ধর্মের আশ্রয় চাইবেই। এটাও মানুষ বিবর্তনের মাধ্যমেই পেয়েছে। পাভলভ মার্কসবাদী ছিলেন না, কিন্তু সংকটের মুখে দৃঢ় মস্তিষ্ক আর দুর্বল মস্তিষ্কর এই টানাপড়েন মার্কসবাদী তত্ত্বর সঙ্গে দিব্যি খাপ খেয়ে যায়। কিন্তু যান্ত্রিক বস্তুবাদের সঙ্গে এটা একেবারেই খাপ খায় না। পাভলভ যান্ত্রিক বস্তুবাদী ছিলেন না। সুতরাং তিনি বুঝেছিলেন ধর্মকে জোর করে বাতিল করে দিলে উলটো ফল ফলবে। ধর্মাচরণের প্রতি আঘাত এলে ধার্মিকরা এমনকী শহিদত্ব বরণ করতেও পিছপা হবে না; আর সেটা হলে 'দুর্বল' মস্তিষ্কের অধিকারী অধিকাংশ লোকের ধর্মপ্রবণতা বাড়বে বই কমবে না।

পাভলভ নিজে ছিলেন কট্টর নাস্তিক; কিন্তু বিপুল সংখ্যক মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে তিনি বৈজ্ঞানিক ও মানবিক কোণ থেকে বিচার করতেন। তাঁর পরিষ্কার কথাঃ

"যতক্ষণ না অধিকাংশ মানুষ অন্য কোনো বিশ্বাসের একটা শক্ত জমি তৈরি করে নিতে পারছে ততক্ষণ তাকে জোর করে তার ধর্মপালনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করাটা অবৈজ্ঞানিক এবং অন্যায়।"

তিনি বলেছিলেনঃ
"অনেকে বলে আমি নাকি ঈশ্বরবিশ্বাসী, ধর্মবিশ্বাসী; কেন বলে? কারণ আমি চার্চ এবং ধর্মের ওপর উৎপীড়নের প্রতিবাদ করি। আমি মনে করি, মানুষকে তার আচরিত ধর্মের বদলে অন্য কোনো ধর্ম না দিয়ে তার ধর্ম ছিনিয়ে নেওয়াটা ঠিক না। একজন বলশেভিকের কাছে ঈশ্বরবিশ্বাস অপ্রয়োজনীয়, কারণ সে যে অন্য একটা ধর্ম পেয়ে গেছে, যার নাম কমিউনিজম।"

বক্তব্য স্পষ্টঃ ধর্মকে টিকিয়ে রাখার পক্ষপাতী তিনি নন, কিন্তু জোর করে সে-কাজ করতে গেলে ধর্মের হাতই আরও শক্ত হবে। সোভিয়েত ইউনিয়নের বেদনাদায়ক পরিণাম কি পাভলভের এই দূরদর্শী ভাবনার বাস্তবসিদ্ধ সত্যতার প্রমাণ নয়?

গোর্কি কিন্তু তাঁর এই মতটা ঠিক ধরতে পেরেছিলেন -
গোর্কিঃ আমি আপনার কথাটা বুঝতে পেরেছি, ইভান পেত্রোভিচ। আপনি নিজে ঈশ্বরবিশ্বাসী নন, কিন্তু আপনি অন্য লোকের ঈশ্বরবিশ্বাসকে শ্রদ্ধা করেন।

পাভলভঃ ঠিক বলেছেন। নিখুঁতভাবে বলেছেন কথাটা। মোক্ষম কথাটা হল ওই শ্রদ্ধা। কিন্তু এই ঈশ্বরবিশ্বাস এমনই একটা জিনিস যাকে আপনি জ্ঞানবুদ্ধির আলোয় বিচার করতে পারেন। শেষ বিচারে ঈশ্বরে বিশ্বাস তো কর্মশীল মস্তিষ্কর মধ্য থেকেই জন্ম নেয়।

অন্যের ধর্মবিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই তার বিশ্বাসকে ‘জ্ঞানবুদ্ধির’, অর্থাৎ যুক্তিতর্কের আলোকে বিচার করতে হবে। তবেই ক্রমে ক্রমে ধর্মবিশ্বাসের অযৌক্তিকতা প্রতিপন্ন করা যাবে। যাজক-পুত্র, যাজক-বিদ্যালয়ের ছাত্র কিশোর পাভলভের ক্ষেত্রে তাই ঘটেছিল। কিন্তু ব্যাপক জনমানসে পাইকারি হারে তো সেটা চট করে হবার নয়; তার জন্য সময় চাই, ধৈর্য চাই। সোভিয়েত আমলে ঝড়ের গতিতে ধর্মকে নিশ্চিহ্ণ করে ফেলার প্রয়াস যে ব্যর্থ, এমনকী বিপরীত ফলপ্রসূ হয়েছিল তার প্রমাণ, রাষ্ট্র যখন নিজেকে ধর্মবিযুক্ত বলে ঘোষণা করছে, জনগণের বিপুল অংশ তখন নিজেদের ধর্মভীরু বলে মনে করছে। আদমশুমারিতে যার প্রমাণ থাকছে। অর্থাৎ ধর্মবিশ্বাসের বাপারে রাষ্ট্র জনগণের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। জোর করে ধর্মপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে গিয়ে অবধারিতভাবেই জনগণের একটা বড়ো অংশের মনে বিরূপতার সৃষ্টি হয়েছিল। পাভলভ এটা মেনে নিতে পারেননি। তিনি প্রতিবাদ করেছিলেন। বিজ্ঞানী হিসেবে সোভিয়েত রাষ্ট্র তাঁকে মহত্তম সম্মান দিয়েছিল; কিন্তু এই জায়গায় তাঁর কথা মেনে নিতে পারেনি। নিলে হয়তো ভালোই হত।