আরেক রকম ● দশম বর্ষ পঞ্চদশ সংখ্যা ● ১-১৫ আগস্ট, ২০২২ ● ১৬-৩১ শ্রাবণ, ১৪২৯

প্রবন্ধ

পঞ্চ ম'কার না হলে মা কালির পুজো!

অর্ধেন্দু সেন


বিনা মেঘে বজ্রপাত! দেখি দুই ম'কারে যুদ্ধ বেঁধেছে। মহুয়া বলেছেন মা কালির পুজোয় মদ মাংস দুটোই দেওয়া হয়। মমতা বলেছেন মহুয়ার কথা একান্ত তাঁর নিজের। ওটা দলের কথা নয়। আমরা পড়েছি সমস্যায়। কোন দিদিকে সাপোর্ট করি?

এক সময়ে নাস্তিকরা ছিল এক পৃথক বর্ণ। শূদ্র নয় তবে তারই মতো। সামান্য। চলচ্চিত্র পরিচালক মনিমেখলা সেই রকমের একজন সামান্যা মহিলা। জন্ম তামিলনাডু। বাসস্থান কানাডা। ঘটনাচক্রে তিনিই এই উপাখ্যানের তৃতীয় ম'কার। তাঁর চলচ্চিত্র 'কালী' রিলিজ হবার কথা ছিল টোরন্টো শহরের আগা খান মিউজিয়ামে। সেই চলচ্চিত্রের এক পোস্টার নিয়েই বিপত্তি। পোস্টারে মা কালিকে দেখা যাচ্ছে সিগারেট খেতে। বলা বাহুল্য ছবিটা সম্পূর্ণ অ-পৌরাণিক। স্বাভাবিক ভাবেই বর্ণ হিন্দুর ধর্মীয় ভাবাবেগ আহত। এফআইআর ইত্যাদি রাষ্ট্রের যা করণীয় রাষ্ট্র তা করেছে। রাষ্ট্রের উপর আস্থা রেখে সেখানেই ইতি টানা যেত ব্যাপারটায়। কিন্তু মহুয়া তা করেননি।

সাংবাদিকরা পোস্টার সম্বন্ধে ওনার মত জানতে চায়। উত্তরে মহুয়া সেই বিতর্কিত মন্তব্য করেন। কি তাৎপর্য এই মন্তব্যের? কেউ যদি কোনও মাকে এসে বলে তোমার মেয়েকে সিগারেট খেতে দেখলাম মা নিশ্চয়ই বলবে না তাতে কি হয়েছে? ও তো মদও খায়! না। সেই অর্থে বলা হয়নি কথাটা। মহুয়া বলতে চেয়েছেন যার অসীম কৃপায় যার পরশে মদ মাংস পবিত্র হয় তাঁর স্পর্শে সিগারেটও পবিত্র। অবশ্যই মহুয়ার নামেও এফআইআর হয়েছে। এফআইআর হলে সাব-ইন্সপেক্টর দেখবে। তাইতো আমরা জানি। পিএম তো দেখবেন না। আমরা কিন্তু দেখলাম একটু দেরিতে হলেও পিএম মোদী নামলেন মাঠে। যোগ দিলেন বিতর্কে। গল্পের চতুর্থ ম'কার।

যোগ না দিয়ে উপায় ছিল না। কোনটা পবিত্র কোনটা অপবিত্র এ হল যেকোনো ধর্মের গোড়ার কথা। ভিত্তিস্তরের কথা। হিন্দু ধর্মে এটা ঠিক করার অধিকার ব্রাহ্মণের। নিজে ব্রাহ্মণ না হলেও অন্তত কট্টর ব্রাহ্মণ্যবাদী হতে হবে। কোনও সামান্যা নারীকে এই অধিকার দেওয়া যায় না। তাই পিএম মহুয়ার বিরোধিতা করলেন। তিনি কিন্তু বললেন না যে মদ মাংস ভোগে দিলে দেবীর অপমান হয়। ওসব কথা বলানো হয় নূপুর শর্মাদের দিয়ে। পিএম মোদী শুধু বললেন রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দের কথা। বললেন তিনি যখনই বেলুড় মঠে ধ্যানে বসেন তিনি সেই দৈবশক্তি অনুভব করেন যা ভারতকে এবং বিশ্বকে মুক্তির পথ দেখায়।

একথা কেন বললেন পিএম মোদী? তিনি জানেন যে, বাংলায় মা কালির পুজো অনেক বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গেছে। মাঝে এর নিয়ন্ত্রণ ছিল কাপালিকদের হাতে। যারা রাতের অন্ধকারে শ্মশানে লুকিয়ে পুজো করতেন মায়ের। যারা খুলিতে মদ খেতেন। ধর্ষণের অভিযোগও ছিল তাদের বিরুদ্ধে। বৃটিশ প্রভাবিত উনবিংশ-বিংশ শতাব্দীর বাঙ্গালি এই মাম্বো জাম্বোর পূজারি ছিলেন না। অনেকের মধ্যে যে দু'জন কালীপূজোকে এই বামাচারের হাত থেকে বাঁচান তাঁরা হলেন শ্রীরামকৃষ্ণ-স্বামী বিবেকানন্দ। তাই মা কালির পুজোয় মদ মাংসের সমালোচনা না করে উপযুক্ত সময়ে বিবেকানন্দের আরাধনা করলেও কাজ হয়।

কিন্তু এতো সাধারণ কথায় মমতা বিচলিত হবেন? ভাবাই যায় না। এইতো সেদিন বাংলার নিজের মেয়ে হয়ে তিনি নির্বাচনে মোদীকে পরাজিত করেছেন। প্রতিটি নির্বাচনী বক্তৃতায় চণ্ডীপাঠ করেছেন। বাপীকে আরেকবার বাড়ি পাঠাবার এই সুযোগ তিনি ছেড়ে দিলেন? এর ব্যাখ্যায় অনেকেই বলেছেন বিধানসভা নির্বাচন রয়েছে পিছনে। সামনে লোকসভা নির্বাচন। চব্বিশ সালে জিততে হলে যে ব্রাহ্মণ মাছ মাংস খায় না তার ভোটও দরকার। বেশি করে দরকার। তাই মদ মাংস নিয়ে বিশেষ হই চই তিনি চাননি। তার মানে এই নয় যে বখাটেদের ডিম্ভাত বন্ধ - এবার থেকে সুক্তো আর ঘ্যাঁট।

এছাড়া অন্য কারণও ছিল। এখানেই গল্পে প্রবেশ আমাদের পঞ্চম ম'কারের। মাঝি। নির্মল মাঝি। নির্মলদা কিছুদিন আগে গুণে প্রমাণ করেছেন যে মা সারদাই জন্ম নিয়েছেন মমতা হয়ে। মঠের তরফে যে কড়া ভাষায় এর বিরোধিতা করা হয় তার নজির নেই। মঠ শ্রীশ্রীমাকে কতোটা শ্রদ্ধার চোখে দেখে এবং একই সঙ্গে মমতাকে কতোটা অশ্রদ্ধা করে তাই পরিষ্কার হয় তাঁদের বিবৃতিতে। ওটা দলের কথা নয় এটুকু বলারও সুযোগ ছিল না। মহুয়ার কথায় মঠ আবার অসন্তুষ্ট হবে না তো? মাসখানেকের মধ্যে দ্বিতীয়বার তীব্র নিন্দার মুখে পড়তে চাননি মমতা। ভীরুতা না বিচক্ষণতা? মহুয়া বলতে পারবেন।

তন্ত্র মানে কি? তত্ত্ব প্লাস মন্ত্র। তত্ত্ব আসবে দর্শন থেকে। যেমন সাংখ্য দর্শন। মন্ত্র আসবে বেদ পুরাণ থেকে। কিন্তু বেদ যখন চলে গেল ব্রাহ্মণের হাতে ব্রাহ্মণ বিরোধীরা নিজেদের জারি করলেন প্রকৃত তান্ত্রিক হিসেবে। যেমন কংগ্রেস (আর) এবং ইন্দিরা কংগ্রেস। দুই দলেরই বক্তব্য ছিল তারাই প্রকৃত কংগ্রেস। বৌদ্ধদের আর ব্রাহ্মণদের তাড়া খেয়ে তান্ত্রিকরা আশ্রয় নিলেন শ্মশানে। সেখানে তাঁরা শবের উপর বসে তন্ত্র সাধনা করতেন। ছোটবেলায় শুনেছি তান্ত্রিক আর কাপালিকরা বাচ্চাদের ধরে নিয়ে যায় বলি দেবার জন্য। নিয়ম ছিল সন্ধ্যাবেলায় কারও ডাকে সাড়া দেবার আগে একটু সাবধান হতে হবে।

বিবেকানন্দ বলতেন শঙ্কর তাঁর অদ্বৈতবাদ ছড়িয়ে দিয়েছেন বনে জঙ্গলে পাহাড়ে। আমি চাই তাকে গৃহস্থের বাড়িতে নিয়ে আসতে। সঙ্গত কারণেই তিনি বামাচারের বিরোধিতা করেছেন। শ্মশানে লুকিয়ে পুজো নয়। পুজো এমন হবে যা সাংসারিক হয়েও করা যায়। বিবেকানন্দ জানতেন বাঙ্গালির ঘরের পুজোতেও তন্ত্রের প্রভাব থেকেই যাবে। তিনি তা মেনে নিয়েছিলেন কারণ তাঁর মতে তন্ত্র ছিল প্রথম ধাপ। বেদান্ত আসবে দ্বিতীয় ধাপে। মঠের সন্ন্যাসীদের বলতেন যদি দেখিস কেউ তন্ত্র সাধনা করছে তাকে বার করে দিবি। ঠিকই তো। যে সন্ন্যাস নিয়েছে তার তন্ত্রের কি দরকার?

স্বামীজি কি সত্যিই কালীপূজোয় মদ মাংসের বিরুদ্ধে ছিলেন? বাংলায় তান্ত্রিকরা দশ মহাবিদ্যার পুজো করছেন অনাদি কাল থেকে। ব্যাপক কালীপূজো শুরু হয়েছে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সময়ে। তাও আজ তিনশ' বছর হতে চলল। মা কালির পুজো হয় মদ মাংস মৎস্য মুদ্রা মিথুন দিয়ে। সে কথা পুঁথিবদ্ধ হয়েছে অন্তত দেড়শ' বছর আগে। কিছুদিন আগেও পুজোর সঙ্গে বলি দেওয়া আবশ্যিক ছিল। স্বামীজি কোনোদিন এই প্রথার বিরুদ্ধে কিছু বলেননি। বরং ভারতবর্ষে হিন্দুধর্ম চিরকাল থাকবে তা বোঝাতে স্বামীজি বলেছিলেন "ঐ বুড়ো শিব ডমরু বাজাবেন মা কালি পাঁঠা খাবেন আর কৃষ্ণ বাঁশি বাজাবেন এ দেশে চিরকাল। যদি পছন্দ না হয় সরে পড় না কেন?" এ প্রশ্ন আজ মোদীকেও করা যায়। মমতাকেও।

বিবেকানন্দের মতো গভীর জ্ঞানী এবং উদারমনস্ক মানুষের নাগাল পাওয়া শক্ত। তিনি বলেই পেরেছিলেন অদ্বৈতবাদের সঙ্গে কালিভক্তি মিলিয়ে নিতে। ভগিনী নিবেদিতা তাঁকে প্রশ্ন করেন মা কি শিবেরই আরেক রূপ? তিনি বলেছিলেন নিজের মতো করে ভেবে নাও। তিনি কি মায়ের পুজোর ফরমুলা বেঁধে দেবার লোক? আর শ্রীরামকৃষ্ণ তো পরিষ্কার বলেছেন, "যতো মত ততো পথ"। মমতার শাস্ত্রজ্ঞান যদি একটু গভীর হতো তিনি অহেতুক ভয় পেতেন না।

সরি মনিমেখলা। বর্ণ হিন্দুদের ঝগড়া মেটাতে গিয়ে আপনার কথা ভুলেই গেছিলাম। আগেই বলেছি এফআইআর হয়েছে। ছবির প্রদর্শনও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এবার কর্তব্য খোঁজ খবর নেওয়া। কি বিষয়ে ছবি? কেন এই পোস্টার? মুস্কিল হল আপনার ছবি কেউ দেখেনি। এক শুদ্ধব্রতবাবু লিখেছেন তাঁর সুযোগ হয়েছে ছবিটি দেখার। তাঁর লেখা থেকেই উদ্ধৃতি দিচ্ছি। প্রথমেই শুনলাম পোস্টারের ছবিটা মা কালির নয়। এক মহিলার যিনি অভিনেত্রী। মা কালির চরিত্রে অভিনয় করেন। দিনের শেষে তিনি টোরন্টোর রাস্তা ধরে হাঁটছেন। পোশাক দেখে মনে হবে সাক্ষাত মা কালি। তবে হাতে একটা ফ্ল্যাগ আছে। যারা চিনবেন বুঝবেন ইনি দেবী নন। মানবী।

এলজিবিটি-দের অধিকার নিয়ে যারা লড়াই করে তাদের একজন। মা কালি বহুদিন হল শাসক-বিরোধী ক্যাম্পের দেবী। এলজিবিটি-রাও তাঁর উপরেই আস্থা রাখেন। মনিমেখলা বলেছেন আমার কালি পিতৃতন্ত্রের বিরোধী হিন্দুত্বের বিরোধী ধনতন্ত্রের বিরোধী। দারোগাবাবুর জন্য এই যথেষ্ট।

একটা পার্কে তাঁর দেখা হয় এক সব-হারা কৃষ্ণ-কায় রাপারের সঙ্গে। তার বাড়ি ঘর নেই। সে পার্কেই থাকে। মহিলার সঙ্গে তার আলাপ জমে। সে মা কালির সাজে সজ্জিতা সেই মহিলাকে একটা সিগারেট খেতে দেয়। পুলিশের তদন্ত এগোলে হয়তো দেখা যাবে সেই আধ-পোড়া সিগারেটও তার নিজের নয়। কুড়িয়ে পাওয়া। মহিলা সেই সিগারেট গ্রহণ করে। অনেকটা সেই ভিক্ষুর মতো যাকে এক মহিলা ঝোপের আড়াল থেকে তার পরনের কাপড়টা দান করেছিল। মহিলা সিগারেটে এক সুখটান দেন। সেই ছবিটা মনিমেখলা তাঁর পোস্টারে ধরেন দুই সব-হারার কয়েক মুহূর্তের আত্মিক সম্পর্ক উদযাপনের জন্য। এতোশত তো আমাদের জানা ছিল না। আমরা ভাবলাম মা কালির অপমান করা হচ্ছে।