আরেক রকম ● দশম বর্ষ পঞ্চদশ সংখ্যা ● ১-১৫ আগস্ট, ২০২২ ● ১৬-৩১ শ্রাবণ, ১৪২৯

প্রবন্ধ

নিয়োগ দুর্নীতির পরিণতি কী?

পার্থপ্রতিম বিশ্বাস


কোনো সন্দেহ নেই যে সাম্প্রতিক কালে এ রাজ্য তো বটেই গোটা দেশজুড়েই দুর্নীতি একটা প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা পেয়েছে। আর প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা প্রাপ্তির সাথে সাথেই সমাজে তার প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি আদায়ের কৌশলী পথ উন্মোচিত হচ্ছে। ইংরাজিতে ঘুষের প্রতিশব্দ হিসাবে এখন ‘স্পিড মানি’ শব্দের প্রকাশ ঘটেছে। ভাবটা এমন যেন ঘুষের টাকা আসলে এক পরিষেবা কর। ফলে এমন ঘুষের বিনিময় মূল্যে বাড়ি-গাড়ি, জয়-পরাজয়, পুরস্কার-তিরস্কার, সবই ঘটানো যাচ্ছে। এ রাজ্যে ঘুষের চেয়েও অধিক প্রচলিত শব্দ 'কাটমানি'। জন্ম থেকে মৃত্যুর শংসাপত্র থেকে শুরু সরকারি অনুদান থেকে পরিষেবা, পিএসসি থেকে এসএসসি, স্কুল থেকে কলেজের চাকরি সবেতেই এখন অবাধ বিচরণ ঘটেছে কাটমানির। এমন কাটমানি এখন রাজ্যের শাসক দলের প্রাণবায়ু হয়ে উঠেছে। ফলে কাটমানির ভাগাভাগির অনুপাত স্থির হয়ে গেছে কেন্দ্র -রাজ্য রাজস্ব ভাগের মতো। প্রয়োজনে কাটমানির প্রভাব সীমানা ছাড়ালে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী টোল ফ্রি নাম্বার খুলে দেন অভিযোগের নিষ্পত্তির লক্ষ্যে। আর এ সবের পাশাপাশি একটা করে ভোটে জিতে গেলে তো আর কথা নেই। সেথায় তখন সব খুন মাফ! আর তখন এটাই প্রমানের চেষ্টা চলে ছলে-বলে-কৌশলে মানুষের রায়ে ভোট জিতে এলেই যেন তার বিরুদ্ধে ওঠা যাবতীয় অভিযোগ মিথ্যা প্রমানিত হয়। আর এমন একটা ভাষ্য মানুষকে গেলানোর চেষ্টা চলে, ঘণ্টা-মিনিট-সেকেন্ড ধরে দেশের শাসককুলের পক্ষ থেকে শাসকের দুর্নীতি আড়াল করতে। তাই এক্ষেত্রে বোঝা প্রয়োজন হয়ে ওঠে যে দ্রৌপদী মুর্মু দেশের রাষ্ট্রপতির চেয়ারে বসলেও দেশের গেরুয়া শাসকদল হাথরাসের দলিত বাল্মিকি কন্যার দায় এড়াতে পারে না। একইভাবে বাঙালি নোবেলজয়ী অভিজিত বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়কে বঙ্গবিভূষণে ভূষিত করলেও রাজ্যের সরকার নিয়োগ দুর্নীতির দায় এড়াতে পারে না।

এরাজ্যের শাসকের লাগামছাড়া নিয়োগ দুর্নীতি ইতিমধ্যেই মানুষের মনে ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছে কিন্তু সেই প্রভাব ইভিএমের বাক্স অবধি পৌঁছাবে কিনা সেটা আরেক মনোজ্ঞ আলোচনার বিষয়। টেলিভিশনের পর্দায় রাজ্যের প্রভাবশালী মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর শহর জুড়ে ছড়িয়ে থাকা ফ্ল্যাটের মধ্যে থেকে টাকার পাহাড় আবিষ্কার রাজ্যের মানুষকে হতভম্ব করে দিয়েছে। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডির তদন্তে ধরা পড়েছে তাল তাল সোনা, গহনা, গণ্ডা গণ্ডা জমি বাড়ির দলিল। মন্ত্রীমশায়ের বাড়িতে তদন্তে মিলেছে বান্ধবীর সম্পত্তির নথি আর বান্ধবী কিংবা এজেন্টের বাড়িতে মিলছে নিয়োগ দুর্নীতির নথি। ইতিমধ্যে নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে গ্রেফতার মডেল স্বীকার করেছেন ঐ বিপুল অঙ্কের মালিক রাজ্যের সেই প্রভাবশালী মন্ত্রী যিনি তাঁর ফ্ল্যাটে ঐ বিপুল বেআইনি অর্থ গচ্ছিত রেখেছিলেন। এমন তথ্য সামনে আসা মাত্র রাজ্যের শাসক দল অবস্থা বেগতিক বুঝে প্রবল জনমতের চাপে সেই মন্ত্রীকে মন্ত্রীসভা থেকে অপসারিত করতে বাধ্য হয়েছে। আর এমন পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে প্ৰমাণের চেষ্টা চলছে দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা মন্ত্রী হলেও ছাড় পাবেন না। কিন্তু যে প্রশ্নের উত্তর এখন সরকারকে দিতেই হবে তা হলো - বিগত সাত আট বছর ধরে ঘটা রাজ্যের শিক্ষায় নিয়োগ দুর্নীতি কি কোনো একজন মন্ত্রী একাই ঘটিয়েছিলেন? নাকি তাতে দলগত সম্মতি ছিল কোনো না কোনো স্তরে? এরাজ্যে মানুষ শুনে অভ্যস্ত যে মন্ত্রীসভায় একটি মাত্র পোস্ট বাকিরা সব ল্যাম্প পোস্ট। ফলে রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধানের অগোচরে যদি এমন ঘটনা ঘটে থাকে তাহলে তার দায় কিন্তু সামগ্রিকভাবে এবং কোনোভাবেই মন্ত্রীসভা এড়াতে পারে না। ইতিমধ্যে সরকারি ভাষ্যে প্রকাশিত যে, গড়পড়তা একশো জনের নিয়োগে দুই একজন ছাড়া বাকিটা নিয়মের পথেই নিয়োগ ঘটেছে। কিন্তু বাস্তব সত্য ভিন্ন, বরং মুষ্টিমেয় নিয়োগ নিয়ম মেনে হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অভিযোগ এসেছে ভুরি ভুরি। আর সেই অভিযোগ এসেছে সরকারের কোনো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের থেকে নয়, সেই অভিযোগ এসেছে নিয়োগ প্রার্থীদের থেকেই। আর এমন অভিযোগের বিহিত চাইতে হাজার হাজার প্রার্থীদের বছরের পর বছর কেটে গেছে কখনও ফুটপাথে, কখনও রাজপথে, আন্দোলনে মিছিলে, মিটিঙে। দাবি ছিল তাঁদের একটাই - মেধার ভিত্তিতে চাকরি। অথচ এমন দাবি নিয়ে নিজেদের অধিকার রক্ষায় পেটের দায়ে তাঁরা সোচ্চার হলে তাঁদের জুটেছে পুলিসের অত্যাচার, প্রশাসনের উপেক্ষা আর ঔদ্ধত্যের শাসানি। তাই সব শেষে যখন তাঁরা আদালতে অভিযোগ জানানোর রাস্তায় গিয়েছে তখন কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেরোতে শুরু করেছে। আদালত স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে চাকুরি প্রার্থীদের অভিযোগের মান্যতা রয়েছে, নিয়োগে ঘটেছে বিধিভঙ্গ, হয়েছে বেআইনি পথে বহু নিয়োগ, রয়েছে সেই নিয়োগের ক্ষেত্রে অর্থের বিনিময়। এমন হাজারের ওপর বেআইনি নিয়োগ আদালত নিজে বাতিল ঘোষণা করেছে যার মধ্যে হয়েছে রাজ্যের বর্তমান শিক্ষার প্রতিমন্ত্রীর কন্যাও। আদালত নিজে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এমন কিছু নিয়োগ দুর্নীতির তদন্ত করিয়েছিল এক প্রাক্তন বিচারপতির নেতৃত্বে বিশেষ কমিটি গড়ে, যেখানেও প্রমাণিত হয়েছে নিয়োগ দুর্নীতির ভয়াবহতা। সরকারি ব্যাবস্থাকে ঢাল বানিয়ে মন্ত্রীমশাইয়ের নির্দেশে, বেআইনি কমিটি বানিয়ে, ভুয়ো সুপারিশ পত্র তৈরি করে ঢালাও নিয়োগ হয়েছে রাতের অন্ধকারে যাবতীয় স্বচ্ছতাকে জলাঞ্জলি দিয়ে। এই প্রেক্ষিতে আদালত রায় দিয়েছে এই বিপুল নিয়োগের পেছনে ঘটা বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের স্বরূপ উন্মোচনের লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার তদন্তে। ফলে সরকারের দাবি মতো কাজ করতে যাওয়ার লক্ষ্যে কিছু মামুলি ত্রুটি নয় বরং আদালতে জমা হওয়া ঝুড়ি ঝুড়ি অভিযোগের পিছনে ইচ্ছাকৃত সংগঠিত অপরাধের ছায়া দেখা যাচ্ছে বলেই মত ব্যক্ত করেছে আদালত। সেই নিরিখে ইডি-র তদন্তে শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির ক্ষেত্রে রাজ্যের প্রভাবশালী মন্ত্রীর যোগাযোগের প্রাথমিক সত্যতার প্রমাণ মিলেছে।

রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর তৃণমূল সরকার বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার আইন বদলে বলেছিল যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার শীর্ষে থাকা মানুষেরা কোনভাবেই রাজনীতির বৃত্তের মধ্যের মানুষ হবেন না। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেলো শাসক দলের বিধায়ক থেকে শুরু করে নেতা কর্মীদের বড় অংশ রাজ্যের স্কুল সার্ভিস কমিশন, কলেজ সার্ভিস কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, মধ্যশিক্ষা পর্ষদ, প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের মাথায় স্থান পেলেন। আর ঘুরপথে নয় একেবারে সরাসরি এভাবেই শাসকের নিয়ন্ত্রণের রাজনীতি নিয়োগ প্রক্রিয়াকে গ্রাস করতে লাগল। অবস্থা এতোটাই শোচনীয় হয়ে উঠেছিল যে পরীক্ষায় সাদা খাতা জমা দিয়ে, ইন্টারভিউ না দিয়ে, পরীক্ষায় পাশ না করে, বেছে বেছে প্রার্থীদের গ্রেস নম্বর দিয়ে, মেয়াদ উত্তীর্ণ প্যানেল থেকে, মেধা তালিকা পরিবর্তন করে স্বেচ্ছাচারী ঢঙে স্কুলে চাকরি দেওয়ার রেওয়াজ চালু হয়ে গিয়েছিল কলকাতা থেকে কোচবিহার পর্যন্ত। আর এমন বেআইনি নিয়োগের পেছনে অর্থের জোগান নিশ্চিত করতে শাসক দলের উদ্যোগেই বিকেন্দ্রীভূত টাকা তোলার ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল একেবারে সিন্ডিকেটের কায়দায়। নির্মাণ ক্ষেত্রের ইট-বালি-চুন-সিমেন্টের সিন্ডিকেটের মতো জেলায় জেলায় অঞ্চলে অঞ্চলে নিয়োগ দুর্নীতির ক্ষেত্রেও এমন সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে।

এই নিয়োগ দুর্নীতি প্রকাশ্যে আসার অনেক আগেই রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী এবং সিবিআই-এর প্রাক্তন কর্তা উপেন বিশ্বাস হেঁয়ালির ছলেই ‘সৎ রঞ্জনের’ কাহিনী সংবাদমাধ্যমের সামনে তুলে এনেছিলেন। চিট ফান্ড দুর্নীতির সময় যেভাবে জেলা থেকে শহরে টাকা ঢোকার ব্যাবস্থা তৈরি হয়েছিল ঠিক তেমনটাই নাকি বর্তমান শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির ক্ষেত্রে ঘটেছে বলে প্রকাশ্যে তিনি অভিযোগ করেছিলেন। কিন্তু সরকার তখনও সে কথা কানে তোলেনি। আর এমন অভিযোগের পর শহরের মন্ত্রীসান্ত্রীদের ঘনিষ্ঠদের ফ্ল্যাটবাড়ি থেকে যখন সরকারি খামে মোড়া কোটি কোটি টাকা, পরীক্ষার আডমিট কার্ড, মার্কসিট উদ্ধার হয় তখন আমজনতার মনে প্রভাবশালী যোগের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় বৈকি! এমন নিয়োগ দুর্নীতিতে প্রথম ‘হুইসল ব্লোয়ারের‘ কাজ করেছিল রাজপথে আন্দোলনকারী পড়ুয়া চাকরি প্রার্থীরাই। ফলে সেই সময় সরকার সজাগ হয়ে ব্যবস্থা নিলে আজ এই দুয়ারে ইডি-র দৌড়ঝাঁপ দেখতে হতো না রাজ্যবাসীকে। স্বাধীনতার পঁচাত্তরতম বর্ষপূর্তির দিকে এগোচ্ছে দেশ তথা রাজ্যের মানুষ। আর স্বাধীনতার পর রাজ্যবাসী এই প্রথম দেখল একই দিনে রাজ্যের শিক্ষার সাথে যুক্ত মন্ত্রী, আমলা, স্বশাসিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার কর্তা, সচিব, পরামর্শদাতা এমন এক ডজন মানুষের বাড়িতে নিয়োগ দুর্নীতি তদন্তে ইডি-র হানা। ভিন রাজ্যের 'ব্যাপম' দুর্নীতির তদন্ত অভিযান ও তার সাথে বহু মানুষের ধারাবাহিক রহস্য মৃত্যু দেখে তাক লেগেছিল সেই রাজ্যের মানুষের। কিন্তু এবার এই রাজ্যেও শিক্ষা কর্তাদের দুয়ারে সিবিআই কিংবা ইডি দেখে চোখ কপালে উঠেছে মানুষের।

ইতিমধ্যে রাজ্যের শাসক দল দ্রুত এই দুর্নীতির তদন্ত শেষ করার দাবি জানিয়েছে তদন্তকারী সংস্থার কাছে। এবিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকা উচিত নয় যে, এই বিরাট দুর্নীতির তদন্তের পরিসমাপ্তি দ্রুত প্রয়োজন চাকরি প্রার্থীদের ন্যায় বিচারের স্বার্থে এবং দোষীদের সাজার লক্ষ্যে। কিন্তু দ্রুত তদন্তের এবং নিষ্পত্তির কথা রাজ্যের শাসকের চোখে কুম্ভীরাশ্রু বলেই মনে হচ্ছে। কারণ রাজ্যে ইতিপূর্বে চিট ফান্ড কেলেঙ্কারিতে সর্বস্ব হারিয়েছিল রাজ্যের লাখ লাখ মানুষ, আর সেই কেলেঙ্কারিতে মুল অভিযুক্ত ছিল তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীরা। অথচ কার্যক্ষেত্রে দেখা গিয়েছিল সেই তদন্ত আটকাতে রাজ্যের সরকার রাজকোষের এগারো কোটি টাকা খরচ করে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করে হেরে গিয়েছিল। সেই দুর্নীতির তথ্য প্রমাণ লোপাটে যে পুলিশ আধিকারিক অভিযুক্ত ছিলেন তাঁর বিরুদ্ধে সিবিআই আটকাতে সদলবলে রাজ্যের গোটা মন্ত্রীসভা পাহারায় বসেছিল রাজপথে। ফলে এবারের নিয়োগ দুর্নীতিতে তদন্ত দ্রুত শেষ হলে অভিযুক্ত নেতা মন্ত্রী সহ সরকারের বিপদ বাড়বে বই কমবে না! এই প্রেক্ষিতে তাঁদের কণ্ঠে দ্রুত তদন্তের নিস্পত্তির আওয়াজ মোটেই মনের কথা নয় বরং সেটা কেবল কথার কথা তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

শিক্ষকের পদে অযোগ্য প্রার্থীদের প্রবেশ শিক্ষাঙ্গনের আঙিনায় কিংবা শিক্ষা পরিচালনায় কেবল আশু বিপদ নয় বরং সেই বিপদের জের দীর্ঘস্থায়ী। এমন নিয়োগ দুর্নীতিতে কেবল বহু অযোগ্য মানুষ যোগ্যদের স্থানচ্যুত করে এমনটাই নয়। পাশাপাশি সেই অযোগ্য, অর্ধযোগ্যদের দল আগামী কয়েক প্রজন্মের পড়ুয়াদের শিক্ষার মানের অধোগতির কারণ হয়ে ওঠে। সরকারি নীতি পঙ্গুত্বের কারণে স্কুলে কলেজে এমনিতেই নিয়োগের করুণ হাল। সরকারের ভ্রান্ত বদলি নীতির কারণে গ্রামে, জেলার স্কুলে শিক্ষকের ঘাটতি ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। আর এসবের সাথে যদি দুর্নীতির ঘুরপথে ভেজাল শিক্ষক নিয়োগ ঘটতে থাকে সে হবে ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা‘। রাজ্যের প্রভাবশালী নেতা মন্ত্রীদের এমন দুর্নীতি যোগ সামনে আসার পর সাম্প্রতিককালে স্কুলে নিয়োগ দুর্নীতির কথা লোকের মুখে মুখে ঘুরছে। ফলে সরকারি স্কুলে এমন নিয়োগ দুর্নীতিতে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা প্রবল। কারণ ক্লাসে ক্লাসে ছাত্র এবং শিক্ষকের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয় পারস্পরিক আস্থার ওপর, বিশ্বাসের ওপর, শ্রদ্ধার ওপর। আর দুর্নীতির জাঁতাকলে পড়ে ছাত্র শিক্ষক সম্পর্কে পড়ুয়াদের এই প্রাথমিক আস্থা, বিশ্বাস কিংবা শ্রদ্ধার জায়গাটা ভেঙে গেলে সেটা জোড়া দেওয়া বড় কঠিন। ফলে সেই কঠিন পরিস্থিতিতে শেষমেশ আক্রান্ত হয় স্কুলের কিংবা ক্লাস ঘরের শিক্ষার পরিবেশ। যে পরিবেশ এক দিনে, কিংবা একটা সরকারের মেয়াদে তৈরি করা যায় না, যার জন্য প্রয়োজন হয় এক যত্নের সামাজিক এবং সরকারি প্রয়াস। আর এই প্রেক্ষিতেই বুঝতে হবে সরকারের অপদার্থতায় সরকারি স্কুলে অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগের ফলে সেই স্কুলের মানের অবনমন ঘটলে একসময় পড়ুয়ার অভাবে বন্ধ হয়ে যাবে সিংহভাগ সরকারি স্কুল। কারণ জেনে বুঝে আপন সন্তানকে এমন স্কুলে কোন মা বাবা পাঠাবেন না যেখানে গেলে মিড ডে মিল জুটলেও উন্নত শিক্ষা জুটবে না। ফলে সমাজের যে বিপুল নিম্নবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্ত পরিবারের পড়ুয়ারা আজ সরকারি স্কুলের ভরসাতে লেখাপড়া শেখে, এমন নিয়োগ দুর্নীতিতে তাঁদেরই পড়তে হবে মহা বিপদে। আজ অবধি এরাজ্যের উচ্চ শিক্ষার সাফল্যের অন্যতম বড় কারণ রাজ্যের সরকারি এবং সরকার পোষিত স্কুলগুলিতে উন্নত মানের শিক্ষা। আর শিক্ষার মানের পেছনে শিক্ষকের মান সবচেয়ে জরুরী অথচ সেখানেই যদি আপোষ ঘটে নিয়োগ দুর্নীতির পথ ধরে তখন সরকারি ক্ষেত্রে সত্যি হবে ‘শিরে সংক্রান্তি’। আর সেই সংক্রান্তির পথ ধরেই ঘটবে উন্নত বিকল্প হিসেবে শিক্ষার বেসরকারিকরণ। আর সে পথে ব্রাত্য হয়ে উঠবে প্রান্তিক মানুষদের জীবনে শিক্ষার অধিকার। তাই শিক্ষায় নিয়োগ দুর্নীতির প্রভাব সমাজে ঘটে চলা বহুস্তরিয় দুর্নীতির থেকে অনেকটাই ভিন্ন এবং এটির অভিঘাত সমাজ জীবনে বহুমাত্রিক। এই বিপদ সম্পর্কে সরকারকে সচেতন করার দায়িত্ব আজ বৃহত্তর নাগরিক সমাজেরই।