আরেক রকম ● দশম বর্ষ পঞ্চদশ সংখ্যা ● ১-১৫ আগস্ট, ২০২২ ● ১৬-৩১ শ্রাবণ, ১৪২৯

সমসাময়িক

ম্যাঘ দে, পানি দে


'কতদিন ধরে শুয়ে আছি
পিপাসায় শুকোচ্ছি সকলে
আমাদের কঙ্কালে জল দাও
জল দাও গণ্ডুষ ভরে ভরে।'

- জয় গোস্বামী

ভারতের মোট আয়তনের ২.৭ ভাগ আছে পশ্চিমবঙ্গে। জনসংখ্যার আট ভাগ বাস করে এই ভূখণ্ডে। এখানে ধান উৎপাদন হয় ১৪৬.০৫ লাখ টন। দেশের মধ্যে ধান উৎপাদনে পশ্চিমবঙ্গ প্রথম। প্রতি হেক্টরে ২,৬০০ কিলোগ্রাম ধান হয়। ৫৮.৩০ লাখ হেক্টরে ধান চাষ হয়। ধান চাষে যুক্ত ৭১ লাখ ২৩ হাজার পরিবার। মোট পরিবার রাজ্যে ২ কোটি ৩ লাখ ৮০ হাজার ৩১৫। পাট চাষেও অগ্রণী বাংলা। ৫.৬৫ লাখ হেক্টরে পাট চাষ হয়। দেশের তিন চতুর্থাংশ পাট হয় পশ্চিমবঙ্গে। এই দুটো চাষ এখন বিপন্ন পশ্চিমবঙ্গে। জলের অভাবে। পাট শুকিয়ে যাচ্ছে। রোদে পুড়ে যাচ্ছে। জল নেই। পাট পচিয়ে আঁশ বের করবে কী করে চাষি? কোথাও হেলদোল নেই। বেশ কিছুদিন ধরে উত্তরবঙ্গে তাপপ্রবাহ চলল। এটা নজিরবিহীন। ঘোষিতভাবে এটা বর্ষাকাল। আষাঢ়-শ্রাবণ বর্ষাকাল। শ্রাবণের ১৪ তারিখ ৩১ জুলাই। পাটের আঁশ ছাড়ানো শেষ হয়ে ধান রোপণ করাও শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু না। তা হয়নি।

রাজ্যে কৃষি থেকে আয় ২১ ভাগ। শিল্প থেকে আয় ২২ ভাগ। পরিষেবা ক্ষেত্র থেকে ৫৭ ভাগ।

আয় ২১ ভাগ। কিন্তু যুক্ত এক তৃতীয়াংশ পরিবার। রাজ্যে মোট গ্রাম ৩৭,৯৪৫। এই গ্রামগুলোর ৯৯ ভাগ কোনো না কোনো চাষের সঙ্গে যুক্ত। অথচ এই চাষিদের দুর্দশা নিয়ে কোনো আলোচনা নেই। বন্যায় ডোবে, খরায় পোড়ে, কীটপতঙ্গের আক্রমণে ফসল মরে। চাষি জড়ান ঋণের জালে।

সেচের সুবিধা তেমন নেই। এ বছর ১৭ জুলাই পর্যন্ত, বৃষ্টি ঘাটতি কলকাতায় ৪৯%, দক্ষিণবঙ্গে ৫৯%। মাত্র ৫০ ভাগ কৃষিজমি সেচ সেবিত। এর মধ্যে বিভিন্ন বাঁধ প্রকল্পের জল আছে আর আছে ছোট মাঝারি বড় নলকূপ। ডিজেলের দাম খুব চড়া। ৯৩ টাকা। ডিজেল চালিত নলকূপ খুব ব্যয়বহুল। আর অগভীর বা গভীর নলকূপের বিদ্যুৎ খরচ অবিশ্বাস্য বেশি। বছরে ২৭,০০০ টাকা। বহু চাষি এর ফলে অগভীর নলকূপ ব্যবহার করা বন্ধ করেছেন। এগুলো আলোচনায় বেশি আসছে না। ৩০ জুলাই 'দি টেলিগ্রাফ' একটা খবর করেছে। পূর্ব বর্ধমান জেলা, যেটা দেশের খাদ্য ভাণ্ডার বলে পরিচিত সেখানে মাত্র ২০% জমিতে চাষ হয়েছে। দামোদর ময়ূরাক্ষীর জলাধারে জল কম। জেলায় ২০ হাজার অগভীর নলকূপ আছে। এর মধ্যে ২,৫০০ বন্ধ। ১,৭০০ অগভীর নলকূপ বকেয়া মেটাতে পারেনি, তাই সংযোগ কেটে দিয়েছে বিদ্যুৎ দপ্তর। পূর্ব বর্ধমান জেলা প্রশাসন বিদ্যুৎ দপ্তরের কাছে আবেদন করেছে সংযোগ ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। হবে কিনা কে জানে?

'স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব' পালন করছে দেশ। সেই সময় সমস্ত খাদ্যপণ্যে জিএসটি বসেছে। দেশকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন কৃষকরাই, করোনার পরোয়া না করে।

সরকার বিনিময়ে কী দিয়েছে?

চড়া দামে বিদ্যুৎ, সার, বীজ কিনতে হচ্ছে। ফসলের দাম পাচ্ছেন না চাষি। সহায়ক মূল্য অধরা। আর এবার তো চাষ করতেই পারছেন না। দেশের প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, প্রতি হাতে কাজ, প্রতি ক্ষেতে জল, প্রতি ঘরে বিদ্যুৎ।

মন কি বাত অনেক হল, এসব কথা শোনা গেল না।

রাজ্যের ৩৭,৬৬০ বর্গ কিমি এলাকা এবং ১১১টি ব্লক বন্যাপ্রবণ। সেক্ষেত্রেও কোনো ব্যবস্থা নেই।

খরাপ্রবণ এলাকা ছাড়াও এবার দেশে খরা পরিস্থিতি। কোনো উচ্চবাচ্য নেই। যেন কোথাও কিছু ঘটেনি। 'জল ধরো, জল ভরো' ঘোষণা মাত্র। কাজের কাজ তেমন নেই।

কৃষকরা চাষ করতে না পারলে দেশ বাঁচবে তো?

১৮.৭৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন চাল রপ্তানি করে ভারত, তা করতে পারবে তো?

আব্বাসউদ্দিন কবে গেয়েছিলেন, ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে, আজো সেই গান গাইতে হচ্ছে, আল্লা ম্যাঘ দে, পানি দে - এটা বড় বেদনার।