আরেক রকম ● দশম বর্ষ পঞ্চদশ সংখ্যা ● ১-১৫ আগস্ট, ২০২২ ● ১৬-৩১ শ্রাবণ, ১৪২৯

সমসাময়িক

চোপ! সংসদ চলছে!


সংসদের বর্ষাকালীন অধিবেশনে নজিরবিহীন ঘটনা ঘটে গেল। রাজ্যসভার ২৩ জন এবং লোকসভার ৪ জন সাংসদ, অর্থাৎ মোট ২৭ জন সাংসদকে সাসপেন্ড করা হল। এত বড় সংখ্যক সাংসদকে একসঙ্গে শাস্তি দেওয়ার ঘটনা ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রায় নজিরবিহীন। কিন্তু কেন এমন ঘটনা ঘটল?

সংসদের অধিবেশন শুরু হওয়ার আগেই সরকার এই ইঙ্গিত দিয়েছিল যে তারা সাংসদদের অধিকার ব্যাপকভাবে খর্ব করতে চায়। সাদামাটা শব্দকেও অসংসদীয় শব্দের তালিকায় নিয়ে আসা হয়, সংসদ চত্বরে ধরনা দেওয়া বা প্রতিবাদ মিছিল করাকে বেআইনি ঘোষণা করা হয়। অর্থাৎ বোঝাই যাচ্ছিল যে সরকার-বিরোধী কথা বলার বিশেষ সুযোগ বিরোধীদের দেওয়া হবে না।

অথচ দেশে মূল্যবৃদ্ধি আগের প্রায় সমস্ত রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে, ডলারের দাম টাকার নিরিখে লাগাতার বেড়ে চলেছে, বেকারত্বের পরিস্থিতি ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছিয়েছে, দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা উদ্বেগের জন্ম দিচ্ছে। বিরোধীদের দাবি ছিল এই সমস্ত বিষয় নিয়ে আলাদা সময় নির্ধারন করে আলোচনা হওয়া উচিত। কিন্তু যেহেতু এই প্রশ্নগুলি সংসদে আলোচিত হলে সরকার বিড়ম্বনায় পড়বে, অতএব সরকার সিদ্ধান্ত নেয় যে, বিরোধীদের এই দাবি মানা হবে না। এই পরিস্থিতিতে সংসদ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং তার পরিণতিতে ২৭ জন সাংসদকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়।

নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, সাংসদদের উপর শাস্তিমূলক ব্যবস্থার মেয়াদ শেষ হবে এবং তাঁরা আবার সংসদে দাঁড়িয়ে তাঁদের বক্তব্য বলবেন। কিন্তু যেভাবে মানুষের সমস্যার কথা বলার এবং সেই বিষয়ে সরকারকে জবাবদিহি করার দাবি তোলায় বিরোধী সাংসদদের শাস্তি দেওয়া হল তার থেকেই পরিষ্কার যে মোদী সরকার ভারতের গণতন্ত্রের মৌলিক শর্তগুলিও মানতে রাজি নয়।

বহু বছর ধরে ভারতে রাজনৈতিক পরম্পরায় দুই ধরনের প্রতিবাদ-আন্দোলন দেখা যায়। প্রথমত, বিরোধীরা সংসদে তাদের বক্তব্য তুলে ধরে সরকারকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করে, জবাবদিহি চান। কিন্তু বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই সংসদের গুরুত্ব কমানো হয়েছে, বিজেপি যা অন্য স্তরে নিয়ে গিয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ শ্রম আইন, ৩৭০ ধারা রদ, নাগরিকত্ব আইন ইত্যাদি সংসদে কোনো আলোচনা ছাড়াই পাশ করানো হয়েছে, বিরোধীদের শত আপত্তি-অনুনয়-বিনয়কে উপেক্ষা করে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে একের পর এক আইন পাশ করানো হয়েছে।

এমতাবস্থায় ভারতে প্রতিবাদ-আন্দোলনের পরম্পরায় সংসদ বহির্ভূত বা সংসদ নিরপেক্ষ আন্দোলনের অপরিসীম গুরুত্ব রয়েছে। সংসদে সরকার যদি মানুষের কথা না শোনে তাহলে সংসদের বাইরে মিটিং-মিছিল-ধরনা ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষকে সংঘবদ্ধ করে সরকারকে মাথা নত করতে বাধ্য করার ধারা বহু বছর ধরে ভারতের গণতন্ত্রে বহমান। কিন্তু বিজেপি সরকার একদিকে যেমন সংসদের ভিতরে বিরোধী স্বরকে স্তব্ধ করতে চাইছে, তেমনি সংসদের বাইরেও প্রতিবাদ আন্দোলনের উপর ভয়াবহ নিপীড়ণ নামিয়ে আনা হচ্ছে। ছাত্র-আন্দোলন হোক অথবা নাগরিক আন্দোলন, পরিবেশ আন্দোলন হোক অথবা আদিবাসীদের আন্দোলন, সরকার পক্ষ সমস্ত আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে পুলিশ-প্রশাসনকে ব্যবহার করে তাদের জেলে পুরছে। তদুপরি 'বুলডোজার সংস্কৃতি'র আমদানি ঘটিয়েছে বিজেপি, যেখানে আন্দোলনকারীদের বাড়ি বুলডোজার দিয়ে ভেঙে দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ সার্বিকভাবে গণতান্ত্রিক পথে আওয়াজ তোলার সব পন্থাই রুদ্ধ করে সরকার এবং শাসকদলের একচেটিয়া আধিপত্য বজায় রাখাই বিজেপি-র প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিজেপি বিগত আট বছর ধরে ধনীদের আরো ধনী করা এবং গরীবদের আরো গরীব করার যে নীতি গ্রহণ করেছে তার বিরুদ্ধে যাতে জনমত সংগঠিত না হতে পারে, মানুষ যাতে প্রতিবাদ না করতে পারে তার জন্যই এই নিপীড়ণের প্রয়োজন। একদিকে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম অগ্নিমূল্য। সরকার তা নিয়ে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করে সাধারণ খাদ্যপণ্যের উপরে জিএসটি ধার্য করেছে। কিন্তু সংসদে এই বিষয়ে বলার উপায় নেই। জুন ২০২২ পর্যন্ত, অর্থাৎ ২০২২-২৩ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকে জিএসটি বাবদ রাজস্ব আদায় হয়েছে প্রায় ১,৮০,০০০ কোটি টাকা, যা কর্পোরেট কর অথবা সাধারণ আয়করের থেকে অনেকটাই বেশি। জিএসটি যেহেতু অপ্রত্যক্ষ কর, তার দায় সাধারণ জনগণের উপরে বর্তায়। অন্যদিকে কর্পোরেট কর অথবা আয় কর মূলত ধনীদের উপর বর্তায়। তাই জিএসটি-র পরিমাণ এই দুটি করের থেকে বেশি হওয়া মানে আসলে ধনীদের তুলনায় গরীবদের থেকে বেশি কর আদায় করা হচ্ছে। এই সহজ সত্যটি সরকার ধামাচাপা দিতে চায়। তাই সংসদে বিরোধীদের কথা বলার অধিকার কেড়ে নিচ্ছে সরকার। আপাতত এই সরকারের বিরুদ্ধে সার্বিক গণ-আন্দোলন গড়ে তোলা ব্যতিরেকে অন্য কোনো পথ নেই। প্রশ্ন হল বিরোধীরা কি সেই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য প্রস্তুত?