আরেক রকম ● দশম বর্ষ পঞ্চদশ সংখ্যা ● ১-১৫ আগস্ট, ২০২২ ● ১৬-৩১ শ্রাবণ, ১৪২৯

সম্পাদকীয়

পশ্চিমবঙ্গে দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ


পশ্চিমবঙ্গের অলীক কুনাট্য বিষয়ে আবার সম্পাদকীয় লেখাটা কিছুটা একঘেয়ে, কারণ মাসের পর মাস ও বছরের পর বছর কেন্দ্র ও রাজ্যের দুই জনবিরোধী সরকারের নানাবিধ কর্মকাণ্ডকে বিরোধীতা করে লিখতে লিখতে কলমেরও ক্লান্তি আসারই কথা। পাঠক ভাবতেই পারেন, নতুন কী-ই বলার থাকতে পারে? শিক্ষামন্ত্রীর দুর্নীতি বিষয়ে সংবাদপত্রের পাতায়, টিভির পর্দায়, সোশ্যাল মিডিয়াতে, সর্বত্র এত এত তথ্য ও বিশ্লেষণ আসছে যে নতুন করে কিছু যোগ করার থাকতে পারে কি? তৃণমূল দুর্নীতিগ্রস্ত, বিজেপি দাঙ্গাবাজ, এসব নিয়ে বহু লেখা 'আরেক রকম'-এর পাতায় আগেই হয়ে গেছে। কিন্তু তার পরেও কিছু কথা থেকে যায়, যা এই পরিস্থিতিতে না বললেই নয়।

দেখুন, শুধু তৃণমূলের দুর্নীতি নিয়ে বললে, অথবা চুরি জোচ্চুরি নিয়ে বললে এই সম্পাদকীয়র কোনও মানে থাকে না, কারণ সমস্ত মানুষ জানেন তৃণমূল চোর। যাঁরা বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন তাঁরা তো বটেই, এমনকী যাঁরা তৃণমূলের ভোটার, তাঁদেরও সিংহভাগ জানেন যে তৃণমূল চোর, এবং এই দলের মাথা থেকে পা পর্যন্ত দুর্নীতিতে ডুবে। ক্যামেরার সামনে ঘুষ নিতে দেখে, সারদার ৭০ হাজার কোটি টাকা হাওয়া হয়ে যেতে দেখেও মানুষ ভোট দিয়েছেন এদের, এটা জেনেই যে এরা ক্ষমতায় এসে চুরি করবে। তাই, শুধুমাত্র চুরি করেছে একটা দল, সেটা বললে বোঝানো যাবে না তৃণমূল কোথায় ক্ষতিটা করে দিল। এই ক্ষতিটা আরও ব্যাপক ও গভীর।

ক্ষতিটা এখানেই যে তৃণমূল কংগ্রেস গত দশ বছরে বাংলায় দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করেছে। দুর্নীতি যদি শুধুমাত্র ব্যক্তিগত হত, যে একজন আধিকারিক বা জনপ্রতিনিধি চুরি করেছেন, তাহলে তার প্রভাব ক্ষতিকর হত না। কিন্তু এটা শুধুমাত্র ব্যক্তি পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের একাধিক ফ্ল্যাট, কোটি কোটি টাকা এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের মধ্যে আর আবদ্ধ নেই। এমনকী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুর্নীতির মধ্যেও আটকে নেই আর। এই দুর্নীতি বাড়তে বাড়তে শুধুমাত্র যে সমাজের তৃণমূল স্তর পর্যন্ত চলে গিয়েছে তাই নয়, প্রতিষ্ঠানগুলোকে নষ্ট করে দিচ্ছে, এবং ক্ষতিটা এখানেই। শিক্ষা পরিকাঠামোকে ধ্বংস করে দিচ্ছে এমনভাবে যে এসএসসি-তে উত্তীর্ণ ব্যক্তিরা সুযোগ পাচ্ছেন না, বদলে মোটা টাকার বিনিময়ে চাকরি পেয়ে যাচ্ছেন অকৃতকার্যরা। এমনকী কত টাকা দিলে কোন পদে কী চাকরি, তার তালিকাও যখন প্রকাশ্যে আসছে, ধরে নিতেই হবে যে এই সমান্তরাল সিস্টেম এতই শক্তিশালী যে স্কুল সার্ভিস কমিশন হোক বা মধ্যশিক্ষা পর্ষদ, সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে পর্যন্ত সেগুলি অধিকার করে নিয়েছে। আগে কি দুর্নীতি হত না? অবশ্যই হত, বামফ্রন্ট সরকারের সময়েও একশ শতাংশ সব নিয়ম মেনেই হত এমন দাবি কেউ করবে না, কিন্তু সেটা ছিল নিয়ন্ত্রিত দুর্নীতি, হয়ত দশ শতাংশ ক্ষেত্রে হয়েছে এমন বলা যায়, ফলত সেটা প্রাতিষ্ঠানিক হয়ে ওঠেনি, জন্ম দেয়নি সমান্তরাল কালো টাকার সিস্টেমেরও। তখন মানুষ জানতেন যে ঘুষ দিলে অনেক কিছুই হয়, আর এখন মানুষ জানেন যে ঘুষ না দিলে কিছুই হয় না - তফাতটা এখানেই। আর তাই এখন এটা শুধুমাত্র ব্যক্তির নৈতিক অবক্ষয়ের মধ্যে আবদ্ধ নেই, এর সঙ্গে জড়িয়ে গেছে লাখ লাখ চাকরিপ্রার্থীর ভবিষ্যতের প্রশ্ন। তৃণমূল দুর্নীতি করেছে তাই রাজ্যে শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ, হাজার হাজার স্নাতক ছেলেমেয়ে পরীক্ষা দিয়ে বসে আছে কিন্তু ঘুষ দিয়ে চাকরি হচ্ছে তাই চাকরি পাচ্ছে না। এর বিপদটা দুই দিক থেকে আসছে, এবং সেই দুটি দিকই একটা সামাজিক কাঠামোকে ধ্বংস করবার জন্য সমান সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে।

সরকারি শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ হওয়া মানে শুধুই চাকরির আকাল নয়, সরকারি বা সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলগুলোয় শিক্ষকের অভাবও। এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে-গঞ্জে বহু স্কুলে মিড ডে মিল দেওয়ার জন্যও পর্যাপ্ত লোক নেই, লেখাপড়া তো দূরের কথা। এর ফলে স্কুলছুটের সংখ্যা বেড়েই চলেছে, এবং তার চেয়েও বেশি বাড়ছে বেসরকারি স্কুলে ভর্তি করার তাগিদ। রাজ্যে অবৈতনিক শিক্ষার অধিকার, যা দেশের মধ্যে প্রথম এই রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা নাম-কা-ওয়াস্তে একটা ব্যবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যাঙের ছাতার মত পাড়ায় পাড়ায় গজিয়ে উঠছে বেসরকারি স্কুল যেখানে নিম্নবিত্ত মানুষও বহু কষ্ট করে সন্তানকে পড়াতে বাধ্য হচ্ছেন, কারণ সরকারি স্কুলগুলিতে শিক্ষক নেই। এটা শিক্ষাব্যবস্থাকে, বিশেষত সংবিধান-স্বীকৃত মৌলিক অধিকারের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষার প্রতি মানুষের মনোভাবকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। এবার এই প্রক্রিয়া আরও দ্রুত হবে।

দ্বিতীয় বিপদ হল, বিশ্বাসের অভাব। মানুষ যখন তাঁর সন্তানদের কোনও বিদ্যালয়ে পাঠান, মোটামুটি একটা নিশ্চিন্তি থেকেই পাঠান যে ছেলেমেয়েগুলো যোগ্য হাতে লেখাপড়া শিখবে। পরের পর ঘুষকাণ্ডে শিক্ষকেরা ধরা পড়ার অর্থই হল এই বিশ্বাস ভেঙে যাওয়া, এবং সামগ্রিক সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা থেকে আস্থা উঠে যাওয়া। এর ইঙ্গিত মিলতে শুরু করেছে, গ্রামে গ্রামে বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষকেরা আক্রান্ত হচ্ছেন ছাত্র-ছাত্রী অভিভাবকদের হাতে, প্রহৃত হচ্ছেন, এমনকী শ্লীলতাহানির ঘটনাও ঘটছে। এগুলো কিন্তু বিচ্ছিন্ন কোনও ঘটনা নয়, বরং পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থার ওপর নির্ভর করে যে ব্যবস্থা টিকে থাকে, তাকেই হুড়মুড় করে ভেঙে পড়তে দেখছি আমরা সবাই চোখের সামনে। আর এই দ্বিতীয় বিপদটি, এই সার্বিক অবিশ্বাস, ক্রোধ ও অশ্রদ্ধার বাতাবরণ প্রথম প্রক্রিয়াটিকে ত্বরান্বিত করবে, আরো বেশি করে গজিয়ে উঠবে বেসরকারি স্কুল, কারণ মানুষ চাইবেন না চোরেদের ব্যবস্থায় নিজেদের সন্তানকে রাখতে। এই যে অবক্ষয়, এটা পার্থ চট্টোপাধ্যায় অথবা অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের ফ্ল্যাটে খুঁজে পাওয়া টাকার থেকেও অনেক মারাত্মক, অনেক বেশি গভীর।

এই পরিস্থিতিতে আশু কর্তব্য হল স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়ার দাবী তোলা, যাঁরা ঘুষ দিয়ে চাকরি পেয়েছেন তাঁদের চিহ্নিত করা, প্রয়োজনে পুরো প্যানেল বাতিল করা। কিন্তু আইনি জট এতই পাকিয়েছে যে শুধুমাত্র শুভবুদ্ধি অথবা সদিচ্ছা দিয়ে এগুলোর সমাধান হবে না। মনে রাখতে হবে প্রাইমারি টেট, আপার প্রাইমারি টেট, নবম-দশম এসএলএসটি, একাদশ-দ্বাদশ এসএলএসটি এবং ফিজিকাল-ওয়ার্ক এডুকেশন টিচার এমপ্লয়মেন্ট, এতগুলো পরীক্ষা হয়েছে দু'বার, ২০১২ ও ২০১৬-তে। প্রতিটা পরীক্ষায় অসংখ্য কারচুপি, তার জন্য এত এত কোর্ট কেস। এই জটিলতার সমাধান করে স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করা খুব তাড়াতাড়ি ও মসৃণ ভাবে হবে না, এবং এই না হবার পুরো দায় বর্তমান সরকারের। তৃণমূল স্বখাত সলিলে ডুবতে বসেছে, এবং নিজেদের বিসর্জনের সাথী করে নিয়েছে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে।

হ্যাঁ, তৃণমূল সরকারকে সরানো এই মুহূর্তে সময়ের দাবি, কিন্তু তা এই কারণে নয় যে তৃণমূল চুরি করেছে। কারণ যে কোনও সময়ে চোরের থেকে দাঙ্গাবাজ বেশি বিপজ্জনক মানুষ জানেন, তাই সমস্ত অন্যায় সত্বেও তাঁরা তৃণমূলকে ভোট দেন। কিন্তু তৃণমূলের অপসারণ এই মুহূর্তে দরকার। যে দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ঘটিয়ে তারা গোটা রাজ্যকে ব্যানানা রিপাবলিকের পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে, যেখানে একসময়ে আর কোনও বৈধ রাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোই কাজ করবে না। নির্বাচন সিস্টেমে রিগিং ও গুণ্ডামি করে সমগ্র প্রক্রিয়াকে তারা ধূলিসাৎ করেছে, শিক্ষাব্যবস্থাকে কব্জা করেছে, এরপর স্বাস্থ্য, প্রশাসন, পৌরবিভাগ, সমস্ত ব্যবস্থাকে গিলে খেয়ে নিয়ে সমান্তরাল অর্থনীতি শুরু করতে চলেছে। কাগজ খুললেই দেখা যাবে দিনেদুপুরে গুলি চলছে এখানে ওখানে, স্কুলগুলিতে হামলা হচ্ছে, ঘুষের টাকা ফেরাবার দাবিতে পঞ্চায়েত প্রধানের ঘরে চড়াও হচ্ছেন ঘুষ দিয়েও চাকরি না পাওয়া মানুষের দল - এগুলো কিন্তু বিচ্ছিন্ন কোনও ঘটনা নয়, বরং সার্বিক এক নৈরাজ্যের প্রতিফলন। এটা তখন হয় যখন সমান্তরাল কালো টাকার অর্থনীতি এসে বৈধ অর্থনীতিকে গিলে খায়। তৃণমূলকে যেতে হবে, কিন্তু মনে রাখতে হবে যে বিজেপি নিজেদের স্বার্থেই এখন তৃণমূল সরকারের অপসারণ চাইবে না। কারণ তারা এসবের জুজু দেখিয়ে, সিবিআই ইডি লেলিয়ে বারেবারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করাবে, ক্রমশ তৃণমূলকে পরিণত করবে নিজেদের পুতুল সরকারে। যাঁরা ‘তৃণমূলকে সরালে বিজেপি চলে আসবে’ জাতীয় বালখিল্য ভাবনায় এখন ভুগছেন ও সরবরাহ করে চলেছেন তৃণমূলকে বৈধতা দেবার কুযুক্তি, তাঁদের জ্ঞাতার্থে জানিয়ে রাখা ভাল যে, বিজেপির নতুন করে আসার কিছু নেই, এই পরিস্থিতি তাদের পক্ষে আদর্শ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কোনওরকম বেগড়বাই করতে পারবেন না, করলেই বিজেপি জুজু দেখাবে, কারণ তাদের বয়েই গেছে সত্যিকারের তদন্ত ও সমস্যার সমাধান করতে। তৃণমূল ও বিজেপি, ক্ষমতার পারস্পরিক ভারসাম্যের খেলায় ব্যস্ত দুই দলকেই তাই ছুঁড়ে ফেলার সময় এসেছে। সেটা করতে পারবেন একমাত্র গণতন্ত্রপ্রিয় প্রগতিশীল মানুষেরাই।