আরেক রকম ● দশম বর্ষ চতুর্দশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ জুলাই, ২০২২ ● ১-১৫ শ্রাবণ, ১৪২৯

প্রবন্ধ

'অজিতেশের শেষ ঠিকানা' - একটি আনন্দ নিকেতন

রত্না রায়


'অমৃত' পত্রিকার ক্রীড়া বিনোদন সংখ্যায় (২৬শে ডিসেম্বর, ১৯৭৫), একটি সাক্ষাৎকারে শান্তিরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়ের প্রশ্ন ছিলঃ ''অভিনয় শিক্ষা ও উৎসাহ - এ ব্যাপারে কার কাছে আপনি সর্বাধিক ঋণী?'' উত্তরে কেয়া চক্রবর্তী বলেন - ''অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়।'' এই তেজস্বিনী অগ্নিশিখাকে প্রথম দেখি আন্তিগোনের ভূমিকায়, রাজা ক্রেয়নের অভ্রংলিহ গরিমাকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে যে কঠিন সংকল্পে অবিচল। নান্দীকারের 'আন্তিগোনে' নাটকে অজিতেশের শেষ সংলাপ ''দরবারের সময় হয়েছে।'' পুত্রের মৃত্যুসংবাদে ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়া একটি মানুষ রাজগৌরবের খোলসকে আঁকড়ে ধরে পথ হাতড়ে এগিয়ে চলেন। কলেজের দ্বিতীয় ধাপে পড়ি তখন। চোখ বুজলে এখনও দুটি মানুষকে মঞ্চে দেখতে পাই, আজকের ষাট-উজোনো দিনেও। কেয়া যদি খাপ খোলা তরবারি হন অজিতেশ তাহলে অগম্য দুর্ভেদ্য এক গগনচুম্বী মিনার। অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের শেষ জীবনের সহযাত্রী রত্না বন্দ্যোপাধ্যায়ের কলমে 'অজিতেশের শেষ ঠিকানা' বইটি নিয়ে দু'একটি কথা বলতে চাই। কিন্তু কেয়া চক্রবর্তীর নাম ফিরে ফিরে আসবেই। তিনি যে অজিতেশের প্রধান সৈনিক।

অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার জীবন আশ্চর্যভাবে জড়িয়ে গেছে। গ্রামের স্কুল থেকে শহরের স্কুলে চাকরি করতে চলে এলাম নব্বই দশকের একদম গোড়ায়। 'হাউস রেন্ট অ্যালাওয়েন্স' দিতে প্রধান শিক্ষিকার আপত্তি ছিল কারণ আমার বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা চলছিল, যদি শেষমেষ সেটা না হয়। কারণ, তাঁর কথায় - "অজিতেশবাবু তো লিলিদিকে ডিভোর্স দিতে পারেননি, কেঁদে ফেলেছিলেন।" অজিতেশের স্ত্রী লীলা বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের স্কুলেই চাকরি করতেন । আমি আসার অনেক আগেই প্রয়াত হয়েছেন। এই বইটি পড়া আমার খুব প্রয়োজন ছিল কারণ অজিতেশবাবু নিজে কিছুই লিখে যাননি। রত্নাদেবীর স্মৃতিচারণটুকুই ভরসা। মূলতঃ কবি শঙ্খ ঘোষের উৎসাহে এবং নাট্যবোদ্ধা শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যমে থীমা প্রকাশনী থেকে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে ২০১৯ সালে। শমীকবাবু বইটির মুখবন্ধ রচনা করেছেন। আজ জানতে পেরেছি অজিতেশবাবুকে তাঁর নিজের পরিবার এবং তাঁর স্ত্রী, উভয়তঃ ডিভোর্স পেতে দেননি। একমাত্র সন্তান সোনা (অর্ণব)-কে ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হন রত্না দেবী। অজিতেশবাবুর আইনি বিচ্ছেদ না হলে সন্তানকে মা-এর কাছে যেতে দেবেন না অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়, রত্নাদেবীর স্বামী। এই বই পড়েই জানতে পারি নিজের মা ও দুই বোনের লেখা উকিলি চিঠি বিবাহ বিচ্ছেদের মামলায় অজিতেশবাবুকে হেরে যেতে বাধ্য করে। এই আঘাত তাঁকে বিধ্বস্ত করে দেয়। এ গ্রন্থের মুখবন্ধে আমরা পড়েছি শমীকবাবুকে অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় গভীর বেদনার সঙ্গে বলেছেন, "ওই একটাই দুঃখ রয়ে গেল, রত্নাকে ওর জায়গাটা দিতে পারলাম না।"

ভূমিকাপর্বে রত্নাদেবী জানিয়েছেন অনেকের সহায়তা ও ভালোবাসায় এই গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে, কোথাও কল্পনার আশ্রয় নেননি তিনি। গ্রন্থের পাতায় পাতায় এই অকপট সত্যের ছবি আমরা খুঁজে পাই। ১৯৭২-এর পনেরোই আগস্ট থেকে অজিতেশের মৃত্যু অবধি অর্থাৎ ১৯৮৩ সালের চোদ্দই অক্টোবর পর্যন্ত পি. তিরাশি, সি. আই. টি. রোড, কলকাতা দশ - এই ঠিকানা ছিল তাঁদের যৌথজীবনের আশ্রয়। এই বাড়ী থেকেই অজিতেশের অনন্তলোকে যাত্রা শুরু হয়। তাই গ্রন্থে বাড়ীটিও একটি চরিত্র হয়ে ওঠে। নিজ নিজ বাসস্থান থেকে একবস্ত্রে বেরিয়ে এসে, কিছুদিন বিচ্ছিন্নভাবে এখানে ওখানে থেকে অবশেষে এক শ্রাবণদিনে এই আশ্রয়ে মিলিত হলেন তাঁরা। 'মনে হল যেন পেরিয়ে এলেম অন্তবিহীন পথ' - এই গানটি সেদিন গেয়েছিলেন রত্নাদেবী। উচ্চাঙ্গসংগীত ও রবীন্দ্রসংগীতের আচ্ছা আচ্ছা জায়গায় তালিম নেওয়া এই মহীয়সী নারী নাট্যজ্যোতিষ্ক অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়কে আগলে রেখেছিলেন দীর্ঘ এগারোটি বছর এই ঠিকানায়।

আত্মীয়স্বজন ও সংসার নিয়ে কতটা চিন্তিত ছিলেন অজিতেশবাবু গ্রন্থের শুরুতেই রত্নাদেবী তা আমাদের বলেছেন। অসময়ে পিতৃবিয়োগের পর বিরাট সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ে অজিতেশের কাঁধে। তিনিও প্রাণপাত করে যথাযোগ্যভাবে সে দায়িত্ব পালন করেছেন। বেলেঘাটায় আসার কিছুদিনের মধ্যেই বছরের সেরা নাট্য পরিচালক হিসেবে 'একাডেমি' পুরস্কারে ভূষিত হন অজিতেশ। পুরস্কার নিতে দিল্লি যান তাঁরা দুজনে।পুরস্কারের অর্থমূল্য হিসেবে পাওয়া পাঁচ হাজার টাকার চেক রত্নাদেবীর চোখের সামনে মেলে ধরেই কলকাতায় পাঠিয়ে দেন বোনের বিয়ের খরচ হিসেবে। তখনকার দিনের হিসেবে এই টাকার মূল্য অনেকটাই। এরপরেও সংসারকে নানাভাবে সাহায্য করেছেন। সর্বংসহা রত্নাদেবী তাঁকে নিজের মতো করেই চলতে দেন। অর্থের তাগিদে সিনেমা ও যাত্রায় অংশগ্রহণ করতে হয় অজিতেশকে। যাত্রার সাধারণ দর্শকদের সাথে কথা বলতে ভালবাসতেন তিনি। একদিন মফস্বলে যাত্রার শেষে বিদেশ থেকে সদ্যপ্রত্যাগত ভাই অজিতেশের সঙ্গে দেখা করতে যান। এই চাষাভূষো মানুষগুলোর সাথে দাদা কিভাবে মিশছেন - বলে অত্যন্ত ন্যক্কারজনক ব্যবহারও করেন। বাড়ীতে ফিরে ভাইয়ের দেওয়া পারফিউম, সাবান রত্নাদেবীর হাতে দিয়ে অজিতেশ বলেন, এর একটাও যেন ব্যবহার করা না হয়।

গ্রন্থের ষষ্ঠ অধ্যায়ে রত্নাদেবী অজিতেশের কলেজ জীবন ও তাঁর সাথে পরিচয়ের সূত্রপাত কিভাবে ঘটে সে ব্যাপারে আলোকপাত করেন। বাল্যবন্ধু অসিতবাবু প্রায়ই কলেজ থেকে ফিরে মনীন্দ্র কলেজে তাঁর সহপাঠী রোগা ডিগডিগে কোলিয়ারী অঞ্চলের এক গ্রাম্য ছেলের বিষয়ে রত্নার সাথে আলোচনা করতেন। ইংরাজী অনার্সের ক্লাসে যে ছেলে শেক্সপীয়র সংক্রান্ত সব প্রশ্নের উত্তর দিত, বাংলা ক্লাসে 'মুক্তধারা' পড়ানোর সময় সেই আবার সবথেকে বেশী অগ্রসর। এমনকি যাবতীয় রেফারেন্স বইও তার পড়া। মনীন্দ্র কলেজের সামনে গাড়ীচাপা পড়া একটি বাচ্চাকে কোলে করে দৌড়তে দৌড়তে আর. জি. কর হাসপাতালের এমার্জেন্সিতে ভর্তি করে তার প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন অজিতেশ। সেদিন আর কলেজে যেতে পারেননি। রক্তে ভেজা জামাকাপড় কেচে বিছানার চাদর জড়িয়ে বসেছিলেন, কেননা তাঁর ঐ এক বই অন্য জামাকাপড় ছিলনা। কোলিয়ারিতে কাজ করতে চাননি বলে বাবা অর্থসাহায্য বন্ধ করে দিয়েছিলেন। টিউশন করেই পড়াশোনা চালাতেন। পাতিপুকুর বস্তিতে থাকতেন, অর্ধেক দিন খাওয়া জুটত না। কিন্তু ধানবাদে এঞ্জিনিয়ারিং পড়া ভাইকে চল্লিশ টাকা মানি অর্ডার করে পাঠাতে হতো। এ সবই অসিতবাবুর কাছ থেকে শোনা। পরবর্তীতে অজিতেশের সঙ্গে রত্নাদেবীর বন্ধুত্বের সম্পর্কটা মেনে নিতে পারেননি অসিতবাবু কারণ তাঁরা কেউই তো অজিতেশের বন্ধু হয়ে উঠতে পারেননি। 'এমন নির্বান্ধব মানুষ আর কাউকে দেখেছি বলে মনে করতে পারছি না' - খেদোক্তি রত্নাদেবীর।

অজিতেশকে নিয়ে নানা ধরণের কুৎসা, বিশেষ করে কেয়া চক্রবর্তীর সঙ্গে তাঁর ওঠাবসা এসব নিয়ে বহুজন রত্নাদেবীর কাছে নানা কথা বলতে আসতেন। কিন্তু এক নিমেষের জন্যও কোন বিরূপ চিন্তা রত্না বন্দ্যোপাধ্যায়কে কবজা করতে পারেনি। আর অজিতেশবাবু এদের প্রতি কোন রাগ বিদ্বেষ পোষণ করতে নিষেধ করতেন, কেননা "এরা দুর্বল বলেই এমন করে বলে।" তাঁর মত মানুষের পক্ষেই এমন কথা বলা সম্ভব ছিল।

রত্নাদেবী আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন - থিয়েটার অজিতেশের প্রেম, অজিতেশের আনন্দ, অজিতেশের মুক্তি আবার অজিতেশের যন্ত্রণা, কষ্টও। এ প্রসঙ্গে দু'একটি ঘটনার কথা স্মরণ করিয়ে দেন। 'নটী বিনোদিনী' নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার আগে টানা আটচল্লিশ ঘন্টা রিহার্সাল চলে। কোন কুশীলব বাড়ি যেতে পারেননি। যেদিন নাটকটি মঞ্চস্থ হয় সেদিনই রাতের ফ্লাইটে অজিতেশকে বম্বে চলে যেতে হয় 'সমঝোতা' সিনেমার শ্যুটিং-এর কারণে। নাটকে নিজের অংশটুকু করে হল থেকে ট্যাক্সি নিয়ে বাড়িতে এসে লাগেজ তুলে বেরিয়ে পড়েন একরাশ চিন্তা মাথায় করে। কিন্তু নাটকটি সাফল্য লাভ করে। ঈশ্বরকে প্রণাম জানান রত্নাদেবী। ভূপালে শো করতে গিয়ে অ্যাক্সিডেন্টে নিদারুণ অসুস্থ হয়ে ফেরেন অজিতেশ। কিন্তু শো থাকায় নার্সিংহোম থেকেই অভিনয় করে ফিরে আসেন রত্না বন্দ্যোপাধ্যায়ের অগোচরে।

১৯৭৭ সালে কেয়ার মৃত্যু হয় আর 'নান্দীকার' ভেঙে যায় ১৯৭৯ সালে। 'ফুটবল' নাটকের শো ছিল অ্যাকাডেমিতে । অজিতেশ তৈরী হয়ে বারান্দায় বসেছিলেন। কিন্তু অন্যান্য দিনের মতো তাঁকে নিয়ে যেতে কোন গাড়ী এলোনা। সন্ধে গড়ালো রাতে। বারান্দায় ঠায় বসে থাকলেন একটি মানুষ। এর কয়েকদিন বাদেই নান্দীকার থেকে একঝাঁক অভিনেতা এসে বললেন - আপনাকে ছাড়া আর কাউকে আমরা চিনি না। তৈরী হল 'নান্দীমুখ'। যোগেশ মাইম থিয়েটার ভাড়া করে নামানো হল পুরোনো নাটক 'শের আফগান'। হৈ হৈ করে চলল সে নাটক। 'নান্দীমুখ'-এর প্রথম নতুন নাটক 'পাপপূণ্য'। টলস্টয়ের লেখা 'Power of Darkness' নাটকটি অজিতেশকে প্রথম পড়ান কেয়া চক্রবর্তী কলেজ লাইব্রেরী থেকে সংগ্রহ করে। পাপের ঘন অন্ধকার নাটকের জন্য নিজেকে নানাভাবে তৈরী করতেন। সব দর্শক হয়ত বুঝতে পারতেন না, কিন্তু কেউ কখনও যদি ধরতে পারতেন, প্রশংসা করতেন, খুব আনন্দ পেতেন অজিতেশ। বেতার নাটক বা দূরদর্শনের জন্য যে কাজ করেছেন, তাতেও যত্নের ছাপ ছিল স্পষ্ট।

রত্নাদেবীর কাছ থেকেই আমরা জানতে পারি নিজে গান না গাইলেও এই নাট্যপুরুষের সংগীতের বোধ ছিল অসাধারণ। 'তিন পয়সার পালা' এই নাটকের গানের কথা ও সুর তাঁরই সৃষ্ট। স্বয়ং হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এ নাটক দেখে বলেছিলেন - ''এমন সুন্দর সুর দিতে আমিও পারতাম না।'' তিনটি শাস্ত্রীয় সংগীতের বন্দিশও রচনা করেন অজিতেশ, যার মধ্যে একটি রত্নাদেবী বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গাইতেন। গ্রন্থের শুরুতেই অজিতেশবাবুর হস্তাক্ষরে একটি বন্দিশের ফোটোকপি আমরা দেখতে পাই। এলভিস প্রিসলে, ন্যাট কিং কোল, পিট সিগার প্রমুখের গান রত্নাকে এনে শোনাতেন তিনি। খ্যাতনামা গুরুদের কাছে তালিম নেওয়া রত্না আবার সংগীতের চর্চা করুন এটা তিনি ভীষণভাবেই চাইতেন। একবার নান্দীকারের জন্মদিনে বাগবাজার রিডিং লাইব্রেরিতে গান গাইতে গিয়ে রত্নাদেবীর গলা একটু ক্র্যাক করেছিল। বাড়ি ফিরে স্বামী অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন - "আজ তোমার গাওয়া উচিত হয়নি।" ভীষণই মুষড়ে পড়েছিলেন রত্না। অথচ প্রতিবেশী অজিতেশ এসে মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন - ''আপনার গান তো সবার থেকেই আলাদা, আর যেটা হয়েছে সেটা প্র্যাকটিশের অভাব।'' এই সহমর্মিতা দুজনকে কাছে টেনেছে বলা বাহুল্য। মূলতঃ অজিতেশের উৎসাহেই রত্নাদেবী আবার গানের ক্লাসে ভর্তি হন। পরবর্তীকালে তাঁদের বেলেঘাটার বাড়ীতে রত্নাদেবীর গান শেখানোর ব্যাবস্থা করে দেন অজিতেশ, নাম দেন 'গানের ইসকুল'।

শিল্পচর্চাকে কোনো ছেলেখেলা মনে করতেন না এই নাট্যব্যক্তিত্ব। কেয়া চক্রবর্তী চাকরি ছেড়ে দিয়ে নান্দীকারের হোলটাইমার হয়ে যান। এই ত্যাগের মূল্য তিনি কি পেয়েছিলেন? রত্নাদেবীকে কথায় কথায় একদিন বলেছিলেন - "ভাবতে পারো কি, আমীর খান, রবিশংকর দিনের বেলা চাকরি বাকরি করে এসে সন্ধেয় গানবাজনা করছেন!" সৃজনশীল কাজ করার জন্য সবসময় তাগিদ জোগাতেন মানুষকে। একদিন 'বেতার জগৎ'-এর জন্য একটি নিবন্ধ লিখতে লিখতে রাত হয়ে গেল, অজিতেশ রিহার্সাল থেকে ফিরে এলে অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন রত্নাদেবী - রান্না হয়নি যে! রাগ তো দূরস্থান, অদ্ভূত প্রসন্ন হাসি হেসে অজিতেশ বলেছিলেন ''কাজ নিয়ে এভাবেই তো সব ভুলে যেতে হয়।'' তারপর লোক দিয়ে রুটি-তড়কা আনা হয়েছিল। আর একদিন রেওয়াজ করতে করতে বেলা হয়ে গিয়েছিল। ধড়ফড় করে ছুটে গিয়ে রত্না দেখলেন অজিতেশবাবু সমস্ত খাবার সাজিয়ে নিয়ে, নুন, লেবু কেটে, বসার জায়গা প্রস্তুত করে রেখেছেন। প্রত্যেকে তার কাজকে পুজো করার মত মর্যাদা দিক এই ছিল তাঁর কাম্য। এই সম্মানটুকু ক'টি মেয়ে তার সংসারে পেয়ে থাকে? তাইতো সর্বস্ব দিয়ে সারাজীবন এই মানুষটিকে আগলে রেখেছিলেন রত্নাদেবী।

বইটি পড়ে জানা যায়, কোন ইমেজ খাড়া করে রাখার মানুষ ছিলেন না অজিতেশ। বাড়ির সুইপার রাজিন্দর সারাদিন বিশ্রী গালাগাল দিয়ে কথা বলত, মদ খেত। তার সাথে দিব্য খোশগল্প করা, বিড়ি খাওয়া চলছে বিষয়টা রত্নাদেবীর পছন্দ না হলে অজিতেশ বলেন - ''ওর কাজ বাথরুম পরিষ্কার করা, না পেয়েছে শিক্ষা, না ভাল খাবার। ও কি রবীন্দ্রনাথের গান করবে?'' বাড়ির কাজের মেয়ে সুভদ্রার লেখাপড়ার ব্যবস্থা করেন । সে পরবর্তীকালে বলত - ''আমি কাকুর কাছে মানুষ।'' রত্নাদেবীর ছেলে সোনার দেখাশোনা করতেন সীতারাম। তাঁর টি. বি. হওয়ায় অসিতবাবুর দ্বিতীয়া স্ত্রী তাঁকে চলে যেতে বলেন। সীতারাম এলে তাঁকে আশ্রয় দিলেন অজিতেশ, বললেন ''তুই আমাদের সোনাকে বড়ো দুঃসময়ে দেখেছিস।'' অজিতেশ তাঁকে সুস্থ করেই ছাড়লেন। অমিত ভালবাসা নিয়ে জন্মেছিলেন এই মানুষটি। রত্নাদেবী তাঁর সন্তানকে কাছে পাননি বলে অজিতেশও মায়ের কাছে যেতেন না।

নাটক ও সিনেমা জগতের বাইরে যে মানুষটিকে অজিতেশবাবু গুরু বলে মনে করতেন তিনি হলেন আসানসোল কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক শ্রী প্রভাসচন্দ্র লাহিড়ি। রত্নাদেবীকে অজিতেশ জানান "উনি আমার জীবনের একমাত্র জ্যান্ত গুরু। উনিই প্রথম আমায় শোনালেন মহাজীবনের আহ্বান।" প্রফেসর লাহিড়ি রত্নাদেবীকে বলেন - "অজিত হল গৃহী সন্ন্যাসী।" তাঁর মধ্যে যে সুমহান বীজ সুপ্ত অবস্থায় ছিল তারই পরিচর্যা করেন শ্রী লাহিড়ি। সন্তানবিচ্ছিন্না রত্নাদেবীকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন - "এই যাত্রাপথে পর্যাপ্ত সুখশান্তি না পেলেও আনন্দ তুমি পাবে।" রত্না তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওয়াটুকু তো এখানেই পেয়েছেন। অজিতেশ তাঁকে বলে গেছেন - "তোমার কাছে পেলাম জীবনের সবচেয়ে ভাল কয়েকটা বছর।" অনতি ভবিষ্যতে রত্নাদেবী তাঁর সন্তানকে সগৌরবে ফিরে পান। মাকে নিয়ে তাঁর সোনা স্ত্রী, পুত্র সহ বৈষ্ণবঘাটা পাটুলির বাড়ীতে এখন বাস করেন। সেই বাড়ীর বারান্দায় রাতের অন্ধকারে বসে রত্নাদেবী আজও অপেক্ষা করেন একটা ট্যাক্সি আসার। যা থেকে নেমে ধবধবে সাদা পায়জামা পাঞ্জাবি পরা একজন দীর্ঘদেহী মানুষ এসে বলবেন - "চল, তোমাকে অনেকক্ষণ বসিয়ে রেখেছি।"

'অজিতেশের শেষ ঠিকানা'
রত্না বন্দ্যোপাধ্যায়
থীমা প্রকাশনী