আরেক রকম ● দশম বর্ষ চতুর্দশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ জুলাই, ২০২২ ● ১-১৫ শ্রাবণ, ১৪২৯

প্রবন্ধ

জন্মশতবর্ষে গৌরকিশোর ঘোষ - একটি ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ

গৌতম লাহিড়ী


প্রথম দর্শনেই শ্রদ্ধাবনত হয়ে গিয়েছিলাম। মোটা ফ্রেমের পুরু কাঁচের চশমার আড়ালে ঝকঝকে দুটি চোখ। পরনে ফতুয়া। হাঁটু পর্যন্ত ধুতি। শুনেছিলাম এই পোশাকেই তিনি প্রধানমন্ত্রী নেহরুর সঙ্গে ভিয়েতনামে সরকারি সফরে গিয়েছিলেন। ব্যাংকায়েটে প্রেসিডেন্ট হো চি মিন নিজে গিয়ে আলাপ করেছিলেন। কলকাতার সাংবাদিক বলে। এহেন প্রবাদপ্রতিম সাংবাদিকের সঙ্গে নেহাতই ভাগ্যক্রমে সাক্ষাৎ হয়ে গেল।

আমি তখন কলকাতার যুগান্তর-অমৃতবাজার পত্রিকায় শিক্ষানবীশ। যুগান্তরে লেখার জন্য কিছু সাম্মানিক পেতাম। অমৃতবাজার থেকে কিছুই না। পারিবারিক সুত্রে পত্রিকার প্রকাশক প্রতাপ কুমার রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। উনি একদিন আমাকে ডেকে বললেন - "বাছা, এখানে তোমার কিছুই হবে না। হয়তো এই প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে। আমার বন্ধু গৌরকিশোর ঘোষ একটা নতুন সংবাদপত্র প্রকাশ করছে। তুমি ওখানে গিয়ে কথা বলো।" খোঁজ নিয়ে আমহার্স্ট স্ট্রিটের লাহা বাড়িতে গেলাম। সেখানেই তখন প্রকাশিতব্য 'আজকাল' পত্রিকার দপ্তর।

গৌরদা। এই নামেই সকলে ডাকে। বেরিয়ে এলেন। আমার কিছু প্রকাশিত প্রতিবেদন দেখে বললেন - “আমরা তো কলকাতার সর্বশ্রেষ্ঠ কুড়ি জন শিক্ষানবীশ সাংবাদিককে নিয়েছি। এখন তো জায়গা নেই। তবে তুই যদি রাজি হোস, তাহলে আমাদের প্যানেল লেখকদের মধ্যে রাখতে পারি।" গৌরদা সকলকেই 'তুই' বলে সম্বোধন করতেন। প্রথমেই আপন করে নেওয়ার উদ্যোগ। আমি সম্মতি দিয়ে কিঞ্চিৎ হতাশ হয়েই ফিরে গেলাম।

কিছুদিন পরে হঠাৎ বাড়িতে একটা পোস্টকার্ড। ইংরাজিতে লেখা আপনাকে সম্পাদকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার নির্দেশ দেওয়া হয়ছে। আবার গেলাম। পৌঁছে দেখি গৌরদার সহায়ক অনন্ত। পোস্টকার্ডটি দেখে বললেন - "আপনি ওই ঘরে বসুন। এখানে লিখিত পরীক্ষা হবে।" আমি কলম নিয়েও যাইনি। চিঠিতে পরীক্ষা দেওয়া কথাও লেখা নেই। মনে আছে অনন্ত প্রথমেই গৌরদাকে জানালো যে, এই ছেলেটি তো কলম নিয়েই আসেনি ও পরীক্ষা দেবে কি করে। বাড়ি পাঠিয়ে দিই। গৌরদা জবাব দিয়েছিলেন - "তোর কলমে কালি আছে? তাহলে ওটা ওকে দিয়ে দে।" অনন্তর থেকে আদ্যিকালের রাইটার পেন নিলাম। তারপরেও অনন্ত থামেনি। অপেক্ষারত আরও কয়েকজনকে দেখিয়ে বললো - "ওঁরা কিন্তু তৃতীয়বার পরীক্ষা দিচ্ছে। আগেরগুলোতে ফেল করেছে। গৌরদা চারবার সুযোগ দেবে। আপনি তো প্রথমবারে পাশ করবেন না।" জানুয়ারি মাস হলেও রীতিমতো ঘামছিলাম।

যাই হোক পরীক্ষা তো দিলাম। কিছুদিন পরে আবার পোস্টকার্ড। ইন্টারভিউতে যেতে হবে। পৌঁছে দেখি ইন্টারভিউ বোর্ডে গৌরদা আর সেই প্রতাপ কুমার রায়। উনি 'আজকাল' পত্রিকারও প্রকাশক। তৃতীয় ব্যক্তিকে চিনলাম না। সাহেবসুবো। পরে জানলাম উনি হামদি বে। 'স্টেটসম্যান' পত্রিকায় ছিলেন। কি কারণে যেন ভারত সরকার ওঁকে আসাম থেকে বিতাড়ন করেছিল। ভারত সরকারের নিরাপত্তা নাকি বিঘ্নিত হচ্ছিল। মুখে একটা জ্বলন্ত সিগারেট। ছাই ফেলছিলেন না। আপনা হতেই ছাই মাটিতে পড়ছিল। এইরকম আচরণ পরেও দেখেছি।

ভাবছিলাম বাংলা সংবাদপত্রে ইংরেজি ভাষার সাংবাদিক কি করবেন? উনি তো বাংলা জানেন না। বলতেও পারেন না। পড়া তো দূর অস্ত। পরে দেখলাম উনিই আমাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। আদতে গৌরদারা ছিলেন আদর্শগত ভাবে 'রইস্ট' নানে মানবেন্দ্র রায় পন্থী। সেই মানবেন্দ্রনাথ রায় অর্থাৎ এম. এন. রায় যিনি লেনিন-স্টালিনের সঙ্গে তর্ক করে মার্কসবাদের ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। হামদি বে সেই আদর্শে বিশ্বাসী। ইন্টারভিউতে হামদি চোস্ত ইংরেজিতে প্রশ্ন করছিলেন। আমি কতগুলো সংবাদপত্র পড়ি। বিদেশের কতগুলো সংবাদপত্রের নাম জানি। নাম বলতে বললেন। আমি তো ঘেমে নেয়ে দশ নম্বরে ফরাসি 'লা মঁদ'-এর নাম বলে ফেলেছি। নাছোড়বান্দা হামদি। বললেন - "গো অন"। এবার গৌরদা থামালেন। বাংলায় বললেন - "আর কত বলবে? যথেষ্ট।" হামদি থামলেন। তবে আজ একটুও দ্বিধা নেই, পরবর্তী সময়ে সাংবাদিক হিসাবে যা কাজ করেছি তার মূল শিক্ষা হামদি বে আর গৌরদার কাছ থেকেই পেয়েছি।

এবার প্রশ্ন শুরু করলেন গৌরদা। প্রথম প্রশ্ন - "সাইকেল চালাতে জানিস?" শিখেছিলাম, বলতে বললেন - "আমরা ঠিক করেছি সংবাদ সংগ্রহের জন্য রিপোর্টারদের একটা করে সাইকেল দেব।" আমি তো অবাক। গৌরদা সংবাদপত্র শুধু নয়, সাংবাদিকতায় নতুন সংস্কৃতি আনতে চাইছিলেন। গতানুতিক সাংবাদিকতার ব্যাকরণ ভেঙে একেবারে অন্য রকম। তিনিই বোধহয় বাংলা সংবাদপত্রের প্রথম সম্পাদক যিনি সাংবাদিকতায় নারী সাংবাদিক নিয়োগ করেছিলেন। তখন হাতে গোনা এক বা দুজন মহিলা সাংবাদিকতায় ছিলেন। বললেন - "আমি কিন্তু বিদ্রোহী মানসিকতার যুবাদের নিতে চাই, যারা সরকারের তাঁবেদার হবে না।" জানতাম - গৌরদা মানবাধিকার সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন। জরুরী অবস্থার সময়ে কারাবন্দী ছিলেন। তিনিই দ্বিতীয় বাঙালি সাংবাদিক যিনি অমিতাভ চৌধুরীর পরে সাংবাদিকতার জন্য 'ম্যাগসাইসাই' পুরস্কার পেয়েছিলেন। প্রতাপ রায় বললেন - "রাম ওঁর কথা বলেছে"। রাম অর্থাৎ বিজ্ঞাপন জগতের প্রবাদপ্রতিম রাম রে। কিছুদিন 'হিন্দুস্থান থমসন'-এ সমীক্ষার কাজ করেছিলাম সেই সূত্রে পরিচয়। এবার গৌরদা বললেন - "রামও বিপ্লবী ছিল। কাজেই রাম বিপ্লবী ছাড়া কাউকে সুপারিশ করবে না।"

আবার পোস্টকার্ড পেলাম। ৯ ফেব্রুয়ারি। ১৯৮১। যোগ দিতে হবে। প্রথম কুড়ি জন যোগ দিলাম। গৌরদা বললেন আমাদের সংবাদপত্র হবে সকলের থেকে আলাদা। আমরা নাগরিক অধিকার-সচেতনতা আর উন্নয়নমুলক সংবাদ পরিবেশন করব। আমাদের কোনো পলিটিক্যাল বিট থাকবে না। একজন সিনিয়ার সাংবাদিক প্রত্যেক দিন রাজনৈতিক দলগুলির দপ্তরে যাবেন, তবে তাঁর কোনো সংবাদ ছাপা হবে না। এভাবে প্রত্যেকদিন বরুণ দাশগুপ্ত রাজনৈতিক দলের অফিসে যেতেন। আর আমাদের হামদি বের প্রশিক্ষণ চলতো সকাল দশটা থেকে রাত দশটা। মধ্যিখানে ব্রেক। প্রত্যেকদিন এক একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি আসতেন। আমলা থেকে বিচারপতি শিল্পপতি শিক্ষাবিদ। তাঁরা লেকচার দিতেন। আমাদের তার ওপর রিপোর্ট করতে হতো। অনেক সময়ে হামদি বলে দিত আজকের রিপোর্ট ইংরাজিতে লিখতে হবে। বাংলা কাগজে ইংরাজি রিপোর্টিং!

গৌরদাকে একদিন বললাম। উনি বললেন - "হামদি যা বলছে তাই করতে হবে। যদি সাংবাদিক হতে চাস। হামদি তোদের মানচিত্র আঁকতে বলতে পারে। ও যে কোনো জায়গার ম্যাপ চোখ বন্ধ করে আঁকতে পারে। একবার ডিব্রুগড়ের ম্যাপ এঁকেছিল। ওটা গিয়ে পড়ল ইন্টালিজেন্সের হাতে। সে ভাবলো হামদি বোধহয় বিদেশি চর। তাই হামদিকে আসাম থেকে তাড়িয়ে দিল। এমনকি আসামে ঢোকাও নিষিদ্ধ করল।" আজকাল তো গুগল ম্যাপ দেখে সব জায়গা চেনা যায়। হামদি বে ছিলেন প্রাক্ গুগল যুগের মানুষ।

যা বলছিলাম। দশটার পর গৌরদা একটা অ্যাম্বাসাডার গাড়ি নিয়ে বাড়ি ফিরতেন। ওঁর বাড়ির কাছাকাছি যাঁরা থাকতো তাদের নিয়ে ফিরতেন। ওই গাড়িতেই গাদাগাদি করে সম্পাদক গৌরদার সঙ্গে আমিও বসতাম। থাকতেন বরণ দাশগুপ্ত। তখন গৌরদা জানতে চাইতেন রাজনৈতিক দলগুলির কি খবর। ছাপা না হলেও সব জানতেন। বরুণদা কিছু বললে, অনেক সময়ে গৌরদা বলতেন - "এটা ঠিক নয়। তুই ঠিক জানিস না।"

১৯৮১-র ২৫ মার্চ প্রথম 'আজকাল' কাগজ প্রকাশিত হলো। এটা ঠিক যে সাধারণ পাঠকের মধ্যে আজকাল সংবাদপত্র নিয়ে প্রবল আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। গ্রাহক নেওয়া হয়েছিল। প্রথম দিনের গ্রাহক ছিল আশি হাজার। গৌরদা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় সাংক্ষাৎকার দিয়ে আজকাল সম্পর্কে একটা কৌতূহল তৈরি করে দিয়েছিলেন।

এইরকম একদিন ট্রেনিং-এ ব্রেকের সময়ে বাইরে বোরোতে গিয়ে হঠাৎ দেখা তপেন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। 'গুপী গাইন বাঘা বাইন' সিনেমার গুপী। তখনও জানতাম না আজকালের যেটা মাস্টহেড সেটা সত্যজিত রায়ের আঁকা। তপেনদা গুপীর মতো হেসে বললেন - "তুমি জয়েন করেছ। আমার সঙ্গে চলো। আমি টালিগঞ্জ স্টুডিও পাড়ায় যাচ্ছি। 'গুগাবাবা' করার পরে তপেনদা বিশেষ কোনো রোল পাচ্ছিল না। তাই রোজ টলি পাড়ায় ঘুরত। 'আজকাল'-এ উনি ছিলেন বিজ্ঞাপন বিভাগে। আমাদের কথার মধ্যেই পিছন থেকে মদন মিত্র হাজির। উনি 'আনন্দবাজার' থেকে সার্কুলেশান ম্যানেজার হিসাবে যোগ দিয়েছেন। তপেনদাকে রীতিমতো ধমক। আরে বিজ্ঞাপন যোগাড় করো। ফিল্ম করার জন্য চাকরি? পিছন থেকে জবাব এলো - "হ্যাঁ। আহা বেচারী চেষ্টা করছে।" গৌরদা। আরে ও আমাদের সঙ্গে আছে জানলেই লোকে বিজ্ঞাপন দেবে। যদিও ঘটনা হলো বিজ্ঞাপন আসছিল না। এই হল গৌরদা।

একদিন বললেন - "তুই সন্দীপনের কাছে যা।" সন্দীপন চট্টেপাধ্যায়। কবি-সাহিত্যিক। লিটল্ ম্যাগাজিনের জনক। উনি সংবাদপত্রের 'চিঠিপত্র' বিভাগের দায়িত্বে। সাংবাদিকতা করতে এসে চিঠিপত্র দেখতে হবে? সন্দীপন বললো - "চিঠি লিখে দিতে হবে। নতুন কাগজ কে লিখবে? আমরাই লিখব।" পরে দেখলাম 'আজকাল' প্রকাশ হওয়ার পর 'চিঠিপত্র' কলাম প্রবল জনপ্রিয় হয়ে উঠল। চিঠি তো নয় - লিটল্ ম্যাগাজিনের কবিতা। তারপর পাঠকরা সেই রকমের চিঠি লিখতে শুরু শুরু করল। পরে অবশ্য হামদি আমাকে রিপোটিং-এ নিয়ে আসে। সন্দীপন প্রথম দেখা হতেই বলেছিলেন - "দশটা টাকা ধার দাও।" দেওয়ার পরে বললেন - "ফেরত দেবো না।" আমার জবাবের আগেই বললেন - "কেন জানো তো? এই যে ঋণ নিলাম। তুমি আমাকে সারাজীবন মনে রাখবে।" গৌরদা এমন সব ব্যক্তিদের প্রথম থেকেই সংবাদপত্রে জোগাড় করেছিলেন।

একদিন আমায় ডেকে গৌরদা বললেন - "তোর সঙ্গে একজন ফটোগ্রাফার দিচ্ছি। কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে যেখানে মানুষ প্রকাশ্যে প্রস্রাব করবে সেখানকার ছবি সহ রিপোর্ট ছাপব।" পরদিন প্রথম পাতায় শিরোনাম সহ প্রকাশ্যে প্রস্রাব করার ছবি। লাগাতার অফিসে ফোন। যাঁদের ছবি ছাপা হয়নি তাঁদের। আর কোনোদিন করব না। আমাদের ছবি প্লিস ছাপবেন না। কয়েকদিন পরে নজরে এল আমাদের দেখেই লোকে পালাচ্ছে। মহাকরণ থেকে ঘোষণা হল সরকার পাবলিক টয়লেট তৈরি করে দেবে। আমার মনে হয় সেটাই ছিল প্রথম স্বচ্ছ ভারত প্রচার। তারপর গৌরদা আমায় দায়িত্ব দিলেন কলকাতার উন্নয়নের বিষয়ে পরিকল্পনা নিয়ে স্টোরি করতে। কলকাতায় চলন্ত ফুটপাত, গঙ্গার নীচে রেল, আকাশ, পথ। আরো কত কী? সবই তখন কাল্পনিক মনে হয়েছিল। আজ এসব তো হচ্ছে। গৌরদা তখন থেকেই এইসব ভাবতেন।

এক কাহিনি বলে স্মৃতিচারণ শেষ করব। আমাদের চিফ রিপোর্টার ছিলেন এক সাবেক ইংরাজি কাগজের সাংবাদিক। তিনি অনেক সময়ে আমাদের তৈরি করা রিপোর্ট নিজের নামে ছাপতেন। কিছু বলতে পারতাম না। একদিন ঠিক করলাম উচিত শিক্ষা দিতে হবে। তখন প্রায়ই সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে ডাইনী অভিযোগে পুড়িয়ে মারার ঘটনা। গৌরদাকে কেউ বুঝিয়েছিল গ্রামে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের শিক্ষা দিতে শাসক দলের পক্ষ থেকে এসব করা হচ্ছে। চিফ রিপোর্টারকে বলা হল তথ্য জোগাড় করতে। আমি তখন মহাকরণ সংবাদের দায়িত্বে। প্রথমে তথ্য জোগাড় করলাম কোন জেলায় কত ডাইনী হত্যা হয়েছে। পরদিন দেখলাম সেটা চিফ রিপোর্টারের নামে ছাপা হয়েছে। প্রচন্ড রাগ হল। চিফ রিপোর্টারকে প্রশংসা করলেন গৌরদা। তারপর চিফ রিপোর্টার আমায় বললেন যে এর একটা ভালো ফলোআপ স্টোরি চাই। তাহলে আমাকে দুটো রসগোল্লা খাওয়াবেন। এবার আমি সম্পূর্ণ বানানো তথ্য দিয়ে ওনাকে স্টোরি দিলাম।

ছোটোবেলায় দেওঘরে মামার বাড়ি বেড়াতে গিয়ে ত্রিকূট পাহাড়ে গিয়েছিলাম। পাহাড়ে ওঠার সময়ে স্থানীয় লোকেরা পাহাড়ের ভয়াবহতা অনুসারে এলাকার নাম দিয়েছিলেন। যেমন খাড়া জায়গার নাম ছিল - বুক ধঢ়ড়ফরিয়া। খাদের পাশের রাস্তার নাম - হামাগুড়িয়া। হামাগুড়ি দিয়ে যেতে হত। চিফ রিপোর্টারকে সেই সব এলাকার নাম পুরুলিয়ার গ্রাম বলে রিপোর্ট করলাম। যথারীতি ছাপা হল চিফ রিপোর্টারের নামে। গৌরদা ভীষণ খুশি।

আগের দিন রাতেই গৌরদা রিপোর্ট দেখেই প্ল্যান করে ফেলেছেন। জ্যোতির্ময় দত্তকে ওইসব গ্রাম পরিদর্শনে পাঠাবেন। জ্যোতির্ময় হলেন কবি বুদ্ধদেব বসুর জামাতা। বলিষ্ঠ লেখক। মানবতা অধিকার কর্মী। গৌরদা ওকে বললেন চিফ রিপোর্টারের সঙ্গে বসে এলাকার ম্যাপ সম্পর্কে ধারণা করতে। প্রয়োজনে হামদি বের সাহায্য নিতে। ও মানচিত্র বিশেষজ্ঞ। হামদি তখন এক বোতল জিন পান করে বেহেড। সব শুনে শুধু বললেন - "বোগাস।" পরদিন সকাল হতেই সাব-এডিটার সুমন চট্টেপাধ্যায়কে (পরবর্তী সময়ে বহু আলোচিত সম্পাদক) বললাম প্রকৃত ঘটনা৷ এইসব জায়গার কোনো অস্তিত্বই নেই। কি হবে? তুই গৌরদাকে বোঝা। সুমন বললো - কি করেছিস! তোর চাকরি যাবে।

এরমধ্যে সাতসকালে হোম সেক্রেটারি রথীন সেনগুপ্তের ফোন। গৌরদার বিশেষ পরিচিত। বললেন - "গৌর এসব কি করেছ? এই জায়গাগুলোর কোনো অস্তিত্ব নেই। তোমার কাগজে এমন গাঁজাখুড়ি গল্প বেরোবে আশা করিনি।" ততক্ষণে সুমন গৌরদার সম্পাদক ঘরে গিয়ে সব বলেছে। সুমন বললো গৌরদা তোকে ডাকছে। আমি তখন নার্ভাস। ধীর পায়ে ঢুকলাম। কিছু বলার আগেই গৌরদা বললেন - "যা করেছিস ঠিক করেছিস। আর কখনও করবি না।" আমি তো দ্বিতীয়বার চাকরি পাওয়ার আনন্দে আত্মহারা। এই হলো গৌরদা। তারপর থেকে উনি সব নিয়ম বদলে দিলেন। নিজেই রিপোর্টার্স টেবিলে এসে জিজ্ঞাসা করতেন কার কাছে কী খবর আছে? এই হলো আমার দেখা গৌরদা। এমন সম্পাদক আর কেউ হয়েছেন কিনা জানি না।

বিহার প্রেস বিলের মতো কালা কানুনের বিরূদ্ধে সাংবাদিকদের নিয়ে রাস্তায় নামলেন। যখন অন্যরা ভয় পাচ্ছে। কেবলমাত্র সাংবাদিকদের জন্য নয়, গৌরকিশোর ঘোষের জন্মশতবর্ষ উদযাপনের সময়কার সম্পাদকদের কাছেও গৌরদা একটা মডেল, যিনি কোনো অন্যায়কে কোনোদিনও মেনে নেননি।