আরেক রকম ● দশম বর্ষ চতুর্দশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ জুলাই, ২০২২ ● ১-১৫ শ্রাবণ, ১৪২৯

প্রবন্ধ

স্মরণঃ তরুণ মজুমদার

তিমিরকান্তি ঘোষ


আত্মজীবনী বা স্মৃতিকথা সবসময়ই সুখপাঠ্য। সেই অর্থে বাংলা ভাষায় লিখিত স্মৃতিচারণসমূহ মহাসাগরের তুলনায় কম নয়। রবীন্দ্রনাথ থেকে মনীন্দ্র গুপ্ত হয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। এবং অশোক মিত্র। বাঙ্গালির শ্রেষ্ঠ স্মৃতিরচনার তালিকায় স্থান পেয়েছে 'জীবনস্মৃতি', 'অক্ষয় মালবেরি', 'অর্ধেক জীবন', 'আপিলা চাপিলা' প্রভৃতি। সেই অর্থে চলচ্চিত্রের রুপালি আকাশ নক্ষত্রভরা থাকলেও বাংলা ভাষায় খুব একটা পূর্ণাঙ্গ স্মৃতিকথা ছিল না। যদিও অসিত সেনের 'স্মৃতির সোনালি রেখা', অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের 'আলোছায়ার দিনগুলি' রবি বসুর 'সাত রং', সৌমেন্দু রায়ের 'চলচ্চিত্র চলচ্চিত্র', বিজয়া রায়ের 'আমাদের কথা' ঋতুপর্ণ ঘোষের 'ফার্স্ট পার্সন' আমাদের মন ভরিয়ে দিয়েছে। অফিসে, আউটডোর-এ বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত-র ব্যক্তিজীবন, আর ফিল্মজীবনের গল্প শুনতাম। পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্তকে প্রায়ই বলতাম - স্যার, এইবার স্মৃতিকথা লিখুন। প্রত্যেকবারই বলত এই ছবিটা শেষ হলেই শুরু করব। পরে 'কাগেরছা বগেরছা' নামে ধারাবাহিক শুরু করেছিলেন 'আনন্দবাজার পত্রিকা'র 'রবিবাসরীয়'তে। কিন্তু লেখা শেষ করতে পারেননি।

ব্যক্তিগতভাবে আমার কৌতূহল ও বাংলা ভাষার চলচ্চিত্র চর্চার ইতিহাস অনুসন্ধানকে পূর্ণতা দিল তরুণ মজুমদারের 'সিনেমাপাড়া দিয়ে' বইটি। তাঁর প্রথম বই 'বাতিল চিত্রনাট্য' ২০১৭-য় প্রকাশিত হল। তরুণবাবু তখন আশি পেরিয়ে গেছেন। পরের বছর বেরোল আবার একটি বই 'নকশি কাঁথা'।

তখন উনি 'গণশক্তি' দৈনিকের লাইব্রেরিতে নিয়মিত বসেন। মাঝে মাঝে প্রুফ দিতে বা নতুন লেখা আনতে যাই। একদিন অপুদা (শুভঙ্কর দে, দে'জ পাবলিশিং) বলল - তিমির, তরুণবাবুর স্মৃতিকথা লেখা শেষ। আগামীকাল কপি দেবেন। অপুদাকে প্রায়ই বলতাম তরুণবাবুর একটা স্মৃতিকথা প্রকাশ করো। সেই আশা এতদিন পর সত্যি হল। পরের দিন অফিসে গিয়ে দেখলাম 'সিনেমাপাড়া দিয়ে'-র এক সুবিশাল পাণ্ডুলিপি। এ-ফোর ৭০ জিএসএম কাগজে হাতে লেখা ১০০ পাতার কয়েকটি কিস্তি। মুক্তোর মতো হস্তাক্ষর। পাণ্ডুলিপি দেখলে বোঝা যায় তাঁর সৃজন মনের ছোঁয়া। মনে পড়ে যায়, তাঁর প্রথম জীবনের পাবলিসিটি কোম্পানিতে কাজের দক্ষতা। শুরু হল কম্পোজ। নব্বই বছর বয়সের দোরগোড়ায় 'সিনেমাপাড়া দিয়ে'-র পাণ্ডুলিপি সম্পূর্ণ হল। অপুদার সঙ্গে 'গণশক্তি'র অফিসে যেতে হয়। প্রচ্ছদ কেমন হবে? ইলাস্ট্রেশন কেমন হবে? এসব উনি নিবিড়ভাবে বলতেন প্রকাশককে। আমি দেখতাম, তাঁর সিনেমার মতোই কত টুকরো টুকরো ডিটেলিং নিয়ে চিন্তিত। কত বিশদে অলংকরণ ও প্রচ্ছদ শিল্পী রঞ্জনদার (রঞ্জন দত্ত) সঙ্গে চলত দীর্ঘ আলোচনা। আস্তে আস্তে এক সত্যিকারের 'সিনেমাপাড়া দিয়ে' নির্মাণ সম্পূর্ণ হল। লেখা হল বাংলা চলচ্চিত্র জগতের এক অনালোচিত ইতিহাস। প্রায় তিরিশ বছরের ফেলে আসা ছায়া সুনিপুণ বর্ণনায় ফুটে উঠল নতুন আঙ্গিকের তথ্য - জীবনী। কাননদেবী থেকে ৮৫৬ পাতার পর একটি দীর্ঘ পূর্ণছেদ। উত্তমকুমারের মৃত্যু দিয়ে।

ঘটনাচক্রে, প্রথম দেখা করতে গিয়েছিলাম ২০০৭-০৮-এ। এন টি ওয়ান স্টুডিও। আমি আর ঝিলদা (বিক্রম সরকার)। আমার কোনো কাজ ছিল না। শুধুমাত্র সঙ্গ দিতে আর একবার কাছ থেকে দেখার ইচ্ছে। লোভ ছিল স্টুডিওপাড়া কেমন হয়, সেই কৌতূহল। এন টি ওয়ানে তখন ছিল বিভিন্ন পরিচালকদের ছোটো ছোটো অফিস। বাংলা সিনেমামাখা ছায়া ছায়া ওয়েদার। ঝিলদার কথা বলা হয়ে গেলে বেরিয়ে যাওয়ার মুখে বললাম - "আচ্ছা - চিল কী সত্যিই এত বন্ধু হয় মানুষের?" তরুণবাবু একটু চমকে উঠে গম্ভীরভাবে বললেন - "কেন?" না মানে, 'একুশ শতক' পত্রিকায় আপনার 'হায় চিল' লেখাটা পড়ে মুগ্ধ হয়েছি। খুব উদাসীনভাবে বললেন আপনি পড়েছেন লেখাটা? আমি বললাম হ্যাঁ। আরও এরকম লেখা পড়তে চাই। আমি আমাদের সম্পাদিত ক্ষীণকায় জেলার জেরক্স অফসেটে ছাপা পত্রিকার একটা কপি দিলাম। দেখে রেখে দিলেন। জিজ্ঞেস করলেন উৎপলদা কেমন আছেন? (উৎপল চক্রবতী, অভিব্যক্তি, বাঁকুড়া)। ভালো আছেন বলে বেরিয়ে এলাম।

এক অদ্ভুত বিস্ময়ে স্টুডিওর চারিদিক ঘুরে ফিরে দেখছি। কিছুটা এগিয়ে টেকনিসিয়ান স্টুডিও। কয়েক বছর আগেই মুক্তি পেয়েছে তরুণবাবুর জনপ্রিয় সিনেমা 'আলো'। এই ছবিটি বড়ো পর্দায় আমার দেখা তরুণবাবুর প্রথম ছবি। এর বাইরে বড়ো পর্দায় আর কিছু দেখার সুযোগ হয়নি। কিছু ছবি - 'দাদার কীর্তি', 'গণদেবতা' দেখেছি দূরদর্শনে। যদিও এইসব ছবির ঘরানা আমার সিনেমা দেখার অভ্যাস থেকে একেবারে আলাদা।

কয়েক মাসের ব্যবধানে উৎপলদা বললেন - "তিমির, তরুণবাবুকে একটা বই পৌঁছে দিতে হবে। 'দুর্গেশনন্দিনী'র চিত্রনাট্যের কাজে বইটি প্রয়োজন। তুমি কলকাতা কবে যাবে?" ফোন করে তরুণবাবুকে বললাম উৎপলদা বই পাঠিয়েছেন। কীভাবে বইটি দেব?

খুব মৃদু আর শান্তস্বরে বললেন - "চলচ্চিত্র শতবর্ষ ভবনে চলে আসুন।" তখন তিনি চলচ্চিত্র শতবর্ষ ভবনে একটি ঘরে বসতেন। আমি আর ঝিলদা গেলাম। দেখলাম দো'তলার একটি ঘরে বসে একা একা লিখছেন। স্পাইরালে বাঁধানো খাতায় 'দুর্গেশনন্দিনী'র স্ক্রিপ্ট। কালো কালিতে সুদৃশ্য হাতে লেখা। বাঁদিকে অনেকটা মার্জিন। পরে হয়তো নোট লিখবেন বা পরিবর্তন করার জন্য এই বিস্তীর্ণ পরিসর ছেড়ে রাখা হয়েছে। লিখতে লিখতে হাত দেখিয়ে বসতে বললেন। কিছুক্ষণ বসে বই দিয়ে চলে এলাম।

তরুণবাবুর সঙ্গে সাক্ষাতের আবার সুযোগ এল দে'জ পাবলিশিং-এ কাজের সূত্রে। এর মধ্যে রাজ্য রাজনীতির আকাশ বদলে গেছে। চিরবামপন্থী তরুণবাবু কিন্তু তাঁর ছবি এবং আদর্শের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে একসুতোও সরে যাননি। তাঁর এই দৃঢ়চেতা মনোভাব শহুরে তথাকথিত বুদ্ধিজীবী মানুষের কাছে অবশ্য শিক্ষণীয়।

২০১৭-র ১ বৈশাখের সকালে বইপাড়ায় তরুণবাবু এলেন। সদ্য প্রকাশিত প্রথম বই 'বাতিল চিত্রনাট্য'। সাদা ধুতি সাদা পাঞ্জাবি পরে টোয়েন্টি ফোর পার সেকেন্ড ফিল্ম স্পিডে হেঁটে যাচ্ছেন বইপাড়া দিয়ে। বলেছিলেন তৃতীয় খণ্ড লিখছেন। শেষ হবে অভিনেতা তাপস পালের মৃত্যু দিয়ে। তার মাঝেই অপুদা একদিন নিয়ে এল তরুণবাবুর নতুন উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি। তাঁর সিনেমার মতোই জীবনবোধের প্রত্যক্ষ গভীরতা আর্দশের প্রতি দায়বদ্ধতা দেখা যায় তাঁর লেখার ভেতরেও। আর কোনো পয়লা বৈশাখ তিনি আসবেন না বইপাড়ায়। বইপাড়ায় জেগে থাকবে 'সিনেমাপাড়া দিয়ে' চিরন্তন।