আরেক রকম ● দশম বর্ষ চতুর্দশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ জুলাই, ২০২২ ● ১-১৫ শ্রাবণ, ১৪২৯

প্রবন্ধ

পশমিন্দা শরমিন্দা

ইমানুল হক


সঙ্ঘ পরিবার হিটলারের আদর্শে বিশ্বাসী। ওরা কমিউনিস্টদের বিদেশি মতাদর্শের কথা বলে। আসলে ওরাই সম্পূর্ণ বিদেশি ভাবধারার। জার্মানি ও ইতালির ফ্যাসিস্ট বাহিনীর অনুকরণে ওদের আরএসএস। জার্মানির এসএস, ভারতের আরএসএস। একই সঙ্গে ওটা গুপ্তচরবৃত্তির কাজ করেছে। রয়াল সিক্রেট সার্ভিস হিসেবে।

সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে চলেছে হিটলারি ঝটিকা এসএস বাহিনীর কায়দায়। এবং অনুসরণ করে চলেছে হিটলারের সঙ্গী গোয়েবলসের কথাঃ এক মিথ্যা বারবার বললে একসময় মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করবে। এবং বলবেও।

সঙ্ঘ পরিবারের সাফল্য আসলে লুকিয়ে আছে জনমনস্তত্ত্ব ব্যবহারে।

মানুষের মনের মধ্যে যে সুপ্ত সূক্ষ্ম সাম্প্রদায়িকতা লুকিয়ে আছে তাকে জাগিয়ে তোলো।

আমাদের মনে একটা অপর আছে। যে অপরকে ঘৃণা, অবজ্ঞা অথবা অনুকম্পার চোখে দেখে - সমান চোখে দেখে না।

নরেন্দ্র মোদির কথায় তাই বহু তথাকথিত প্রগতিশীলও বিচলিত হয়ে পড়েন। ভেবে দেখা দরকার।

পশমিন্দা মুসলমানদের অবস্থা খুব খারাপ।

এটা যেন মোদি বলার পর জানলেন।

ভারতে কোন মুসলিম ভালো আছেন জানতে ইচ্ছে করে?

কেউ কি নিরাপদ বোধ করেন? নিজের পছন্দের খাবার দূরে থাক কোনো ধরনের মাংস এখন ট্রেনে বসে খাওয়ার সাহস করেন? বেড়াতে যাওয়ার আগে আঁধার কার্ড ভোটার কার্ড নিয়েছেন তো? বাড়ি ভাড়া পাবেন না জানতেন, কিনতেও পারবেন না।

আগে সুবিধা বঞ্চিত মুসলিমরা নাম বলতে সাহস করতেন না, এখন উচ্চবিত্ত মুসলিমও অচেনা জায়গায় নিজের নাম বলতে চান না।

এমনকী এই পশ্চিমবঙ্গেও।

অনেকেই রাজনীতি করেন, রাজনীতি না বুঝেই।

হাউড়ের মতো।

করতে হয় করেন। বলতে হয় বলেন।

ভেতর থেকে ভাবেন না। বলেনও না।

কোনটা আসল সমস্যা বোঝার ক্ষমতা নাই থাকতে পারে, চেষ্টাও নাই।

আগে তো বুঝতে হবে, নিজের খামতিটা, পরে তো প্রতিক্রিয়া দেখাবেন।

প্রতিক্রিয়া আছে। ক্রিয়া নেই।

মহারাষ্ট্রে শিবসেনা কংগ্রেস জোটে কিছু জনের আপত্তি ছিল। সবচেয়ে বেশি ছিল সঙ্ঘ পরিবারের। বিজেপির। মোদির। অমিত শাহের।

সেই আপত্তির সঙ্গে মিলেছিল কিছু প্রগতিশীল কন্ঠও।

মহারাষ্ট্রে উদ্ধব ঠাকরে আর মুখ্যমন্ত্রী নেই। শিবসেনার আরেকটি অংশ ইডি - আয়কর - সিবিআই তদন্তের ভয়ে বিজেপির সঙ্গে সরকার গড়েছে।

ফল, আরেতে পরিবেশের কারণে যে প্রকল্প বন্ধ ছিল, তা ছাড় পেয়েছে। এবং পুলিশ আবার সংখ্যালঘুদের হয়রানি করতে শুরু করেছে।

মাংস খুঁজছে। গ্রেপ্তার করছে।

সব খুনে জঙ্গি ও ইসলামি সন্ত্রাস খুঁজে পাচ্ছে।

যা গত আড়াই বছর বন্ধ ছিল।

এমনিতেই এই উপমহাদেশে সব বড় রাজনৈতিক দল কমবেশি ধর্মীয় নরমপন্থার আশ্রয় নিয়ে চলছে।‌

ভারত কার্যত হিন্দু আফগানিস্তান হতে চলেছে।

হিন্দু তালিবানরা বাবরি মসজিদ ধ্বংস করেছিল মুসলিম তালিবানরা বামিয়ানে বুদ্ধমূর্তি।

শ্রীলঙ্কায় সব তামিল ও মুসলিম এলাকায় প্রত্নতাত্ত্বিক অভিযান চালানো শুরু হয়েছিল, এখানেও নানা মসজিদে শিবলিঙ্গ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে।

নন ইস্যুকে ইস্যু বানিয়ে মুদ্রাস্ফীতি বেকারি ছাঁটাই আত্মহত্যা বৃদ্ধির পরিসংখ্যানকে পিছনে ফেলে দিচ্ছে।

দেশে কার্যত কোনো বিরোধী জোট নেই। শক্তিশালী বিরোধী দলও। আর বামপন্থীরা কে আগমার্কা তা নিয়ে লড়াইয়ে এত ব্যস্ত আসল লড়াই করতে গিয়ে দেখছে পিছনে তত সমর্থক নেই।

মেরুকরণের রাজনীতির পালে হাওয়া দিচ্ছে অনেকেই।

হিন্দু মুসলমান দুই মৌলবাদী শক্তি সামনে লড়ছে।‌ পিছনে গাঁটছড়া বেঁধে চলছে।

তাই হিজাব বোরখা এসব ইস্যু হয়। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বাড়ছে। বাড়ছে ধর্মীয় অনুষ্ঠান। গরিব মানুষের মধ্যেও আজকাল ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি। রেডিও টিভি সংবাদপত্র সিনেমা ধারাবাহিক - সর্বত্র ধর্ম ধর্ম।

তাকে এখন উৎসব নাম দিয়ে প্রগতিশীলরাও সামিল।

ধর্ম নিপীড়িত জনগণের দীর্ঘশ্বাস - কিন্তু এটা সমস্যা মুক্তির আশ্বাস নয়। কে বলবে।

সবাই লাইনে আছে। নানারকমভাবে।

আত্মসমর্পণের আদেশ না এলেও মানসিকভাবে আত্মহত্যা করতে সামিল অনেকেই।

বেপরোয়া মানুষ কি নেই? আছেন।

তাঁদের মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে হয়রানি করা হচ্ছে।

অনেককেই জেলে পুরে রাখা হয়েছে।

তিস্তা শীতলবাদের কথাই ধরা যাক।

গুজরাটের ডিজিপি শ্রীকুমার মোদির গণহত্যা চলতে দেওয়ার নির্দেশ ফাঁস করে দেওয়ায় বন্দি। ২৭ বছরের পুরনো মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার করে জেলে রাখা হয়েছিল আইপিএস অফিসার সঞ্জীব ভাটকে। তাঁকে জেল থেকেই আবার গ্রেপ্তার।

এবার তাতে যুক্ত করা হচ্ছে, সুপ্রিম কোর্টের আদেশ।

আমেদাবাদের তিনবারের সাংসদ কবি এহসান জাফরিকে পুড়িয়ে মারা হয় গুলবর্গা আবাসনে ঢুকে। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে গলায় টায়ার ঝুলিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়।

জাফরি সাহেব মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ফোন করেন বলেও পরিবারের বক্তব্য। ফোন করেন পুলিশকেও। কিন্তু কেউ বাঁচাতে আসেননি।

জাকিয়া জাফরি, সাংসদ এহসান জাফরির স্ত্রী মামলা করেন। তাঁকে সাহায্য করেন সাহসী সমাজকর্মী তিস্তা শীতলবাদ।

এই মামলা চলেছে ২০ বছর। ২০ বছর পর মামলা করার অপরাধে জেলে তিস্তা শীতলবাদ।

আর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলছেন, তিনি পশমিন্দা মুসলমানদের ভালো চান। ভালো তো চান! তাই বলেছিলেন, সবকা সাথ সবকা বিকাশ। কবর আর শ্মশানের তুলনাও এসেছিল তাঁর কন্ঠে। ভালো চান বলেই তো লোকসভা রাজ্যসভায় একজনও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সাংসদ নেই বিজেপির। ১৬ রাজ্যে ক্ষমতায়। কোনো বিধায়ক নেই। নেই মন্ত্রী।

কী বলছে গুরুত্বপূর্ণ। কে বলছে সেটাও যেন মাথায় থাকে।

মুসলিম সংগঠনগুলোর দাবি, দেশে ৫৫ লাখ কোটি টাকার ওয়াকফ সম্পত্তি আছে। তার রাজস্ব বা ভাড়া ঠিকঠাক আদায় করে মুসলমানদের উন্নয়নে কাজে লাগালেই হয়। রেল সেনাবাহিনী ছাড়া এত জমি আর কারো নেই। যা আছে ওয়াকফের। কলকাতাতেও বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান তৈরি ওয়াকফের জায়গায়। ভাড়া অতি অতি অতি কম।

দেশের ওয়াকফ সম্পত্তির তালিকা প্রকাশ করা খুব জরুরি।

তা না করে সংখ্যালঘুদের বৃত্তি কমিয়ে বলা হচ্ছে সংখ্যালঘু উন্নয়নের গালগল্প।

আসলে রাণা আইয়ুব, মহম্মদ জুবায়ের, নাসিরউদ্দিন শাহ, শাবানা আজমি, জাভেদ আখতার, সাবা নাকভিরা দেশে বিদেশে পরিচিত মুখ। তাঁরা মুখ খুলছেন।

মেনে নিচ্ছেন না সব কিছু। মনেও। তাই এদের বিরুদ্ধে বিষিয়ে দেওয়া মুসলিম মন। সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মনে বিদ্বেষ ছড়ানো সহজ। সহজ লড়িয়ে দেওয়া।

সূক্ষ্ম সুপ্ত সাম্প্রদায়িকতা যাদের মনে তারাও একটু নড়েচড়ে বসবেন।

কিন্তু প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ বুঝতে পারবেন, সংঘ পরিবারের আসল উদ্দেশ্য আদিবাসী দলিত সংখ্যালঘু ও গরিবের জীবনকে বিপন্ন করা।

এটা না বুঝলে নিজেও বিপন্ন হবেন।

পুনশ্চঃ উত্তরপ্রদেশে লুলু বলে এক শপিং মল খুলেছে। উদ্বোধক মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। মলের মালিক মুসলিম। সেখানে নামাজ পড়া হয়েছে, তাই অখিল ভারত হিন্দু মহাসভা বিক্ষোভ দেখিয়েছে গত ১৪ জুলাই।

বিনিয়োগকারীর ধর্ম দেখতে নেই, ভেবেছিলেন, বিষবৃক্ষের ফল ফলছে।

আবার রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী দ্রৌপদী মুর্মু নিজেকে হিন্দু বলে ঘোষণা করেছেন। রাজস্থানে আদিবাসীরা ঢুকতে পারেননি দ্রৌপদী মুর্মুর সভাকক্ষে।

এর মাঝেই এসে গেছে অসংসদীয় শব্দের তালিকা।