আরেক রকম ● দশম বর্ষ চতুর্দশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ জুলাই, ২০২২ ● ১-১৫ শ্রাবণ, ১৪২৯

প্রবন্ধ

প্রশ্ন সহজ। উত্তর কঠিন।

শেখর দাস


ইব্রাহিমকে স্বপ্নে দেখা দিলেন আল্লাহ্‌। স্বপ্নে আল্লাহ্‌ জানতে চাইলেন, তিনি তাঁর (আল্লাহ্‌র) জন্য কতটা ত্যাগ করতে পারেন। ইব্রাহিম বললেন তাঁর সবটা, সবকিছু আল্লাকে দিয়ে দিতে পারেন। আল্লাহ্‌ প্রশ্ন করলেন, সবথেকে ভালবাসার জিনিসটাও দিয়ে দিতে পারেন কিনা? ইব্রাহিম নির্দ্বিধায় হ্যাঁ বললেন। তখন আল্লাহ্‌ জানতে চাইলেন তাঁর সবথেকে প্রিয় জিনিসটা কী। ঘুমের মধ্যে ইসমাইলের নামটা মুখে এল ইব্রাহিমের। তাকে কুরবানি দিতে পারে কিনা জানতে চেয়েই মিলিয়ে গেলেন আল্লাহ্‌। ঘুম ভেঙে গেল ইব্রাহিমের।

ঘুম ভাঙতেই কেমন যেন পাগলের মতো হয়ে গেলেন ইব্রাহিম! আল্লাহ এ কী পরীক্ষায় ফেললেন তাঁকে। ইসমাইল - ফুটফুটে ছেলেটা তাঁর - তাকেই চাইছেন আল্লাহ্‌! কীভাবে দেবেন? আল্লাহ্‌ চাইলে নিজের জীবন হাসতে হাসতে দিয়ে দিতে পারেন, কিন্তু ইসমাইল! কিন্তু না দিয়েই বা পারেন কী ক’রে? আল্লাহ্‌ চেয়েছেন! পরমবিশ্বাসী ইব্রাহিম জানেন আল্লাহ্‌র দ্বারা তাঁর কোনো ক্ষতিই হতে পারে না, তাঁর যে কোনো সঙ্কটে তিনিই তো ভরসা! আবার বাপের মনও বুঝ মানতে চায় না, যদি...। অস্থির ইব্রাহিম ছটফট করতে থাকেন। আব্বার ওইরকম অস্থির দশা তেরো বছরের সু-দীর্ঘ জীবনে কোনদিন দেখেনি ইসমাইল! চিন্তামগ্ন শিশু আব্বাকে কারণ জানতে চাইল। চোখের পানিতে ভাসতে ভাসতে ইব্রাহিম সব কথা বললেন শিশুকে।

স্বপ্ন-কথা শুনে ইসমাইল তো লাফিয়ে উঠলো - আব্বাকে বলল, তার তো পরম সৌভাগ্য! আল্লা ডেকেছেন তাকে - সে তো খুব আনন্দের কথা। ওইরকম ভাগ্য ক’জনের হয়? নরম হাত দুটো দিয়ে চোখ মুছে দিয়ে আব্বাকে একটু বকেই দিল ইসমাইল। তারপর তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল সে। আব্বা ইব্রাহিমকে ঘরে রেখে অনুগত ইব্রাহিম চলতে লাগল ছেলের পিছু পিছু! তাঁর জীবনের আজ সবথেকে বড় ইমতেহান - পরীক্ষা।

মোরিয়া পাহাড়ে গিয়ে ইসমাইলের হাত দু’টো পিছমোড়া ক’রে বেঁধে একখণ্ড পাথরের ওপর শুইয়ে দিলেন ইব্রাহিম। বেঁধে নিলেন নিজের চোখও। খোলা চোখে ওই শিশুকে কুরবানি দেয়া তাঁর পক্ষে না-মুমকিন। একটু অপেক্ষা ক’রে আল্লাহ্‌কে স্মরণ করেই চালালেন অস্ত্র। আল্লাহ্‌ ততক্ষণে জিব্রায়েল-পরীর হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন একটা মেষ। অস্ত্রের আঘাতে কুরবানি হলো পশুটি।

তামাম দুনিয়ার মুসলিমদের প্রধান উৎসব ঈদ অল-ফিতর এবং ঈদ উল-আধা। ইসলামি ক্যালেন্ডারের শেষমাস জিলহজ। সে মাসের ১০ তারিখ ওই মিথ-কুরবানি স্মরণে পালিত হয় ঈদ উল-আধা। শতশত বছর ধরে চলে আসছে এই পরব। যে পরবে বিদেশের মানুষ দেশে ফেরেন, ঘরে ফেরেন বাইরে কাজে-যাওয়া মানুষ। বাচ্চা-বুড়ো, আমীর-গরিব, নারী-পুরুষ, বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী নির্বিশেষে সকলেই মেতে ওঠেন আনন্দে। ঈদ্গাহ্‌, মসজিদে গিয়ে সবাই একসাথে নামাজ পড়েন। তারপর চলে কুরবানি। তারপর কুরবানির মাংস বিলিবণ্টন। দুঃখ, গ্লানি, হতাশা সবকিছু পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাবার জন্য এক হৈহৈ রৈরৈ উৎসবে মেতে ওঠেন সকলে।

সত্যিই কি সকলে মেতে ওঠেন? না। দুর্যোগ অনেক সময়েই কেড়ে নেয় উৎসবের সুযোগ। যেমন, এবছর সুযোগ হারালেন শ্রীনগরের কিছু মানুষ।

জম্মু-কাশ্মীরের মানুষদের কাছে রাজধানী শ্রীনগরের অতি প্রাচীন জামিয়া মসজিদ অত্যন্ত আবেগের এক স্থান। শুধু ধর্মের কারণেই নয় - সেই ১৪০২ খৃস্টাব্দ থেকে সামাজিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা বিভিন্ন কারণে কাশ্মীরের মানুষদের কাছে জামিয়া মসজিদের আবেদন অত্যন্ত গভীর। কাশ্মীরের ইতিহাসে, প্রতিদিনের যাপনে ওই মসজিদের কর্মকাণ্ড ওতোপ্রোতভাবে জুড়ে রয়েছে। তাই ওইরকম একটা স্থানে, বিশেষ ক’রে উৎসবের দিনে মেলার আকাঙ্ক্ষায় সকলেই সারাবছর ভক্তমানুষ অপেক্ষায় থাকেন। এ বছরও (১০ জুলাই) বহু মানুষ জামিয়া মসজিদ সংলগ্ন ঈদ্গায় ঈদের নামাজ পড়ার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। সলতে পাকানো যখন শেষ, উৎসবের আগের রাতে (৯ জুলাই) প্রশাসনের তরফ থেকে জামিয়া মসজিদের পরিচালন কমিটি আঞ্জুমান ওয়াকফকে জানিয়ে দেওয়া হয় নিরাপত্তার কারণে সকাল ৭টার মধ্যে নামাজ শেষ করতে হবে! আঞ্জুমান ওয়াকফ অনেক আগেই ঠিক ক’রে রেখেছিল আবহাওয়া ভাল থাকলে সকাল সাড়ে ১০টায় ঈদ্গাহ্‌তে, নইলে ওই একই সময়ে জামিয়া মসজিদে নামাজ পড়া হবে। কিন্তু ওই সময়ে প্রশাসনের বড্ড ভয়। আবার বাচ্চা-বুড়ো সকলে মিলে ভোরবেলা মসজিদে হাজির হয়ে, সকাল ৭টার মধ্যে নামাজ পড়ে মসজিদ ফাঁকা ক’রে চলে যাওয়া অসম্ভব, তাই আঞ্জুমান উৎসব বাতিল ক’রে দিতে বাধ্য হয়।

কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত হওয়া কাশ্মীরে এই ঘটনা অবশ্য প্রথম নয়। এ বছরই পবিত্র রামজান মাসে ওই জামিয়া মসজিদে সাব এ-কাদির উদ্‌যাপন করতে দেওয়া হয়নি। রামজান মাসের ২১, ২৩, ২৫, ২৭ এবং ২৯তম দিনগুলি ইসলাম ধর্মের মানুষদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র। পবিত্রতম ২৯তম দিনটি। যাকে বলা হয় সাব এ-কাদির। সেদিন মসজিদে মসজিদে সারাদিন-সারারাত ধরে কোরান পাঠ হয়। পণ্ডিত মানুষেরা কোরানের বিভিন্ন ধারা ব্যাখ্যা করেন। প্রাজ্ঞ মানুষদের সাথে আলাপ-আলোচনায় আম-আদমি তাঁদের মনের ভুলভ্রান্তি দূর ক’রে নেন। সারারাত ধরে চলে প্রার্থনা। পবিত্র রাতে আল্লাহ্‌র কাছে সুখ, সমৃদ্ধি, শান্তি প্রার্থনা করেন মানুষ। কিন্তু অশান্তির আশঙ্কায় জামিয়া মসজিদের সেদিনের উৎসবও নিষিদ্ধ ক’রে দিয়েছিল প্রশাসন। এমনকি, রামজান মাসের বহু আকাঙ্ক্ষিত শেষ শুক্রবারের নামাজও ওই মসজিদে কাউকে পড়তে দেয়া হয়নি।

অথচ অমিত শাহ্‌ প্রায় নিয়ম করেই জম্মু-কাশ্মীরের শান্তির কাহিনি বিশ্ববাসীকে শুনিয়ে যাচ্ছেন। ৫ আগস্ট (২০১৯)-এর পর থেকে কাশ্মীর পরিস্থিতির নাটকীয় উন্নতির কথা শুনে শুনে বাকি-ভারত উৎফুল্লও হচ্ছে। বিশেষ ক’রে বন্যার জোয়ারের মতো পর্যটকদের উপস্থিতি শুধু অর্থনীতি নয়, আইনশৃঙ্খলারও সু-স্বাস্থ্যরই ইঙ্গিত দেয়। এবং অনেক অবিশ্বাসীও ভাবতে শুরু করেছেন অস্ত্রই কাশ্মীর-অসুখের উপযুক্ত ঔষধ।

জম্মু-কাশ্মীরের সৈন্য সংখ্যা বহু চর্চিত। দুনিয়ার কোনো প্রান্তে দেশের সরকার দেশের মানুষের বিরুদ্ধে এতো সেনা নিযুক্ত করেনি। কোনো যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরে তামাম দুনিয়ার আর কোথাও এতো সেনা-ঘনত্ব নেই। যদিও হাজার চেষ্টা করেও ওই ভূখণ্ডে কতো সেনা মজুত রয়েছেন তা জানা যায়নি। হয়তো সরকারের হাতেও সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তাই নানারকম গুজব রটে। কেউ বলেন জম্মু-কাশ্মীরে প্রতি ২০ জন মানুষ পিছু ১ জন সেনা। কেউ বলেন সেনা-ঘনত্ব আরও বেশি। যাহা রটে তার কিছু তো বটে! যেখানে সাধারণ মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করছে বুলেট-বেয়নেট সেখানে অশান্তি হবার কথাও নয়। তবু নিরস্ত্র মানুষ ধর্মচর্চায় বাধা পেলেন। কেন? অতো সেনা দিয়েও নামাজের সম্ভাব্য অশান্তি রোখা যেত না? সরকারের এই মনোভাব কি আমাদের সেনাবাহিনীর ক্ষমতাকেই অসম্মান করছে না? কিন্তু ভারতীয় সেনাবাহিনীর অসীম ক্ষমতার পরিচয় যুদ্ধের ময়দান থেকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ সব পরিস্থিতিতেই আমরা পেয়েছি। ওই কাশ্মীরেই, ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যেই এবছর চলছে দুর্গম অমরনাথ তীর্থ দর্শনের কাজ। মেঘভাঙা প্লাবনে সবকিছু ভেসে গেলেও ওই দুঃসাহসী সেনাদের ভরসায় রাতারাতি আবার শুরু হয়ে গেছে তীর্থযাত্রা। ওইপথে লক্ষ লক্ষ ভক্তমানুষ পুণ্য অর্জন করবেন, পুজো দেবেন দেবতার সামনে। অথচ, অপেক্ষাকৃত সুগম শ্রীনগরে, একটা অতি পবিত্র মসজিদে মানুষকে নামাজ পড়তে দেয়া হচ্ছে না। নিয়মিত। অশান্তির ভয়ে। কেন?

প্রশ্নগুলো সহজ। উত্তরও তো জানা।

সেই মহারাজ রঞ্জিত সিংহের আমল থেকেই 'কুরবানি' দিয়ে চলেছেন কাশ্মীরের মানুষ। হয়তো আরও আগে থেকে। আজও আল্লাহ্‌ তাঁদের স্বপ্নে হাজির হন। জানতে চান কী কুরবানি তাঁরা দিতে পারেন। কাশ্মীরের মানুষ তাঁদের সবকিছু, সবটা আল্লাকে দিতে পারেন। দিয়েও চলেছেন। হাজারে হাজারে ইসমাইলকে কুরবানি দিয়ে চলেছেন কোনো জিব্রায়েলের অপেক্ষায়। কবে আসবেন তিনি?

এই উত্তরটা কঠিন?