আরেক রকম ● দশম বর্ষ চতুর্দশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ জুলাই, ২০২২ ● ১-১৫ শ্রাবণ, ১৪২৯

প্রবন্ধ

ঠিকা ফৌজি

কালীময় মৈত্র


ঠিকা বিষয়টি কিছুটা গোলমেলে। মোটের ওপর ঠিকা শ্রমিক বলতে আমরা বুঝি যারা দিনের হিসেবে মজুরী পান। বিষয়টি সাম্প্রতিক বিশ্বব্যবস্থায় মোটেই অপরিচিত নয়। সরল কল্যাণকামী ভাবনায় একজন মানুষের জীবন এবং জীবিকার দায়িত্ব নেয় দেশ। সভ্যতা যত এগোয় তত সমাজ দুর্বলের দায়িত্ব নেবে এমন একটা ভাবনাই মাথায় আসে। কিন্তু বাস্তব তেমন নয়। ফলে অগ্নিপথে দগ্ধ হয়ে অগ্নিবীর যখন দেশরক্ষার দায়িত্ব নেবেন, সেই চুক্তিভিত্তিক উত্তাপের অভিঘাত তার মননে কি পরিমাণ হতাশা এবং অস্থিরতার সৃষ্টি করবে, তা নীতি নির্ধারকদের অঙ্কে এসেছে কিনা জানা নেই। ক্ষমতাশালীদের পক্ষে সাধারণ মানুষের যন্ত্রণা উপলব্ধি করার মতো মানবিক বৈশিষ্ট্য অনুশীলন করা কঠিন। তাই অগ্নিপথে হাঁটা অগ্নিবীরদের চুক্তিপত্রে ঠিকা ফৌজির শ্রেণীবৈষম্যের রূঢ় এবং নগ্ন রূপ কতটা মুখ লুকিয়ে থাকবে সেই বিতর্ক প্রাসঙ্গিক। সামরিক বাহিনীতে যোগদান করার প্রস্তুতিপর্বে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশের তরুণ-তরুণীরা কঠোর পরিশ্রম করেন। এই চাকরি মূলত জওয়ানের।

'চাকরি' শব্দটির ব্যবহারে আমাদের সচেতনতা সাবলীল নয়। কোনো কাজ করে বেঁচে থাকার রসদ সংগ্রহ মানুষের প্রথম এবং প্রধান কাজ। সেই কাজের নিরাপত্তাও একই রকমের গুরুত্ব পাওয়ার দাবি রাখে। তবে আমাদের রাজ্য, আমাদের দেশ, এবং অবশ্যই বিশ্বের অনেকাংশেই বর্তমান আর্থসামাজিক পরিস্থিতিতে জীবিকা অর্জন এবং বৃত্তির নিরাপত্তা, এই দুটি বিষয় শাসকগোষ্ঠীগুলির অভিধান থেকে বিলুপ্তপ্রায়। বিশেষ করে অগ্নিপথ প্রকল্প এবং অগ্নিবীরদের জয়গাঁথা নিয়ে শাসককুল এবং কর্পোরেট জগতের উদ্বাহু নৃত্য যুক্তিবাদী এবং চিন্তাশীল শ্রেণীর কাছে উদ্বেগের বিষয়। এই প্রকল্পের খুঁটিনাটি এর মধ্যেই জেনেছেন দেশের জনগণ। সেই নিয়োগের প্রস্তুতিও চলছে। ফলে গোটা বিষয়টি বর্ণনা করে শব্দ খরচ করার প্রয়োজন নেই।

শুরুতেই বলা দরকার যে সাড়ে সতেরো থেকে একুশ বছরের টগবগে যুবক যুবতী অগ্নিপথে হাঁটা সম্পন্ন করে স্থায়ী চাকরির দোরগোড়ায় পৌঁছনোর সময়ই কিন্তু বিদায়ের দিন গোণা। এ বছর হইচই-এর পর উর্দ্ধসীমা তেইশ অবধি বেড়েছে। তবে যাহা একুশ, তাহাই তেইশ, কারণ সাধারণভাবে চারের মধ্যে চাকরি পাবেন এক, বাকি তিন-এর কাছে বিষয়টা ঠিকাদারের অধীনে অস্থায়ী চুক্তিভিত্তিক কাজের মতো। এবার প্রশ্ন হল, এই যে উদ্বেল তারুণ্য সে কি প্রথম দিন থেকেই বিদায়ের মুহূর্তের হিসেব করবে, নাকি দেশপ্রেমের আবেগে জীবন উৎসর্গ করার ব্রত নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে? পরের প্রশ্ন এই ধরণের পরিকল্পনার কারণ কি? একটি যুক্তি হতে পারে যে সামরিক খাতে বেতন এবং পেনশন বাবদ ব্যয় মোট বরাদ্দের একটা বড়ো অংশ নিয়ে নিচ্ছে। ফলে টাকা কম পড়ছে উন্নত সাজসরঞ্জাম বা আধুনিক প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে। সুতরাং স্থায়ী চাকরির সংখ্যা কমিয়ে দেওয়া একটি সহজ পাটিগণিত বৈকি। কিন্তু তা তো মোটেই কল্যাণকামী রাষ্ট্রের রূপরেখা নয়। সেইখানেই বর্তমানের বিজেপি শাসিত কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি নিয়ে তীব্র সমালোচনার ক্ষেত্র প্রস্তুত। প্রতিরক্ষার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে মাত্র মাত্র চার বছরের জন্যে ছেচল্লিশ হাজার যুবক যুবতীকে মাসে চল্লিশ হাজার টাকা মত মাইনে দিয়ে রাখা হবে। তার পরেই বেশিরভাগ অংশের জন্যে বিদায়কালীন উপহারসহ গালভরা সোনালী করমর্দন। হাতে দেওয়া হবে এগারো লাখের কিছু বেশি। সোনালী চুক্তি শেষে একদল প্রশিক্ষিত ঠিকা ফৌজির সামনের বিশাল ফাঁকা ক্যানভাসে তখন কোন যুদ্ধের প্রস্তুতি? ততদিনে বর্তমান বাজারমূল্যে এগারো লাখ কিন্তু আর্দ্ধেক। এইভাবে আগামী দশ বারো বছরের মধ্যে সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কয়েক লাখ কর্মঠ যুবক যুবতী ভিড় করবেন নতুন কর্মসংস্থানের আশায়।

গড়ে যেখানে পঞ্চাশ-ষাট হাজার স্থায়ী নিয়োগ হয় সেনাবাহিনীতে, গত দু'বছরে কোভিডের যুক্তিতে তা বন্ধ ছিল। তার মানে সরল ঐকিক নিয়মে এক লক্ষ শূন্যপদ তো ছিলই। বছরে পাঁচ লক্ষ টাকা একজনের পেছনে খরচ হলে মোট টাকার পরিমাণ হয় পাঁচ হাজার কোটি। তাই সরল অঙ্কে এই প্রশ্ন তো আসবেই যে এই পাঁচ হাজার কোটি ব্যয় হল কোন প্রশিক্ষণে, কোন আধুনিক সমরসজ্জায়? সামরিক জাতীয়তাবাদ বর্তমানের কেন্দ্রীয় সরকারের স্বাভাবিক চরিত্র। অনেক দেশেই এমন হয়। কিন্তু সেখানেও রাষ্ট্রবাদের অগ্নিপথ সঠিকভাবে অনুশীলন করছেন কি দেশনেতারা? স্বচ্ছ থাকছে কি বিদেশ থেকে অস্ত্রের কেনাকাটার হিসেব? মনে রাখতে হবে যুদ্ধ ছাড়া কিন্তু সেই অস্ত্রের ব্যবহার খুবই কম। বড়জোর প্রজাতন্ত্র দিবসের প্যারেডে। অন্যদিকে মানুষের হাতে টাকা এলে কিন্তু চাঙ্গা হত বাজার। সে পথে না এগিয়ে ব্যাঙ্ক, বীমাক্ষেত্র, অন্যান্য সরকারি ক্ষেত্রের বিলগ্নিকরণ এবং চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ একেবারেই ঠুনকো পুঁজিবাদের অংশবিশেষ। সেইখানেই বিজেপির চিন্তনদল আরএসএস-এর কাছে প্রশ্ন থাকবে যে তাহলে হিন্দু সামরিক জাতীয়তাবাদ কি মাথা নোয়াচ্ছে বন্ধু শিল্পগোষ্ঠীর বেনামী পুঁজিবাদে? চুক্তিপ্রথার আড়ালে সরকারি ব্যয়ে কি প্রস্তুত করা হচ্ছে বেসরকারি ঠিকা সৈনিক, যারা আগামীদিনে সুরক্ষা দেবে বহুজাতিক সংস্থার মালিক বা উচ্চপদস্থ কর্মচারিদের? প্রশ্ন উঠছে এই কারণে যে হর্ষ কাকার বা জি. ডি. বকসির মতো অভিজ্ঞ সেনানায়কেরা প্রশ্ন তুলছেন জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের প্রধান অজিত ডোভালের নীতি নির্ধারণের স্বচ্ছতা নিয়ে। দেশের ইতিহাস, দেশের প্রতি সম্মান এবং আগামীদিনে সেনাবাহিনীর দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে ঠিকা ফৌজির প্রেক্ষাপটে। এখানেই কর্পোরেট সেবা ছাড়াও আর একটি প্রশ্ন উঠছে সেনাবাহিনীর গৈরিকিকরণের। পশ্চিমবঙ্গে যেমন তৃণমূল সরকারের রাজত্বে দলীয় কর্মীদের 'সিভিক ভলান্টিয়ার' নামে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের কথা উঠছে, একই ধরণে ভাড়াটে সেনাবাহিনী নিজেদের জন্যে কি বানাতে চলেছে বিজেপি? সিভিক ভলান্টিয়ারদের হাতে তাও শুধু পাকা বাঁশের লাঠি। উল্টোদিকে ভাড়াটে সৈন্যদের দখলে থাকবে অত্যাধুনিক অস্ত্রচালনার প্রশিক্ষণ। সাধারণ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রেক্ষিতে এই ধরণের সৈন্যবাহিনী সবসময়েই একনায়কতন্ত্রী শাসক কিংবা বহুজাতিক সংস্থার মালিকদের জন্যে সুরক্ষা বলয় তৈরি করবে তা বলাই বাহুল্য।

ক্লিশে হয়ে গেলেও এ প্রশ্ন তো তুলতেই হবে যে বিশ্বজুড়ে আর্থিক বৈষম্য ক্রমাগত বাড়ছে। অপুষ্টিতে ভোগা মানুষের সংখ্যা গত এক দশকে বেড়েছে তিনশো কোটির বেশি। গোটা বিশ্বে অন্তত দশ শতাংশ মানুষ অনাহারে থাকে। আমাদের দেশে অনাহারে থাকা, অপুষ্টিতে ভোগা মানুষের সংখ্যা পরিযায়ী শ্রমিকদের সংখ্যার মতই অস্পষ্ট। পরিসংখ্যান বড়ো গোলমেলে। তবে এ প্রশ্নের উত্তর প্রয়োজন যে ভারতে একশো কোটি মানুষ কি দিনে নিজের চাহিদামতো পুষ্টিকর খাবার পেতে পারেন? কোভিড পরিস্থিতিতে দশ কোটির মতো মানুষ এ দেশে কাজ হারিয়ে দু'বেলা পেটভরা খাবার পাচ্ছেন না একথা কি সত্যি? এই প্রশ্নগুলো তোলার উদ্দেশ্য একেবারে সরল। চরম অর্থনৈতিক বৈষম্য যে সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করতে পারে এটা জানেন আজকের শাসকগোষ্ঠী। সেই জনমত বিস্ফোরণের আশঙ্কাই হয়ত তথাকথিত নব্য উদারবাদের প্রবক্তাকুলের কাছে অশনি সংকেত। কাছের দেশ শ্রীলঙ্কাতেই শাসকের ব্যর্থতার ছবি স্পষ্ট। এই সামাজিক অস্হিরতার মধ্যে আগামী কয়েক বছরে লক্ষাধিক সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ঠিকা বাহিনী শ্রমদানের বেসরকারি বাজারে ভিড় করবে। অল্প মজুরীতে তাদের নিয়োগ করতে কর্পোরেট দুনিয়ার এতোটুকু বিলম্বিত বোধোদয়ের কারণ নেই। তাই কোভিড পেরোতেই হয়তো পরিকল্পনার রূপায়ণ হল। সেই প্রেক্ষিতেই আসতে পারে চরম সামাজিক বিপদ।

এই মুহূর্তে কিন্তু ভারতে কোনো বেসরকারি সামরিক বাহিনী নেই। কিন্তু গত দু'দশকে মধ্যপ্রাচ্য, লাতিন আমেরিকা এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে এই ধরনের ব্যবস্থা বর্তমান। সেসব জায়গায় রাজনীতির অস্থিরতা কোন জায়গায় পৌঁছেছে তা সকলেই জানেন। আমাদের দেশে বিভিন্ন ধর্মীয় সংস্থা এবং অতি ডান বা অতি বাম রাজনৈতিক দলগুলির প্রশিক্ষিত সশস্ত্র বাহিনীর কথা অজানা নয়। তথাকথিত ধর্মগুরু রাম রহিম অথবা তাদের 'দেরা সাচা' নামের বাহিনী, এসব উদাহরণ চরম বাস্তব। তারা যে কি ভয়ঙ্কর গোলমাল পাকাতে পারে সেকথা সকলেই জানেন। এমন আরও অনেক ধর্মগুরু আছেন যাদের কাছে বিশেষ বিশেষ রাজনৈতিক দলের টিকি বাঁধা। এভাবেই তো লেঠেল থেকে আগ্নেয়াস্ত্র বহনকারী বাহিনীতে উত্তরণের ইতিহাস তৈরি হয়। উচ্চবর্ণের জোতদারদের 'রণবীর সেনা' নামক বাহিনীর কথাও আসবে উদাহরণে। আধা সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সরকারি বাহিনী থেকে অবসরপ্রাপ্ত চুক্তিহীন সৈনিক দেশের প্রভুদের সেবায় নিবেদিত প্রাণ হলে তো আর সেই ঠিকা ফৌজিকে দায়ী করা যায় না। এইসমস্ত জায়গায় যদি চাকরি হারানো অল্প কয়েকজন অগ্নিবীরও হতাশ হয়ে যোগ দেন, দেশের পক্ষে তা সমূহ বিপদ। সামাজিক এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার এই ফ্র্যাঙ্কেস্টাইন সংসদীয় গণতন্ত্রের উদ্বেগ বাড়ানোটাই স্বাভাবিক। পাকিস্থান বা আফগানিস্থানে যে ধরনের সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ ঘটে তার থেকে অনেক ভালো আছি আমরা। সেই কারণেই সতর্ক থাকা প্রয়োজন দেশবাসীর। এই লেখা প্রস্তুতির সময়ের অবশ্যই একটি ইতিবাচক খবর যে, এগারোই জুলাই তারিখে এই পরিকল্পনা নিয়ে সংসদীয় কমিটির বৈঠকে আলোচনা হয়েছে।

আসলে ডেমোক্রেসি থেকে ডেমোটোক্রেসিতে অবতরণের সময় দেশের মানুষকে বাদ দিয়ে দেশে উন্নয়নের খোয়াব দেখে শাসকদল। বিতর্ক থাকলেও, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ সমাজ এবং রাষ্ট্রের ইতিবাচক বিবর্তনের অংশ হবে এটাই ছিল স্বাধীনতার পর আমাদের দেশনেতাদের সামগ্রিক ভাবনা। অর্থাৎ জাতীয়তাবাদ সেখানে সাধারণ মানুষের উন্নয়নে বাধা হবে এমনটি কেউ ভাবেননি। আজ কিন্তু স্বাধীনতার পঁচাত্তর বর্ষপূর্তিতে দেশের প্রাকৃতিক এবং মানবসম্পদকে কর্পোরেটের হাতে তুলে দেওয়ার উদাহরণ প্রচুর। সেখানেই অগ্নিবীরের সিঁদুরে মেঘ দেখে ডরানোর কারণ আছে। যারা সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন, তাদের সাধারণভাবে সরকার পরামর্শ দেয় যে তারা যেন কোন দেশবিরোধী বা সন্ত্রাসবাদী বাহিনীকে প্রশিক্ষণে যুক্ত না হয়ে পড়েন। সেই সহজ সত্যটুকুকেও কি অস্বীকার করছে সরকার? মনে রাখতে হবে বিজেপি ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে গড়ে ওঠা একটি রাজনৈতিক দল। তারা যদি অতি দক্ষিণপন্থী ভাবনা নিয়ে চলে, সেক্ষেত্রে উল্টোদিকে অতি বাম ভাবনাও বাড়বে প্রচণ্ড। এই জায়গাতে ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে গড়ে ওঠা সংসদীয় বাম দলগুলির গুরুত্ব অপরিসীম। বিরোধী দলগুলির লাগাতার কৌশল এবং বাম নেতৃত্বের দুর্বলতা আজকের সংসদে প্রতিনিধির সংখ্যা শূন্যের কাছে নিয়ে গেছে। তাই দেশ আগলানোর ভাবনা অনেকটাই বিপথে। ২০০৪ সালের পর থেকে প্রায় দু'দশক সংসদীয় বামপন্থা বারবার পিছিয়ে গেছে নির্বাচনী লড়াইতে। আজকের নীতি নির্ধারণে তাদের প্রতিনিধিত্বের অভাবে ঠিকা ফৌজির সংকট তৈরি হওয়াটাই ভবিতব্য।