আরেক রকম ● দশম বর্ষ চতুর্দশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ জুলাই, ২০২২ ● ১-১৫ শ্রাবণ, ১৪২৯

সমসাময়িক

বানভাসি বরাক এবং বিপদসীমায় জীবনযাপন


প্রলয়ঙ্করী বন্যায় ভেসে গেছে আসাম। প্রতিবেশী বাংলাদেশ। বন্যার ভয়াবহতা সর্বাধিক অনুভূত হয়েছে আসামের শিলচর শহর ও লাগোয়া অঞ্চলে। এই জল প্লাবনের অভিঘাতেই ডুবে বরাকের নদীগুলির নিম্ন অববাহিকা অঞ্চল বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চল। সিলেটের বন্যার জন্যে শুধু বরাকের প্লাবন নয় মেঘালয়ের অতিবৃষ্টিও দায়ী। এমনিতে বরাক উপত্যকা বা সিলেটে বন্যা কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। বৃষ্টিপ্রধান এই অঞ্চলে বন্যা সম্বৎসরের ঘটনা। প্রতি বছরই বন্যা হয়। কখনো একাধিক বারও হয়। জলপ্লাবিত অঞ্চলের দুর্দশাগ্রস্ত মানুষ অপেক্ষাকৃত উঁচু অঞ্চলের অস্থায়ী আশ্রয় শিবিরগুলিতে যেতে বাধ্য হয়। জল নেমে এলে তাঁরা ফিরে আসে আবার নিজেদের ঘরবাড়িতে। বাৎসরিক বন্যার সাথে এই অঞ্চলের জীবনযাপনের একটা স্বাভাবিক সম্পর্ক থাকলেও প্রতি বছরই বাসস্থানের মেরামতিতে পর্যাপ্ত সরকারি সাহায্যের অভাব, অস্থায়ী আশ্রয় শিবিরে অপ্রতুল সরকারি ত্রাণ ও স্বাস্থ্য সহায়তার অভাবে মানুষ দুর্দশা ক্লিষ্ট হয়। তারপরও এই অঞ্চলের জীবনধারার সাথে বন্যার একটা সহজাত সম্পর্ক রয়েছে। এই অঞ্চলের বিশিষ্ট কবি বিজয় কুমার ভট্টাচার্যের ভাষায়, বিপদসীমায় জীবনযাপন।

বাৎসরিক বন্যার আসা যাওয়ার মধ্যেও হঠাৎ কোনো কোনো বছর বন্যা ভয়ঙ্করী রূপ ধারণ করে। বৃষ্টি তখন স্বাভাবিক মাত্রা ছাড়ায়, জলপ্লাবনও স্বাভাবিকতা ছাড়িয়ে যায়। খাল বিল হাওর মাঠ ভরে গেলে নদীর জলস্তরও অস্বাভাবিক পর্যায়ে চলে যায়। তখন বন্যা প্রতিরোধী বাঁধ উপচে শহর গ্রামে জল ঢোকে। কোনো কোনো জায়গায় বাঁধে ফাটল ধরে। কোনো কোনো জায়গায় বাঁধ ভেঙে যায়। বরাক উপত্যকার সাথে অবশিষ্ট ভারতের রেল ও সড়ক সংযোগ ছিন্ন হয়। আকাশপথে চলাচলও স্বাভাবিক থাকে না কারণ বিমান বন্দরের সাথে সংযোগের রাজপথও চলে যায় জলের তলায়। গত একশ বছরে এমন ভয়ঙ্কর বন্যা হয়েছে অন্তত দশবার। বরাক উপত্যকার লোক স্মৃতিতে সবচেয়ে বেশি চর্চিত হয় ১৯২৯-এর বন্যার কথা। বিভিন্ন স্মৃতিকথায় পাওয়া যায় ওই প্রলয়ঙ্করী বন্যার সময় শিলচরের রেলস্টেশনে প্রায় ছ'ফুট উচ্চতা দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে বন্যার জল। শহরের প্রধান রাজপথ সেন্ট্রাল রোডের দু'পাশের তৎকালীন অনুচ্চ দোতলা বাড়িগুলির একতলা অবধি ডুবে গেছে বন্যার জলে। ওই রাজপথ দিয়ে চলাচল করেছে নৌকা। পাশ দিয়ে ভেসে গেছে গবাদিপশু ও মানুষের লাশ। বরাক উপত্যকায় শেষবার বড়সড় বন্যা হয় ২০০৪ সালে। পাহাড় ও সমতলের পৌনপুনিক বৃষ্টিতে একই বছরে বন্যা হয়েছে একাধিক বার।

বন্যার সমস্ত ইতিহাসকে ভেঙে দিয়েছে এবারের জল প্লাবন। বিভীষিকাময় এই বন্যা ফিরিয়ে এনেছে ১৯২৯-এর মহাপ্লাবনের স্মৃতিকে। এ বছরের মে মাসেই বরাক উপত্যকা প্রথমবার বন্যা পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। প্রথমবারের বন্যাতেই বরাকের বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চল জল প্লাবিত হয়। অস্বাভাবিক অতিবৃষ্টির ফলে বরাক উপত্যকার সাথে দেশের বাকি অংশের রেল ও সড়ক সংযোগ সম্পূর্ণ ছিন্ন হয়ে যায়। এর ফলে বরাক উপত্যকায় অত্যাবশ্যকীয় সামগ্রীর এক চরম সংকট দেখা দেয়। ডিমা হাসাও জেলার পাহাড়ে অভূতপূর্ব ভূমিধ্বস ও জল প্লাবনের ফলে বরাক উপত্যকার সাথে যোগাযোগের রেলপথ সম্পূর্ণ ভেসে যায় স্থানে স্থানে। ভেঙে পড়ে অসংখ্য রেলসেতু। সড়ক যোগাযোগের পথও বন্ধ হয়ে যায় অস্বাভাবিক ভূমিস্খলন ও পাহাড় থেকে নেমে আসা জলের তোড়ে। শৈল শহর হাফলং কখনো বন্যার শিকার হবে এ ছিল ভাবনার অতীত। বন্যার এই প্রথম পর্বেই শিলচর শহরের লাগোয়া অঞ্চলে নদী বাঁধের ক্ষয়ক্ষতি হয়। বন্যার পর বাঁধের ভেতরের অংশে দীর্ঘদিনের জলাবদ্ধতায় ক্লিষ্ট মানুষ পরিত্রাণ পেতে নদী বাঁধের অংশ বিশেষ কেটে বদ্ধ জল বের করে দেয়। জুন মাসে হওয়া দ্বিতীয় বন্যায় বাঁধের এই কাটা অংশ দিয়ে প্রবল বেগে নদীর জল ঢুকে পড়ায় খুব অল্প সময়ের মধ্যে শিলচরের দক্ষিণ ও মধ্য দক্ষিণ অংশ খুব অল্প সময়ের মধ্যে জলের তলায় চলে যায়। শহরের অভিজাত এলাকাগুলির একতলা অবধি অংশ জলের তলায় চলে যায়। কাঁটা বাঁধের অংশ ছাড়াও সন্নিহিত আরো বেশ কিছু অঞ্চলে নদীবাঁধ উপচে জল ঢুকে পড়ে ভিতর এলাকায়। একটি জায়গায় অনেকটা জায়গা জুড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় নদীবাঁধ। একদিকে নিরবচ্ছিন্ন বৃষ্টিপাত, অন্য দিকে পাহাড় থেকে নামা নদীর জলের ঢল বিনা বাধায় শহরে ঢুকে পড়ায় গোটা শিলচর চলে যায় জলের তলায়। বিদ্যুতের ট্রান্সফরমার, মোবাইলের টাওয়ার ডুবে যাওয়ায় শহরের প্লাবিত অংশ অন্ধকারে ডুবে যায়। দ্রুতবেগে জলস্তর বেড়ে একতলা পেরিয়ে জল দোতলা ছুঁতে যাচ্ছে। আর্ত মানুষ কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারছেন না। বন্যার জলের তীব্র স্রোতে এক নৌকা বা বাঁশের ভেলা চালানো দুষ্কর। যেখানে মানুষের ডুব জল সেখানে তো প্রশ্নই নেই। যেখানে ডুব জল নয় সেখানেও জলের প্রবল তোড়ে হেঁটে যাওয়া অসম্ভব। এক দু'দিন যেতে না যেতেই খাবার জল খাদ্য ও প্রাণদায়ী ওষুধের সঙ্কট চরমে ওঠে।

অভূতপূর্ব এই সঙ্কটের সময়ে জাতীয় ও রাজ্য স্তরের সংবাদ মাধ্যম সম্পূর্ণ উদাসীন। রাজ্যের সরকার ব্যস্ত মহারাষ্ট্রের সরকার ভাঙার খেলায়। জলে ডোবা মানুষের চেয়ে তাদের দরদ তখন অনেক বেশি মহারাষ্ট্রের শিবসেনার বিধায়কদের জন্যে। মুখ্যমন্ত্রী বিধায়ক সরকারি আধিকারিক সকলেই তখন ব্যস্ত মহারাষ্ট্র নিয়ে। বরাক উপত্যকার বিধায়ক ও সাংসদরা তখন মেতে আছেন পার্শ্ববর্তী রাজ্য ত্রিপুরার উপনির্বাচনের প্রচারে। বন্যা পর্বের প্রথম বেশ কয়েকটি দিন সরকারি প্রশাসন সম্পূর্ণ অকেজো ও অনড় অবস্থায় প্রতিভাত হয়। এই দুর্গতির সময়ে সংকটাপন্ন মানুষের পাশে এসে দাঁড়ান প্রতিবেশী অঞ্চলের সাধারণ মানুষই। আশে পাশের গ্রাম গঞ্জ শহর থেকে দলে দলে তরুণ তরুণীরা ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে এসে হাজির হন শহর শিলচরে। শিলচরের শ্মশান ও গোরস্থান তখন জলের তলায়। মৃতের সৎকার করার উপায় নেই। বন্যার জলে ভেসে গেছে অনেক লাশ। একটি ভাসিয়ে দেওয়া মৃতদেহের শরীরে পরিজনেরা একটি চিঠি লিখে সহমর্মী সহনাগরিকদের কাছে শেষকৃত্যের কাতর আর্জি জানান। পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের স্বেচ্ছাসেবীরা শুধু ত্রাণ সরবরাহই করেনি। বন্যাক্রান্ত অঞ্চল থেকে মৃতদেহ নিজেদের অঞ্চলে বহন করে নিয়ে গিয়ে যথাযথ মর্যাদায় শেষকৃত্য করেছেন। একদিকে প্রকৃতির ভয়ঙ্করী রূপ ও সরকারি উদাসীনতা, অন্যদিকে সহনাগরিকদের অভূতপূর্ব মানবিক উদ্যোগ এবারের বন্যার বৈশিষ্ট্য হয়ে দেখা দিয়েছে।

প্রশ্ন উঠছে প্রকৃতি এমন ভয়ঙ্করী হয়ে উঠল কেন? জলের স্বাভাবিক স্রোত পথের ধ্বংসের মাধ্যমে নির্বিচার নগরায়ন, নিকাশী ব্যবস্থার প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ প্রদর্শন, বন্যা নিয়ন্ত্রণ দপ্তরের সীমাহীন দুর্নীতি, কাণ্ডজ্ঞানহীন অরণ্য ধ্বংস ও পরিবেশ সংক্রান্ত বিধিনিষেধের উপেক্ষা - বছরের পর বছর চলে আসা এই পাপকর্মের যোগফল হিসেবেই জলবায়ু পরিবর্তন, কোথাও অতিবৃষ্টি কোথাও অনাবৃষ্টি। এই ঘোরতর বিপর্যয়ের মুখে সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পূর্ণ দিশেহারা। দুঃখের বিষয়, এত ভয়ঙ্কর বন্যার পরও কেন্দ্রের তরফে কোনো উচ্চবাচ্য নেই। শাসক দল নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে 'ফ্লাড জিহাদ'-এর অভিনব তত্ত্ব উদ্ভাবন করে বিভেদের খেলায় মশগুল। আসামের বন্যা শুধুমাত্র একটি স্থানীয় সমস্যা নয়। সারা দেশের জন্যেই অশনি সংকেতের সমতুল। পরিবেশ ও জলবায়ু নিয়ে একই ধরনের উদাসীনতা সারা দেশেই দৃশ্যমান। এই একই বিপদ দেশের অন্য প্রান্তে নেমে এলে বিস্ময়ের কারণ থাকবে না। এর আগে আন্তর্দেশীয় জন চলাচলকে উপলক্ষ্য করে আসাম থেকে জন্ম নিয়েছে নাগরিকত্বের রাজনীতির। আজ আসামের বরাক উপত্যকা ও সিলেটের বন্যা নিয়েও শুরু হয়েছে জলস্রোতের রাজনীতি। নাগরিকত্বের মতই জলবায়ু ও নদীর জল সংক্রান্ত বিষয়গুলিরও সংকীর্ণতার রাজনীতি দিয়ে সমাধান সম্ভব নয়। এর জন্যে প্রয়োজন আন্তর্দেশীয় সংলাপ ও উদার মানসিকতার।