আরেক রকম ● দশম বর্ষ চতুর্দশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ জুলাই, ২০২২ ● ১-১৫ শ্রাবণ, ১৪২৯

সমসাময়িক

মোদী ও অশোক স্তম্ভ


অশোক স্তম্ভের সিংহ মোদীর দম্ভে হিংস্র রূপ নিয়েছে, সিংহ বলীয়ান হয়ে উঠেছে, এক ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। মহান সম্রাট অশোক যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে বৌদ্ধ এবং অহিংস মতাদর্শে বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। কিন্তু মোদী এবং আরএসএস-এর রাজনীতির ভিত হিংসা। এক ধর্মের মানুষকে অন্য ধর্মের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দিয়ে, মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ সৃষ্টি করে ভোটের গুড় খাওয়াই মোদীর রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য। অতএব, মোদীর আশীর্বাদে যদি অশোক স্তম্ভের সিংহ ভয়ঙ্কর হিংস্র রূপ গ্রহণ করে, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

আসলে অশোক স্তম্ভের এই অবমাননা এবং পরিবর্তিত রূপের মধ্য দিয়ে মোদী তথা বিজেপি-আরএসএস রাষ্ট্রের চরিত্রের যে মৌলিক পরিবর্তন তারা করছে তার একটি অবয়ব ফুটে উঠেছে। রাষ্ট্র বিজ্ঞানের প্রথম শ্রেণির শিক্ষাও আমাদের শেখায় যে আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় অস্ত্র এবং হিংসা (violence)-এর উপর একচেটিয়া আধিপত্য থাকে রাষ্ট্রের। তাই রাষ্ট্রের অহিংসায় বিশ্বাসী হওয়ার কথা নয়। কিন্তু গণতন্ত্রের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্র তার হিংস্র ছবিকে আড়াল করে এক জনকল্যাণমুখী ছবি মানুষের সামনে তুলে ধরে। বিশেষ করে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে গান্ধীজির ভূমিকা এবং অহিংসবাদী আন্দোলনের অবদানের ফলে রাষ্ট্রের চরিত্রে একটি জনমুখী ছবি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ক্ষমতা রাষ্ট্রের কাছে কুক্ষিগত থাকলেও, জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্রের কল্পনা নেহরুর হাত ধরে ভারতের রাজনীতির একটি ভরকেন্দ্র হয়ে ওঠে। এই জনকল্যাণমুখী চরিত্রের হাত ধরেই ভারতে উন্নয়ন নির্ভর জাতীয়তাবাদ গড়ে ওঠে নেহরুবাদী অধ্যায়ে, যেখানে ধর্ম-জাত ইত্যাদির ঊর্ধ্বে উঠে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ বলতে নতুন উন্নত দেশের কল্পনা ভারতীয়দের মনে প্রোথিত করার চেষ্টা দেখা যায়। তদুপরি গণতান্ত্রিক চেতনার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্র মানুষের বিভিন্ন দাবি-দাওয়ার সঙ্গে মতের আদান-প্রদানে সামিল হয়, যার মাধ্যমে অসংখ্য নতুন আইন, পুরোনো আইনের পরিবর্তন ইত্যাদি সম্ভব হয়ে ওঠে।

রাষ্ট্রের এই বিবর্তনের সঙ্গে আরএসএস-বিজেপি-মোদীর মৌলিক দ্বন্দ্ব রয়েছে। এই দ্বন্দ্বের দুইটি দিক গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, রাষ্ট্রের জনকল্যাণকামী উন্নয়ন নির্ভর জাতীয়তাবাদ মোদী জমানার মতাদর্শ নয়। জাতীয়তাবাদকে এক ক্ষুদ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদে পর্যবসিত করার চেষ্টা আরএসএস বহু বছর ধরে করে এসেছে, যা মোদী জমানায় অনেকটাই মানুষের মনে প্রোথিত হয়েছে। এই হিন্দু জাতীয়তাবাদ গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা যা ভারতের সংবিধানের প্রধান দুটি স্তম্ভ, তার পরিপন্থী। যেহেতু হিন্দু জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে এক সুবিশাল রাজনৈতিক মতাদর্শগত অবস্থান ভারতের মানুষের মনে রয়েছে, তাই এই জাতীয়তাবাদের প্রচারে ক্ষমতা এবং বলের গুরুত্ব অপরিসীম। তাই মোদীর রাষ্ট্র মানুষের মনে যে শুধু ভেদাভেদ সৃষ্টি করতে চায়, তা নয়, সেই রাষ্ট্র মানুষের মনে ভয়ের সঞ্চার করতে চায়। দ্বিতীয়ত, যেহেতু হিন্দু জাতীয়তাবাদ চরিত্রগতভাবেই অগণতান্ত্রিক, তাই গণতন্ত্রের উপর আক্রমণ মোদীর ভারতে আগের সমস্ত রেকর্ডকে ভেঙে দিয়েছে। পরিবর্তিত অশোক স্তম্ভের সিংহরা এই বার্তাই দিতে চায় যে এক হিংস্র এবং কঠোর রাষ্ট্রব্যবস্থা চতুর্দিক থেকে আপনার উপরে নজর রাখছে, এবং আপনি যদি রাষ্ট্র নির্দেশিত পথে না চলেন তবে ওই হিংস্র সিংহরা আপনার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। অতএব রাষ্ট্রকে ভক্তি করুন এবং ভয় পান। হিংস্র সিংহের সামনে অস্বস্তিকর প্রশ্ন তুলবেন না।

এই প্রচ্ছন্ন হুমকি যখন দেওয়া হচ্ছে তখন দেশের অর্থব্যবস্থার বেহাল দশা রোজ প্রস্ফূটিত হচ্ছে। আপাতত ডলারের দাম অতীতের সমস্ত রেকর্ড ছাপিয়ে আশি টাকার দোরগোড়ায়। একটা সময় ছিল যখন ডলারের দাম নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মোদী রোজ তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিতেন। কিন্তু আপাতত তার সরকারের তত্ত্বাবধানে ডলারের দাম যখন অতীতের সমস্ত রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে তখন মোদী মৌনতা অবলম্বন করাকেই তার দায়িত্ব বলে মানছেন। ডলারের দামের এই প্রবল স্ফীতির ফলে ভারতে আমদানি করা পেট্রোল-ডিজেলের দাম বাড়ছে যেখানে আন্তর্জাতিক বাজারে খনিজ তেলের দাম নিম্নমুখী। আপাতত রান্নার গ্যাসের দাম ১,০৮০ টাকা প্রতি সিলিন্ডার, যা মোদী ক্ষমতায় আসার আগে ৪৫০ টাকায় পাওয়া যেত। পাইকারি বাজারে মূল্যবৃদ্ধির হার জুন মাসে ১৫ শতাংশের উপরে। বিগত বেশ কিছু মাস ধরেই এই হার ১০ শতাংশের উপরে থাকছে। মূল্যবৃদ্ধির রেকর্ডও মোদী সরকারের আমলে ভেঙে গেছে। বিগত তিন দশকে এত বেশি মূল্যবৃদ্ধি দেখা যায়নি। অথচ সরকারের তরফে এই বিশাল মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে কোনো কথা নেই। মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। কিন্তু কোনো সুরাহা পাওয়া যাচ্ছে না। সরকার ব্যস্ত নতুন পার্লামেন্ট ভবন নিয়ে, জুবেইর এবং তিস্তার মতো কর্মীদের জেলে পাঠানো নিয়ে, সার্বিকভাবে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের উপর আক্রমণ নামিয়ে এনে সমস্ত বিরুদ্ধ স্বরকে স্তব্ধ করার মাধ্যমেই সরকার সমালোচনার জবাব দিতে চাইছে।

সরকারের এই মানসিকতার সর্বশেষ নিদর্শন নতুন 'অসংসদীয়' শব্দের তালিকা। বিজ্ঞপ্তি জারি করে বলা হয়েছে যে সংসদে দাঁড়িয়ে দুর্নীতি, ভণ্ডামি, কুম্ভীরাশ্রু, জুমলাবাজি, স্বৈরাচার, একনায়কতন্ত্র ইত্যাদি শব্দ আর ব্যবহার করা যাবে না। অর্থাৎ সচরাচর বিরোধীরা সরকারকে সমালোচনা করার সময় যেই সমস্ত শব্দ ব্যবহার করে থাকেন তা আর তারা ব্যবহার করতে পারবেন না। এরপরে আবার বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ঘোষণা করা হয় যে, সংসদ চত্বরে কোনো ধর্না বা প্রতিবাদসভা করা যাবে না। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে মোদী সংসদে প্রথমবার ঢোকার সময় সিঁড়িতে প্রণাম করে বলেছিলেন যে সংসদ গণতন্ত্রের মন্দির। আজ সেই মন্দিরের প্রাঙ্গনে গণতন্ত্রের যে প্রাথমিক শর্ত অর্থাৎ প্রতিবাদ করা এবং নিজের কথা বলার অধিকার - দুইয়ের উপরেই মোদী সরকার কুঠারাঘাত হানছে।

অতএব, অশোক স্তম্ভের সিংহের হিংস্র হয়ে ওঠায় আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। এই কাজটি অত্যন্ত পরিকল্পিত এবং সুচিন্তিতভাবে করা হয়েছে। মানুষের জীবনে যখন সমস্যা লাগাতার বেড়ে চলেছে, সেখানে গণতান্ত্রিক অধিকারকে প্রকাশ্যে হত্যা করা হচ্ছে, সংসদে বিরোধীদের কথা বলার অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, মানবাধিকার কর্মী, সত্যবাদী সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে শুধু একটি বার্তা দেওয়ার জন্য - ‘কোনো প্রশ্ন নয়’। অশোক স্তম্ভের মোদী সংস্করণের দিকে তাকিয়ে আতঙ্কিত হন। রাষ্ট্র দাঁত-নখ বার করে যখন তখন মানুষের উপর ঝাপিয়ে পড়তে পারে। এখনই একতাবদ্ধ না হলে, সরকারের এই দম্ভের বিরুদ্ধে বড় আন্দোলন সংগঠিত করা না হলে রাষ্ট্রের এই স্বেচ্ছাচারিতার উপর লাগাম পরানো সম্ভব হবে না।