আরেক রকম ● দশম বর্ষ চতুর্দশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ জুলাই, ২০২২ ● ১-১৫ শ্রাবণ, ১৪২৯

সম্পাদকীয়

মহারাষ্ট্রের ঘটনার কারণ অনুসন্ধান


মহারাষ্ট্রের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সংকটের খবরে নাটকীয়তা থাকতে পারে, ক্ষমতা দখলের লড়াই হতে পারে, কিন্তু অন্তর্নিহিত মূল কারণ কি প্রকাশ্যে এসেছে? হঠাৎ কী এমন ঘটনা ঘটল যে আড়াই বছর ক্ষমতাসীন থাকার পর শাসক গোষ্ঠীর একগুচ্ছ বিধায়ককে গোপনে এক বিদ্রোহের ষড়যন্ত্র রচনা করতে হল? কোন অজ্ঞাত কারণে স্বেচ্ছায় বন্দিজীবন বেছে নিয়ে কখনও গুজরাট আবার কখনও আসামে গিয়ে বিধায়কদের লুকিয়ে থাকতে হল? চার্টার্ড বিমানে নিয়মিত যাতায়াত, বিলাসবহুল পাঁচতারা হোটেলে বসবাস ইত্যাদির খরচ কে দিচ্ছে? কেন এতো বিপুল বিনিয়োগ? এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সংবাদমাধ্যমে নিরন্তর আলোচনা করে অনেক যুক্তি তথ্যের অবতারণা হয়েছে। টাকাপয়সা লেনদেনের প্রসঙ্গে যুক্তি সাজানো হয়েছে। পুরোনো মিত্রকে ছেড়ে এসে ঘোষিত শত্রুর সঙ্গে হাত মিলিয়ে সরকার গঠনের বিষয়টি নাকি বিদ্রোহীদের পছন্দ হয়নি। সেই অপছন্দের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে কেন যে আড়াই বছর লেগে গেল তার উত্তর নেই। তবে চূড়ান্ত বিচারে সবকিছুই হতে পারে।

তবে নবগঠিত মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকের সিদ্ধান্ত কিন্তু বুঝিয়ে দিয়েছে যে এক জঙ্গলের মালিকানা নিয়ে যত গন্ডগোল। মুম্বাই মহানগরীর পূর্ব গোরেগাঁও অঞ্চলের ১৬ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে 'আরে' অরণ্য। এখন এ এক শহুরে অরণ্য বলে বিবেচিত হলেও বাস্তবে বহুকাল ধরে এখানে অন্ততঃ ২৭টি স্থানীয় জনজাতির মানুষের বসবাস। আরে অরণ্যে বন্য জীবন এবং বিভিন্ন প্রজাতির পোকামাকড়, প্রজাপতি এবং পাখি রয়েছে। এখানে কমপক্ষে ৮৬ প্রজাতির গাছ এবং নানান প্রজাতির পাখি রয়েছে। শ'তিনেক প্রজাতির বন্যপ্রাণী আরে আরণ্যকে সমৃদ্ধ করেছে। বিশেষতঃ পাঁচটি বিরল প্রজাতির প্রাণী যা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ্ নেচার (IUCN)-এর অন্তর্ভুক্ত। এছাড়া এখানে রয়েছে বহু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। রয়েছে অষ্টম শতাব্দীর এক বৌদ্ধ শিক্ষা কেন্দ্রের অস্তিত্ব, যা 'কানহেরি কেভস্' নামে পরিচিত। আরে অরণ্যের মধ্যেই গড়ে উঠেছে 'সঞ্জয় গান্ধী ন্যাশনাল পার্ক'। সবমিলিয়ে দেশের বাণিজ্য নগরী মুম্বাইয়ের ফুসফুসের ভূমিকা পালন করে আরে অরণ্য।

আরে অরণ্যের মধ্যে অবস্থিত চারণভূমিকে ভিত্তি করে উনিশশো পঞ্চাশের দশকে গড়ে ওঠে এক ডেয়ারি, যা 'আরে ডেয়ারি' বা 'আরে মিল্ক কলোনি' নামে অভিহিত। মূলতঃ এই আরে ডেয়ারির জমি দখল নিয়ে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সমস্যার সূত্রপাত।

মুম্বাই মেট্রোর প্রস্তাবিত তৃতীয় লাইনের কারশেড কোথায় হবে? দেবেন্দ্র ফড়নবিশ মন্ত্রিসভা বিদায়বেলায় সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আরে ডেয়ারির এক প্রান্তে প্রস্তাবিত মেট্রো কারশেড নির্মাণ করা হবে। সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর করার জন্য হাজার তিনেক প্রাচীন গাছ কাটা দরকার। প্রচলিত আইনে তা সম্ভব নয়। গাছ কাটার অনুমতি চেয়ে বৃহম্মুম্বাই মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের তরফে আদালতে আবেদন করা হয়।

পরিবেশকর্মীদের উদ্যোগে মুম্বাইয়ে শুরু হয় গণ আলোড়ন। আদালতে জনস্বার্থের মামলা হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে আদালতের ডিভিশন বেঞ্চ গাছ কাটার পক্ষে সম্মতি দিলেও আইনী জটিলতার ফলে রায় দিতে হয় যে, প্রায় ৩,০০০ গাছ কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় যুক্তিযুক্ত ভাবে বিবেচনা করা হয়নি।

ইতিমধ্যে রাজ্য রাজনীতির পট পরিবর্তন হয়ে ২০১৯-এ ক্ষমতাসীন হয় উদ্ধব ঠাকরের নেতৃত্বাধীন নতুন মন্ত্রিসভা। নতুন মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকেই আরে অরণ্যে মেট্রো কারশেড নির্মাণের পুরোনো সিদ্ধান্ত বাতিল করা হল। একই সঙ্গে বদলি করা হয় মুম্বাই মেট্রোর ম্যানেজিং ডিরেক্টরকে। ওই বৈঠকেই ঠিক করা হল যে, আরে-র বদলে কাঞ্জুরমার্গ গ্রামে নির্মিত হবে মুম্বাই মেট্রোর লাইন ৩-এর কারশেড। ২০২১-এর মার্চ মাসে, মুম্বাই মেট্রোপলিটন রিজিওন ডেভেলপমেন্ট অথরিটি হাইকোর্টকে জানায় যে, কাঞ্জুরমার্গ গ্রাম আরে-র চেয়ে অনেক ভালো। কারণ কাঞ্জুরমার্গ গ্রামের সমীক্ষা থেকে জানা গেছে যে, সেখানকার ১০২ একর জমিতে মেট্রো লাইন ৩-এর জন্য কারশেড নির্মাণ ছাড়াও ভবিষ্যতের মেট্রো লাইন ৪ ও ৬ এবং প্রস্তাবিত লাইন ১৪-র এর জন্য একটি ইন্টারচেঞ্জ স্টেশন তৈরির জন্য যথেষ্ট জমি রয়েছে।

এই ডামাডোলের আবহে আদানি শিল্পগোষ্ঠী মেট্রো নির্মাণ ও পরিচালনার জন্য একটি পৃথক সংস্থা তৈরি করে। সম্পূর্ণ মালিকানাধীন সহায়ক সংস্থা। শুধুমাত্র মুম্বাই নয় সারাদেশে আরও যে সব শহরে মেট্রোর পরিকল্পনা/প্রস্তাব করা হচ্ছে, আদানি শিল্পগোষ্ঠীর নতুন সংস্থা সেইসব প্রকল্পে অংশ নিতে আগ্রহী বলেই ৫ লক্ষ টাকা মূলধন নিয়ে এই নতুন সংস্থার সৃষ্টি।

ঘটনাক্রম বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, আদানি শিল্পগোষ্ঠীর বিভিন্ন সংস্থা এইভাবেই বাণিজ্য সফর শুরু করে। উনিশশো নব্বইয়ের দশকে আরব সাগরের এক খাঁড়ির পাশে পড়ে থাকা কচ্ছ এলাকার মরুভূমিতে 'এক সিক্কায় (২৫ পয়সা) এক একর' জমি কিনে শুরু হয়েছিল আদানি গোষ্ঠীর প্রথম উদ্যোগ। গড়ে ওঠে ভারতের প্রথম বেসরকারি বড়ো (major) সমুদ্র বন্দর - মুন্দ্রা। সেই অভিজ্ঞতা ভাঙিয়ে আজ দেশের সরকারি ক্ষেত্রের অন্য তেরোটি বড়ো বন্দরের মধ্যে বারোটির রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনা আদানি শিল্পগোষ্ঠী করায়ত্ত করেছে। একবিংশ শতাব্দীর সূচনা লগ্নে আহমেদাবাদ বিমানবন্দরের পুনর্নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনার দায়িত্ব পায় আদানি শিল্পগোষ্ঠী। সেই অভিজ্ঞতায় সম্পৃক্ত হয়ে আজ দেশের ছ'টি বিমানবন্দরের পুনর্নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনা করছে আদানি শিল্পগোষ্ঠী। অস্ট্রেলিয়া থেকে আমদানি করা কয়লা ব্যবহার করে আদানি শিল্পগোষ্ঠী গড়ে তুলেছে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। প্রয়োজনে অস্ট্রেলিয়ায় কয়লা খনিই কিনে নেয়। এই ক্রয় প্রক্রিয়ায় অস্ট্রেলিয়া সরকার আইনি আপত্তি করে। কিন্তু ভারত সরকারের সময়োপযোগী হস্তক্ষেপে অস্ট্রেলিয়া সরকার বিষয়টিকে আইনানুগ করে নেয়। আর এখন তো ভারত সরকার নির্দেশিকা জারি করে জানিয়ে দিয়েছে যে, দেশের সমস্ত তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রকে তিরিশ শতাংশ আমদানি করা কয়লা ব্যবহার করতে হবে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোল ইন্ডিয়া লিমিটেড কয়লা আমদানি করবে। কোত্থেকে? অনুচ্চারিত।

মহারাষ্ট্রের সদ্য গঠিত মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে বাতিল করা হয়েছে কাঞ্জুরমার্গ গ্রামে মেট্রো কারশেড নির্মাণের সিদ্ধান্ত। পূর্বনির্ধারিত আরে মিল্ক কলোনিতেই নির্মিত হবে মেট্রো কারশেড। সেই ধারাবাহিকতায় ফিরে এসেছেন বদলি হয়ে যাওয়া ম্যানেজিং ডিরেক্টর। এবার শুরু হতে পারে নির্মাণ প্রক্রিয়ার খুঁটিনাটি কাজকর্ম। এবং কাটা পড়তে চলেছে হাজার তিনেক প্রাচীন বৃক্ষ।

দেশের পরিকাঠামো সংক্রান্ত সমস্ত শিল্প ও পরিষেবা ব্যবস্থা একটি নির্দিষ্ট শিল্পগোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়ার জন্য সরকারের সক্রিয়তা সম্পর্কে সকলেই অবহিত। সবকিছুই নিয়ম মেনে হচ্ছে। প্রয়োজনে নিয়মনীতি বদলে দেওয়া হচ্ছে। যেমন, সদ্যগঠিত মহারাষ্ট্র মন্ত্রিসভা আরে অরণ্যে মেট্রো কারশেড নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কেন্দ্রীয় স্তরে ২০০৬-এর অরণ্যের অধিকার আইন পাল্টিয়ে নতুন নির্দেশিকা জারি হয়েছে। নতুন নিয়মে কেন্দ্রীয় সরকার বনবাসীদের অনুমতি না নিয়েই জঙ্গল কেটে তার জমি শিল্পের কাজে লাগানোর ছাড়পত্র দিতে পারবে বলে অভিযোগ উঠেছে। আগের নিয়ম অনুযায়ী, জঙ্গলের জমি বেসরকারি সংস্থার হাতে তুলে দেওয়ার আগে স্থানীয় জনজাতি-বনবাসীদের সায় আছে কি না, তা খতিয়ে দেখার দায়িত্ব ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের। এখন থেকে কেন্দ্রীয় সরকার আগেই জঙ্গলের জমি বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার অনুমতি দেবে। ক্ষতিপূরণ বাবদ বৃক্ষ রোপণের অর্থ আদায় করবে। তার পর রাজ্য সরকার জনজাতি-বনবাসীদের অরণ্যের অধিকার সংক্রান্ত দাবিদাওয়া খতিয়ে দেখবে। তাদের পুনর্বাসনের বন্দোবস্ত করবে। সংসদে সংখ্যাধিক্যের সুবাদে সংশোধিত বিধিকে মূল আইনের সঙ্গে জুড়ে দিতে অসুবিধা হবে না।

সবই আইন মেনে হচ্ছে বলে আদালতের কিছু করার সুযোগ নেই। সর্বজনবিদিত অথচ অজ্ঞাত কারণে সংবাদমাধ্যম নীরব। নীতিনির্ধারকদের আশীর্বাদ ধন্য বলে প্রশাসনের হাত-পা বাঁধা। অর্থাৎ গণতন্ত্রের প্রধান স্তম্ভগুলি নিস্ক্রিয়। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি এখনই এই বিষয়ে সোচ্চার হয়ে দেশজুড়ে গণ আন্দোলন শুরু না করলে আগামী দিনে দেশের অন্যান্য রাজ্যেও এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটা অসম্ভব নয়। তখন কিন্তু বিস্ময় প্রকাশ করারও সুযোগ থাকবে না।