আরেক রকম ● দশম বর্ষ ত্রয়োদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুলাই, ২০২২ ● ১৬-৩১ আষাঢ়, ১৪২৯

প্রবন্ধ

বিবর্তিত সমাজচিত্রের দামোদর অববাহিকা

গৌতম কুমার দাস


এখনও বর্ষার জলে টইটুম্বুর হয়ে উঠলে কোথাও কোথাও ফুঁসে ওঠে কৃষ্ণবর্ণ রুদ্র দামোদর, অথবা জলস্রোত বাধা পেয়ে ঘূর্ণি চক্কর দেয় সুদর্শন চক্রের মতো, খানিক হলেও যৌবনের জয়গানে মন জয় করে নেয় অববাহিকার বাসিন্দাদের, হয়তো দামোদর নদের এমন রূপে মোহিত প্রকৃতির মাঠ ঘাট গাছগাছালি নিয়ে ফেরি করে বেড়ানো ফেরিওয়ালারা নদীকে গদ্য কবিতার বিষয় হিসেবে বেছে নেয়। প্রকৃতির ক্যানভাসে, রং তুলির আঁচড়ে দামোদর দেখা দেয় কোথাও জলে ভরা স্রোতস্বিনী, কোথাও আবার বালু চিকচিক এক মুঠো রোদ্দুর, কখনও কাশফুলের আমন্ত্রণ, কখনওবা চড়ুইভাতির বিনোদন, সব মিলিয়ে স্তব্ধগতির রুদ্ধ দামোদরের থেকে প্রকৃতির সব দরজা খোলা, এবং সেইসব মানুষের জন্যই যারা তাকে স্থবির করে দিয়েছে বাঁধ ও ব্যারেজে।

সারা বছর ধরে বিভিন্ন ঋতুতে দামোদর উপত্যকা জুড়ে এমন সব বিভিন্ন রূপ উপভোগ্য। গ্রীষ্মের শুষ্কতার পরে ভরা বর্ষার জলের ঘূর্ণি। বৃষ্টি বেশি হলে সেই জল দুকূল ছাপিয়ে যায়। সঙ্গে বাঁধের অতিরিক্ত জল, তখন বানভাসি শরতের কাশ কখনো যেন মাথা দুলিয়ে আগমনীর আলোর বেনুকে আহ্বান করে, কোজাগরীর চন্দ্রালোকের চিকচিকে বালুতে লুটোপুটি খায়। হেমন্তিকা গোপন করতে পারে না অন্ধকারের ব্যথা, দীপ জ্বেলে রাখে রাতের দামোদরের জলে, যখন জেলেরা যায় মীনের সন্ধানে। শীতের বনভোজন বা চড়ুইভাতির হাত ধরে দূষণের বোঝা বয়ে চলা। তবু বসন্ত আসে, পাতাঝরা গাছের নতুন পাতা আসার মতোই আবার সেই জীবনচক্রে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া। বাঁধ বাঁক কিছুই হারায় না, হারিয়ে যায় দিন, সময়, তার সাথে জড়ানো অনুভূতি, সুখ, দুঃখ, যা ইতিহাসের পাতায় লেখা হয় না, জীবন আর জলধারার মধ্যেই সেসব থেকে যায়।

তবুও দ্বিধা, বর্ধমানের দামোদরকে খুব আপন করে দেখতে ও পরশ পেতে চাইলে সুবিধামতো জায়গা, সেতুর কাছে, ভূমিরূপ যেখানে অনেকটাই উঁচু, মাটি ফেলে মানুষের কাজ, আর সেখান থেকে দামোদরের নাগালে, তারই জলের সিঞ্চন পেতে অনেকটাই নেমে যেতে হয়। নামাটা না হয় সহজ, কিন্তু ওঠার সময় বেশ কষ্টকর, তবু এই চড়াই-উৎরাইয়ে দামোদরকে ভালোবাসার ভাটা পড়তে পারে না যে!

দামোদরকে ঘিরে চোরাবালি আর ধূ ধূ বালুচর। এসব পেরিয়ে প্রাণের পরশ, নাগাল পাওয়া ওই চোরাবালিতে নেমে এই অমূল্য জীবন, যা শুধু দিয়ে যায়, সেই জীবন বিপন্ন করা যাবে না, বন্ধুদের মতামত। প্রকৃতির বন্ধু হয়ে প্রকৃতির বুকে যে পদচারনা নিরন্তর, তাঁকে দিক নির্দেশ করার দুঃসাহস দেখানো কি সাজে!

উত্তর জোগায় অন্তরাত্মা, চোরাবালি বিপর্যয়ের পথ বাতলানোর কাজ হয়েছে তো কয়েক দশক আগেই, আর যে এসব করে, তাকে কি আর চোরাবালি কোলে টেনে নিতে পারে, অবশ্য চোরাবালির চক্করে প্রায় দু’দশক আগেই, সাগর উপকূলে, ভর দুপুরে, নির্জনে একাকি, সেখানে আর কেউ নেই, পশু পাখিও না, পূর্ণিমার কোটালে, ভরা জোয়ারে, সে যাত্রায় প্রাণে বেঁচে ফেরা তারপর ভাটার ওখানে আবারও পর্যবেক্ষণে, ওখানে শুধু চোরাবালি নয়, সমুদ্রের দিকে ঢাল ছিল প্রায় ২০ ফুটেরও বেশি গভীরতায়, তার থেকে রেহাই পেয়ে এসেছে যে সে আর যাই হোক নদীর চোরাবালি থেকে নিজেকে সামলে নিতে পারবে, এমনটা আশা করাই যায়, তবে ভয় দেখালে জেদ বেড়ে যায়, এই গোধূলির দোরগোড়ায় এসেও, অবশ্য একটা বিষয় দুর্বলতার কথা স্বীকার করে নেওয়া ভালো, ফ্লুভিয়াল সিস্টেমের প্রায় কিছুই জানা নেই, পড়ে কি আর শেখা যায়, তাই দামোদরের কাছে যাওয়ার এতো তাড়া, আর পথ বাতলে না দিলেও দিশা একদিন নির্ণীত হয়ে যাবে নিশ্চিত, আর কোন একদিন দেখা যাবে দামোদর নদীর চরে এক ভবঘুরে দাঁড়িয়ে জলে মাছের জলকেলি দেখছে।

উতলা মন বলে, মনের জোর যার, তিনি চোরাবালি সহ সব কিছু অস্বাভাবিকতা সামলে নিতে পারবেন, তাঁকে ভয় দেখাবার মতো কাজ নাইবা করা গেল। আর লেখা ছুঁয়ে বোঝার চেষ্টা করি, মন ছুঁয়ে যাওয়া লেখা।

উপকূল সমুদ্র নিয়ে এত লেখা আর নদী ব্যবস্থা কিছু জানা নেই, এটা কি হতে পারে? তবে প্রকৃতি শেখা বা জানার ইচ্ছে অনুসারে নদীকে আপন করে পরশ পাবার কথা মনে আসে। পথ বাতলে দেবো কিভাবে? নদীকে কি চিনি এতো গভীরভাবে? মাঝে মাঝে যাই, একটু নদীর চরে দাঁড়ায় অস্তরাগের রক্তিম আভায়, সুরে অন্তরার অনুরণনে স্থায়ী ফিরে আসি। তখন যদি দেখি এক ভবঘুরে মাছ সাঁতরানো দেখছেন, সেই দেখা থেকে অন্য কেউ বঞ্চিত হবে না, এই আশা তো রাখাই যায়।

নদী দিয়ে কাজ শুরু করেছি একদিন, হয়তো নদীতেই সে কাজের অন্তিম চলন, অবশেষে এসবের আত্মবিসর্জন। তবে শুরুতে ছিল জোয়ার ভাটার নদী, শেষে মালভূমি থেকে বেরোনো নদী সমাজ, প্রথমটায় শুধু বিজ্ঞান, আর শেষটায় হয়তো বা সমাজচর্চা, সেখানে মানুষ আর জনপদ শিল্প ও সংস্কৃতি।

এতো অন্তিমে ঝোঁক কেন! কেনই বা বিসর্জন। আবাহনের কোনো স্থান কি নেই? আবারও সেই শেষের কথা! নদী তো চলমানতার কথা বলে। তাই চলমানতায় নদী পথের বদল হয়, আবার সমাজের হয় নদীর মতোই। সেই বদলটাই পাঠ্য হোক না! সেটাই আপাতত পাখির চোখ করে এগোনোর ইচ্ছে তবে ক্রমে ধার ও ভার কমছে, নদী বা সমাজের পরিবর্তনের মতো এই ধূসর মননেও যে পরিবর্তন উঁকি দিয়ে যায়, তা বেশ টের পায় যে, তাছাড়া মেধাও তুলনামূলকভাবে কম, অপরাহ্নে সেখানেও অবঘর্ষ প্রক্রিয়ায় ক্ষয়কাজ নিরন্তর চলমান।

বালুকণা খানিক ধূসর, তবু গোধূলির আলোর ছটায় ধূসরতার লেশমাত্র চিহ্ন থাকে না, রঙের আধিক্য না থাকলেও তা রঙিন। যে মন পরিবর্তন দেখতে পায়, সে মন ভীষণ প্রগতিশীল। ধূসরতা বা অপরাহ্ন সেখানে ছায়াপাত করে না। তবে অবঘর্ষের চেয়ে ঘর্ষণ ক্ষয় মেধাকে ক্রমাগত ক্ষুরধার করে তোলে বলেই মনে হয়।

অবঘর্ষ পাথর কেটে নদীকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া, যে পাথরের ভার আছে, কিন্তু আলো নেই। আর যার আলোর বিচ্ছুরণ, সে খনিজ, তাকে কাটে অন্য খনিজে, দামোদর নদের ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য, সে যেখানে পাথর কেটে কেটে এগোয়, উচ্চ গতিপথে এমনটাই হয়ে থাকে, সেখানে গতি আছে, গভীরতা আছে, সৌন্দর্যের প্রকাশ নেই। অথচ মাঝে, নদীর মধ্যে গতিপথ চর জেগে থাকে কোথাও না কোথাও, ধূ ধূ করে বালুরাশি, কোথাও বা এক বাঁও জল, পাশ দিয়ে বয়ে চলে জলস্রোত, গভীরতায় টানটান, ওখানে হয়তো চরপাটা জালে আটকা পড়ে কোনো না কোনো দিন এক মস্ত বাঘা আড়মাছ। এমন দামোদরকে না ভালোবেসে যে আর পারা যায় না।

দামোদর নদ এমনিতেই মন কেড়ে নিয়েছে তার লড়াইয়ের জন্য, দেবী গঙ্গা সমঝোতার রাস্তায় হেঁটেছে শেষমেষ, দানবকূলের প্রতিভূ হিসেবে দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য তার নাম দিয়েছে দামোদর, মালভূমি থেকে বেরোনো সব নদীরই সে গৌরব গাথা রচনাকারী মুখ, এই দামোদরকে কে না ভালোবাসে, পাঠক- লেখক সবাই।

দামোদর নদ এখন আর নিজে ডোবে না, বা অন্যকে ডোবায় না। শুকিয়ে গেছে সে, এবং এতটাই যে বর্ষায়ও তার নদীবুক দেখা যায়। এককথায়, নদী নামের মাহাত্ম্য হারিয়েছে দামোদর নদ। তবু নদী ও নারীর মন বোঝা দায়। বাঁধ, ব্যারেজে নদী, আর বিবাহবন্ধনে নারীকে হয়তো বেঁধে ফেলা যায়, কিন্তু তার মন সবসময় মেলে না। সামাজিক বন্ধনে বেঁধে ফেলা নারী সংসার ধর্ম পালন করে চলে, সন্তানের জন্ম দেয় বটে, কিন্তু তার পদবী বদল হলেও, মনের গোত্রান্তর হয়না, আর তা বোঝা যায়, ঝড় এলে, তখন হয়ত দেখা যায়, সেই ঝড়ের রাতে, "সুদূর কোন্ নদীর পারে, গহন কোন্ বনের ধারে, গভীর কোন্ অন্ধকারে হতেছ তুমি পার", অথচ ‘তিনিই পরাণসখা বন্ধু হে আমার’। ঝড়ে নদীও খানিক তাই। প্রাকৃতিকভাবে নদীর চলাচল বাঁধ-ব্যারেজে বেঁধে ফেললেও, প্রাকৃতিক দুর্যোগে, বর্ষার ঘনঘটায়, বাঁধ-ব্যারেজের জলধারের জল উপচে পড়লে, জলধারের ছাড়া জল ও ভারী বর্ষার জল মিলে নদীর ভয়াবহ প্রবাহমানতা, ফলে বন্যা, আর ঠিক এমন সময়েই নদী বেছে নিতে পারে তার সহজ নদীখাত, পরিণামে নদীর গতিপথ পরিবর্তন। দামোদর নদও এর ব্যতিক্রম নয়, তবে বাঁধ-ব্যারেজে বাধা পাওয়া দামোদরের অল্পবিস্তর পাড় ভাঙার খেলা চললেও দৃশ্যত বড় ধরনের গতিপথ বদলের কোনো সাক্ষ্য এযাবৎ সে রাখেনি! যদিও বানভাসি ভয়ঙ্কর রূপের সেকালের দামোদরের কথা আলাদা যখন সে বাঁধা পড়েনি, তার গতিপথ জুড়ে বাধার আগল তুলে দেওয়া হয়নি, তখন মাত্র বিশ বছরেই তার গতিপথের নদীখাতের বদল, নিম্ন গতিপথে দামোদর নদের জল বইতে তখন গাঙ্গুর ও বেহুলা-র নদীখাত বরাবর, আর দামোদরের আত্মবিসর্জন হুগলি নদীতে, কালনার কাছে (১৬৪০ খ্রিস্টাব্দে), তার ঠিক বিশ বছর পরে, দামোদরের গতিপথের বদল, চলাচল তখন আমতা খাতে, নাম তার মন্ডলঘাট নদী, আকারে সে একটি খাল মাত্র (১৬৬০ খ্রিঃ), আর সবশেষে হুগলি নদীতে এসে মিশেছে গড়চুমুকে, হাওড়ায়। আরও আগে, কানা দামোদর দিয়ে এই দামোদরের প্রবাহপথ, দ্য বারোসের মানচিত্রে, যার প্রকাশকাল ১৫৫০ সাল। তখন কানা দামোদর একটা প্রশস্থ খাল, আর ১৭২০ ও ১৭৩০-এর চার্টে একটি সরু নালা।

প্রায় তিন শতক (১৫৫০-১৮৫০ খ্রিঃ) জুড়ে ভয়াল বন্যা, অতিরিক্ত জলরাশির ভার, ও সে কারণে দামোদরের উদ্দাম জলপ্রবাহ, দামোদর নদের বারবার গতিপথ পরিবর্তনের কারণ আর তারপর থেকে নদী খাতের পরিবর্তনের জন্য দায়ী মানুষ ও তাদের কীর্তিকলাপ। বিংশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে দামোদর নদ বাঁধা পড়তে শুরু করেছে বাঁধ ও ব্যারেজে, সেই থেকে গতিপথ পরিবর্তন আর চোখে পড়ে না।

মালভূমি থেকে, পাথর কেটে, তেড়ে-ফুঁড়ে বেরোনো এক নদীর নাম দামোদর নদ। ছোটনাগপুর মালভূমির টিলাগুলোর মাঝের অংশগুলো নিচু এলাকা দিয়ে আঁকাবাকা পথে, দামোদর নদের এগোনো, আর এই ভূমিরূপ কাজে লাগিয়ে, স্বল্প সামান্য পরিসর এলাকায় বাঁধ ও ব্যারেজ, আর তাতেই সফল পরিকল্পিত জলধার, যা আধুনিক বিজ্ঞান অধ্যবসায়ী মানুষের কীর্তি। অবশ্য টিলা থাকায় এমন সুযোগ মানুষ কাজে লাগাতে পেরেছে দামোদর নদের উচ্চ গতিপথে, যেখানে নদীর প্রশস্ততার পরিসর অপেক্ষাকৃত কম। মধ্য গতিপথে নদী চওড়া, বারবার বানভাসি হওয়ায় বর্ধমানে পাড় বেড়েছে, একূল ওকূল, দু’কূলে, যখন যেমন, একসময় এ কারণে এ নদের আরেক নাম 'বাংলার দুঃখ', অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক, কারণ দামোদরের মধ্য গতিপথ এই বর্ধমান জেলায়, ও তার বানভাসি খেলায় প্রায়শই মেতে ওঠা এই এখানেই। অবশ্য কিছুটা প্রভাব হাওড়া জেলায়, দামোদর নদের নিম্নগতিপথে, যেখানে তার শেষ পর্যন্ত আত্মবিসর্জন হুগলি নদীতে, গড় চুমুকে এমনকি সঙ্গমের কিছু আগেও বাঁধ, আটান্নটি স্লুইস গেটে, আটান্ন গেট নামটি তাই স্থানীয়দের মুখে মুখে। এমনই একাধিক নদীবাঁধে, বাংলার দুঃখ অপবাদ হয়তো ঘুঁচেছে, কিন্তু দামোদর, নদীর পরিচয় হারিয়েছে, এখন সে আর তেমন দুরন্ত নেই, যে দুরন্তপনার জন্য পুরাণ পর্যন্ত টেনে আনা, আর তার থেকেই নদ-বর্ণনা - কৃষ্ণবর্ণ রুদ্র, দামোদরের কল্পিত পুরাণ নাম এমন রুদ্রকে ঘায়েল করতে, তেনুঘাট বাঁধ, কোনার বাঁধ, মাইথন বাঁধ, পাঞ্চেত বাঁধ, দুর্গাপুর ব্যারেজ, আটান্ন গেট, পরপর আর বর্ষার রুদ্রবীণার ঝংকার থামিয়ে, হুগলি রূপী গঙ্গার সাথে নাচতে নাচতে, মানুষের সুনিদির্ষ্ট সুর তাল লয়-এ, অবশেষে হরিহররূপী সমুদ্রে মিলন।

বাঁধ-ব্যারেজ মানুষের সমাজ ভাল না মন্দ এই একটি প্রশ্নের মীমাংসা করার উপায় খুঁজে না পেয়ে বিপন্নতায় ভোগে অন্তরাত্মা, যার দুই সত্ত্বার বিপরীতমুখী চলন, চলে দ্বন্দ্ব অবিরাম মননে বোধনে। জিজ্ঞাসা একটাই দামোদর নদের ওপর লাগাতার বাঁধ, উজান থেকে মোহানা কিছুটা হলেও মানুষের সমাজে বিবাহ বন্ধনের সামিল, যদিও একটি প্রাকৃতিক, ও অন্যটি সামাজিক। বিবাহ বন্ধন যেমন ছেলে বা মেয়েটির অথবা উভয়ের স্বাধীনতা কেড়ে নেয়, ঠিক তেমনই নদীর ওপর বাঁধ নির্মাণ নদীর স্বাধীনভাবে চলার পথে এক বিষম বাধা, নদী তার স্বভাবসিদ্ধ গতিপথে, প্রাকৃতিক উপায়ে চললে হয়তো মাঝে মধ্যে তার গতিপথ বদলে ফেলতে পারতো, সেই অধিকার তার কেড়ে নিয়ে তার তাকে স্থবির করে দেয় মানুষের আধুনিক কৃৎকৌশল ও কারিগরীবিদ্যা।

এসব তত্ত্ব শুনে, নৃতত্ত্ব গলায় ঢেলে, উভয়ের জন্য ঢোঁক গিলে, দ্বিতীয় সত্ত্বার তাৎক্ষণিক জবাব - অসাধারণ উপস্থাপন, উপকরণ, উপমা। লেখকের মতো গভীরতা না থাকলেও এমন মনোজ্ঞ বিষয় থেকে দূরে থাকা যায় না। কিন্তু দামোদরই ভাবালো কেন? কেনো অন্য নদী নয়?

দামোদরে খানিক পৌরুষের মহিমা, যেখানে বিজ্ঞানের কোন ব্যাখ্যা না থাকলেও সে পুরুষ, নদ, তাছাড়া, ঘরছাড়া ভবঘুরেদের মতো সেও পরিচিতির বহরে বাংলার দুঃখ।

দ্বিতীয় সত্তা এবার খানিক ভেবে উত্তর দেয়, দামোদরের ওপর বাঁধ দেওয়া হলেও মধ্য বা নিম্নগতিতে গতিপথের বদল কি হয়নি? গঙ্গা, ভাগীরথী, হুগলি - এদের ক্ষেত্রে কি একই কথা বলা যায়? নদীর বাঁধ আর জীবনের বাঁধ চলাচলের পথে বাধা বা স্বাধীনতাহরণ ছাড়া আর কিছুই না। তবে প্রাকৃতিক বা সামাজিক উভয় প্রকার বাঁধ না দিলেও জীবনের পরিবর্তন আসেই, জীবন স্থবির থাকে না, তবে সেটা প্রভাবিত করে একটি জীবনকেই, জল-জীবন বা মানব-জীবন যাই হোক না কেন। শুধু একটা বদলের জন্য বৃহত্তর ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসে যায়, সেটা সমাজেই হোক বা জীবনেই হোক। ঘরছাড়া ভবঘুরেদের সাথে দুঃখ একইভাবে সম্পর্কিত হয় না, বোধ হয় অনেক সময় সুখও থাকে অগোচরে। কেউ ঘর ছাড়ে স্ব-ইচ্ছায়, কেউবা ভাঙ্গার জন্য। পৌরুষের মহিমা বা নারীর লালিত্য যাই হোক না কেন, সবটাই আপেক্ষিকতাবাদের ব্যাখ্যায় বদলে যায়।

সুখ কি সত্যিই থাকে - প্রশ্ন জুড়ে দেয় প্রথম সত্ত্বা, যেখানে পাঁচ বছরে একবার বানভাসি হলে নদীর বয়ে আনাপলির সঙ্গতে সবুজে ভরে উঠত ক্ষেত, তা কি আর হয়, মাটির ওপর ঘোলা জলের প্রকৃতি-পরশ বুলিয়ে দিতে দিতেই আবার পাঁচ পাঁচটি বছর হয়তো এমনি করে চলে যায়। নদীর ওপর তার জলপ্রবাহের প্রবাহী স্রোত না বইলে পাড় ভাঙবে কি করে, তৈরি হবে না কোনও হাঁসুলী বাঁক, আর এতো কম সময়ে নদী তার গতিপথ বদলাতে পারে না।

‘তারে ধরি ধরি মনে করি, ধরতে গেলে আর পেলাম না...’ হয়েই থেকে যায় সুখ। বড় চঞ্চলা। দানাপানি দিয়ে হৃষ্টপুষ্ট করে দাঁড়ে বসিয়ে ইচ্ছে মতো গান শোনাতে বলাও যায় না। বাংলার সে দুঃখ হয়তো আজ আর নেই। জলস্রোতের গতিও বাঁধ নির্মাণে আজ অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত, বন্যায় দু'কূল প্লাবিত হলেও, রবিঠাকুরের শেষের কবিতার অমিত-লাবণ্য’র মতো রেখে যায় না ফসলের জন্য ভালোবাসা। সবটাই বদলে যাওয়ার ছবি। নদীর গতিপথ, নদী-বাঁক তৈরি, পাড় ভেঙে যাওয়া, বদল দশকের পর দশক চলতে থাকে, ধরা পড়ে না সাধারণ চোখে। কিন্তু তবু কি বদল ঘটে না? নদী পাড়ের জীবনযাত্রাও প্রভাবিত হয়। যেসব গ্রামগুলো প্রায় প্রতি বছর অল্প বৃষ্টিতেই প্লাবিত হয়, অথবা, একটু দূরবর্তী জায়গায়, যেগুলো সচরাচর প্লাবিত হয় না, নদীতীরের সেই সব মানুষগুলোর সাথে কথা বললে বোঝা যায় সামাজিক জীবন যাত্রার সময় কালগত পরিবর্তন। আপাতদৃষ্টিতে স্থবির নয় কিছুই, সবকিছুই পরিবর্তনশীল।

বাঁধ দেওয়ার পরও অল্প বৃষ্টিতেই তবে জলে ভাসে কেন গাঁ? কি কারণে, শুধুই কি ভিন্ন ভূমিরূপ? কেনই বা ভালবাসতে পারেনা তাদেরই সযত্নের প্রাপ্তি সোনার ফসলকে? জমি আর বানভাসি হয় না বলে, নাকি ফি-বছর জমির উৎপাদিত ফসলের পরিমাণে কোনো হেরফের নেই, তাই বানভাসি হলে এই দুটি সমস্যা একযোগে মিটে যেত, আর পরের বছর অতিরিক্ত ফসল, সাথে বানের পলি বিছিয়ে দিয়ে যাওয়ার কারণে নীচু জমির ভূমিরূপের পরিবর্তন।

নদীর বুকের বোঝা হালকা হয় না, বহন করতে না পারা সবকিছুই ক্রমে জমা হয়, অল্প বৃষ্টির ভার বহনে অক্ষম নদীবক্ষ তার সবটুকু দুপাশে ছড়িয়ে দেয়। দূষিত, কলুষিত সেই সব কিছুর দ্বারা ফসলের ভালো আর হয় না। জমির স্বাভাবিক উর্বরতা ক্রমশ হ্রাস পায়। শস্যাবর্তনেই বা কতটা ফিরে আসে। আবার সেই কৃত্রিম উর্বরতা বৃদ্ধির চেষ্টা, যা সাধারণ কৃষকের পক্ষে চাপের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনতে চাইলে কি তাহলে সেই কবির ভাষায় বলতে হবে - ‘বাঁধ ভেঙে দাও, বাঁধ ভেঙে দাও’।

বাঁধ ভাঙবে কি রাখবে, তার সিদ্ধান্ত নিক তারাই যারা বানিয়েছে। তবে কৃষক কিন্তু কখনও অধিক ফলন চায়নি, সম্বৎসরের যেটুকু, তার পরিবারের জন্য, ও বাকিটা বিক্রি করে অন্যান্য পারিবারিক খরচপাতি, শুধু সেটুকুনই। কৃষক কোনদিন রাজা হওয়ার স্বপ্ন দেখেনি, যদিও কখনো-সখনো রাজনৈতিক দলনেতা তাকে রাজা বানিয়ে দিয়েছে, কিন্তু তার চোখে ভাসে শস্য ক্ষেতের শ্যামলা রং, ভালো লাগে ধূসরমাটির ওপর ছড়ানো বীজ, একবার মাত্র জল দিতে হয় তার ওপর, তাতেই, দিন কয়েকের মধ্যে ঘুম থেকে জেগে ওঠে বিজ, মেলে ধরে বীজপত্র, তাতে বীজতলা, আর জল দেবার প্রয়োজন হয়না, শস্য বা সবজি চাষের প্রয়োজনীয় যেটুকু জল তার জোগান দেয় মাটি, পর্যাপ্ত ভৌমজলের নিয়মমাফিক পুনর্নবীকরণের মাধ্যমে, এবং তার নিয়ন্ত্রণ নদীর স্বাভাবিক প্রবাহে, নদীপথে বাঁধ দেওয়ায় ভৌমজলের ভান্ডার তলানিতে ঠেকেছে, ভৌমজলের যথেষ্ট উত্তোলন, যেটুকু পড়ে আছে এখনও, কিছুদিন পরে পানীয় জলের ভান্ডার পর্যন্ত প্রশ্নচিহ্নের সামনে এসে দাঁড়াবে, অথচ যাদের গাঁ এই সব নদী বাঁধের কাছাকাছি নয়, তাদের কি অপরাধ!

স্বল্প চাহিদার সহজ সরল গ্রামবাংলার মানুষেরা খুব সাধারণ জীবন নিয়েই খুশি থাকেন। শত অভাব অনটন সত্ত্বেও প্রাণের টানে চাষাবাদ করেন। আর্থ-সামাজিক কারণে জোতের আয়তন ক্রমশ ছোট হয়ে যাওয়ায় অনেক অসুবিধা হয় কৃষি সহায়ক উপাদান প্রয়োগে। তবে নদী সংলগ্ন ছবিগুলি ছাড়া অপেক্ষাকৃত দূরবর্তী পলি সমৃদ্ধ জমিগুলো জলের অভাবে অনেক ক্ষেত্রেই এক-ফসলীই থেকে যায়। আর ভৌমজল ব্যবহারের সামর্থ্য কতজনেরই বা থাকে। কিন্তু তাই বলে শহরাঞ্চল বা গ্রামাঞ্চলের মানুষ ভৌমজলের ব্যবহারের মোটেই পিছিয়ে নেই। নদীতে বাঁধ দিয়ে উচ্চ অংশে জল ধরে রাখায়, নিম্ন অংশে প্রায় সারা বছর শুষ্ক থাকে, কি নিদারুণ জল সংকট। দামোদর তখনও দুঃখের ছিল, এখনো দুঃখের। তবে দুঃখটা সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী।

এসব তো দামোদরের প্রান্তজনের দুঃখ, কিন্তু দামোদর নদের আপন ব্যথা, একান্তই নিজস্ব, স্বাভাবিক প্রবাহমানতা না থাকায় দুঃখ, যা সে গোপন রাখে না, নদীবুকের ফাটলে ফাটলে বুক চিরে তুলে ধরে তার শুষ্কতা, মাঝেমধ্যে বাঁধ থেকে জল ছাড়লে, বা বর্ষার জলে সে ফাটল ঢাকা পড়লেও জলের ঘূর্ণি, গভীরতা, আঁকাবাঁকা স্রোতের স্বাভাবিকতা না থাকার হাহাকার দামোদর নদের বুকের অলিন্দ থেকে নিলয়ে ঘোরাফেরা করতে থাকে। নদীর গতিপথ বরাবর নৌকা চলাচল যেকোনও নদীর কাছে গর্বের, কিন্তু দামোদর নদ তার থেকে বঞ্চিত, কেবল কোথাও কোথাও নদী পারাপারের খেয়াতরীতেই তার সন্তুষ্টি।

বুকের গভীরে এত ব্যথা গোপন করে, বয়ে চলা নদীর যেন দমবন্ধ হয়ে আসে, নাভিশ্বাস উঠে যায়। এই অবস্থায় স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনা সোনার পাথর বাটির মতোই। নদীর ক্ষত কিছুটা পূরণ হলেও ব্যথা কখনো কমেনা, এও যেন অনন্ত অন্তঃসলিলা! মাঝি মাল্লার নৌকা বাওয়া, খেয়াতরীর নিয়মিত এপার ওপার সবই অতীত। শুষ্ক ঋতুতে বাঁশের সাঁকো দিয়ে মোটর সাইকেলে যাতায়াত সবকিছুর সাক্ষী হয়ে থাকে ক্ষীণকায় নদী। পুনর্যৌবন লাভের কোনো শর্তই যখন আর দৃশ্যমান নয়, তাহলে তো বার্ধক্যই ভবিতব্য।

এমনই দামোদরকে নিয়ে কম চর্চা হয়নি। তবে অন্য চোখে দামোদরকে নতুন করে দেখা। নতুন করে প্রেমে পড়া। আকর্ষণ, প্রেম যেন ক্রমেই বেড়ে চলেছে।

উচ্চগতির সাথে তেমন সাক্ষাৎ-পরিচয় হয়নি। তবে উচ্চগতিতেও গভীরতায় সৌন্দর্য আছে, প্রকাশ তো দেখার চোখেই। মধ্য ও নিম্নগতির নয়নাভিরাম কবি সাহিত্যিক-সহ সবাইকে আকর্ষণ করে। আর জায়গা বিশেষে মাছের আধিক্য আছেই।

পুরাণের কথা বিশেষ জানা নেই, তাই জানার আগ্রহ, থেকেই যায়। জানার জানালা খুলে রাখা তাই, আলো হাওয়ার সমৃদ্ধ হোক হৃদয়।

দামোদর নদকে বাগে আনতে হরেকরকম কৌশল কারসাজি বাঁধ ব্যারেজ ইত্যাদি। তার বানভাসী পৌরুষকে জব্দ করে, গতিপথ বরাবর ম্যাড়ম্যাড়ে জলপ্রবাহ নিতান্ত অবহেলায় বেড়ে যেতে দেখা দিলে, মানুষের পৌরাণিক কথনে তা হয়ে দাঁড়ায় দামোদরের উপনয়নত্ব। মানুষের এমন প্রাকৃতিক অবরোধের দুষ্কর্মকে অবলীলায় বলে দেওয়া যায় এ এক পৌরাণিক ঘটনা। পুরাণমতে তাই, গঙ্গারূপী হুগলি প্রায় স্তব্ধ, দামোদরকে আহ্বান করে বলে, "হে কৃষ্ণ বর্ণ রুদ্র, তুষ্ট হয়েছি আমি, চলো প্রসন্ন উদার ছন্দে মিলিত হবো সমুদ্ররূপী হরিহরের সাথে"। অবশ্য এসবের আগেভাগেই গঙ্গার পূণ্যতোয়া কীর্তির নামে ও অস্ত্রে দামোদর নদকে বধির করে দিয়েছে মানুষ ও তার আধুনিক বিজ্ঞানের কৃৎকৌশল। সেই বধিরত্ব মোচনের কঠোর তপস্যায় ব্রতী হতে হলো দামোদরকে। তপস্যায় তুষ্ট হয়ে দেব বিশ্বকর্মা বরদান করে বললেন, "তুমি দেবত্ব অর্জন করেছ দামোদর, উপবীত ধারণ করে আত্মত্যাগের কল্যাণের ব্রত গ্রহণ করে সংযম বন্ধন প্রতিকার কর, নিজেকে মানুষের সেবায় প্রবাহিত করো।" নতমস্তকে দেবতার নির্দেশ মেনে নেয় দামোদর।

দামোদরের গতি স্তব্ধ করার প্রক্রিয়া পুরাণের আশ্রয় নিয়ে মানুষ খুব কৌশলে তার ব্যাখ্যা দিয়েছে, তার জন্য ধার নিতে হয়েছে গঙ্গার মর্ত্যে আগমন ও তার সাগর সঙ্গমে মিলিত হবার কাহিনী। আনন্দনগরীর এক উল্লেখযোগ্য নাট্যগোষ্ঠীর সম্পাদনায় ও পরিবেশনায় উত্তম-সুচিত্রা অভিনীত 'বিপাশা' (১৯৬২) ছবিতে দামোদর নদের একইসঙ্গে উদ্দাম প্রবাহ ও স্তব্ধ গতি একটি গীতি আলেখ্যে সুচারুরূপে উপস্থাপিত হয়েছে। তাদের পরিবেশিত গীতিনাট্য-এ প্রথম প্রবেশ গঙ্গার, নাচে গানে -
"আমি শিবের মাথায় ঝরব
মর্ত্যভূমি ধনধান্যে শ্যামল কোমল করব।"

গঙ্গা দেবীর মহিমা গৌরবে বিক্ষুদ্ধ অপমানিত দানবকুল, সমস্বরে আহবান করলে দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য্যকে, তাদের বক্তব্য গঙ্গার অবতরণের অংশগ্রহণে দানবদের অধিকার দেওয়া হয়নি, এর প্রতিকার চাই। দৈত্যাচার্য নিজ শিষ্যদেরকে প্ররোচিত করলেন গঙ্গার পূর্ণ মহিমান্বিত অঞ্চলকে বন্যায় বিধ্বস্ত করতে, গঙ্গার মহিমাকে খর্ব করতে, আর বিক্ষুব্ধদের নেতৃত্ব দিতে কৃষ্ণবর্ণ রুদ্রের নামকরণ করলেন দামোদর।

"দিলাম তোমায় শৌর্যবীর্য, দিলাম তোমায় বর
আর নাম দিনু দামোদর
প্রলয় নৃত্যে আকাশ কাঁপিয়ে গঙ্গার বুকে পড়ুক ঝাঁপিয়ে
গঙ্গার মহিমা খর্ব কর।"

সদলবলে গঙ্গার পথ রোধ করে দাঁড়াল দামোদর, আস্ফালন করে বললে, "বরণ করো গো দেবতার মেয়ে, কালোদের দেখে এসেছ, এবার নয়নেতে কাজল কালো টানো।"

দেবী গঙ্গা শঙ্খধ্বনি করে আহ্বান জানালো আপন সঙ্গিনীদের, তাদের প্রচন্ড আক্রমণের বেগে বিধ্বস্ত ও পরাজিত হয়ে পশ্চাৎ অপসরণ করল দামোদরের দল। যদিও ঠিক তার পরেই মোহানার মুখে গঙ্গাকে বন্দিনী করার জন্য বিপুল বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ে দামোদর। নিতান্ত অবহেলায় সে আক্রমণের বেগ প্রতিহত করে গঙ্গা। পরাজিত হয় দামোদর। গঙ্গা তখন বললেন, তপস্যা করো দামোদর, দানবভাব বর্জন করে যখন তুমি কল্যানব্রতী হয়ে আসবে, তখনই গ্রহণ করবো তোমাকে। আমাদের হবে সন্ধি। অবশেষে, দামোদর অনুগৃহীত হয়ে, বহুবার গতিপথ বদল করে, তার আত্মবিসর্জন সেই গঙ্গায়।

ছোটনাগপুর মালভূমির ঝাড়খন্ড রাজ্যের রামগড়ের বোড়া থেকে যাত্রা শুরু করে প্রায় ৫৯২ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে আসার সময় যে বিপুল পরিমাণে পলি বহন করে আনে দামোদর, তার অধিকাংশই প্রায় ২৩,৩৭১ বর্গ কিলোমিটার নিজেরই অববাহিকা জুড়ে ছড়াতে ছড়াতে আসে, আর বাকিটার অবক্ষেপণ মোহানায়। মোহানায় জমা কাদা পলি নিয়ে 'বিপাশা' (১৯৬২) ছবিতে উত্তম-সুচিত্রার কথোপকথনের দামোদর নদ চর্চা যেন আরও মনোগ্রাহী হয়ে ওঠে। শুরুটা এমনই - একসময় দামোদর জলে ডুব দিয়ে উঠে আসত, আর হাত তুলে বলত, এই আনিয়াছিরে শুভ্র বরণ কন্যা, তোর কুমারী হৃদয়খানি তুলে এই বাহু বলে। তারপর, হাতখানি যেই খুলে ফেলত, তখন ঝরঝর করে ঝরে পড়ত কালো কাদা, নদীর মোহানায় তো আর নুড়ি পাওয়া যায় না। সবই পলি আর কাদা।

- হুঁ, বলেছেন ভালোই, কিন্তু কাদা ছুঁড়ে তো আর কপাল ফাটানো যায় না।
- কেনো, মুখে তো মাখানো যায় ('বিপাশা', ১৯৬২)।

উজানের নুড়ি বালি, ঘর্ষণ প্রক্রিয়ায় যতই কাদা হয়ে মোহানার বুকে অবক্ষেপিত হোক না কেন, তাতে কি নদী আদৌ বুড়ি হয়, দামোদর নদও বুড়ো নয়, নদনদী বরং যৌবনের প্রতীক, যখন কোথাও সে শুকনো খটখটে, তখনও সে চঞ্চলা, যতক্ষণ না পর্যন্ত মানুষ তার প্লাবনভূমি দখল করে ফেলেছে। নদী মৃতপ্রায় তখনই, যখন তার প্রবাহ-স্রোত রূপী দেহ বেদখল হয়ে যায়, এই মানুষের নশ্বর দেহের মত নয়, যাহারায় চিরতরে, বরং জল বিছানোর সুযোগ পেলেই সে ফের যৌবনবতী, কলকল্লোলে মেতে ওঠে পুরনো সেই দিনের মতোই। আসলে নদীবুক শুকনো দেখতে পেলেই, রাজনীতির কারবারিরা পাট্টা বিলোতে শুরু করে দেয়, ভোটের হিসাব নিকেষে হারিয়ে যায় নদীর একাল ও সেকাল।

চার-চারটি বাঁধ ও ব্যারেজের আধুনিক সংস্কৃতি বিবর্তিত দামোদর নদের পাড়ের জমির এখন অগাধ দাম, তিন-চার ফসলি জমির মূল্য যেমনটি হয়। বন্যায় ডোবে, ব্যারেজ থেকে জল ছাড়লে, তাও আবার সব বছর নয়, এমন বন্যা বলে কয়ে আসে, সতর্ক করে দেয় ডিভিসি কর্তৃপক্ষ, সরকারি প্রশাসন, কৃষি অধিকর্তা, কৃত্রিম বন্যার জন্য প্রস্তুতি নেবার তাই অঢেল সময়। বর্ধমানের এমনই দামোদরের পাড়ে পাঁচ-পাঁচ বিঘে জমির মালিক কালু বিশ্বাস, ভালো নাম তার কালাচাঁদ। মিছিলের সামনে হাঁটার অভ্যাস শুধু নয়, 'বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক' স্লোগান তার মুখেই একসময় মানাতো, এবং এতটাই তারস্বরে যে তার তীক্ষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ত মহল্লা থেকে মহল্লায়। নেতারা তাই কালুকে, তখন ভূমিহীন চাষী, পাঁচ বিঘে চর জমির পাট্টা দান, একসাথে। কালু এখন এলাকায় সম্পন্ন চাষী, ধান অঘ্রাণে তুলেই, আলু বসিয়ে দেয়। আলু তোলার সপ্তাহ খানিক আগে সেখানেই কুমড়ো বীজ, আর কয়েক কুইন্টাল কুমড়ো ক্ষেত থেকে সরাসরি আড়তদারকে বেচে, ওই ক্ষেতে পাওয়ার টিলারে এক চাষ কর্ষণ, মাটি ঝুরঝুরে, হপ্তাখানিক রোদে শুকোনো, তার ওপর মই দিয়ে মসৃণ ও মুগ কলাই-এর বীজ ছড়িয়ে দেওয়ার পর কালুর আপাতত বিশ্রাম। কালুর এমন জমি যেবার কৃত্রিম বন্যার ব্যারেজ থেকে ছাড়া জলে ভাসিয়ে দেয়, কালুর আনন্দ হয়, তৃপ্তিতে মন চনমনে, কারণ বছর পাঁচেক কম করে, সার কীটনাশকের খরচ আর পোয়াতে হবে না তাকে। এমন দামোদর চরজমির মালিক কালু বিশ্বাস এখন শুধু সম্পন্ন নয়, বর্ধিষ্ণু কৃষক, বর্তমানে যে সবরকমের সরকারি পরিষেবা উপভোক্তা। এমনই এক সরকারি পরিষেবা স্বাস্থ্যসাথীর জন্য তার এইট পাস সার্টিফিকেট দরকার হয়ে পড়ে। গাঁয়ের স্কুলে গিয়ে শোনে, হেডমাস্টার অন্য স্কুলে বদলি হয়ে গেছেন, আছেন সহকারি প্রধান শিক্ষক, তিনি এখন ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক, যার চেয়ারে একবার আঠা লেপে দিয়েছিল কালু, তার থেকে তার নাম আঠা। কালুকে দেখে সেই আঠা স্যার সস্নেহে ডেকে বলে, কিরে কালু, কি চাই? কালু রেগে গিয়ে বলে, কেনো বাবু বলে ডাকতে কি কষ্ট হয়, আমার একটা ট্যাটাস আছে না। আপনি একটা ফালতু লোক।

মিটমিট করে হেসে ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক বলেন, তা কালুবাবু, ছাত্রাবস্থার কথা মনে নেই?
- মনে থাকবে না আর, আপনার অংক ক্লাস ছিল বলে, আমাদের অংক শেখা আর হয়নি। আপনাকে তখনকার বোস ঘোষ মাস্টাররা বলতো - আপনি একটা মিথ্যাবাদী, স্বার্থপর, ধূর্ত আর আত্মকেন্দ্রিক।
- ওসব ছাড়, ওই যে ট্যাটাস বললে কালুবাবু, তা কেমন ট্যাটাস তোমার?

কালু বিশ্বাস বলে, এখন গাঁয়ের পশ্চিম পাড়ার পঞ্চাত মেম্বার, ঘাসফুলের, আমার পাড়ার গোটা চত্বরেই ঘাসফুল ফুটেছে। ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক তখন শুধু ভাবে, দামোদর নদের ব্যারেজ থেকে ছাড়া জলের কৃত্রিম বন্যার মতোই, দামোদর পারের মানুষ এই কালুরা বাড়ি নদীজল সমাজের কৃত্রিম পটপরিবর্তনের আভাস দিয়ে যায়। কেবল চরে দাঁড়িয়ে থাকে সার সার কাশ, ও তাদের থোকা থোকা শুভ্র কাশফুল, আদি ও অকৃত্রিম, যেখানে নদী, নদীচর, নদীর প্লাবনভূমি, নদীর অববাহিকা - সবই মানুষের লোভের শিকার। অথচ এই নদীরই তীরে একসময় শুরু হয়েছিল সভ্যতার ক্রমবিকাশ।

শুধু দামোদর নদ কেন, সব নদীর তীরে সভ্যতার বিকাশ। তার জলের সাহায্যে নিয়ে ফসল ফলানো। গ্রাম্য কৃষিনির্ভর সমাজ জীবনের সাথে নদীর সখ্যতা। আবার সেই নদী মানুষের লোভের শিকার, চর-মানায় চাষ আবাদ, ভরা বর্ষায় প্লাবিত অঞ্চল পূর্ণতা আনে নদীর জীবনে আর সমৃদ্ধি আনে কৃষকের পরিবারে। নদীর যৌবন তার জলধারার প্রবাহ ও গতিশীলতায় বাঁধা। কিন্তু "কি তৃষা জাগে হায়, সে নদীর হিয়া তলে, বেদনার মহাসাগরে সন্ধান করো করো সন্ধান"। কে করবে এই সন্ধান, কেই বা করবে সমাধান, সফলতার মুকুট কি পারবে, নদীর জীবন যৌবন ফিরিয়ে দিতে, দামোদর নদ তার উত্তর খুঁজে ফেরে হায়।

বাঁধ ও ব্যারেজের জটাজালে দামোদর নদ ও তার অববাহিকা, এমনকি, তার মোহানার একশ হাত দূরেও সুবিশাল স্লুইশ গেট, নাম পরিচয়ে আটান্ন গেট, গড়চুমুকে, হাওড়ায়। বাঁধ, ব্যারেজ, স্লুইশ গেট পুরাণের দানব কুলের প্রতিনিধি দামোদর নদকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। নদের মাথার দিকে দুই উপনদী, যাদের জলে কৃষ্ণবর্ণ রুদ্র দামোদর পুষ্ট, তাদেরকেও বেঁধে ফেলা হয়েছে বাঁধ দিয়ে, তৈরি হয়েছে বরাকর নদের ওপর মাইথন বাঁধ, আর কোনার নদের ওপর কোনার বাঁধ, যদিও এরা দামোদর উপত্যকা প্রকল্পের অংশবিশেষ যার পোশাকি নাম দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন বা ডিভিসি। মূল দামোদর নদের ওপর দুটি বাঁধ তেনুঘাট বাঁধ ও পাঞ্চেত বাঁধ এবং একটি ব্যারেজ যা দুর্গাপুর ব্যারেজ নামে পরিচিত। দামোদর নদ ধানবাদ, দুর্গাপুর ও আসানসোলের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে এই অঞ্চলের শিল্পাঞ্চলকে সমৃদ্ধ করেছে, শুধু তাই নয়, এই বৃহৎ এলাকাজুড়ে দামোদর অববাহিকা বসে যাওয়ায় লাভবান হয়েছে দেশ ও দশ, কারণ এমনই বসে যাওয়া অববাহিকা মহামূল্যবান কয়লার ভান্ডার, যা উত্তোলনের মাধ্যমে সমৃদ্ধ হয়ে চলেছে দেশ। তাছাড়া, দামোদর নদের অংশবিশেষে কিছু চ্যুতির ফলে দামোদর উপত্যকার কয়লা মাটির দিকে নিশ্চিন্তে সংরক্ষিত হয়েছে, কোনও ভূবিপর্যয়ে এই মহামূল্যবান কয়লার ভান্ডারের কোনও ক্ষতি হয়নি। দামোদর নদ উপত্যকাকেও তাই ঝাড়খন্ড ও বাংলার পশ্চিমাঞ্চলে যেমন প্রাণবায়ু বলা যায়, তেমনি এই নদীর তীরে গড়ে উঠেছে ঐতিহাসিক শহর বর্ধমান, যা মহাবীরের নামানুসারে, যার ইতিহাস কয়েক সহস্র বছরের পুরানো, আছে আরও অজস্র ইতিহাস যেমন শের আফগান-মেহেরুন্নেসার (পরে নূরজাহান) কাহিনী বর্ধমানের আনাচে-কানাচে। দামোদর নদ আজ নিজে রিক্ত, চলনে ক্লান্ত কিন্তু খনিজের আকর যুগিয়ে চলেছে আজও, তারই বাহিত পলিতে সমৃদ্ধ হয়েছে কৃষি ও কৃষক, সমাজ ও জনপদ।