আরেক রকম ● দশম বর্ষ ত্রয়োদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুলাই, ২০২২ ● ১৬-৩১ আষাঢ়, ১৪২৯

প্রবন্ধ

মণীন্দ্র গুপ্ত ও ঔপনিবেশিক আমল

চিরন্তন সরকার


১৯২৬ থেকে ১৯৪৭ - জীবনের এই প্রথম দুই দশক মণীন্দ্র গুপ্তের কেটেছিল ব্রিটিশ আমলে। এর মধ্যে ১৯২৬ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত তিনি বরিশালে ছিলেন। সাত বছর বয়স যখন, অর্থাৎ ১৯৩৩ সাল, তখন থেকে শুরু হয় তাঁর শিলচর পর্ব। ১৯৪১ সালে কলকাতায় চলে আসেন। ১৯৪৬ সালে লাহোরে সেনাবাহিনীর কাজে ইস্তফা দিয়ে ফের কলকাতায় ফেরেন। সাত বছর বয়স অব্দি বরিশালে অবিভক্ত ব্রিটিশ ভারতে ছিলেন বালক মণীন্দ্র গুপ্ত, তখনকার রাজনৈতিক জীবন তাঁকে কতটা স্পর্শ করেছিল অত কম বয়সে, অক্ষয় মালবেরি-র প্রথম পর্ব সে ব্যাপারে তেমন কিছু জানায় না আমাদের।

বরিশাল অবশ্য মণীন্দ্র গুপ্তের জন্মের অনেক আগে থেকেই উপনিবেশবিরোধী সংগ্রামের একটি প্রধান কেন্দ্র ছিল, ১৯০৭ সালের পুলিশ রিপোর্ট মোতাবেক পূর্ববঙ্গে গোপন সমিতির মোট ৮,৪৮৫ জন প্রকাশ্য সদস্যের মধ্যে বরিশালেই ছিল ৫,২০০ জন। গোপন বিপ্লবী সংগঠনের মধ্যে উল্লেখ্য 'ঢাকা অনুশীলন সমিতি'র বরিশাল শাখা এবং ১৯০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত 'বরিশাল দল', যা ১৯২০ অব্দি ‘বরিশাল পার্টি’ নামেও খ্যাত ছিল। এছাড়া ১৯০৫-এ প্রতিষ্ঠিত 'বরিশাল স্বদেশ বান্ধব সমিতি' ছিল ১৯২১ সালে কংগ্রেসের সংগঠন গড়ে ওঠার আগে পর্যন্ত একমাত্র প্রকাশ্য রাজনৈতিক সংগঠন, যার প্রথম সভাপতি অশ্বিনীকুমার দত্ত এবং সম্পাদক সতীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। স্বদেশ বান্ধব সমিতিতে রেবতী দাশগুপ্ত বলে একজন যুক্ত ছিলেন, যিনি মণীন্দ্র গুপ্তের গ্রামের মানুষ। ১৯২০ সালে বরিশাল পার্টি এবং কলকাতার যতীন মুখার্জীর দল মিশে নতুন নাম নেয়ঃ 'যুগান্তর দল'। ১৯২০-২১ সাল থেকে অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের রাশ অবিভক্ত পূর্ববঙ্গে বিপ্লবীদের হাতেই ছিল এবং বরিশালে সে আন্দোলনের অগ্রদূত ছিলেন অশ্বিনীকুমার দত্ত ও শরৎকুমার ঘোষ। ৫০০-র ওপর নেতাকর্মী সে আন্দোলনে শুধু বরিশাল থেকেই গ্রেপ্তার হন। মহাত্মা গান্ধী প্রথমবার বরিশালে আসেন ১৯২১-এর সেপ্টেম্বরে এবং দ্বিতীয়বার ১৯২৫-এর জুনে। মণীন্দ্র গুপ্ত যে গ্রামের মানুষ, সেই গৈলা-র সম্ভ্রমসূচক অবস্থান ছিল বরিশালের ব্রিটিশবিরোধী রাজনীতির পরিসরে। মনিরুজ্জামান শাহীন জানানঃ "বরিশালের গ্রামগুলির মধ্যে স্বাধীনতা আন্দোলনে গৈলা-ফুল্লশ্রী ছিল অগ্রণী। অসহযোগ আন্দোলনে এ গ্রামের বহু কর্মী কারাবরণ করেন। এ গ্রামের চিন্তাহরণ গুপ্ত, সুধীর চন্দ্র সেন, কেশব চন্দ্র সেন প্রমুখ অসহযোগ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। 'দরিদ্র বান্ধব সমিতি' ও 'গৈলা-ফুল্লশ্রী যুবক সমিতি' আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে" (পৃ. ৯০)। শরৎ কুমার ঘোষের অভিভাবকত্বে যখন লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলন চলে বরিশালে, মণীন্দ্র গুপ্তের বয়স তখন চার। সত্যাগ্রহে বিশিষ্ট ভূমিকা নেন সতীন্দ্রনাথ সেন, যিনি ১৯২৪ সালে বরিশাল কংগ্রেসের সম্পাদক ছিলেন। মণীন্দ্র গুপ্তের শৈশবে বরিশালে এ. কে. ফজলুল হকের পরিচালনায় কৃষক-প্রজা আন্দোলন জোরকদমে শুরু হয়। ১৯২০ থেকে ১৯৪৩ পর্যন্ত 'কৃষক-প্রজা পার্টি' সক্রিয় ছিল। যেহেতু বিশ শতকের প্রথম দশক পর্যন্ত সম্পন্ন পরিবারের নেতাদের দ্বারা নির্ধারিত কংগ্রেস, মুসলিম লিগ বা বিপ্লবী দলগুলির আন্দোলন বরিশালে সাধারণ কৃষকদের সমস্যার প্রতি কার্যত উদাসীন ছিল, সেই শূন্যতা থেকে কৃষক-প্রজা আন্দোলনের উদ্ভব, যা ইংরেজ-বান্ধব দেশি জমিদারদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়। ১৯৪২-এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনে মণীন্দ্র গুপ্তের গ্রাম গৈলা-র নয়নারঞ্জন দাশগুপ্ত, গৈলা ছাত্র ফেডারেশনের অতুল চক্রবর্তী, অমূল্য সরকার, বিমলকান্তি ঘোষ, মাখন সেন, সুশীল দাশগুপ্ত, হীরেন চট্টোপাধ্যায়, স্বদেশ গুপ্ত, প্রাণকুমার সেন (ফুল্লশ্রী) প্রমুখ যখন ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, মণীন্দ্র গুপ্তের অবশ্য ততদিনে শিলচর-পর্বও শেষ হয়ে গেছে, তিনি কলকাতায় ও সেখান থেকে লাহোরে পাড়ি জমাচ্ছেন ততদিনে।

লক্ষনীয়, বালক মণীন্দ্র গুপ্ত যদিও বিভোর হয়ে ছিলেন প্রকৃতি ও নিঃসঙ্গতার পরিমণ্ডলে, অক্ষয় মালবেরি-র প্রথম পর্বে তাঁর বরিশালি জীবনের বিবরণের একমাত্র রাজনৈতিক ব্রিটিশবিরোধী তথ্যটি এসেছে সাংস্কৃতিক কার্যকলাপের অনুষঙ্গেঃ "পালার নাম মনে নেই, শুধু মনে আছে ধবধবে সাদা পোশাকের উপর চওড়া লাল বনাতের ফেট্টি পৈতের মতো পরা, পায়ে কালো হান্টিংবুট দু-জন ইংরেজ বাঙালিদের উপর চাবুক চালাচ্ছে। আর, আামার ভাগ্য, মাত্র দু-হাতের দূরত্বে আমি স্বয়ং মুকুন্দ দাসকে দেখলাম - গেরুয়া লুঙ্গি, আজানুলম্বিত গেরুয়া পাঞ্জাবি এবং গেরুয়া পাগড়ি পরা, বুকে সম্ভবত মেডেলের সাতলহরী, পাকা গোঁফ দু-পাশে ঝোলা, দশাসই চেহারার প্রৌঢ় সাজঘর থেকে গান গাইতে গাইতে ধেয়ে চলেছেন মঞ্চের দিকে। তাঁর গলার স্বর গম্ভীর, উঁচু, ক্রোধান্বিত এবং ঈষৎ ধরা" (পৃ. ৬৩)। তথ্যটি তাৎপর্যময়, কেননা বরিশালের অশ্বিনীকুমার দত্তের রাজনৈতিক মতে দীক্ষিত, ‘স্বদেশী যাত্রা’ নামে এক অভিনব যাত্রাপালার নির্মাতা, ‘বরিশাল হিতৈষী’ পত্রিকার লেখক মুকুন্দ দাস (১৮৭৮-১৯৩৪) তাঁর গান ও যাত্রাপালার মাধ্যমে মণীন্দ্র গুপ্তের জন্মের কয়েক বছর পর আইন অমান্য আন্দোলনে ও মণীন্দ্র গুপ্তের জন্মের কয়েক বছর আগে অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রভূত উদ্দীপনার সঞ্চার করতে সমর্থ হয়েছিলেন। অশ্বিনীকুমার দত্তের ভূমিকা সম্পর্কেও অবহিত না হয়ে উপায় ছিল না বালক মণীন্দ্র গুপ্তেরঃ "অশ্বিনীকুমার দত্তের গ্রাম বাটাজোড় ছাড়ালাম, সন্ধ্যার আগেই পৌঁছোলাম ছোট পিসিমার বাড়ি" (অক্ষয় মালবেরি, প্রথম পর্ব, পৃ. ৭১)। প্রসঙ্গত, "কয়েকজন সাহেব ঘোড়ায় চড়ে শিকার বা খুনোখুনি করতে চলেছে" - এমন বিষয়নির্ভর নির্বাক, সাদাকালো একটা চলচ্চিত্র মণীন্দ্র গুপ্ত বরিশালের কালুপাড়ায় দেখেছিলেন, বিদ্যুৎবিহীন গ্রামে ডায়নামো চালিয়ে তা দেখানো হয়েছিল (গদ্য সংগ্রহ ২, পৃ. ৭৯)। মনে রাখা ভালো, বুড়ো বয়সে পৌঁছে লেখা উপন্যাস ‘নেংটি’-তে নিজের জন্মস্থান বরিশালের গৈলায় চলা স্বদেশি আন্দোলনের কথা বলতে গিয়ে মণীন্দ্র গুপ্ত গান্ধীভক্ত 'তরুণ দল' ও 'সেবাশ্রম ক্লাব' ছাড়াও বিশেষভাবে উল্লেখ করেন ১৬.০৯.১৯৩১ তারিখে হিজলি বন্দিশালায় নিহত গৈলা গ্রামের স্বদেশি আন্দোলনের কর্মী ছাব্বিশ বছর বয়সী তারকেশ্বর সেনের স্মরণে ছেলেদের স্কুলের মাঠে আয়োজিত সভার কথা। হয়তো এই ঘটনাটি স্মৃতিপটে সমুজ্জ্বল ছিল স্মৃতিধর মণীন্দ্র গুপ্তের; তখনও তিনি গৈলা গ্রামেই ছিলেন - বয়স প্রায় পাঁচ বছর।

সাত বছর বয়সে আসামের শিলচরে চলে আসার পর থেকে ব্রিটিশদের সম্পর্কে নানা ধারণা গড়ে উঠল মণীন্দ্র গুপ্তের। "লম্বা, অস্থিসার, বুড়োমানুষ" চা-বাগানের সাহেব মি. মান্ডিকে দেখলেন মণীন্দ্র গুপ্ত, যিনি চাকরির পরও সংসার করেছিলেন চা-পাতা তোলা ভারতীয় মজুরনীর সঙ্গে, বাচ্চাকাচ্চা সমেত (অক্ষয় মালবেরি, দ্বিতীয় পর্ব, পৃ. ৫১)। বেঢপ গাউন পরা, লম্বা চুলে বিনুনি করা সেই "মান্ডি সাহেবের কুলি মেম", তাদের "লেন্ডিগেন্ডি ফরসা অপরিচ্ছন্ন ছেলেমেয়ে" আর রংজ্বলা, পেটের রোগে ভোগা মান্ডি সাহেবের বর্ণনা 'সেক্স অ্যান্ড দ্য কলোনিয়াল ইন্ডিয়া'- তে দুর্বা ঘোষের বিশ্লেষণ মনে করায় - ঔপনিবেশিক আমলে সাহেবদের এইসব বিচিত্র সংসার ব্রিটিশ শাসকদের উদ্বিগ্ন করত, একে তো সেই সংসারের নিম্নশ্রেণীর, অশিক্ষিত দেশি ঘরনীর মূর্তি ব্রিটিশ পারিবারিকতার নিয়মে বাঁধা আদর্শের সাপেক্ষে ছিল এক বেয়াড়া বিশৃঙ্খলা, বর্ণসংকর সন্তানরাও তাই, তদুপরি মি. মান্ডির মতো "অধঃপতিত’ সাহেবরা সংযম ও সভ্যতার তথাকথিত ভিকটোরীয় ব্রিটিশ মূল্যবোধকেও বিপর্যস্ত করতেন, রাজনৈতিক কর্তৃত্ব অক্ষত রাখতে গেলে যেটুকু খাঁটি ব্রিটিশ কৌলীন্য রক্ষা করা জরুরি সেই শাসনের এক যুক্তি হিসেবে, তা সাহেবদের সঙ্গে দেশি কুলিকামিন মেয়েদের যৌন সংসর্গে বিপন্ন হয়ে যেতে পারে - এখন একটা আশঙ্কায় সাদা কর্তারা জুজু হয়ে থাকতেন" (অক্ষয় মালবেরি, দ্বিতীয় পর্ব, পৃ. ৫১)। নরসিংহ হাইস্কুলের পাশের রাস্তার ওপারে সাহেবদের ক্লাব দেখতেন সাত বছরের মণীন্দ্র গুপ্ত এবং তারই সাথে বড়ো গাছের ফাঁকে গোর্খা সৈন্যদের হাতে সুরক্ষিত ট্রেজারি। গভর্নমেন্ট হাইস্কুলে সহপাঠী ধনেশ্বর পরিধার বাবা প্লান্টারদের ক্লাবে কাজ করেন, মণীন্দ্র গুপ্ত খেয়াল করেন, সে স্কুল ছেড়ে ক্লাবে চলে যায়, সাহেবরা যা খায় তাই খায়, স্কুলে পুরোনো টেনিস বল, পোলো বল নিয়ে আসে। কাছাড় ক্লাবের লনে সাহেব ও মেমদের মিক্সড ডাবলস টেনিস দেখতে গিয়ে তাদের দীপ্ত চেহারা, উচ্চকণ্ঠের হাসি, সাদা তোয়ালে আর মেহেদি বেড়ার ছায়ায় ইংল্যান্ডের গ্রামের আদল মুগ্ধ হয়ে খেয়াল করতেন মণীন্দ্র গুপ্ত। তাঁকে অভিভূত করত প্রাচীন উঁচু ঝাউগাছের ছায়ায় ঘেরা নিস্তব্ধ গির্জা এবং তার গথিক মিনারঃ "ছবিতে যেমন দেখা যায় তেমনি কাঠের আসনের সারি, পুলপিট, পিয়ানো। সিলিং অসম্ভব উঁচু। মাথার দিকে আর্চ, লম্বা লম্বা জানলা। তাতে রঙিন স্টেইনড্ গ্লাস। নিশ্চয়ই ইউরোপ থেকে আনানো" (অক্ষয় মালবেরি, দ্বিতীয় পর্ব, পৃ. ৫০)। তাঁকে হাতছানি দিত গাছপালায় ঘেরা সাহেবদের নিভৃত কবর, সেখানকার মসৃণবেদির নকশা, কখনো ঘাস ও ফুলগাছের সান্নিধ্যে সেসব পাথরে তিনি শুয়ে থাকতেন। কিন্তু উজ্জ্বল চামড়ার ওয়েলার ঘোড়া, বাবুর্চি, বেয়ারা, খানসামা, ট্রাম্পেট, বিউগল, ইউনিয়ন জ্যাক, গোর্খা প্লাটুনের কুচকাওয়াজ - এইসব বাহাদুরি সম্বল করে ১১ নভেম্বর আর্মিস্টিসের দিন স্মরণ করার যে আয়োজন চলত কিছুদিন আগে থেকেই, বাঁশের রেলিঙের বাইরে দাঁড়িয়ে নেটিভ কাছাড়িদের সঙ্গে তা দেখতে দেখতে মণীন্দ্র গুপ্ত বিস্ময়াবিষ্ট হয়েও বুঝতে পারতেন বা হয়তো পরে বুঝেছিলেন আরও স্পষ্ট করে, অধীনস্থ দেশীয় প্রজাদের দেখিয়ে দেখিয়ে সাহেবপ্রভুদের নিজেদের "সুখ আর শখের চরম করে" তোলার তীব্র অহংকারই আসলে ওইসব অনুষ্ঠানের সারবত্তা (অক্ষয় মালবেরি, দ্বিতীয় পর্ব, পৃ. ৫১)। ঘটা করে কাছাড়ি নেটিভদের কাছে আর্মিস্টিসের দিন পালন করা, পঞ্চম জর্জ মারা গেলে এদেশের সরকারী কর্মচারীদের কালো ফিতে পরার নির্দেশ দেওয়া, ষষ্ঠ জর্জের রাজ্যাভিষেক উপলক্ষে শিলচরের স্কুলের পড়ুয়াদের মিঠাই খাওয়ানো ও বাজি পোড়ানোর মধ্যে যে নির্মম পরিহাস ও হাস্যকর অসঙ্গতি - দুই-ই আছে, তা বুঝে মণীন্দ্র গুপ্তের সিদ্ধান্তঃ "ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের ভাবভঙ্গি গ্রাম্য সামন্ততন্ত্রেরই মতো" (অক্ষয় মালবেরি, দ্বিতীয় পর্ব, পৃ. ৫৩)। স্কাউটরা বাধ্যতই ইউনিয়ন জ্যাক আঁকা শিখত, মণীন্দ্র গুপ্ত নিজেও পঞ্চম জর্জ ও রানি এলিজাবেথের যুগল ছবি আঁকতে পারতেন, ব্যান্ডে শোনা যেত ‘গড সেভ দ্য কিং’। শিলচরে চা-বাগানের সাহেবদের আড্ডা, সরকারি অফিস ও বাংলোর কাছে থাকার ফলে ইংরেজদের সঙ্গে প্রায়ই দেখা হত কাছাড়ের দেশীয় প্রজাদের; কিন্তু সে ছিল "অদ্ভুত দৃষ্টিহীন দেখা" (অক্ষয় মালবেরি, দ্বিতীয় পর্ব, পৃ. ৪৯)। সাদা প্রভু ও বাদামি প্রজার এই দূরত্বের নানা ব্যঞ্জনা ছিল অন্তর্মুখী কিশোর মণীন্দ্র গুপ্তের কাছে। একদিকে "মেমদের বব করা চুল, জানু দেখানো স্কার্ট, রঞ্জিত লাল অধরোষ্ঠ" (অক্ষয় মালবেরি, দ্বিতীয় পর্ব, পৃ. ৫০)-এর দিকে চেয়ে থাকা এক ‘বান্ধবীহীন, সহপাঠিনীহীন’ কিশোর, জীবন যাকে ‘নানারকম কুপ্রস্তাব’ দিচ্ছে সেই ‘উগ্র’ সময়ে, অন্যদিকে জেলার কমিশনারের সাদা চামড়ার কিশোরী মেয়ে সাইকেল সমেত রাস্তায় কিশোর মণীন্দ্র গুপ্তের ঘাড়ে এসে পড়ে তাঁকেই গালাগাল দিয়ে চলে যাচ্ছে সে সময় (‘শিলচরের গল্প’, কবিতা সংগ্রহ, পৃ. ১৮৭)। তবে প্রত্যাখ্যানের আরও নানা সূক্ষ্ম বন্দোবস্ত যে বরাদ্দ ছিল নেটিভদের জন্য, তা বন্ধুদের কাছে কিশোর মণীন্দ্র গুপ্তের শোনা একটি গল্পেও মালুম হয়ঃ "সাহেবের বাংলোয় কাজ করতে আসা দুই চুনকাম মিস্ত্রি কাজের ফাঁকে বিভোর হয়ে সুন্দরী মেমসাহেবকে দেখে; কিন্তু যখন সেই মেমসাহেব তাদের সামনেই নিঃসংকোচে স্নানের জন্য নগ্ন হয়, তারা টের পায় তারা সেই মেমসাহেবের কাছে মনুষ্যপদবাচ্যই নয়, নিজেদের রূপমুগ্ধ দৃষ্টি থেকে বিচ্যুত হয়ে তারা তাই তখন উপনিবেশের শাসিত অপর হিসেবে নিজেদের অধঃপতিত সামাজিক-নৈতিক হীনাবস্থা বুঝে বিড়ম্বিত পৌরুষের যন্ত্রণায় সচকিত হয়ে ওঠে।" এ-ই হল মণীন্দ্র গুপ্তের লব্জে ‘দৃষ্টিহীন দেখা’-র মর্ম - উপনিবেশের প্রভুর শূন্যবীক্ষণে বাদামি চামড়ার সাধারণ ভারতীয়রা বিমূর্ত, সত্তাহীন, ক্ষমতা-নিষ্ক্রান্ত, ‘ছায়াবাজির লোক’ (অক্ষয় মালবেরি, দ্বিতীয় পর্ব, পৃ. ৪৯)।

শিলচরেই গ্রন্থকীট মণীন্দ্র গুপ্ত দুই কৃতী বাঙালি অক্ষয়কুমার নন্দী ও অমলা নন্দীর লেখা 'বিলাত ভ্রমণ ও সাত সাগরের তীরে'-তে ইউরোপের বর্ণনা পড়েছিলেন, পরে কলকাতায় গিয়ে তাঁর এক জার্মানি-ফেরত মামার কাছে ইউরোপের গল্প শুনবেন, যাঁর 'ইউরোপের আলো' নামে একটি বইও ছিল, কিন্তু স্বদেশে প্রাত্যহিক জীবনে অধীনস্থ অপর হয়ে থাকার যে অভিজ্ঞতা আরো অনেকের মতো তাঁরও হচ্ছিল, তা কি তাঁকে ভেতরে ভেতরে ক্ষিপ্ত করে তুলত না? আসাম-ব্রহ্ম সীমান্তে পাহাড় জঙ্গলের দুর্ভেদ্য এলাকায় বংশানুক্রমে বাস করা নৃমুণ্ডশিকারী নাগাদের হাতে বৃটিশ সরকারের হেনস্থার বর্ণনা যখন মণীন্দ্র গুপ্ত দেন, তাঁকে কিন্তু বেশ সন্তুষ্ট মনে হয়। কিন্তু স্বভাবের দিক দিয়ে এমন আত্মমগ্ন ছিলেন যে ব্রিটিশবিরোধী রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। ক্লাস এইটে যখন, তখনই তিনি কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র সংগঠনের তৎপরতা লক্ষ করেন শিলচরে। জওহরলাল নেহরু, সুভাষচন্দ্র বসু, মানবেন্দ্রনাথ রায়, বাটলিওয়লা ও সোমনাথ লাহিড়ীদের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বক্তৃতা শিলচরে সরাসরি শুনেছেন, আরও পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লাহোরের সেনা ছাউনিতে গিয়ে সুভাষচন্দ্রের দেশজোড়া আবেদন তিনি উপলব্ধি করেছেন। মণীন্দ্র গুপ্ত যখন বরিশালে নেহাতই বালক, সেই সময়টাই কিন্তু ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িকতার জটিল রাজনীতির সলতে পাকানোর ও পেকে ওঠার সময়, শিলচরে এসে সেই রাজনীতিকেও তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন স্বদেশী-করা ছেলে এবং মুসলিম লিগের কর্মীদের রক্তাক্ত দ্বন্দ্বে। বলা বাহুল্য, হিন্দু-মুসলিম বিভেদকে কীভাবে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ নিজেদের স্বার্থে উসকে দিচ্ছিলেন, তাও খেয়াল করার পরিসর তৈরি হল শিলচর-পর্বের শেষ দিকে মণীন্দ্র গুপ্তের জন্য।

তারপর কলকাতায় এসে মণীন্দ্র গুপ্ত ডালহৌসি স্কোয়ারে ক্লাইভ বিল্ডিংসে এক ইংরেজ ব্যবসায়ী অফিসে সাহেবের কাছে ইন্টারভিউ দিয়ে নথিপত্র নকল করার কাজ জুটিয়েছিলেন, জাপানি বোমার ভয়ে ত্রস্ত কলকাতায় দিন কাটিয়েছিলেন, কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক কাজকর্মের মূল্য অনুধাবন করেছিলেনঃ "ইতিমধ্যে ভারত ছাড়ো আন্দোলন হল, মাতঙ্গিনী হাজরা মারা গেলেন, সুভাষচন্দ্র বসু ইংরেজের চোখে ধুলো দিয়ে ভারতের বাইরে চলে গেলেন, জাপান যুদ্ধটাকে আমাদের দোরগোড়ায় নিয়ে এল" (অক্ষয় মালবেরি, তৃতীয় পর্ব, পৃ. ২৩)। শিবপুরে বি. ই. কলেজে আধবুড়ো ইংরেজ কোপল্যান্ডের কাছে এঞ্জিনিয়ারিং ড্রইং শিখলেন মণীন্দ্র গুপ্ত এরপর, টাইফয়েডের কবলে পড়ে কম্যান্ড হাসপাতালে ব্রিটিশ মহিলা মেট্রনের তৎপরতা লক্ষ করলেন, লাহোরে আর্মি ব্যারাকে বিল নামের এক ব্রিটিশ কর্পোরালের সঙ্গে একই কামরায় থাকলেন, সার্জেন্ট জর্ডানের সঙ্গে পরিচয় হয়। এখানেও ফৌজি স্কুলে এক দ্বিজাতিতত্ত্ব-প্রচারক পাঞ্জাবি মুসলমানের ক্লাস করতে গিয়ে মণীন্দ্র গুপ্ত তাঁর ভেদবুদ্ধিতে যারপরনাই অবাক হন, পরে তাঁর সন্দেহ হয় যে ব্রিটিশ শাসকের দেশভাগের ষড়যন্ত্রের আর্দশগত ভিত্তি নির্মাণ করার লক্ষ্যেই দ্বিজাতিতত্ত্বের কারবারিরা সে সময়ে এইভাবে সক্রিয় হয়েছিলেন। স্বাধীনতার অব্যবহিত পূর্বের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র সম্পর্কে ফৌজে থেকে তেমন কিছুই সে সময়ে জানতে পারেননি তিনি। শুধু ‘ফৌজি আখবর’ পড়তে পেতেন (অক্ষয় মালবেরি, তৃতীয় পর্ব, পৃ. ৮৩)। ১৯৪৫ সালেও ফৌজে বসে, দেশভাগ তাঁর মতো অনেকের কল্পনার বাইরে। ব্রিটিশ আমলে উপনিবেশের অধীনস্থ অপর হয়ে থাকা মণীন্দ্র গুপ্ত কি স্বাধীন ভারতবর্ষ নিয়ে খুব আহ্লাদিত ছিলেন? তা মোটেই নয়। সাদা চামড়ার যে মেয়েটি তাঁকে গালি দিয়েই রেহাই দিয়েছিল শিলচরে, সে প্রসঙ্গ স্মরণ করে তাই তিনি বলেন, স্বাধীন ভারতে তেমন ঘটলে দেশি সাহেবের "জেড ক্যাটাগরির রক্ষীরা" হয়তো তাঁকে পিটিয়ে দেশছাড়া করত (অক্ষয় মালবেরি, তৃতীয় পর্ব, পৃ. ৫৩)। দেশভাগ স্বাধীনতার অর্থ যাঁদের জীবনে লুপ্ত করেছিল এবং যাঁরা দেশী ধনিকতন্ত্রের কুৎসিত উত্থান দেখতে পেয়েছিলেন স্বাধীন ভারতবর্ষে, মণীন্দ্র গুপ্ত তাঁদেরই একজনঃ "আস্ত একটি গোটা দেশ কাকে বলে, সেই পরাধীনতার মধ্যেও আমরা জানতাম, আজকাল এত সার্বভৌমত্ব, এত স্বাধীনতার মধ্যেও যা আর টের পাই না" (গদ্য সংগ্রহ ১, পৃ. ১০৭)। শ্লেষ ছেড়ে কখনো তিনি সরাসরি প্রশ্ন করেছেনঃ "এসব কথা খুব প্রতিক্রিয়াশীল মনে হতে পারে, কিন্তু খতিয়ে দেখুন তো স্বাধীনতা-পরবর্তী এই চুয়াল্লিশ বছরে হিন্দি সংস্কৃতির নতুন চটক, ফাঁকিবাজ ঘুষখোর বিরাট এক দঙ্গল চাকুরিজীবী, কয়েকটি ধনী ব্যবসায়ী পরিবার, যাচ্ছেতাই কতগুলো নেতা এবং জনসংখ্যার তিনগুণ বৃদ্ধি ছাড়া আর কী কী উন্নতি হয়েছে আমাদের?" (গদ্য সংগ্রহ ১, পৃ. ১১৪)। এ প্রশ্ন যে সময়ের, তার তেইশ বছর পরেও, অর্থাৎ ২০১৪-তেও, খানকতক পরিচিতিব্যঞ্জক কার্ড হাতে নিয়ে নিজেকে "বেআইনি লোক" বলে বিড়ম্বিত মনে হত তাঁর (গদ্য সংগ্রহ ২, পৃ. ১৮৭)। সুতরাং, মণীন্দ্র গুপ্তের ব্রিটিশ আমলের অভিজ্ঞতার কথা ভাবার সময় একইসঙ্গে উত্তর-ঔপনিবেশিক ভারত রাষ্ট্রে সম্প্রতি কালে নাগরিক ব্যক্তিমানুষের সমূহ অস্তিত্বকে ‘Governmental surveillance identity’-তে সংকুচিত করার নিয়ন্ত্রণপন্থী রাজনীতির যে সমালোচনা তিনি করেছেন, তা মনে রাখলে একপেশেমির বিপদ থেকে পাঠকরা রক্ষা পাবেন হয়তো (Barnard-Wills, p. 3)।


সূত্রঃ
● গুপ্ত, মণীন্দ্র। অক্ষয় মালবেরি। প্রথম পর্ব। চিত্রক পাবলিকেশন। কলকাতা। ২০০৪।
● গুপ্ত, মণীন্দ্র। অক্ষয় মালবেরি। দ্বিতীয় পর্ব। অবভাস। কলকাতা। ২০০৬।
● গুপ্ত, মণীন্দ্র। অক্ষয় মালবেরি। তৃতীয় পর্ব। চিত্রক পাবলিকেশন। কলকাতা। ২০০৪।
● গুপ্ত, মণীন্দ্র। কবিতা সংগ্রহ। আদম। কৃষ্ণনগর। ২০১১।
● গুপ্ত, মণীন্দ্র। গদ্য সংগ্রহ ১। অবভাস। কলকাতা। ২০০৭।
● গুপ্ত, মণীন্দ্র। গদ্য সংগ্রহ ২। অবভাস। কলকাতা। ২০১৬।
● শাহীন, মনিরুজ্জামান। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে বরিশাল ১৯২০-১৯৪৭। সুবর্ণ। ঢাকা। ২০১৬।
● Barnard-Wills, David. Surveillance and Identity: Discourse, Subjectivity and the State. Ashgate Publishing Ltd. Surrey. 2012.