আরেক রকম ● দশম বর্ষ ত্রয়োদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুলাই, ২০২২ ● ১৬-৩১ আষাঢ়, ১৪২৯

সমসাময়িক

বামপন্থার কলম্বিয়া বিজয়


বিশ্বজুড়ে দক্ষিণপন্থী মৌলবাদী রাজনীতির দাপিয়ে বেড়ানোর আবহে প্রথম বামপন্থী প্রেসিডেন্ট পেল লাতিন আমেরিকার আরও একটি দেশ কলম্বিয়া। বিগত শতাব্দীর শেষ দশক থেকে লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে বামপন্থী সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া, চিলি, পেরু, উরুগুয়ে, ভেনেজুয়েলা প্রভৃতি দেশে বাম বা মধ্য-বাম সরকার ক্ষমতায় এসেছে। এই ধারাবাহিকতায় একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল কলম্বিয়া।

১৮১০-এর জুলাই মাসে স্পেনের ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার পর থেকে দেশের শাসন ক্ষমতায় কলম্বিয়ার নাগরিকদের দেখা গেলেও বাস্তবে অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ চলে যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে। কৃষি নির্ভর দেশের প্রায় সমস্ত কৃষিপণ্যর উৎপাদন-বিপণন থেকে শুরু করে দাম নিয়ন্ত্রণের সার্বিক দায়িত্ব নিয়ে নিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থা। এমনকি লাতিন আমেরিকার প্রবাদপ্রতিম সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতা সিমোন বোলিভার যিনি এল লিবের্তাদোর (মুক্তিদাতা) নামেই ভেনেজুয়েলা, কলম্বিয়া, ইকুয়েডর, পেরু, পানামা এবং বলিভিয়ায় পরিচিত তিনিও যখন ১৮১৯ থেকে ১৮৩০ সাল পর্যন্ত কলম্বিয়ার রাষ্ট্রপতি ছিলেন তখনও এই প্রক্রিয়া অব্যাহত ছিল।

কলম্বিয়ার অর্থনীতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার লড়াই ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ লগ্নে সশস্ত্র গৃহযুদ্ধে পরিণত হয়। কলম্বিয়াতে ১৭ অক্টোবর থেকে ২১ নভেম্বর, ১৯০২ পর্যন্ত লিবারেল পার্টি এবং ন্যাশনাল পার্টির মধ্যে চলে ঐতিহাসিক 'হাজার দিনের লড়াই'। বাস্তবে এই লড়াই ছিল বিভিন্ন মার্কিন বহুজাতিকের বিবাদ। এই ধরনের যুদ্ধে যে পক্ষই জিতুক না কেন চূড়ান্ত পর্যায়ে কৃষিজীবী-শ্রমজীবী মানুষের কোনো উন্নতি হয় না। এবং খেটে খাওয়া মানুষের প্রতিবাদ বন্দুকের গুলিতে স্তব্ধ করে দেওয়া হয়। যেমন ঘটেছিল ১৯২৮-এর কলম্বিয়ার কলা বাগিচায়। কতজন কৃষক মারা গেছিলেন? আজও হিসেব পাওয়া যায়নি।

বহুজাতিক নিয়ন্ত্রিত ভূস্বামী আর ধনী ব্যবসায়ীদের রমরমা অবস্থার বিপ্রতীপে কৃষিজীবী-শ্রমজীবীদের অসন্তোষ থেকেই কলম্বিয়ায় গণ-আলোড়নের সূত্রপাত। একই সঙ্গে বাড়তে থাকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। সামগ্রিক রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বন্ধ করার উদ্দেশে সংগঠিত হতে থাকে গণ আন্দোলন। এই আন্দোলনের প্রধান সংগঠক ছিলেন হোর্খে এলিয়েসের গাইতান। কলম্বিয়ার সমাজ ও রাজনীতিকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস মুক্ত করার আহ্বান জানিয়ে জনগণকে সংগঠিত করার জন্য গাইতান অল্প সময়ের মধ্যেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। পরিস্থিতি এমনই হয় যে, দেশবাসী ধরেই নিয়েছিলেন যে ১৯৪৮-এর নির্বাচনের পর কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট হবেন গাইতান। রাষ্ট্রের পক্ষে তা মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি। ১৯৪৮-এর ৯ এপ্রিল গাইতানকে রাজধানী বোগোতায় প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করা হয়। সেই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তৎক্ষণাৎ শুরু হয় সশস্ত্র লড়াই। কলম্বিয়ার ইতিহাসে যা 'এল বোগোতাজো' বলে পরিচিত। লড়াইয়ের প্রথম তিন দিনেই মারা যায় অন্ততঃ আড়াই হাজার মানুষ। আগুন জ্বালিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয় গ্রাম-শহর, ক্ষেত খামার। সংসদের অধিবেশনে ভাষণ দেওয়ার সময় গুলিতে নিহত হলেন জনৈক উদারপন্থী সাংসদ। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস থেকে প্রাণ বাঁচাতে প্রতিবেশী দেশ ভেনেজুয়েলায় পালিয়ে গেলেন দশ লক্ষাধিক কৃষক। প্রায় দুই দশক ধরে চলতে থাকা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের (যা সমাজতত্ত্বের পরিভাষায় 'লা ভিয়োলিন্সেইয়া' নামে পরিচিত) বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্য তৈরি হল বেশ কয়েকটি জঙ্গি গেরিলা সংগঠন। একই সময়ে গড়ে ওঠে ড্রাগ-মাদক উৎপাদন ও ব্যবসার আধিপত্য।

ইএলএন, এফএআরসি, এম-১৯ নামের সংগঠনগুলি ১৯৬০-৭০ দশক থেকেই সক্রিয়। কলম্বিয়ার রাজনীতিতে এই সংগঠনগুলি দীর্ঘকাল সংসদীয় রাজনীতির পথ পরিহার করেছিল। এম-১৯ বা এফএআরসি-এর মতো সংগঠনগুলি সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের প্রচেষ্টা করে এসেছে দীর্ঘকাল এবং সেই প্রচেষ্টা বিশেষ ফলপ্রসূ হয়নি। মার্কিন সমর্থনে কলম্বিয়া সরকার সেনাবাহিনী এবং অতি-দক্ষিণ বেসরকারী আধা-সামরিক বাহিনীর সহায়তায় সাফল্যের সঙ্গে বিপ্লব প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছে। একের পর এক বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়নিস্ট, সমাজকর্মী, বুদ্ধিজীবী খুন হয়েছেন। এই পথ সঠিক পথ নয়, তা উপলব্ধি করে ১৯৯০-এর দশক থেকে গেরিলা বাহিনীগুলি অস্ত্র পরিত্যাগ করে সংসদীয় রাজনীতিতে ফিরে আসতে শুরু করে। তবুও বামপন্থী নেতা-কর্মীদের রাজনৈতিক হত্যার ধারাবাহিকতা কিন্তু অটুট ছিল।

লাতিন আমেরিকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম মিত্র এই দেশটিতে কোনোদিন বামপন্থা তেমনভাবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায়নি। কিন্তু ২০২২-এর মার্চ মাসের কলম্বিয়ার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অপেক্ষা করছিল নতুন চমক। ফল ঘোষণা হতেই দেখা বাম জোট ‘প্যাক্টো হিস্টোরিকো’ বা ‘হিস্টোরিক প্যাক্ট’ ১৬.৭৮ শতাংশ ভোট আর ২৭টি আসন লাভ করে ভোট শতাংশের বিচারে প্রথম এবং আসন সংখ্যার বিচারে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে। পরে আরও কয়েকটি বাম দল যারা পৃথক ভাবে লড়াই করেছিল এবং সদ্য সশস্ত্র রাজনীতি ছেড়ে নির্বাচনী রাজনীতিতে যোগদান করা এফএআরসি-এর রাজনৈতিক দল ‘কমিউনস্’ এই জোটে যোগদান করলে জোটের আসন সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৪। ফলে আসন সংখ্যার বিচারে নতুন জোট কলম্বিয়ার সংসদে প্রথম স্থানে উঠে আসে। তবে ব্যক্তি হত্যা, অপহরণ ইত্যাদির শেষ নেই।

এম-১৯ গোষ্ঠী ১৯৯০-এর দশকে সংসদীয় রাজনীতিতে ফেরত এলে দলের প্রথম রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশগ্রহণের সময়ই রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী ও দলের নেতা কার্লোস পিজারো গুপ্তঘাতকের হাতে নিহত হন। তারপরেও অন্যান্য নির্বাচনে বামপন্থী প্রার্থীদের হত্যা করা হয়। ২০২২-এ এখনও অবধি ৪৮ জন বামপন্থী কর্মী-সমর্থক রাজনৈতিক হত্যার শিকার হয়েছেন। সদ্য নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি গুস্তাভো পেত্রো এম-১৯ গোষ্ঠীর প্রাক্তন সদস্য। গুপ্তহত্যার প্রচেষ্টা থেকে তিনিও রেহাই পাননি। প্রচেষ্টা সফল না হলেও তিনি এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট ফ্রান্সিয়া মার্কেস্ দুজনের কেউই বিপদমুক্ত নন বলেই শোনা যায়।

পেত্রো নিজে অবশ্য খুব চিন্তিত নন। পেত্রো এবং মার্কেস্ দুজনেরই জন্ম নিম্নবিত্ত পরিবারে। রাজনীতিতেও রাজধানী বোগোতার মেয়র হিসেবে পেত্রো কলম্বিয়ার প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে লড়াই করেই প্রশাসন চালিয়েছেন। প্রতিটি অধিকার প্রতিটি দাবী লড়াই করেই আদায় করতে হয়েছে। এইরকম প্রতিকূল স্রোতের বিরুদ্ধে তিনি সাঁতার দিতে অভ্যস্ত। এম-১৯-এর সক্রিয় সদস্য ছিলেন বলে কলম্বিয়ার গ্রামাঞ্চলকে তিনি হাতের তালুর মতো চেনেন। একসময় সশস্ত্র সংগ্রামে যে অভিজ্ঞতা গড়ে উঠেছিল, সেই অভিজ্ঞতা তিনি এখন সংসদীয় সংগ্রামে সাফল্যের সঙ্গে কাজে লাগাচ্ছেন। বহু প্রাক্তন জঙ্গি গোষ্ঠীর নেতা-কর্মী, পুরোনো বিবাদ ভুলে তাঁর পতাকার নিচে জড়ো হয়েছেন। পেত্রো সফল হবেন কিনা, এর উত্তর ভবিষ্যৎ দেবে। কিন্তু এতে সন্দেহ নেই, কলম্বিয়ার রাজনীতিতে বামেরা আর প্রান্তিক শক্তি না, পেত্রোর নেতৃত্বে তাঁরা এখন দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক শক্তি। তাঁদের উপেক্ষা করা আর কারোর পক্ষে সম্ভব নয়।

সদ্য নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেত্রো নির্বাচনী ইশতেহারে বলেছেন যে, ক্ষমতাসীন হওয়ার পর দেশের ৪ হাজার ধনকুবেরের উপর বিশেষ কর বসিয়ে সেই অর্থে বিভিন্ন সামাজিক প্রকল্প চালু করা হবে। ভাইস প্রেসিডেন্ট ফ্রান্সিয়া মার্কেস্ নিজে একজন পরিবেশকর্মী। কাজেই নির্বাচনী প্রচারে বলা হয়েছিল যে, কলম্বিয়াকে পেট্রোল-ডিজেল ভিত্তিক অর্থনীতি থেকে পরিবেশবান্ধব শক্তি উৎপাদনের দিকে নিয়ে আসার উদ্যোগ নেওয়া হবে। বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তাঁবেদারি বন্ধ করার প্রস্তাব রয়েছে। লাতিন আমেরিকার অন্যান্য বামপন্থী সরকারগুলির সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার কথাও বলা হয়েছে।

অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে এইসব প্রস্তাব পেত্রোকে কলম্বিয়ার মার্কিন সমর্থক রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলির পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন। কলম্বিয়ার সেনাবাহিনীও সন্তুষ্ট নয়। সেনাপ্রধান জেনারেল এডুয়ার্ডো জাপাতেইরো প্রকাশ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। পেত্রোর বিরুদ্ধে তাঁর প্রকাশ্য বিষোদ্গার সংবিধানের প্রকাশ্য লঙ্ঘন। কাজেই সামরিক অভ্যুত্থানের আশঙ্কাও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।

নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর কলম্বিয়ার রাজধানী বোগাতার এস্টাদিও নেমেসিও কামাচো স্টেডিয়ামে সমবেত লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাবেশে বাম মনোভাবাপন্ন বিভিন্ন দলের জোট 'প্যাক্টো হিস্টোরিকা'-র (হিস্টোরিকাল প্যাক্ট) পক্ষে সদ্য নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেত্রো বলেন, - “আপনারা ইতিহাস লিখেছেন। আমি আপনাদের মর্যাদা রাখব। বড়লোক আর এই দেশে আরও বড়লোক হবে না। যে মানুষ অভাবে কাটাচ্ছেন, তাঁদের ঘরে জ্বলবে শিক্ষা-স্বাস্থ্য-উপার্জনের রঙমশাল।”

গত তিন-সাড়ে তিন বছর ধরেই কলম্বিয়ার দক্ষিণপন্থী সরকারের বিরুদ্ধে ক্রমশ তীব্র হচ্ছিল ক্ষোভ। যা গণ আন্দোলনের রূপ নিয়ে মাঝে মাঝেই আছড়ে পড়ছিল। মূলত ছাত্র ও শ্রমিক আন্দোলনে উত্তাল হচ্ছিল কলম্বিয়া। এই সময়পর্বে অন্তত ৩১ জন আন্দোলনকারীর মৃত্যু হয়েছে। সেই তীব্র সরকার বিরোধিতার ফসলই ঘরে তুলেছে প্যাক্টো হিস্টোরিকা। হিসেব বলছে, প্রায় ৫০.৪ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন পেত্রো। তাঁর বিরুদ্ধে দক্ষিণপন্থীদের প্রার্থী ছিলেন ধনকুবের রডল্ফো হার্নান্দেস্। তিনি পেয়েছেন ৪৭.৩ শতাংশ ভোট। অর্থাৎ হার্নান্দেস্ গুস্তাভো পেত্রোর থেকে প্রায় সাত লক্ষ ভোট কম পেয়েছেন।

১৯৬০ সালে কলম্বিয়ার কর্ডোবায় জন্ম পেত্রোর। মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি এম-১৯ গোষ্ঠীর সদস্য হন। ১৯৯১-এ তিনি একটি নির্বাচনে চেম্বার অব রিপ্রেজেন্টেটিভের সদস্য হন। এরপর থেকে তিনি দীর্ঘদিন বিরোধী দলনেতা ও গেরিলা যুদ্ধের নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বেশ কিছু সময়ের জন্য তিনি বেগোতার মেয়র পদ সামলেছেন। তাঁর শাসনকালে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এর ফলে খুব দ্রুত কলম্বিয়ায় হত্যার ঘটনা হ্রাস পায়। আবার এখন তাঁর হাতে বিরাট দায়িত্ব। অতীত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে দেশকে নতুন করে গড়ার অঙ্গীকার নিয়ে পেত্রো দু'হাত আকাশে ছুড়ে বলছেন, “এল পুয়েবলো ইউনিডো, জামাস সেরা ভেনসিডো।” অর্থাৎ মানুষ ঐক্যবদ্ধ হলে, জয় হবেই হবে।