আরেক রকম ● দশম বর্ষ ত্রয়োদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুলাই, ২০২২ ● ১৬-৩১ আষাঢ়, ১৪২৯

সমসাময়িক

হাল ছেড়ো না বন্ধু


একটা দেশ, দেশের পরিস্থিতি, দেশের সংকটকে দেখতে হয় দেশের সুবিধাবঞ্চিত অধিকারবঞ্চিত দরিদ্র, বিশেষত সংখ্যালঘুদের দৃষ্টি থেকে। কীভাবে তাঁরা দেখেন, বা বলা ভালো দেখতে বাধ্য হন, একটা ঘটনাক্রমকে।

পরিস্থিতি এমন, কয়েক বছর আগেও যে উদ্ধব ঠাকরে ও তাঁর দল শিবসেনা ছিল মুসলিম সমাজের আতঙ্ক, সেই উদ্ধব ঠাকরেকে মুখ্যমন্ত্রী পদ ছাড়তে হলে মুসলিম সমাজের মধ্যে নেমে আসে বিষণ্ণতা, চেপে বসে আতঙ্ক। এরপর কি রাজস্থান ঝাড়খণ্ড হয়ে পশ্চিমবঙ্গে সরকার ভাঙার পালা? মহারাষ্ট্রে গত আড়াই বছর মোটামুটি একটা ধর্মনিরপেক্ষ সরকারি ব্যবস্থা বজায় ছিল। শুধু মুসলিম বলে যেখানে সেখানে পিটিয়ে মেরে ফেলবে, দাঙ্গা বাধাবে - এই ভয় থেকে খানিকটা মুক্ত ছিলেন মহারাষ্ট্রের সংখ্যালঘু ও ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ। যখন তখন 'দেশদ্রোহী' বলে দেগে দিয়ে জেলে পুরে দেওয়া হয়নি। ধারাভি বস্তিতে মুসলিমরা করোনা ছড়িয়েছে বলে, প্রচার চলেনি।

এরই মাঝে রাজস্থানের উদয়পুরে দুই মুসলিম মৌলবাদী কানহাইয়ালাল নামে দর্জিকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। কানহাইয়ালাল ক'দিন আগে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হতে পারে এমন মন্তব্য করে বন্দি হয়েছিলেন। জামিনে মুক্ত ছিলেন। ২৮ জুন দুপুরে হামলা করে দুজন আততায়ী। ধর্মের নামে অপধর্মীয় কাজ। হত্যা করেন কানহাইয়ালালকে। একজন খুন করেন। আরেকজন ভিডিও। সেটা নিজেরাই সম্প্রচার করেন অনলাইনে। এই ঘটনায় স্বাভাবিকভাবেই দেশজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে। মুসলিম সংগঠনগুলোও প্রতিবাদ জানিয়েছে। যদিও সঙ্ঘ পরিবারের মধ্যে উল্টো হাওয়া। ওঁরা এটাই চান। যত বেশি ধর্মের নামে হিংসা হবে তত মেরুকরণের সুবিধা।

ঘটনাটি ঘটেছে রাজস্থানের উদয়পুরে। ২৮ জুন, ২০২২। এর ঠিক পাঁচ বছর আগে ৬ ডিসেম্বর, ২০১৭ রাজস্থানের উদয়পুরে রাজসমন্দে পুড়িয়ে হত্যা করা হয় পশ্চিমবঙ্গের ৫০ বছর বয়স্ক আফরাজুলকে। লাভ জিহাদ করেছে নাকি আফরাজুল। পরে খুনী শম্ভুলাল রেগার বলে, ভুল লোককে খুন করেছে। ও আফরাজুলকে চিনতো বা জানতো না। শম্ভুলাল পুড়িয়ে মারার ভিডিওটা করায় আট বছরের শিশু ভাইপোকে দিয়ে। ঘৃণা কতদূর বিস্তারিত এটা তার একটা জ্বলন্ত উদাহরণ। আট বছরের শিশু আগুনে পুড়ে মারা দেখেও প্রতিবাদ করছে না। এটা সবচেয়ে ভয়ের লক্ষণ।তার আগে ২০১৭-তে রাজস্থানে মুসলিম হত্যার কিছু ঘটনা ঘটে। আলোয়াড়ে পহেলু খানকে পিটিয়ে মেরে ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া হয়। ১ এপ্রিল, ২০১৭। দোষীরা বেকসুর খালাস। চাকরিও পেয়েছে। জাফর খানকে প্রকাশ্যে মেরে ফেলা হয় ১৬ জুন, ২০১৭। প্রতাপগড়ে। উমর খুন হন প্রকাশ্যে ১০ নভেম্বর আলোয়াড়ের গোবিন্দগড়ে।

রাজস্থানে কংগ্রেস সরকার আসার পর এগুলো কিছুটা কমেছিল। তাকে বাড়াতে সাহায্য করবে মুসলিম মৌলবাদীদের দ্বারা সংঘটিত এই অমানবিক হত্যা। এর নিন্দার ভাষা নেই। মৌলবাদ দিয়ে মৌলবাদকে ঠেকানো যায় না। এতে সংখ্যালঘুর বিপদ আরো বাড়বে। ধর্মনিরপেক্ষতাই পথ। বুঝতে হবে বিপথগামীদের। মুসলীম মৌলবাদীরা বকলমে আসলে হিন্দু মৌলবাদকেই শক্তিশালী করে। এই সার কথাটি বোঝার এবং সোচ্চারে বলার প্রয়োজন রয়েছে।

এর মাঝেই মহারাষ্ট্রে সরকার বদলের খেলা। দেশে ১০টি উপনির্বাচন হয়েছে। বিজেপি পাঁচটি জিতেছে। পাঁচটিতে হেরেছে। মধ্যপ্রদেশে ব্যালটে ভোট হয়েছে জেলা পরিষদের।‌ কংগ্রেসের জয় বিপুল। শাসকদল বিজেপি ধরাশায়ী। মধ্যপ্রদেশ, কর্ণাটক, মেঘালয়, মণিপুর, গোয়া, সিকিম - বিজেপি ভোটে হেরেও সরকার গড়েছে বিধায়ক কিনে। এটাও চরম দুর্নীতি। এখানে কিন্তু সিবিআই ইডি আয়কর দপ্তর দেখেও দেখে না।‌ মহারাষ্ট্রে শিবসেনা ইডির দপ্তরের সামনে ব্যানার ঝুলিয়ে দিয়েছেঃ বিজেপির প্রদেশ কার্যালয়। রাষ্ট্রীয় বিধিবদ্ধ সংস্থা দলীয়ভাবে ব্যবহার হলে তা দেশের পক্ষে অতি ভয়ের।

কেরালার মুখ্যমন্ত্রী বিজয়নের বিরুদ্ধে বিরিয়ানির কৌটোয় সোনা নেওয়ার মিথ্যা অভিযোগ তুলেছে ইডি। বিভিন্ন রাজ্যে যেখানে ইডি অভিযোগ করলেই বিরোধী বিধায়করা সুড়সুড় করে বিজেপিতে আশ্রয় নিচ্ছেন। এবং বিজেপির ওয়াসিং মেশিনে সাফ হয়ে যাচ্ছেন। সারদা নারদ কেলেঙ্কারি দর কষাকষির খেলায় রূপান্তরিত।

এই অবস্থায় দেশে ১৮ জুলাই রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। বিরোধীরা এই প্রথম বিজেপির রাজত্বকালে সম্মিলিতভাবে একজনকে প্রার্থী করেছে। রাষ্ট্রপতি পদের প্রার্থী যশবন্ত সিনহা বাজপেয়ী সরকারের অর্থমন্ত্রী ছিলেন। পরে দলীয় নীতির বিরুদ্ধে কিছু কঠোর বিবৃতি দেন। এখন পদত্যাগ করে সর্বসম্মত প্রার্থী। যদিও মায়াবতী, বিজু, রেড্ডিরা বিজেপির প্রার্থী দ্রৌপদী মুর্মুর পক্ষে ভোট দেবেন জানিয়েছেন। ঝাড়খণ্ডে হেমন্ত সোরেন মুখ্যমন্ত্রী। বিজেপি বিরোধী জোটের। কিন্তু আদিবাসী প্রার্থী বলে হেমন্ত সোরেনরাও বিজেপির প্রার্থীকে ভোট দেবেন। যদিও অতীতে দেখা গেছে প্রার্থীর জন্ম বা দলীয় পরিচয় তার ধর্ম বা দলের খুব কাজে লাগে না।

কালাম রাষ্ট্রপতি থাকার সময় নজিরবিহীনভাবে মুসলিম নির্যাতন হয়। রামনাথ কোবিন্দ দলিত হলেও তাঁর সময়ে সবচেয়ে বেশি দলিত নির্যাতন ঘটেছে।‌ প্রণব মুখোপাধ্যায় রাষ্ট্রপতি হিসেবে মোদির আমলে মোদির কথাই শুনেছেন, পরে সঙ্ঘ পরিবারের সভায় গেছেন, কংগ্রেসের আদর্শ ভুলে।

যশবন্ত সিনহার জেতার সুযোগ কম। অভাবনীয় কিছু না ঘটলে। যশবন্ত সিনহাকে তৃণমূলের সঙ্গে সিপিআই(এম) সহ সব বামপন্থী দল সমর্থন করেছে। মোট ১৮টি বিরোধী দল। যশবন্ত সিনহা বাজপেয়ী মন্ত্রীসভায় অর্থমন্ত্রী ছিলেন, যেই সরকার বিলগ্নীকরণের জন্য মন্ত্রক তৈরি করেছিল, ২০০২ সালে তিনি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী থাকার সময় গুজরাত দাঙ্গা সংঘটিত হয়। তখন থেকে আজ অবধি তাঁকে এই বিষয়ে মোদীর বিরোধিতা করতে দেখা যায়নি। তিস্তা সেতালবাদ, মহম্মদ জুবেইর গ্রেপ্তার কিন্তু যশবন্ত সিন্হা নিশ্চুপ। আসলে সুবিধাবাদ দিয়ে কখনও বিজেপির মোকাবিলা করা যায় না। ২০০২ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে কালামকে রাষ্ট্রপতি করার জন্য প্রায় সব দল সম্মত হয়। কিন্তু নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থানকে স্বচ্ছ রাখতে এবং বিকল্প রাজনীতির বার্তা দিতে বামেরা প্রার্থী করে ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী সাহগলকে। বামেদের এই বিকল্প ভাবনার অভাব প্রতিনিয়ত প্রকট হচ্ছে। তৃণমূলের পৃষ্ঠপোষকতায় যশবন্ত সিনহার মত ব্যক্তিকে বিরোধী ঐক্যের নামে সমর্থন আসলে বিরোধী রাজনীতির দারিদ্রকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়। বাম রাজনীতি এই নব-উদারবাদী অন্তঃসারশূণ্য বিরোধী রাজনীতির পদাঙ্ক অনুসরণ করলে আরো বড় বিপদে পড়তে হবে। দ্রোপদী মূর্মূ বিজেপি-র সদস্য হলেও একজন সাঁওতাল রমণী। তাঁর বিরুদ্ধে যশবন্ত সিন্‌হার মতন একজন উচ্চবর্ণের প্রাক্তন বিজেপি পুরুষকে প্রার্থী করে বিরোধীদের রাজনৈতিক কোনো লাভই হওয়ার নয়।

আর দেশের সংকটের সময় সবচেয়ে বড় শত্রু ফ্যাসিবাদের মোকাবেলা করাই আশু কর্তব্য। কিন্তু সেই লড়াই সমস্ত নীতি-নৈতিকতাকে বিসর্জন দিয়ে লড়া সম্ভব নয়। এতে আখেরে বিজেপির কোনো ক্ষতি হবে না।

তাই টাকার বিনিময়মূল্য ডলারের তুলনায় বহু পিছনে পড়লে (এখন ৭৯.৫ টাকা) বা পেট্রল ডিজেল কেরোসিন সহ সব জিনিসপত্রের দাম আগুনছোঁয়া হলেও প্রতিবাদ তেমন নেই। বরং বিরোধী দলগুলোর নিজেদের মধ্যে আকচাআকচি। কোনো বিকল্প আখ্যান বিরোধীরা এখনও মানুষের সামনে হাজির করতে পারেনি। তাই ফ্যাসিবাদ ফাঁকা মাঠে গোল দিচ্ছে। এখনো এই পরিস্থিতিতেও সঙ্ঘ পরিবারের শাখা বিজেপির ভোট প্রাপ্ত ভোটের ৪০%-এর বেশি নয়। তাই আশা আছে।

আশাকে ফলবতী করতে চাই ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে বৃহত্তম ঐক্য। হাল ছেড়ো না বন্ধু।