আরেক রকম ● দশম বর্ষ ত্রয়োদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুলাই, ২০২২ ● ১৬-৩১ আষাঢ়, ১৪২৯
সম্পাদকীয়
অগ্নিপথ আন্দোলন - সমস্যা ও সম্ভাবনা
ভারতে বেকারত্ব সমস্যা এক ভয়াবহ অবস্থায় পৌঁছিয়েছে। কোটি কোটি বেকার যুবকের জীবন অন্ধকার। দেশের অর্থব্যবস্থা খাদের কিনারে। আকাশ ছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি। ডলারের দাম অতীতের সমস্ত রেকর্ড ভেঙে দিয়ে আপাতত ৭৯ টাকা পেরিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার তথা রাজ্য সরকারগুলি শূন্যপদে নিয়োগ রদ রেখেছে আজ বহু বছর হল। এমতাবস্থায় হিন্দি বলয়ের রাজ্যগুলিতে গরীব বেকার যুবকদের একমাত্র ভরসার স্থল ছিল সেনাবাহিনীতে চাকরি। অল্প বয়স থেকেই তারা এর জন্য প্রস্তুতি নিতেন। একবার ঢুকে পড়তে পারলে ১৫ বছরের জন্য নিশ্চিন্ত। একদিকে সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা, চাকুরি জীবনের পরে নানান সুযোগ-সুবিধা এবং অন্য কোনো ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের সুযোগ, এবং সর্বপরি দেশের জন্য লড়াই করার গর্ব - এই সমস্তটা মিলিয়ে সেনাবাহিনীর চাকরির প্রতি যুবসমাজের আকর্ষণ অত্যন্ত স্বাভাবিক।
কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর জমানায়, দেশে কোনো ব্যবস্থাই স্থায়ী নয়, সবই পরিবর্তনশীল। অতএব, রাতারাতি ‘অগ্নিপথ’ নীতি ঘোষিত হল, যেখানে বলা হল যে, সেনাবাহিনীতে এখন থেকে চার বছরের জন্য চাকরি দেওয়া হবে, তারপরে যাদের নেওয়া হল তাদের মাত্র ২৫ শতাংশকে স্থায়ী চাকরি দেওয়া হবে সেনাবাহিনীতে। একমাত্র আকর্ষণীয় এবং স্থায়ী চাকরি রাতারাতি সরকারী নীতির ফলে বেমালুম উধাও হয়ে গেল। তাই প্রতিক্রিয়া হল তীব্র। বিহার, উত্তরপ্রদেশ এবং অন্যান্য রাজ্যে যুবকরা রাস্তায় নেমে তীব্র প্রতিবাদ জানালো, ট্রেন পোড়ানো হল, বেশ কয়েকদিন বহু ট্রেন বাতিল করা হল। কিন্তু সরকারকে টলানো গেল না। তারা তাদের সিদ্ধান্তে এখন অবধি অনড়।
এত আন্দোলনের পরেও সরকার কেন নিজের সিদ্ধান্তে অনড় রইল। এর কারণ অর্থনীতিতে খুঁজতে হবে। আসলে সরকার সেনাবাহিনীর উপরে খরচ কমাতে চায়। এই কারণে নয় যে বিজেপি রাতারাতি একটি শান্তিপ্রিয় দলে পরিণত হয়েছে। আসলে তারা বুঝেছে যে, দেশে যেই পরিমাণ বেকারত্ব রয়েছে, তাতে খামোকা সেনাবাহিনীর জওয়ানদের অত টাকা মাইনে দিয়ে, তাদের পেনশন দিয়ে চাকরি দেওয়ার কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। যেমন সাধারণভাবে শ্রমের বাজারের সংস্কার করে সেখানে ঠিকা শ্রমিকের পরিমাণ বিগত বেশ কিছু বছর ধরে বিপুলভাবে বৃদ্ধি করা হয়েছে, সেই পথেই সেনাবাহিনীতেও এখন থেকে ঠিকা শ্রমিকের মতন ঠিকা-সৈনিকের আবির্ভাব ঘটবে। অচিরেই সরকারের খরচ কমবে। কাজেই এই পথ ধরেই সরকার আগামীদিনে সেনাবাহিনীকে পরিচালিত করতে চান।
এই নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনকে সরকার খুব বেশি পাত্তা দিল না কারণ বেকার যুবকদের আন্দোলন করার ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ঝোঁকের বশে তারা রাস্তায় নেমে হইচই করলেও অচিরেই পেটের তাগিদে কাজ খুঁজতে হবে, তখন সবাইকেই নিজের নিজের কাজে যেতে হবে, আন্দোলনের জোর এমনিই কমে যাবে। এই আন্দোলনের মধ্যে বৃহত্তর দাবি সংগঠিতভাবে উঠে এল না, এই দাবি উঠল না যে, সমস্ত সরকারী ক্ষেত্রে শূন্যপদ পূরণ করতে হবে এবং ঠিকা শ্রমিকের সংখ্যা কমাতে হবে, স্থায়ী পদে নতুন নিয়োগ করতে হবে। ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের দুর্বলতা, বাম রাজনীতির প্রান্তিক অবস্থায় চলে যাওয়া এবং অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের কাছে এই বিষয়ে কোনো পরিকল্পনা না থাকার ফলে এই আন্দোলনের পরিণতি কী হবে তা বিজেপি জানত।
কিন্তু পরবর্তী নির্বাচন নিয়ে কী তারা চিন্তিত নয়? এখানেই হিন্দুত্ববাদের উপযোগিতা। যেই বিপুল যুবসমাজ এই আন্দোলনে নেমেছিল, তাদের এক বৃহদাংশকে সাম্প্রদায়িকতার মধ্য দিয়ে বিজেপি নিজেদের দিকে টেনে নেবে। বিহার-উত্তরপ্রদেশের নির্বাচন সেই বার্তাই দিচ্ছে। মুসলমানদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা এখন ভারতে নির্বাচন জেতায়। সেই তাসের উপরেই বিজেপি ভরসা রাখছে। এই কারণেই এত ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের পরেও প্রধানমন্ত্রী কোনো কথা বললেন না, পোষাক দেখে আন্দোলনকারীদের চিনে নেওয়ার যেই পরামর্শ তিনি সিএএ আন্দোলনের সময় দিয়েছিলেন, তা এইবার তাঁকে বলতে দেখা গেল না।
এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আরেকটি বিষয় আমাদের সামনে পরিষ্কার হল। আন্দোলনের বিষয় যতই জোরদার হোক না কেন, সংগঠিত শক্তি ছাড়া কোনো আন্দোলন বাস্তবায়িত হয় না। কৃষক আন্দোলন তার বড়ো প্রমাণ।
কিন্তু এতগুলি নেতির মধ্যেও অগ্নিপথকে কেন্দ্র করে এই আন্দোলন কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিচ্ছে। গত বছর রেলের চাকরি নিয়ে গন্ডগোলকে কেন্দ্র করে বিহার এবং উত্তরপ্রদেশের যুবসমাজ রাস্তায় নামে, তখনও রেল ভাঙচুর করা হয়। আবার অগ্নিপথকে কেন্দ্র করে যুবসমাজ চাকরির দাবিতে রাস্তায় নামল। এই আন্দোলনগুলি সাফল্য না পেলেও যুবসমাজের মধ্যে যে এই সরকার এবং বেকারত্বের বিরুদ্ধে ক্ষোভ পঞ্জীভূত হচ্ছে তার সাক্ষ্যবহন করছে। যুবসমাজের এই রোষ এখনও কোনো রাজনৈতিক বিকল্প আধার পাচ্ছে না যার মাধ্যমে তারা কোনো ইতিবাচক পরিবর্তনের রূপরেখা দেখতে পাবে। আপাতত তাই মাঝে মাঝে হয়ত বিস্ফোরণ ঘটবে ক্ষোভের, কিন্তু বৃহত্তর কোনো রাজনৈতিক বিকল্পের দিকে এই আন্দোলনগুলিকে নিয়ে যেতে হলে আরো বহু পরিশ্রম করতে হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় বিরোধী রাজনীতি মানুষের এই ক্ষোভ-বিক্ষোভগুলিকে ভাষা দিতে, তাদের সংঘবদ্ধ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। হারবার্টের মতন ভাবা সহজ যে, কোথায় কখন বিস্ফোরণ হবে রাষ্ট্রশক্তির তা জানতে বাকি আছে, কিন্তু সেই বিস্ফোরণ শাসক দল ও শাসক শ্রেণির ভিত নড়াতে পারবে কি না, তা নির্ভর করবে সংগঠিত রাজনীতির উপর। সেই রাজনীতির দুর্বলতা অতিক্রম করাই প্রগতিশীল শক্তির আশু কর্তব্য।