আরেক রকম ● দশম বর্ষ ত্রয়োদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুলাই, ২০২২ ● ১৬-৩১ আষাঢ়, ১৪২৯

সম্পাদকীয়

বিচারের দাবি ও বাণী


এই মুহূর্তে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের সামনে বহু গুরুত্বপূর্ণ মামলা রয়েছে যা নিয়ে আদালত কোনো শুনানি করেনি বা পদক্ষেপ নেয়নি। সিএএ আইনের বৈধতাকে প্রশ্ন করে বহু মামলা দায়ের হয়েছে, কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বাতিলের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে, নির্বাচনী বন্ডের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছে মহামান্য আদালতকে - এই সমস্ত মামলায় মহামান্য আদালত এখনও অবধি কোনো শুনানি করেননি। রাজনৈতিক বিতর্ক রাজনীতিবিদরা চালিয়ে যাচ্ছেন, মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে দেওয়ার জন্য তৈরি হওয়া আইন নিয়ে আদালতের সামনে উপস্থিত প্রশ্ন নিয়ে মহামান্য বিচারপতিরা কোনো মন্তব্য করছেন না। অন্যদিকে, সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানেই অসমে এনআরসি হয়েছে, যার ফলে ১৯ লক্ষ মানুষের নাগরিকত্ব প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। আবার ২০১৯ সালে বাবরি মসজিদের জমিকে রাম মন্দিরের জন্য হিন্দু পক্ষের হাতে তুলে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। এই ঘটনা পরম্পরা যে মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট নিয়ে মানুষের মনে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু তবু ভারতের আপামর জনসাধারণের মনে এই বিশ্বাস রয়েছে যে বিচারের দাবিতে সুপ্রিম কোর্টে যাওয়া যায়, ন্যায়ের দরজায় কড়া নাড়া যায়।

দুর্ভাগ্যজনক হলেও বলতেই হয় যে, সুপ্রিম কোর্ট নিয়ে মানুষের মনে যে মৌলিক বিশ্বাস রয়েছে বিচারের শেষ আবেদনস্থল হিসেবে, তা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে কোর্টের জাকিয়া জাফরি সংক্রান্ত মামলার রায়ে। জাকিয়া জাফরির স্বামী এহসান জাফরিকে ২০০২ সালে গুজরাত দাঙ্গার সময় আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। বিগত ২০ বছর ধরে জাকিয়া জাফরি বিচার চাইছেন, বলতে চাইছেন যে গুজরাত দাঙ্গার নেপথ্যে রাজ্যের সর্বোচ্চ পদাধিকারী অর্থাৎ মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও অন্যান্যদের ষড়যন্ত্র ছিল। সুপ্রিম কোর্ট জাকিয়া জাফরির এই বক্তব্য নাকচ করে দিয়েছে। সমস্যা সেখানে নয়। প্রমাণের অভাবে আবেদন নাকচ হতেই পারে। ২০০২ সালে নরেন্দ্র মোদীর ভূমিকা কী ছিল তা নিয়ে বিতর্ক থাকবেই, কারণ তিনি তখন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন এবং একাধিক বিতর্কিত মন্তব্য করেছিলেন। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ভি এন খারে ২০০৩ সালের সেপ্টেম্বরের ১২ তারিখে বলেছিলেন যে তাঁর গুজরাতের প্রশাসনের উপরে কোনো ভরসা নেই। ২০০৪ সালের এপ্রিলের ১২ তারিখে সুপ্রিম কোর্ট বেস্ট বেকারির ১৪ জনকে হত্যা মামলায় পুনর্বিচারের রায় প্রদান করে এবং এই মামলাকে গুজরাতের বাইরে পাঠায় কারণ গুজরাত প্রশাসনের উপরে সুপ্রিম কোর্টের কোনো আস্থা ছিল না। এই মামলার রায়েই মহামান্য আদালত গুজরাত প্রশাসনকে ‘আধুনিক নিরো’-র সঙ্গে তুলনা করেন।

অতএব গুজরাত প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট যথেষ্ট সন্দিহান ছিলেন যেই কথা তার রায় থেকেই পরিষ্কার। অথচ ২০২২ সালে দাঁড়িয়ে সুপ্রিম কোর্ট গুজরাতের তৎকালীন সরকারের দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণ করার ভূমিকাকে প্রশংসা করছেন! তাই যদি সত্যি হয় তাহলে এর আগে সুপ্রিম কোর্ট গুজরাত প্রশাসনের এত কঠোর সমালোচনা করল কেন? এই প্রশ্নের থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন অবশ্য এই যে সুপ্রিম কোর্ট জাকিয়া জাফরির মামলাকে বাতিল করেই ক্ষান্ত হননি। তিস্তা সেতালবাদ এবং গুজরাত পুলিশের প্রাক্তন পুলিশ আধিকারিক শ্রীকুমারের বিরুদ্ধে এই রায়তে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করা হয়। বলা হয় যে, এই মামলা স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে করা হয়েছে, বিষয়টি যাতে ঠাণ্ডা না হয়ে পড়ে তার সমস্ত চেষ্টা তিস্তা এবং শ্রীকুমারের মতন ব্যক্তিরা করেছেন। তদুপরি সুপ্রিম কোর্ট বলেন যে এদের বিরু্দ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। মামলার রায় প্রদানের কয়েক ঘন্টার মধ্যেই দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সরাসরি তিস্তার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেন এবং তারপরে তাঁকে এবং শ্রীকুমারকে গুজরাত পুলিশ গ্রেপ্তার করে।

এই মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায় ভারতের গণতন্ত্রের সামনে এক বিরাট প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দিয়েছে। রাষ্ট্রের অপদার্থতা বা তার ব্যর্থতা নিয়ে কিছু ব্যক্তি আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন, যা তাঁদের সাংবিধানিক অধিকার। হতেই পারে যে তাঁদের বক্তব্য আদালত গ্রাহ্য করেনি। কিন্তু আদালত রাষ্ট্রকে মামলাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে উপদেশ দিচ্ছে, তা ভারতের বিচারব্যবস্থার ইতিহাসে বিরল। মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট কী বার্তা দিতে চাইছেন? রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে না? রাষ্ট্রকে প্রশ্ন করা যাবে না? প্রশ্ন করলে গর্দান যাবে?

ভারতের সংবিধানে বিচারব্যবস্থার স্বাতন্ত্র স্থান দেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক নানান উত্থান পতনের মধ্যেও ভারতের বিচারব্যবস্থা শুধুমাত্র ভারতের সংবিধানের প্রতি দায়বদ্ধ থাকবে, এটাই ভারতের সংবিধানের প্রধান কথা। কিন্তু ন্যায় প্রার্থীদের বিরুদ্ধে যদি সুপ্রিম কোর্ট সরকারকে মামলা রুজু করতে বলে তাহলে সাধারণ মানুষ বিচারের জন্য কোন দরজায় যাবে? ব্যক্তির স্বাধীনতা, ব্যক্তির অধিকারকে সুরক্ষিত রাখা, রাষ্ট্রের অধিকারের অপব্যবহার রদ করা এবং সর্বপরি সংবিধানকে রক্ষা করা সুপ্রিম কোর্টের দায়িত্ব। আমরা অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছি সুপ্রিম কোর্ট এই ক্ষেত্রে সেই দায়িত্ব পালন করেনি। এই স্খলন ভারতের গণতন্ত্রের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর। যদি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মানুষ মামলা করতে ভয় পায়, কারণ মামলায় হারলে পুলিশ আমাকে গ্রেপ্তার করতে পারে, তাহলে ভারতের গণতন্ত্র ও সংবিধানের আর কিছুই প্রায় অবশিষ্ট থাকে না। বিজেপি ও আরএসএস দীর্ঘদিন ধরেই তিস্তা সেতালবাদের মতন মানবাধিকার কর্মীকে শায়েস্তা করার খোয়াব দেখে এসেছে। সুপ্রিম কোর্টের বদান্যতায় তাদের সেই খোয়াব আপাতত বাস্তবায়িত হচ্ছে।

আজকের ভারতে দেখা যাচ্ছে বিজেপি তথা কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলেই রাষ্ট্রব্যবস্থা ঝাঁপিয়ে পড়ছে, ব্যক্তিদের জেলে পাঠাচ্ছে। মহম্মদ জুবেইরের মতন সাংবাদিক ভারতে বিরল। বিগত বহু বছর ধরে সাধারণ মানুষের সামনে সত্যকে তুলে ধরার কাজ করেছেন তিনি ‘অল্ট নিউজ’-এর মাধ্যমে। নূপুর শর্মার মতন সাম্প্রদায়িক ঘৃণ্য মানুষের স্বরূপ জনগণের সামনে তুলে ধরেছেন তিনি। অতএব তাঁর জন্য শাস্তি অপেক্ষা করছিলই। ২০১৮ সালে তিনি একটি টুইট করেন ঋষিকেশ মুখার্জীর একটি সিনেমার দৃশ্য নিয়ে যেখানে ‘হানিমুন’ হোটেল রাতারাতি ‘হনুমান’ হোটেলে পর্যবসিত হয়। এই কথা লেখার জন্য ঋষিকেশবাবুর কোনোদিন শাস্তি হয়নি, কারণ তিনি অন্য ভারতে থাকতেন এবং তিনি মুসলমান নন। কিন্তু জুবেইর, ‘নতুন ভারত’-এর বাসিন্দা, তদুপরি মুসলমান। অতএব ‘হানিমুন’ ও ‘হনুমান’ একই পংক্তিতে লিখলে হিন্দুদের অনুভূতিতে আঘাত লাগবে এই অভিযোগে মহম্মদ জুবেইরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মহামান্য আদালত এই হাস্যকর দাবিকে পত্রপাঠ নাকচ না করে, তাঁকে পুলিশী হেফাজতে পাঠিয়েছে। সত্যের প্রহরী জুবেইর আপাতত থানার লকআপে কারণ সত্য আরএসএস-বিজেপি ও সরকারের পছন্দ নয়।

দেশ আপাতত এমন একটি সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে যেখানে সত্য কথা বললে আপনি ক্ষমতার চক্ষুশূল হবেন, সুপ্রিম কোর্টে বিজেপি নেতৃত্বর বিরুদ্ধে মামলা করলে আপনার বিরুদ্ধেই পুলিশ তদন্ত করবে, এবং কোর্ট দুর্ভাগ্যজনকভাবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হিন্দুত্ববাদী শক্তির পক্ষেই রায় দিচ্ছে। তাই নূপুর শর্মা ইসলামের নবীর বিরুদ্ধে জঘন্য মন্তব্য করলেও গ্রেপ্তার হন না, অনুরাগ ঠাকুর, ‘গোলি মারো সালো কো’ স্লোগান দিয়েও বেকসুর খালাশ হয়ে মন্ত্রী থেকে যান, জেএনইউ-এর হামলাকারীদের আজও পুলিশ ধরতে পারে না, বুলডোজার দিয়ে প্রতিবাদীদের বাড়ি ভেঙে দেওয়া হয়, কপিল শর্মা দাঙ্গার উস্কানিমূলক কথা বলেও বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়ান। শুধু জেলে পচেন তিস্তা-শ্রীকুমার-সঞ্জীব ভাট-গৌতম নাভলখা-আনন্দ তেলতুম্বে, বিচারের আশায় জামিনের জন্য লড়তে লড়তে প্রাণ হারান ফাদার স্ট্যান স্বামী। স্বাধীনতার ৭৫-তম বর্ষে এই হল ভারতের গণতন্ত্রের বর্তমান ছবি।

স্বাধীন, ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক ভারতের যেই ছবি বুকে নিয়ে হাজারো মানুষ স্বাধীনতা আন্দোলনে শহীদ হয়েছিলেন, তাদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর শ্রেষ্ঠ উপায় আরএসএস-বিজেপিকে গদিচ্যূত করা। এর জন্য যেই আন্দোলনের প্রয়োজন আপাতত তার প্রতীক্ষায় আপামর শুভবুদ্ধি সম্পন্ন জনসাধারণ।