আরেক রকম ● দশম বর্ষ দ্বাদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ জুন, ২০২২ ● ১-১৫ আষাঢ়, ১৪২৯
পুনঃপাঠ
ভালোবাসার কথা
গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়
সম্পাদকমশাই সারা জীবন সাহিত্যটাহিত্য কবিতাটবিতা নিয়ে কাটিয়ে, কেন যে এই অবেলায় ব্যাধের ব্যবসায় নামলেন, কে জানে! টার্গেট ঘুঘু - আমি, গীতা বাঁড়ুজ্জে এবং যেহেতু সম্পর্কে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের রেজিস্ট্রিকৃত স্ত্রী একনাগাড়ে ৪৭ বছর ধরে ৫-বি, ডঃ শরৎ ব্যানার্জি রোডের ভাড়া বাড়িতে 'রোপ ওয়াকিং' করে চলেছি।
এবার ওঁরা আরও দাবি জানিয়ে বলছেন, সেই একান্ন সালের সতেরোই আগস্ট থেকে আজ পর্যন্ত লম্ফঝম্প করে সংসার করার যে ভান করছি তার থেকে বেছেবুছে - "প্রেমের কথাটথা কিছু বলো।" - বলবো। বলছি।
"হ্যাঁ, বেশ মনে আছে। ব্যাপারটা হয়েছিল এইরকম: তারপর যেতে যেতে যেতে যেতে এক কবির সঙ্গে দেখা। সেই কবির দু'দিকে দুটো মুখ। এক মুখে কবিতা, অন্য মুখে মিছিলের স্লোগান। সেই স্লোগানের সুর ধরে ধরে মিছিল থেকেই কবিকে পাকড়ানো গেল। কেননা, সত্যি বলতে কি, কবিতার দিকের মুখটা - যারা জানে তারাই জানে - একেবারে বদ্ধ উন্মাদের - এবং কোনো চিকিৎসা নেই।
তারপর আর কি?
বাঃ বাহবা!
বাহবা বাঃ!
সাবাস বলিহারি -
হাঁড়ির মধ্যে
মাটি আছে, না
মাটির মধ্যে হাঁড়ি!
এই ছিল না -
এই তো আছে!
এই আছে, এই ফক্কা।
বুকের মধ্যে
রঙের তাস
হরতনের টেক্কা।
এই যে হরতনের টেক্কা, এটা কিন্তু একটা অদ্ভুত ধরনের তূরুপের তাস। দু'জন 'হাইপার-অ্যাকটিভ লোকের হাতে একখানা হরতনের টেক্কা। এর মধ্যে আবার যে কবি তার গনগনে রাগ খুব চাপা হওয়ায় এই টেক্কাখানা অপরপক্ষের হাতে দিয়ে বলে - 'খেলো'। তখন অপরপক্ষ, যার রাগলেই চন্ডাল-চামুন্ডা মূর্তি - সে, মানে আমি, হেরে ঢোল।
তাই বলে, সত্যি সত্যি কি আর হেরেছি।
চলে গেলাম বজবজে, চটকল মজুরদের মধ্যে। তখন 'প' দিয়ে কিছু বলতে শুরু করলেই - দেবী, রামকৃষ্ণ, অমলরা টিপ্পনী কেটে বলত - 'এই রে এবার প্যারিস বলবে'। সত্যিই তো, দেশ জানি না, মানুষ চিনি না - কেবল ঝুড়ি ঝুড়ি কথা।
তাই একদিন, ১৯৫২ সালের এক ভোরবেলায় শ্বশুরমশাইয়ের চোখের জলের মধ্যে দিয়ে, 'ফিরে চল মাটির টানে' বলে একটা ধড়ধড়ে ট্রাকে কিছু নড়বড়ে তক্তোপোষটোস নিয়ে যখন উঠলাম গিয়ে বজবজের ব্যঞ্জনহেড়িয়া গ্রামের এঁদো পুকুরের ধারে এক মুসলমানের কুঁড়ে বাড়িতে, তখন কিন্তু এসব উঁচুনিচু সুর একটা মজাদার লয়ে বাঁধা পড়ে গিয়েছিল। আর বোধহয় সেই 'সুরে সুরে সুর মিলায়ে' সুভাষ আবার অনেকদিন পরে এক ঝুড়ি কবিতাও লিখে ফেলেছিল।
তবে, আজও সুভাষের বাবার সেই একমাত্র ছেলের তাকে ছেড়ে গ্রামে চলে যাওয়ার শোক আমি ভুলতে পারিনি।
তখনকার দিনে সেইসব চরকিঘোরা কাজকর্মের কথা ভাবলে হতভম্ব হতে হয়। সকালে চটকলের মজুরদের বোনাসের দাবিতে গেট মিটিং-এ সামিল, দুপুরে মেয়েদের নিরক্ষরতা দূর করতে সাজ্জাদদার বাড়িতে দাওয়ায় মাদুরপাতা স্কুলে পড়ানো, বিকেলে পোলট্রি তৈরি করার তোড়জোড়। তার মধ্যে প্রায়ই কলকাতায় এসে সুভাষ 'বোনাস' আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে কাগজ বের করার প্ল্যান বানিয়ে ফেলল। এর ওপর ঈদের দিনে ঢালাও খাওয়াদাওয়া তো আছেই। ঈদ বলতে মনে পড়ল। লক্ষ্য করলাম ঈদগা-তে নমাজ পড়ার সময় তাবড় কমিউনিস্ট নেতা থেকে চুনোপুঁটি পর্যন্ত সকলকে উপস্থিত থেকে নমাজ পড়তে হতো। ব্যাপারটায় আমরা যত অবাক হতাম, অন্য মুসলমান কমরেডরা কিন্তু তা মোটেই হতেন না। এটা ওদের কাছে অনেকটা দাবায় দান দেবার মতো ব্যাপার। ছকের সামনে বসে দান না দিয়ে উপায় আছে?
এমনি একজন গোঁড়া মুসলমানও বটে, গোঁড়া কমিউনিষ্টও বটে, এক ধারে আলাদা করে আমাকে ডেকে নিয়ে গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, "আপনি নাকি গরুর মাংস খান বলেছেন।"
"হ্যাঁ তো!"
"বলবেন না, খাবেনও না। ওটা ঠিক নয়। আপনি উচ্চশ্রেণীর ব্রাহ্মণের মেয়ে - ওটা ঠিক নয়। আন্দোলনের ক্ষতি হবে।"
সুভাষকে কথাটা বলতে ও হেসে উঠে বলল, "আরে বাবা, ওসব কথা কানে নিও না - কান ভারি করে লাভ কী? চেপে যাও! যে দেশের যা হাল।"
চেপে গেলাম। যবনের খানা, যেমন দেবে তেমন খাবে।
চটকলের গেট মিটিং-এ গেলাম। সুভাষ টেবিল বইছে, আমি চেয়ার। কিন্তু মজুর নেতারা এসব ছোট কাজে হাত দেন না। শুধু "বোনাস চাই, বোনাস চাই!" বলে লম্বা বক্তৃতা দেন। বোনাস আন্দোলনের পালে বিরাট হাওয়া লাগে। কিন্তু বোনাস মেলে না। পালের কাপড়ের বুননি গামছার মত ফ্যারফ্যারে হাওয়ায় আন্দোলন ছেতরে যেতে থাকে।
সেবার পয়লা জুন, আন্তর্জাতিক শিশু দিবসে আমরা এক অবাক কাণ্ড করে বসলাম। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের হাতে রাখি বাঁধা হলো বাটা থেকে বিড়লাপুর পর্যন্ত। সুভাষ - ময়দানের সমাবেশে, বেলুন, বিস্কুট থেকে লজেন্স-ললিপপ পর্যন্ত ছোটদের হাতে হাতে বেলানো হলো - ভোর থেকে সন্ধে পর্যন্ত। সুভাষরা সব, যাকে বলে, 'বডি ফেলে দিয়ে' কাজে নেমে গেল। বাটা কোম্পানি দিল বেলুন, ব্রিটানিয়া থেকে পাওয়া গেল বিস্কুট, আরো কত কত কোম্পানি হাত বাড়িয়ে উপহার দিয়ে গেল তার ঠিক নেই। সেইসব ছেঁড়াজামা পরা সালেমন, জমিলা, আহমদ, সেলিমদের মুখে যে হাসি ফোটানো গিয়েছিল সেই সময়ে, সুভাষ তাদেরই নানা সুখ-দুঃখের তদারকি করেছিল হরেক রঙের কবিতা লিখে।
চটকলের মেয়েদের মধ্যে বহু হিন্দু মেয়ের কাছাকাছি এসে অবাক হয়েছিলাম তাদের বেঁচে থাকার ক্ষমতা দেখে। বিধবা, স্বামী-পরিত্যক্তা, গৃহছাড়া আইবুড়ো মেয়ে, ধর্ষিতা - সব চটকলে, নামমাত্র মজুরিতে বেঁচে আছে। কিন্তু নানা রং আছে তাদের মধ্যে। একবার অরুণা আসফ আলি আসবেন সুভাষ-ময়দানে। সে কী উত্তেজনা। ছোট ছোট মিছিল, বড় বড় ফেস্টুন হাতে মেয়েরা সময়ের আগে চলে গেছে সভায়। আমি চটকল মজুর সরযূদের ডাকতে গেছি। দেখি তারা সব সেজেগুজে তৈরী। কী ব্যাপার? ও হেসে বলল, "যাবনি? সবাই যাবো গো। হিঁদু বামুনের মেয়ে, মোছলমান বিয়ে করেছে - সে কেমন মেয়ে, দেখতে যাবনি?" সত্যিই সেদিন অরুণাদিও অবাক হয়ে গিয়েছিলেন সেই হাজার হাজার মেয়ের আশীর্বাদ পেয়ে।
ইতিমধ্যে চিনুদা (চিন্মোহন সেহানবীশ) আমাদের এই অদ্ভুত জীবনপদ্ধতিতে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে নিজেই যেচে আমাদের 'পাবলিক রিলেশনস অফিসার' হয়ে পড়লেন। কলকাতায় চিড়িয়াখানা, জাদুঘর, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল-এর জায়গায় অনেককে ভুলিয়েভালিয়ে নিয়ে যেতেন ব্যঞ্জনহেড়িয়া গ্রামে আমাদের কুঁড়ে বাড়িতে। সেখানে আমি আর সুভাষ ছাড়া ছিল কুকুর বিলি আর সুন্দরী বেড়াল, রুশি। রুশি সেদিন একটা ছোটখাটো খড়িশ কেউটে নিয়ে তক্তোপোশের ওপর খেলছিল। সেটাকে আবার 'কী সুন্দর রিবন' বলে ধরতে গেছে সুভাষের ভাই পুনপুন আর তার দিদি তানিয়া। সে এক ভজকট অবস্থা। ইতিমধ্যে চিনুদা কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া-র সাধারণ সম্পাদক অজয় ঘোষকে এনে হাজির। তাঁকে বলা যায়নি যে তিনি তাঁর ছ'ফুট লম্বা দেহখানি নিয়ে যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন, তার ঠিক ওপরে, সবুজ গাছে, একটা লাউডগা সাপ জিভ লকলকিয়ে মাঝে মাঝে ঝুঁকে ঝুঁকে সব দেখছে।
যাই হোক, সব দেখেশুনে অজয় ঘোষ খুশি হলেও হঠাৎ কেন কে জানে, চোখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, "ঐ যে এঁদো পুকুর, ওর জলই ব্যবহার করা হয়?" "হ্যাঁ।" "আর খাওয়ার জল?" "ঐ, ঐ...।" খুব রেগে গেলেন তিনি। কাকে উদ্দেশ করে জানি না, বলে উঠলেন, "ওদের পার্টি মেম্বারশিপ খারিজ করে দাও। যে-কোনো দিন ভীষণ অসুখে পড়বে।"
পার্টি মেম্বারশিপ অবশ্য খারিজ করেননি। কেননা, ক'দিন পরেই আমার হলো ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া। জ্বর হওয়ার অভ্যেস না থাকায় বুঝতে পারিনি যে, আমার বেশ জ্বর হচ্ছে। দারুণ নেশা নেশা ভাব। কলকাতায় এসে আমার ছোট বোন আবু (আভা) আর রিকু (রেখা) দু'জনেই হাউমাউ করে বলে উঠলো - "ওরে বাবা, এ তো খুব জ্বর। ডাক্তার ডাকো।" ডাক্তার এসে তো তাজ্জব - এ যে একেবারে সাবাড় হবার দশা। আবু নার্সের ভূমিকায় নেমে গেল। কিন্তু সুভাষ যখন আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে খুব মিহি গলায় - "তুমি মরে যাচ্ছিলে, জানো?" বলল বেশ স্বাভাবিক স্বরে, তখন ডাক্তার থেকে আরম্ভ করে সবাই - এই মারে তো সেই মারে! কিন্তু সুভাষ অবিচল - "মরে গেলে কী বিচ্ছিরি হতো!"
এই অসুখের জের চলল কিছুদিন। রক্ত কমে গেল, পেটের মধ্যে কীসব গোলমাল। স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিনও বেশ গোলমেলে রিপোর্ট দিল। তখন উমার (উমা সেহানবীশ) সঙ্গে খুব ভাব। ও ছিল সুভাষের বিশেষ অনুরাগী আর আমার রাঙাদার সহপাঠী,'বেথুন বিউটি' এবং মিষ্টি কথার ফুলঝুরি ঝরিয়ে দিতে পারত যখন তখন। ও আমাকে নিয়ে গেল এক বড় ডাক্তারের কাছে - সবিশেষ নামকরা এবং সমাজসেবী। তিনি পরীক্ষা করতে করতে জিজ্ঞেস করলেন - "কবে বিয়ে হয়েছে?" আমি বেশ স্বাভাবিক গলায় পালটা প্রশ্ন করলাম, "কোন বিয়ের কথা জিজ্ঞেস করছেন?" প্রশ্ন শুনে ডাক্তারবাবুর স্টেথো হাতে আটকে রইল, উমার বড় বড় চোখ আরো বড় বড় হয়ে উঠলো। কয়েক সেকেন্ড। ডাক্তারবাবু, "ঠিক আছে ঠিক আছে - এই বিয়েটার কথাই বলুন" বলে শেষে 'ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি' গোছের একটা সমাধান করে দিলেন প্রেসক্রিপশনটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে। বেরিয়ে এসে উমা সুভাষকে দেখে হেসে উঠে বলল, "গীতাকে নিয়ে আর পারা যায় না।" উৎকণ্ঠিত সুভাষ "কী হয়েছে, কী হয়েছে" বলে উঠতেই আমি একেবারে হামলে পড়ে বলে উঠলাম, "আরে বাবা, একজন ডাক্তার যদি জিজ্ঞেস করে কবে বিয়ে হয়েছে, তার মানে তো হলো - তুমি কতদিন বিবাহিত। সে-কথাই বলেছি। তোমাদের এসব স্বদেশী প্যাঁচপয়জার বুঝি না বাবা।" সুভাষ তখনই আমার সমর্থনে আওয়াজ তুলে ব্যাপারটা 'অনেকদিনের সরস গল্প'র ধাঁচে সমাধান করে দিল।
শরীর সারতেই বজবজে মজুরনেতা সুধীনদার জন্য 'কনস্ট্রাক্টিভ' রোজগারের উপায় হিসেবে পোলট্রি খোলা হলো। মুরগি সংগ্রহের কাজে কবিতাটবিতা বিসর্জন দিয়ে সুভাষ উঠে পড়ে লেগে গেল। রোড আইল্যান্ডরেড, লেগহর্ন - লাল, সাদা সব দারুণ দারুণ তাগড়াই মুরগি। সরকারি পোলট্রি থেকে কেনা হলো গুঁড়ো গুঁড়ো একশোটা বাচ্চা আর গোটা তিরিশ ধাড়ি মুরগির সন্ধান মিলল লোয়ার সার্কুলার রোডের এক বড়লোকের বাড়িতে। প্রায় জলের দরে আমাদের হাতে তাঁরা সেগুলোকে তুলে দিয়ে বাঁচলেন। কিন্তু এরা যাবে কী করে বজবজ? অশোক মিত্র (প্রাক্তন মন্ত্রী) না বুঝে গলাটি বাড়িয়ে দিলেন। একে বিলেত-ফেরত তায় বিরাট বিদেশি মোটরগাড়ি। লেফট-হ্যান্ড ড্রাইভ। রাইট-হ্যান্ডে, সামনের সিটে বসে খোদ ব্রিটিশ কাউন্সিলের এক ব্লন্ড সাহেব বন্ধু। হাসিখুশি সবাই। শুধু মুরগিগুলো বিক্ষুব্ধ জনসাধারণের মতো ব্যবহার শুরু করলো নিউ আলিপুরের পথে। কিছু মুরগি ঝুড়িতে আটকানো ছিল পেছনের লাগেজ রাখার জায়গায়। কিছু কিছু ভেতরের সিটে এবং পা রাখার জায়গায়। সেখানে কীরকম একটা আওয়াজ উঠতেই তাকিয়ে দেখি - দুটো সাদা মুরগি উঠে ডানা ঝাপটে জানলা দিয়ে বেরিয়ে গেল। "থামাও থামাও।" ঘ্যাঁচ করে ব্রেক। সুভাষ গ্যাঁট হয়ে বসে রইল। অশোক আর আমি পড়ি-মড়ি করে অ্যাকসিডেন্ট সামলে মুরগিদুটোকে ধরে এনে দেখি সুভাষ আর সায়েবটি মহানন্দে সিগারেট খাচ্ছে আর হাসছে। আবার যাত্রা শুরু। মাঝেরহাট বরাবর চারটে মুরগি পেছনের ঝুড়ির ফাঁক দিয়ে চম্পট। আবার সেই ছুটোছুটি। এবার সায়েব হাত লাগাতে, তাড়াতাড়ি কাজ হলো। অশোক হাঁপাতে হাঁপাতে খাড়া চুলগুলোকে মাথায় বসাতে বসাতে বলে উঠলো - " এবার আমি ট্রাই করবো"। যাই হোক, হাসিকান্নার মধ্যে দিয়ে 'ধর-ধর বাঁধ-বাঁধ' করতে করতে আমরা গ্রামে পৌঁছে গেলাম। মুরগিগুলো নামাতে নামাতে সাজ্জাদদা হঠাৎ বলে উঠলেন, "আরে, গাড়ির সিটে ওরা দুটো ডিম পেড়ে গেছে।" শুনে যা হল্লা হলো। সাহেব বন্ধুটি ঘাসের ওপর গড়িয়ে গড়িয়ে হোহো করে হাসতে লাগলো - "ওহ! হোয়াট ফান।" আর সুভাষ তখনই "ওমলেট ভাজো..." বলে ফতোয়া জারি করে দিলো।
একদিন অবশ্য এসব ছেড়ে 'পুনর্মূষিক ভব' হতে হলো। আমি পেটের দায়ে চাকরির সন্ধানে প্রশান্তকুমার মহলানবীশের দ্বারস্থ হলাম। রোজ সকাল-বিকেল বরাহনগর যাওয়া আর সাদার্ন অ্যাভেনিউতে সন্ধ্যেবেলা ন'নম্বর বাস থেকে নামা। তার মধ্যে অবশ্য 'সন্দেশ' আপিসে হানা দেওয়া, নাটকের রিহার্সাল, মেয়ে পুপেকে নিয়ে আদিখ্যেতা - আপিসের কাগজে 'ববির বন্ধু' লেখা, সবই চলছে। হাইপার অ্যাকটিভরা যেমন হয় আর কী।
'সন্দেশ' আপিস তখন ধর্মতলায় রমরম করে চলছে। সত্যজিৎ আর সুভাষের হাসি হাসি মুখে ডাঁই ডাঁই লেখা ফেরত দেওয়ার ব্যাপারটা তখন নব্য আর নামকরা লেখকদের মধ্যে 'অমায়িক-ইয়ে' নাম কিনেছে। অন্যান্য আনন্দের মধ্যে কিছু কচি কচি নতুন মুখ দেখা যেতে লাগল আপিসে। ইনস্টিটিউট থেকে ফেরার পথে 'সন্দেশ' আপিসে দেখা মিলল কিছু 'ভোরের শেফালি'র। একদল তরুণী। হিমানী, শিবানী, মালিনীর দল। কিন্তু সেই - 'তার দুটি আঁখি খঞ্জন পাখি/ দূরে কাছে ঘুরে নাচে/ এই আছে এই নেই আছে নেই/ দূরে কাছে ঘুরে নাচে...।' সুভাষ মুগ্ধ হলেও ধরেছিল ঠিকই। কেননা সেই খঞ্জন পাখির দলের একজন চলে গেল কানাডায় 'জেন্ডার পলিটিক্স'-এর হিসেব-নিকেশ করতে। দ্বিতীয়জন পাড়ি দিল লন্ডনে, লেখালিখি আর মাস্টারির টানে। আর তৃতীয়জন - যে নাকি, সত্যি বলতে কী, ভীষণ রকমের 'ভোরের শেফালি', রাজনীতির খপ্পরে পড়ে কলকাতায় অতিগম্ভীর জীবনযাপন করতে আরম্ভ করলো।
এরপর আবার শুরু হলো সেই 'কবিগঞ্জনা'। সুভাষের কপালে চাকরি নেই বা নিজের কপালে ও সেই ফোঁটাটাই দিয়ে রেখেছে। বলা হতে লাগল - "...ফুঃ, এখনও সেই চারমিনারেই রয়ে গেলে/ তোমার কপালে আর করে খাওয়া হলো না দেখছি/ বুঝলে মুখুজ্জে, জীবনে কিছুই কিছু নয়/ যদি কৃতকার্য না হলে।" - সুভাষ মিহি গলায় হেসে বলল, "তা বটে, তা বটে।"
তার আগে একটা সময় মানিকবাবু (বন্দোপাধ্যায়) অসুখের ঘোরে আমাদের বড্ড টেনেছিলেন। চুম্বকের টানে আমরা মানিকবাবুর অগোছালো ছোট্ট ঘরে যেতে আরম্ভ করেছিলাম। ভক্তি-রস আমার নেই বললেই হয়। তবু স্বীকার করতেই হবে মানিকবাবু আমাদের মনে এই ধরনের একটা রস সৃষ্টি করেছিলেন। অতুল গুপ্ত, দেবীপ্রসাদ চাটুজ্জে, রমাকৃষ্ণ মৈত্র, সুভাষ, অমল দাশগুপ্ত, দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায় আর আমি, আর মাঝে মধ্যে অন্যান্য কেউ কেউ নানাভাবে মানিকবাবু, কমলাবৌদি আর তাঁদের চার ছেলে মেয়ের হাত ধরে রেখে মনে যে আনন্দ পেয়েছিলাম তা খুব কম লোকের কপালেই জোটে। যেন এক ছ'ফুট লম্বা সুপুরুষ মানুষকে কে বা কারা ভীষণ চরকিঘোরা এক নাগরদোলায় চড়িয়ে দিয়েছে আর আমরা হাত ধরাধরি করে আছি, ছিটকে গেলেই ধরবো বলে।
যেদিন মানিকবাবু চলে গেলেন, দেবী, হাসপাতালের দরজায় প্রেসের লোকদের তাঁর 'ডেথ সার্টিফিকেট' দেখিয়ে বলল, "ভালো করে দেখে নিন, উনি কিন্তু সিরোসিস অফ দি লিভার-এ মারা যাননি। বুঝেছেন? ভালো করে দেখে নিন।" একটা নামী খবরের কাগজ খুলে পরের দিন দেখলাম, লেখা আছে - "মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সিরোসিস অফ দি লিভার-এ মারা গেছেন...।"
বেঁচে থাকার সময় যে যাই করে থাকুক, যত দারিদ্র্যের মধ্যেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ফেলে থাকুন, ছেলেমেয়েদের গরম জামার অভাবে কাঁপুনি যত লেগে থাকে লাগুক - তখন কিন্তু ডাঁই ডাঁই ফুল এলো, যেন পপি ফুলের 'ম ম' করা গন্ধ নিয়ে। বেঁচে থাকলে ও ফুলের ডাঁই উনি সরিয়ে ফেলে দিতেন। সুভাষ তাই লিখল -
ফুলগুলো সরিয়ে নাও
আমার লাগছে
মালা
জমে জমে পাহাড় হয়
ফুল জমতে জমতে পাথর।...
তারপর?
তারপর -
হে জননী,
আমরা ভয় পাইনি।
যজ্ঞে বিঘ্ন ঘটেছে ব'লে
আমরা বিরক্ত।
মুখ বন্ধ করে
অক্লান্ত হাতে -
হে জননী,
আমরা ভালোবাসার কথা ব'লে যাব।
______________________________
'রবির বন্ধু', 'সেই জলছবি', 'গাড়ির হাওয়া হাওয়া গাড়ি' বা 'পিকলুর সেই ছোটকা'র মতো কিশোর উপন্যাসের রচয়িত্রী, সাংবাদিক, সমাজকর্মী, নাট্যকার ও নাট্য পরিচালক গীতা বন্দোপাধ্যায় এই ১৬ জুনে (১লা আষাঢ়, ১৩২৯) শতবর্ষ পেরোচ্ছেন। দিনটিকে মনে রেখে 'পুনঃপাঠ'-এ তাঁর এই লেখাটি প্রকাশ করা হলো।