আরেক রকম ● দশম বর্ষ দ্বাদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ জুন, ২০২২ ● ১-১৫ আষাঢ়, ১৪২৯

প্রবন্ধ

‘দাও ফিরে সে অরণ্য’

মালবী গুপ্ত


আজ বোধহয় তাকে আমরা ফিরে পাবার জন্য, এই ‘নিষ্ঠুর’, ‘সর্বগ্রাসী’ নগর সভ্যতার কাছে আর কোনও আর্জি জানাতে পারব না। পারব না এই কারণে যে, প্রায় ১২৬ বছর আগে রবীন্দ্রনাথের কন্ঠে যখন অরণ্যকে ফিরে পাবার ওই আকুলতা প্রকাশ পেয়েছিল, তখনও বিশ্ব উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের পূর্বাভাস বা পরিণতির বিষয়টি এমনভাবে জনসমক্ষে আসেনি। যে পরিবর্তনের সঙ্গে আরও কিছু কারণ সহ, নির্বিচারে গাছ কাটা ও অরণ্য ধ্বংস ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এবং মানুষের হাত ধরেই সেই ধ্বংস প্রক্রিয়া ক্রমশ চরম পরিণতির দিকে দ্রুত ধাবমান। তবে অরণ্যকে উৎখাত করে নগর সভ্যতার ক্রম আগ্রাসনের প্রভাব কবি সেদিন যতটুকু প্রত্যক্ষ করেছিলেন, তার ভবিষ্যৎ পরিণতি সম্পর্কে যে আশঙ্কার মেঘ পুঞ্জীভূত হয়েছিল তাঁর অনুভবে, তাই-ই যেন চিরকালীন এক হাহাকার হয়ে রইল। এবং সেই অমোঘ সত্যের মুখোমুখি হতে হতে আমাদের স্বরও যেন ক্রমশ ওই হাহাকারের মধ্যেই ডুবে যেতে লাগল।

সত্য যে, বহু যুগ ধরে ক্রমশ হারিয়ে যেতে থাকা প্রাকৃতিক অরণ্যের আজ পুনরুদ্ধার প্রায় অসম্ভব। তবু তাকে ফিরে পাওয়ার এক নিরুচ্চার আকাঙ্ক্ষা হয়তো আমাদের অনেকের অবচেতনেই সতত জাগরুক। তাই হয়তো আমাদের কেউ কেউ গাছ কাটার বিরুদ্ধে এখনও পথে নামেন। কেউ নিজের মতো গাছ লাগিয়ে বেড়ান। আবার কেউ ইতস্তত অরণ্য গড়ে তোলার চেষ্টা করেন এটা জেনেও যে, সেই আরণ্যক আশ্রয় ফিরে পাওয়া এখন দূর অস্ত।

কারণ তার অভাব এই ধরিত্রীকে যতই বিপর্যস্ত করে তুলুক না কেন, সব দেশের হাতেই যে এখন মারণ কুঠার। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে সেই কুঠার অবিরত ধ্বংস করে চলেছে লক্ষ লক্ষ হেক্টর প্রাচীন বনভূমি। রাষ্ট্রপুঞ্জের 'ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন’-এর হিসেব বলছে, ১৯৯০ থেকে এই গ্রহের প্রায় ১০০ কোটি একর বনভূমি ধ্বংস হয়ে গেছে প্রধানত আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকায়। আর অ্যামাজনের বর্ষণারণ্য তো গত ৫০ বছরে বিলুপ্ত হয়েছে ১৭ শতাংশ। এবং সেই ধ্বংসের হার ২১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে শুধু ২০২০-তেই। যা প্রায় ইজরেইল’র আয়তনের সমান।

কেবল এইটুকু তথ্যই হয়তো বলে দিতে পারে, আমরা কি প্রবল নৃশংসতায় প্রতিদিন নির্বিচারে গাছেদের নিধন করে চলেছি। কোথাও কৃষি, শিল্প বা গবাদি পশুর চারণভূমি, কোথাও বা নগরায়ন ইত্যাদি আমাদেরই নানা চাহিদা পূরণে পৃথিবীর শ্যামল বনাচ্ছাদনটিকে নিয়ত উপড়ে ফেলা হচ্ছে। যার ধাক্কা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে এসে লাগছে কিন্তু এই বসুন্ধরার তাবৎ প্রাণের ওপরই। মনে হয়, যেন মানব সভ্যতা নিজের কবর নিজেই খুঁড়তে খুঁড়তে এগিয়ে চলেছে।

গান্ধীজি সেই কবে বলেছিলেন না যে, আমাদের যা প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে, পৃথিবী তা দিয়ে তার সমস্ত মানুষের প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম, কিন্তু তাদের লোভের চাহিদা পূরণে নয়। আসলে আমাদের অপরিসীম লোভ আর অপ্রতিরোধ্য চাহিদাই তো যুগ যুগ ধরে এই বসুন্ধরার অরণ্য প্রকৃতিকে ধ্বংস করে চলেছে। তার সমস্ত সম্পদকে নির্বিচারে নিঙড়ে নিঙড়ে একেবারে ছিবড়ে করে ফেলছে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত ওই সম্পদ ব্যবহারে তাই অদূর ভবিষ্যতে এই নীলগ্রহের আমরা সব বাসিন্দাই সেই ধ্বংসের মুখোমুখি হতে চলেছি।

আশ্চর্য, সাড়ে ৪০০ কোটি বছরের প্রবীণ এই গ্রহ। সেখানে মানুষের বয়স মাত্র ২ লক্ষ বছর। কিন্তু এই নীল গ্রহই যে কোটি কোটি বছর ধরে গাছপালা-নদী-সমুদ্র-পাহাড়-অরণ্য-জল-মাটি-হাওয়া তথা তার তাবৎ প্রকৃতি, সমস্ত প্রাণের জন্য উপযোগী পরিবেশ গড়ে তুলেছিল। কিন্তু তাকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেওয়ার ক্ষেত্রে অন্য সব প্রজাতির তুলনায় মানুষের ভূমিকাই দেখা গেল সব থেকে বেশি। যতই সবার শেষে এই ধরায় তার আবির্ভাব ঘটুক না কেন।

দেখা যাচ্ছে স্বাভাবিকের তুলনায় ১০,০০০ গুণ বেশি মাত্রায় পৃথিবীর প্রাণীকুল বিলুপ্ত হচ্ছে। 'ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ফান্ড ফর নেচার’-এর একটি সমীক্ষা বলছে, সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে আজ অবধি মানুষ সমস্ত স্তণ্যপায়ীর ৮৩%ই ধ্বংস করে ফেলেছে। আর উদ্ভিদ জগতের ধ্বংস করেছে প্রায় অর্ধেক। এক দিকে নির্বিচার অরণ্য ধংস, অপর দিকে আমাদেরই নানা কৃতকর্মে বিশ্ব উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন যে বিলুপ্তিকে ত্বরান্বিত করে চলেছে।

এবং বলা হচ্ছে যে, এই সর্বাত্মক ধ্বংসক্রিয়া যদি এখন বন্ধও করা হত, তাহলেও পৃথিবীর সেই প্রাকৃতিক জগৎ পুনরুদ্ধারে লেগে যেত ৫০ থেকে ৭০ লক্ষ বছর। বিজ্ঞানীরা বিশ্ববাসীকে এই নিয়ে সেই কবে থেকে সজাগ করার, সতর্ক করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু সেই সতর্কবাণীতে কিছুমাত্র কর্ণপাত না করে আমরা কুঠারে শান দিয়েই চলেছি। এবং বিশ্বজুড়ে যার বিধ্বংসী প্রভাব বছর বছর ক্রমে প্রকটও হয়ে উঠছে। অরণ্য ধ্বংসের পাশাপাশি আমরা নিরবচ্ছিন্ন ভাবে জারি রেখেছি পৃথিবীর জল-মাটি-হাওয়া বিষিয়ে তোলার কাজও।

আজ তাই আমরা ফুসফুস ভরে আর বিশুদ্ধ বাতাস টেনে নিতে পারছি না। পাচ্ছি না তৃষ্ণার পরিশ্রুত জল। ক্ষেত থেকে উঠে আসা নানা ফসল, বহুবিধ দূষণের রেশ নিয়ে আমাদের ভাতের থালায় হাজির হচ্ছে। আর দেশের নগরগুলি একাধারে গাছপালা কেটে, জলাশয় বুজিয়ে কেবলই আড়ে বহরে বিস্তৃত হতে হতে সবাইকে যেন গ্রাস করে চলেছে।

বস্তুত পোস্টারে, স্লোগানে ‘একটি গাছ, একটি প্রাণ’ বলা হয় বটে, আসলে একটি গাছ মানে কিন্তু অনেক প্রাণ। কারণ তাকে আশ্রয় করে পশু-পাখি-কীট-পতঙ্গ নিয়ে সহস্র প্রাণ বেঁচে থাকে। এবং বিশ্বজুড়ে সেই কোটি কোটি সন্নিবদ্ধ গাছ নিয়েইতো গড়ে ওঠে নিবিঢ় অরণ্যানী। সৃষ্টির আদিকাল থেকেই যে অরণ্য আমাদের সকলের বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় রসদ জুগিয়ে চলেছে। যার শ্যামল শীতল আচ্ছাদনই এই নীল গ্রহের সমস্ত প্রাণকে আজও সতত বহমান রেখেছে।

কিন্তু কি কঠোর নির্মমতায় বসুন্ধরার সেই অমূল্য আচ্ছাদনকে নিয়ত ছিঁড়ে, উপড়ে তাকে নগ্ন করে ফেলা হচ্ছে। কোটি কোটি প্রাণের পরম আশ্রয় সেই আদিম অরণ্যকে প্রতি মুহূর্তে নিহত হতে হচ্ছে। আমরা কিছুতেই যা প্রতিহত করতে পারছি না। এবং না পারার সেই বিষাদ আমাদের যতই ভারাক্রান্ত করুক না কেন মনে হচ্ছে, তার সমস্ত প্রাণের ওপরই এক অদৃশ্য মৃত্যুর পরোয়ানা জারি হয়ে গেছে। আর সেই পরোয়ানা হাতে নিয়ে যে চরম মূঢ়তায় নিজেদের বসে থাকা ডালটিই আমরা কেটে চলেছি, তাতে আমাদের পতনের অনিবার্যতার গতি কে রুদ্ধ করবে?

কারণ এটা সত্য যে, সেই ১৯৭২ সালে সুইডেনের স্টকহোমে রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রথম পরিবেশ সম্মেলন থেকে শুরু করে গত পঞ্চাশ বছর ধরে আজ পর্যন্ত পৃথিবীর পরিবেশ সংরক্ষণ নিয়ে কম তো অধিবেশন হল না। কম চুক্তিও তো স্বাক্ষরিত হল না। এবং তার রোগ সারিয়ে তাকে সুস্থ করে তোলার জন্য, তার সম্পদের নির্বিচার ব্যবহার বন্ধ করে, তার অরণ্য প্রকৃতি সংরক্ষণের জন্য দেশে দেশে কত নীতিমালাই না তৈরি হল। কিন্তু সব দেশই শেষ পর্যন্ত যেন ন যযৌ, ন তস্থৌ অবস্থাতেই রয়ে গেল।

যদিও সম্প্রতি ১০০ জনেরও বেশি বিশ্ব নেতা ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীর গাছ কাটার সমাপ্তি ঘটিয়ে অরণ্যের পুনরুজ্জীবন ঘটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এবং সেই কর্মযজ্ঞের জন্য কোটি কোটি ডলার ধার্যও হয়েছে। এই উদ্যোগটি যে একটি দিক-নির্দেশক তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু তা রূপায়নে আস্থা বা বিশ্বাস স্থাপনে যেন তেমন জোর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। যাচ্ছে না, কারণ পূর্ব অভিজ্ঞতা বলছে, প্রতিশ্রুতি যতটা দেওয়ার জন্য, ততটা পালনের জন্য নয়। তেমনটা না হলে আজকের ধস্ত, বিষণ্ণ রোগ জর্জর বসুন্ধরার চেহারা অন্যরকম হত না কি?

তা না হলে ইউনেপের ২০২০’র রিপোর্ট বলছে কি করে যে, প্রতি বছরই পর্তুগালের মতো আয়তনের অরণ্য হারিয়ে যাচ্ছে? প্রকৃতি পরিবেশ রক্ষা নিয়ে বিভিন্ন দেশের নেতারা অহরহ যে সব প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দেন, তা রূপায়নে তাঁদের তৎপরতার এত অভাবই বা থাকে কেন?

ক্রমাগত ওই বিপুল অরণ্যের বিলুপ্তিতে মনে হয় আমাদের পূর্বপুরুষ/পূর্বনারীদেরই যেন আমরা হত্যা করে চলেছি।যাঁরা তাঁদের অমন করুণাঘন মায়াময় কোল পেতে, অপার স্নেহে আমাদের লালন করেছেন, আজও করে চলেছেন।কিন্তু প্রবল ঔদাসীন্যে আমরা তাকে উপেক্ষা করার স্পর্ধা দেখিয়ে চলেছি। এটা জেনেও যে, জলবায়ু পরিবর্তনের গতি ধীর করতে, বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণে ও কয়েক’শ কোটি মানুষের জীবনযাপনে সহায়তা দিতে, এক কথায় তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে গাছেরা যে অপরিহার্য। তাই পৃথিবী যদি একদিন গাছহীন, অরণ্যহীন হয়ে পড়ে তাহলে তার প্রাণহীন হয়ে পড়াও তো শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র।


কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ

● https://www.unep.org/news-and-stories/story/inside-global-effort-save-worlds-forests
● https://www.culturalsurvival.org/publications/cultural-survival-quarterly/appiko-movement-forest-conservation-southern-india
● https://www.nationalgeographic.com/environment/article/deforestation