আরেক রকম ● দশম বর্ষ দ্বাদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ জুন, ২০২২ ● ১-১৫ আষাঢ়, ১৪২৯

প্রবন্ধ

রাজদ্রোহ, সন্ত্রাসবাদ, গণবিশৃঙ্খলা আইন নয়, চাই একটি ব্যাপক, বিস্তৃত ব্যক্তি স্বাধীনতা আইন

অশোক সরকার


দেশদ্রোহী কে

কথার অসচেতন ব্যবহারে জনমানসের কতটা ক্ষতি হতে পারে, তার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ দেখা যাচ্ছে Sedition নিয়ে গণ আলোচনায়। খবরের কাগজে, টেলিভিশনের পর্দায়, ডিজিটাল পত্রিকায়, ইউটিউব ভিডিওতে, হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজে ছেয়ে গেছে Sedition কথাটার এই অসচেতন ব্যবহার। প্রায় সবার অজান্তে জনমানসে জায়গা করে নিচ্ছে এই ধারণা, যে Sedition মানে হল দেশদ্রোহ। Sedition আইনের নিদারুণ অপব্যবহারও তার জন্য দায়ী। তার সঙ্গে সমান দায়ী গণমাধ্যম। এক এক জন গ্রেপ্তার হয়েছেন আর গণমাধ্যম চেঁচিয়ে উঠেছে, “ওই দেখ আরও একজন দেশদ্রোহী ধরা পড়েছে”। গেরুয়া দেশপ্রেমীরা একথা প্রায় প্রমাণ করে দিয়েছে বলা যেতে পারে।

তাই আইনের বর্ণপরিচয় থেকেই শুরু করা ভালো। ইংরেজিতে দুটো আলাদা কথা আছে, একটা হল Treason, আরেকটা Sedition। প্রথমটার মানে দেশদ্রোহ, আর দ্বিতীয়টার মানে রাজদ্রোহ। দ্বিতীয় কথাটা বাংলা হিন্দিতে আছে ঠিকই কিন্তু সাম্প্রতিক দেশপ্রেমের জোয়ারে ব্যবহার হয় না। দেশপ্রেমের জোয়ার বইতে গেলে দেশদ্রোহের কাহিনী-র দরকার হয়, তাই দেশদ্রোহ কথাটার এত জনপ্রিয়তা। অদ্ভুত ব্যাপার এই যে বহুক্ষেত্রে সেকুলার লিবারাল দেশপ্রেমীরাও একই কাহিনীতে বাঁধা পড়েছেন।

রাজদ্রোহ কথাটার মানে সরকারের বিরোধিতা, বা সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। Sedition আইন নামে ভারতীয় দন্ডবিধির ১২১, ১২২, ১২৩, ১২৪, ১২৪-এ ধারায় যা যা লেখা আছে, সবই সরকারের বিরোধী কার্যকলাপ সংক্রান্ত, 'দেশ' কথাটার কোন উল্লেখ নেই সেখানে। এর মধ্যে ১২৪-এ সরকারের কাছে সবচেয়ে প্রিয়। কেন? কারণ সরকার বিরোধী কোন লিখিত বা উচ্চারিত কথা, ছবি, কার্টুন পছন্দ না হলেই পুলিশ ১২৪-এ ধারা অনুযায়ী সেই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করতে পারে, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই। পছন্দ না হবার কারণ কি? ১২৪-এ বলছে যদি উচ্চারিত বা লিখিত কথা, ছবি, কার্টুন, টুইট সরকারের প্রতি বিরাগ প্রকাশ বা অনাস্থা বা অসন্তোষ প্রকাশ করে, তাহলেই হয়ে গেল, পেয়াদা এসে ধরে নিয়ে যাবে। আরও একটা কথা, ১২৪-এ 'আমলযোগ্য অপরাধ' বা Cognizable Offence যার অর্থ, ম্যাজিস্ট্রেটের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারে। এই ঘোষণা হয়েছিল ইন্দিরা গান্ধীর হাতে ১৯৭৩ সালে।

বর্ণ পরিচয়ই যখন চলছে তখন আরেকটু খোলসা করে বলা ভালো। ১২৪-এ ধারায় ইংরেজিতে Disaffection কথাটা ব্যবহার হয়েছে, যার তিনটে বাংলা করেছি আমরা - বিরাগ, অনাস্থা, বা অসন্তোষ। লেখা বা বলা কথা সরকারের বিরুদ্ধে Disaffection-এর প্রকাশ ঘটলেই চলবে, পুলিশের গ্রেপ্তার করার জন্য আর কিছু লাগবে না।

এবার কি তাহলে ব্যাপারটা একটু হলেও বোঝা যাচ্ছে? একটা টুইট করে ১৫ মিনিটের মধ্যে মুছে দিলেও রাজদীপ সরদেশাই-এর বিরুদ্ধে Sedition-এর ১২৪-এ ধারা লাগানো হয়েছিল, জিগনেস মেওয়ানি একটা টুইট করেছিলেন গুজরাটে, তার জন্য আসাম থেকে পুলিশ গিয়ে সেই দিনই তাঁকে গ্রেপ্তার করে। কমেডিয়ান মুনাবর ফারুকী যে কথা তখনো বলেননি, বলতে পারেন সেই সন্দেহেই তাঁকে ইন্দোরে গ্রেপ্তার করে Sedition-এর ১২৪-এ-তে ভূষিত করা হয়। দিশা রবিও 'ভারত জিন্দাবাদ-পাকিস্তান জিন্দাবাদ' বলে এই ভূষণে ভূষিত হয়েছিলেন। ডাক্তার, উকিল, সমাজকর্মী, সাংবাদিক, কমেডিয়ান, লেখক, অধ্যাপক, ছাত্র-নেত্রী, বিপক্ষের রাজনীতিবিদ - কেউই বাদ যাননি। ২০১০ থেকে ২০২০ - এক দশকের হিসেবে ৭৩৬টি রাজদ্রোহের মামলা হয়েছে, সবচেয়ে বেশি হয়েছে বিহারে (১৬৮), তারপর আছে তামিলনাড়ু (১৩৯), এবং তৃতীয়স্থানে উত্তরপ্রদেশ (১১৫)। তামিলনাড়ুতে কুন্ডকুলাম নিউক্লিয়ার বিদ্যুতকেন্দ্রের বিরুদ্ধে ২০১১ সালে গড়ে ওঠা স্বতঃস্ফূর্ত গনআন্দোলনের প্রায় সব নেতা-নেত্রীর বিরুদ্ধে ১২৪-এ প্রয়োগ হয়েছিল। মোদী শাসনে ২০১৪ থেকে ২০২০ পর্যন্ত মামলা হয়েছে ৩৯৯টি। অপব্যহার শুধু মামলার সংখ্যায় নয়, ৩৯৯টি মামলার মধ্যে ছয় বছরে মাত্র ১৪৪টিতে চার্জশিট দেওয়া গেছে, এবং দোষী সাব্যস্ত করা গেছে মাত্র ২৫ জনকে। ২০১৯ সালে ৯৩টি মামলা হয়েছিল, দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল ১ জনকে।

আইনজ্ঞরা বলবেন, না না ব্যাপারটা এত সহজ নয়। আইনে যাই লেখা থাক না কেন, ১৯৬২ সালে কেদারনাথ সিং মামলায় সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চ রায় দিয়েছিল, শুধু বলা বা লেখা-কথা সরকারের বিরাগভাজন হলেই হবে না, সেই কথা থেকে হিংসা উৎপন্ন হল কিনা, এবং গণবিশৃঙ্খলা তৈরী হল কিনা সেটা দেখতে হবে। তবেই তা রাজদ্রোহের যোগ্য বলে গণ্য হবে। অম্বিকেশ মহাপাত্র থেকে কফিল খান, রাজদীপ সরদেশাই থেকে বিনোদ দুয়া, মৃনাল পান্ডে, দিশা রবি থেকে শশী থারুর - কারুর কথার সূত্রে হিংসার ছিটেফোঁটাও উৎপন্ন হয়নি। তাহলে তা রাজদ্রোহ হয় কি করে, আর তার চেয়েও বড় কথা দেশদ্রোহের কথা আসছে কি করে?

কেদারনাথ সিংহের বিরুদ্ধে কিন্তু দেশদ্রোহের মামলা হতে পারতো। তিনি ছিলেন বিহারে 'ফরোয়ার্ড কম্যুনিস্ট পার্টি' নামক এক রাজনৈতিক দলের নেতা, ১৯৬২ সালেও তাঁদের পার্টির ঘোষিত অবস্থান ছিল 'ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়' এবং তাঁরা দেশের সংবিধানে বিশ্বাস করতেন না। তাঁরা আমূল বিপ্লবের কথা বলতেন। অর্থাৎ দেশের পুরো সাংবিধানিক ব্যবস্থায় - পার্লামেন্ট, সরকার, আদালত, নির্বাচন - কোনটাতেই তাঁদের আস্থা ছিল না। বিহারের এক জনসভায় কংগ্রেসকে 'কালা সাহেব' বলেছিলেন, “বলেছিলেন গোরা সাহেবরা চলে গেছে, রেখে গেছে কিছু কালা সাহেব, এবং সেই কংগ্রেসি কুত্তারা এখন দেশ চালাচ্ছে”। এহেন ঘোষিত অবস্থান এবং উক্তির পরেও মামলা সাংবিধানিক বেঞ্চ পর্যন্ত গড়িয়েছিল। কেদারনাথ সিংহের সেই উক্তি থেকে যেহেতু হিংসা হয়নি, গণবিশৃঙ্খলা তৈরী হয়নি, তাই তিনি রেহাই পেয়ে গিয়েছিলেন। আজকে হলে কেদারনাথের কি হত?

কিন্তু ওই মামলার সূত্রেই সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছিল যে, ১২৪-এ ধারা সাংবিধানিকভাবে বৈধ। কি করে হল? কারণ সংবিধানের ১৯(২) ধারায় বলা আছে, দেশের নিরাপত্তা, রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, গণ-শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হলে নাগরিকের স্বাধীন মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বেড়ি টানা যেতে পারে। এই গণ-বিশৃঙ্খলার দোহাই দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট ১২৪-এ ধারাটিকে বৈধ ঘোষণা করে। পুলিশ ও প্রশাসনের কাছে এর ফলে অস্ত্রটা রয়েই গেলো। বিনা গ্রেপ্তারি পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করার অস্ত্র, ১২৪-এ ধারায় মামলা করার অস্ত্র, আর এই গ্রেপ্তারিকে 'দেশদ্রোহ' বলে চালিয়ে দেবার অস্ত্র। গণমাধ্যমও তৈরী, তাকে দেশদ্রোহ বলে রটিয়ে দেবার জন্য। আইনের অপব্যবহার ব্যস্ত পুলিশ ও প্রশাসন, আর তার অপব্যাখ্যায় ব্যস্ত গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক প্রচারমাধ্যম। ফলে জনমানসে অপবিশ্বাস, বা মিথ্যা ধারণা তৈরি হতে বাঁধা কোথায়? আর সেটাই তো চায় সরকার।

যে প্রশ্নটা তোলার সময় এসেছে তা হল হিংসা, গণ-বিশৃংখলা তো পরের কথা, গণতন্ত্রে রাজদ্রোহের কোনো স্থান আছে কিনা। সরকারের প্রতি বিরাগ, আনুগত্যের অভাব, অসন্তোষ কি গণতন্ত্রের অবিচ্ছিন্ন অঙ্গ নয়? গণতান্ত্রিক দেশে সরকার আর দেশ কি আলাদা নয়? গণতন্ত্রে গণ-বিশৃঙ্খলা-র সম্ভাবনা কি অবশ্যম্ভাবী নয়? জনতার অসন্তোষ কি একটা ডিনার পার্টি যে সেখানে থালা-চামচের টুংটাং ছাড়া অন্য কোন শব্দ অপাংতেয়? সরকারের মন্ত্রী-র বিরুদ্ধে কোন নাগরিকের রাজনৈতিক অসন্তোষের প্রকাশ কি একেবারেই স্বাভাবিক নয়? যে সরকার জনতার রায়ে প্রতিষ্ঠা হয়, সেই সরকার ও তার শাসন সম্পর্কে জনতার একাংশের বা কোন ব্যক্তি বিশেষের রাজনৈতিক মতামত, সেই শাসনের বিরুদ্ধে জনতার এক অংশের আন্দোলন, সরকারের বিরুদ্ধে খোলা আওয়াজ, প্রয়োজনে তার জন্য জনজীবন স্তব্ধ করে দেওয়া, জনতার রাজনৈতিক বহিঃপ্রকাশ ছাড়া অন্য কিছু নয়। জয়প্রকাশ নারায়ণের আন্দোলন, অন্না হাজারের আন্দোলন, পশ্চিমবঙ্গের খাদ্য আন্দোলন, - সবই ছিল তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে জনতার একাংশের অনাস্থার প্রকাশ।যদি সেই আন্দোলন থেকে বা কারুর কোন বলা কথা বা আঁকা কার্টুন থেকে সম্পত্তি ধ্বংস হয়, খুনখারাপি হয়, তাহলে সম্পত্তি ধ্বংসে প্ররোচনা দেওয়া বা খুনে প্ররোচনা দেওয়া-র জন্য দণ্ডবিধির একাধিক ধারায় মামলা হতে পারে কিন্তু তার কোনটাই রাজদ্রোহের সমার্থক নয়।

বর্ণ পরিচয়ের শেষ অংশটি দেশদ্রোহ নিয়ে। সংবিধানের ভিত্তিতে তৈরী গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় দেশদ্রোহী চিহ্নিত করা কঠিন নয়। যারা এ দেশ থেকে আলাদা হতে চায় সেই বিচ্ছিন্নতাবাদীরা নিশ্চিতভাবে দেশদ্রোহী। সংবিধানে যাঁদের এদেশের অংশ বলে মেনে নেওয়া হয়েছে, তাদের যদি কেউ এই দেশ থেকে আলাদা করতে চায়, তারা দেশদ্রোহী। যারা দেশের সাংবিধানিক ব্যবস্থা ভেঙে গুড়িয়ে দিয়ে অন্য শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চায় তারা দেশদ্রোহী। যে শক্তি দেশের সুরক্ষা বিপন্ন করতে চায়, বা দেশের একাংশ দখল করে অন্য দেশ বা শাসনব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত করতে চায়, বা অন্য শাসনব্যবস্থা কয়েম করতে চায় তারা দেশদ্রোহী। যাদের এদেশে জন্ম, যারা এদেশের নাগরিক তাদের যদি কেউ অন্য দেশে চলে যেতে বলে তাহলে সে দেশদ্রোহী। কিন্তু এসব ক্ষেত্রেও দেশদ্রোহী মানসিকতা, আর দেশদ্রোহী কাজের মধ্যে তফাৎ করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। আলোচনা হোক সেই তফাৎ নিয়ে, রাজদ্রোহ বা গণবিশৃংখলা হল কি, হল না তা নিয়ে নয়। শ্রীলংকার দিকে তাকালেই বোঝা যায় যে সেখানে যা ঘটছে তা দেশপ্রেমের প্রকাশ, রাজদ্রোহের বা দেশদ্রোহের নয়।

● ● ●

সন্ত্রাসবাদী কে?

ধরুণ আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, আপনি পড়ান 'সন্ত্রাসবাদের একাল সেকাল' বা 'সন্ত্রাসবাদের ইতিহাস' জাতীয় কোন বিষয়। আপনার ল্যাপটপে, বাড়ির বইয়ের তাকে, আপনার ইমেলে, প্রকাশিত লেখায়, আপনার কোনো বক্তৃতায় সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কে বই, লেখা, পত্রিকা, লিফলেট, পোস্টার ইত্যাদি পাওয়া যাবে। হয়ত আপনার বক্তৃতায় সন্ত্রাসবাদীরা যে সব বিষয়ে কথা বলে, যে সব প্রশ্ন রাষ্ট্রের সামনে তুলে ধরে সে সম্পর্কে, তার দু'একটার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে অল্প সহমত থাকতেই পারে। তার মানে আজকের Unlawful Activities Prevention (ইউ-এ-পি-এ) আইনে সরকারের কাছে আপনি সন্ত্রাসবাদী। কারণ দুটো। প্রথমত, ২০১৯-এর সংশোধনের পরে সরকার শুধু কোন সংগঠন নয়, ব্যক্তিকেও সন্ত্রাসবাদী ঘোষণা করতে পারে। সেই ব্যক্তির কোন সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের সঙ্গে কোন যোগাযোগ না থাকলেও চলবে। দ্বিতীয়ত, সরকারের যদি মনে হয় আপনি সন্ত্রাসবাদী, তাহলেই হবে, পেয়াদা এসে নিয়ে যাবে। এ আবার অন্য পেয়াদা। 'ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি' (এন-আই-এ)-র পেয়াদা। জেলে ভরে দেবে আর মামলা রুজু করে দেবে। আর কিছু তাকে করতে হবে না। আপনাকে প্রমান করতে হবে আপনি সন্ত্রাসবাদী নন।

কোবাড গান্ধী, অরুন ফেরেরা, গৌর চক্রবর্তীকে প্রমান করতে হয়েছিল তাঁরা সন্ত্রাসবাদী নন, তাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদী অভিযোগ যে ভুয়ো, কোর্টকে সেই রায় দিতে সাত বছর লেগেছিল। সুধা ভরদ্বাজ দু'বছর বাদে জামিন পেয়েছিলেন। এ এক এমন আইন যেখানে আগে আপনি গ্রেপ্তার হবেন, তারপর কোর্টে আপনি জানতে পারবেন, সরকারের মনে হয়েছে আপনি সন্ত্রাসবাদী, এখন সরকার তদন্ত করবে, ততদিন আপনাকে জেলে থাকবে হবে, আপনি কারারুদ্ধ থাকবেন এই সন্দেহে যে সরকারের মনে হয়েছে আপনি সন্ত্রাসবাদী, কিন্তু আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগটি সঠিক কি তা জানার আগেই আপনাকে উকিল ঠিক করে প্রমাণ করতে হবে আপনি সন্ত্রাসবাদী নন।

ইউ-এ-পি-এ আইনে জামিন পাওয়াটাই প্রায় অসম্ভব। স্ট্যান স্বামী জামিন না পেয়ে কারারুদ্ধ অবস্থাতেই মৃত্যুবরণ করেন। অধ্যাপক আনন্দ তেলতুম্বে, মানবাধিকার কর্মী রোনা উইলসন, উমর খালিদ, শারজিল ইমাম ও অন্যান্য অনেকেই এই আইনে কারারুদ্ধ, কিন্তু জামিন পাননি। কেন? কেননা এই আইনের ৪৩ডি(৫) ধারায় বলা আছে, কোর্ট যদি মনে করে অভিযোগ প্রাথমিকভাবে সত্য, তাহলে জামিন দেওয়াই যাবে না। আরও বলা আছে, পাবলিক প্রসিকিউটরের কথা না শুনে আদালত জামিনের সিদ্ধান্ত নিতেই পারবে না।

ন্যায়বিচারের একটা ভিত্তি হল, যতক্ষণ না দোষী সাব্যস্ত হচ্ছেন, ততক্ষণ আপনি নির্দোষ। দ্বিতীয় ভিত্তি হল পালিয়ে যাওয়া, সাক্ষ্য প্রমান লোপাট করার খুব সম্ভাবনা না থাকলে, আর যদি আরও ক্ষতি করার সম্ভাবনা না থাকে (যেমন সিরিয়াল খুনির ক্ষেত্রে হতে পারে), তাহলে জামিনটাই স্বাভাবিক, জেলে থাকা বা পুলিশ হেফাজতে থাকা স্বাভাবিক নয়। সেটা ব্যক্তির অধিকারের পর্যায়ে পড়ে। তৃতীয়, কোনো অভিযুক্তকে বেশিদিন কারারুদ্ধ রাখা যায় না। চতুর্থ ভিত্তি হল আদালত জামিন দেবার বেলায় অভিযোগকারীর উকিলের কথা শুনতে বাধ্য নন। পঞ্চম ভিত্তি হল অভিযোগকারীর দায়িত্ব অভিযোগ প্রমাণ করবার, অভিযুক্তের নয়। এই আইনে এই পাঁচটি ভিত্তিকেই উপড়ে ফেলা হয়েছে। বিশেষত ২০১৯ সালে যে সংশোধন হয়েছে, তাতে সরকারের পক্ষে যে কাউকে সন্ত্রাসবাদী বলতে আর বাধা রইল না।

উপরের দুটি আইনকে এক সঙ্গে দেখলে বোঝা যায়, সরকার চাইলে যে কোন নির্দোষ নাগরিককে রাজদ্রোহের অথবা সন্ত্রাসবাদী অভিযোগে জেলে পুরতে পারে। শুধু ইউ-এ-পি-এ আইনেই গত সাত বছরে ১০,৫৫২ জনকে জেলে পুরেছে সরকার, কিন্তু দোষী সাব্যস্ত হয়েছে ২৫৩ জন, মানে ২.৫%। অর্থাৎ দোষী সাব্যস্ত করাটা সরকারের মূল উদ্দেশ্য নয়, জেলে পুরে রাখাটাই প্রধান উদ্দেশ্য, একথা দুটি আইন সম্পর্কেই খাটে। যেহেতু দেশের মানুষ অনেক সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ দেখেছে, তাই সরকারের পক্ষে কাউকে সন্ত্রাসবাদী ঘোষণা করে দিলে, আর সরকারের পোষ্য মিডিয়া তা ১০০০ বার পুনরাবৃত্তি করলে, মানুষের মনে প্রাথমিকভাবে তা সত্যি বলেই মনে হবে এবং সরকারের শক্ত মনোভাবের প্রতি আকর্ষণ বাড়বে। মানুষ ভাববে সরকার আমাদের রক্ষা করছে। কে আমজনতাকে রুক্ষ করার জন্য আওয়াজ তুলছে, আর কে সেই আওয়াজ গলা টিপে মারছে, মানুষের পক্ষে সেই তফাৎ করার ক্ষমতাটাই ঘুচে যাবে, আর সেটাই চায় সরকার।

● ● ●

গণ বিশৃঙ্খলাকারী কে?

২০১৮ থেকে ২০২০-র মধ্যে এলাহবাদ হাইকোর্টে ন্যাশনাল সিকিউরিটি আইনে (এন-এস-এ) বেশ কিছু মানুষকে আটকে রাখার ১২০টি আদেশের বিরুদ্ধে হেবিয়াস করপাস আবেদন এসেছিল। এন-এস-এ আইনে এই আদেশ দেন জেলাশাসক। জেলাশাসক নিজেই এই আদেশ দিতে পারেন, কোন সরকারি মন্ত্রক বা দপ্তরের সিন্ধান্তের দরকার হয় না। হাইকোর্ট ১২০টির মধ্যে ৯৪টি আদেশ খারিজ করে দিয়েছিল। এর মধ্যে ৪১টি আদেশ ছিল বেআইনিভাবে গরু হত্যা সংক্রান্ত! ২০টি ছিল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিঘ্ন করার জন্য। ১২০টির মধ্যে ৮০টি মত আদেশ ছিল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদের বিরুদ্ধে।

এন-এস-এ একটি মারাত্মক আইন। সরকারের যদি সন্দেহ হয় যে, কেউ সার্বজনীন শান্তি বিঘ্ন করছে, গণবিশৃঙ্খলা তৈরী করছে বা করতে পারে, তাহলে তাকে এক বছর পর্যন্ত আটকে রাখতে পারে। ইংরেজিতে বলে Preventive Detention। আটকে রাখা আর গ্রেপ্তার করা আইনের চোখে এক নয়। গ্রেপ্তার করলে সেই ব্যক্তির একাধিক অধিকার থাকে, ১) গ্রেপ্তারের কারণ জানার অধিকার, ২) জামিনের অধিকার, ৩) উকিলকে পরামর্শ করার অধিকার, ৪) বিচারের অধিকার, এমনকি ৫) যদি কারোর পক্ষে আইনের সহায়তা নেওয়া সম্ভব না হয়, তাহলে সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রের তরফে তার উকিলের সহায়তা পাবার অধিকার। এন-এস-এ পাস্ করানোর পিছনে যুক্তি ছিল যে এই ব্যবস্থায় সহজেই কেউ ছাড়া পেয়ে যেতে পারে, জামিন তো পেতেই পারে। তাই এমন আইন দরকার যার শক্তিতে কাউকে আটকে রাখা যায়, যাতে সে আইনের বলে ছাড়া না পেয়ে যায়। আটকে রাখা কোন অপরাধের শাস্তি নয়, কোন অপরাধের বিচার প্রক্রিয়ার অঙ্গও নয়, এটা শুধু একটা সতর্কতামূলক ব্যবস্থা। এন-এস-এ আইনে আটকে রাখার কারণ জানাতে ১৫ দিন পর্যন্ত সময় নেওয়া যায়! শুধু তফাৎটা এই যে কাউকে গ্রেপ্তার করলে তাকে পুলিশি হেফাজতে বা জেল হেফাজতে রাখতেই হয়, এক্ষেত্রে বাড়িতেও আটকে রাখা যেতে পারে। এন-এস-এ আইনে আটকে রাখলে সরকারকে আদালতে কোন চার্জশিট দাখিল করতে হয় না, আদালতে গিয়ে তার বিচারও চাইতে হয় না। এমনকি যে যে কারণে কোন ব্যক্তিকে আটকে রাখা হচ্ছে, তা যদি অস্পষ্ট হয়, অপ্রাসঙ্গিক হয়, ওই ব্যক্তি সম্পর্কিতই না হয়, তাহলেও সেই আদেশ বহাল থাকবে। এ এক এমন আইন যেখানে আদালত যদি দেখে যে জেলাশাসকের উদ্দেশ্যই সৎ ছিল না, তাহলেও তাকে শাস্তি দিতে পারবে না। জেল বন্দি করার এর চেয়ে সহজ উপায় বোধহয় আর নেই।

এইসব ক্ষেত্রে আটক ব্যক্তির ক্ষেত্রে হেবিয়াস কর্পাস আবেদন করা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। এলাহাবাদ হাইকোর্টে সেই আবেদনই এসেছিল ১২০ খানা। শুধু এলাহাবাদ নয়, তবলঘি জামাত-এর ৬ নেতার বিরুদ্ধেও এই আইন প্রয়োগ হয়েছিল, সবাইকেই আদালত বেকসুর খালাস করেছিল। মনিপুরে এক সাংবাদিক 'গোবর এবং গোমূত্র পান করলে করোনা সারে না' লেখায় তাকে এন-এস-এ আইনে আটক করা হয়েছিল! উত্তরপ্রদেশে তো এক ব্যক্তি তার বাবার জন্য অক্সিজেন সিলিন্ডার চাই বলে টুইট করায়, তাকে এই আইনে আটক করা হয়, কারণ পরে দেখা গিয়েছিল তার বাবা হার্ট অ্যাটাকে মারা গিয়েছিলেন। পুলিশ বলেছিল সেই ব্যক্তি অযথা ভয় ছড়ানোর চেষ্টা করছে। এঁরা সবাই হেবিয়াস কর্পাস করেই ছাড়া পেয়েছিলেন।

এই তিনটি আইন ছাড়াও আরও অনেক আইন আছে, এবং আরও অনেক সরকারি সংস্থা আছে, নাগরিককে গ্রেপ্তারের জন্য। তবে নাগরিকের দৃষ্টিতে 'কালাকানুন' বলতে গেলে এই তিনটি আইনকেই বোঝাবে। কালাকানুন সাধারণত রাজনৈতিক বিরোধিতাকে স্তব্ধ করার ব্যবহৃত আইনগুলির ক্ষেত্রেই খাটে, সেই দৃষ্টিতে এই তিনটি আইন কালাকানুনের উৎকৃষ্ট উদাহরণ বলা চলে।

এমন কথা ভাবার কোন কারণ নেই যে এই আইনগুলি বর্তমান সরকারের তৈরী। সিডিশন আইন ১৮৭০ সাল থেকে আছে, ইউ-এ-পি-এ আছে ১৯৬৭ সাল থেকে, এন-এস-এ আছে ১৯৮০ সাল থেকে। আইনের অপপ্রয়োগ যে এই শুধু সরকারের আমলে হয়েছে, তাও নয়, অপপ্রয়োগ হয়েছে সব সরকারের আমলেই। শুধু এই সরকারের আমলে আইনের অপপ্রয়োগ একটা মহামারীর আকার নিয়েছে। ত্রিপুরায় একদিনে ১০২টি সোশ্যাল মিডিয়া একাউন্ট হোল্ডারদের বিরুদ্ধে ইউ-এ-পি-এ আইনে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। ২০১৭, ২০১৮ এই দুই সালে ১১৩৮টি এন-এস-এ আইন প্রয়োগ করে আটক করার ঘটনা এসেছে শুধু দুটি রাজ্য থেকে উত্তরপ্রদেশ আর মধ্যপ্রদেশ। এসব ঘটনা অভূতপূর্ব। এই আইনের প্রয়োগ এবং অপপ্রয়োগ দুইই সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে বিজেপি শাসিত রাজগুলিতে; চার ভাগের তিন ভাগ প্রয়োগ ঘটছে ওই রাজ্যগুলিতে। দ্বিতীয়ত, সব আমলেই সরকার বিরোধীদের প্রতি এই তিনটি আইন প্রয়োগ হয়েছে, কিন্তু মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি এই তিনটি আইনের প্রয়োগ সবচেয়ে বেশি হয়েছে বিজেপি রাজ্য সরকারের আমলে।

এই তিনটি আইনকে একসঙ্গে দেখলে আইন প্রয়োগের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যটা স্পষ্ট হয়ে যায়। সংখ্যালঘু বিশেষত মুসলমান সম্প্রদায়কে আলাদা করে দেশদ্রোহী, সন্ত্রাসবাদী, গণ-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী হিসেবে চিহ্নিত করার এ এক সুচিন্তিত সংঘবদ্ধ প্রয়াস। হিন্দু সমাজ জাতপাত, ভাষা, অঞ্চল, সম্প্রদায়ে বিভক্ত। এই সমাজকে একত্রে আনতে গেলে একটা কমন শত্রুর দরকার হয়। সাধারণভাবে মুসলমানেরা হিন্দুদের শত্রু এটা জনজীবনে প্রমাণ করা প্রায় অসম্ভব। ভারতীয় জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে, হিন্দু-মুসলমান এক সঙ্গে জড়িয়ে - ব্যবসায়, চাকরিতে, সংস্কৃতিতে, খেলাধুলায়, শ্রমের জগতে, চাষবাসের জগতে, ধর্ম আচরণের জগতে, কোথায় নয়। তাই প্রয়োজন হয় তাদের দেশদ্রোহী, সন্ত্রাসবাদী, এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী হিসেবে চিহ্নিত করতে যাতে জনমানসকে মুসলমান বিরোধী হিসেবে একত্রিত করা যায়। এই কাজে অনেকটাই সফল হয়েছে বিজেপি, অন্তত উত্তর ভারতের বেশ কিছু রাজ্যে।

কিন্তু এই কাহিনীটা শুধু মুসলমানদের দেশের শত্রু বানানোর কাহিনী নয়। এই কাহিনী একই সঙ্গে বিজেপি সরকার বিরোধিতাকে সন্ত্রাসবাদ, দেশদ্রোহিতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির আলোয় দেখানোর কাহিনী। সাধারণভাবে সরকার বিরোধিতাকে 'গণতন্ত্রের স্বাভাবিক অঙ্গ' বলে ধরে নেওয়া হয়, গণতন্ত্রে সরকার বিরোধিতাকে কেউ অবাঞ্ছিত বলে ভাবে না, বরং সরকারের সমর্থনের চেয়ে বিরোধিতার আকর্ষণ জনমানসে বেশি থাকে। গণতন্ত্রকে দুর্বল করতে গেলে বিরোধিতার ধারণাকে দুর্বল করতে হয়, বিরোধিতাকেই অবাঞ্ছিত বলে পরিচিতি দিতে হয়। সেটা সম্ভব যদি বিরোধিতাকে দেশদ্রোহিতা, সন্ত্রাসবাদ ইত্যাদি তকমায় রাঙানো যায়, যাতে জনমানসে মনে হয় যে বিরোধিতা মানে দেশের ক্ষতি।

তিনটি আইনের ধারাবাহিক অপপ্রয়াগের যে ধারাপাত আমরা তুলে ধরলাম তাতে আন্দাজ করা যায়, যে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার প্রতি সরকারের কমিটমেন্ট ক্রমশ কমছে, আইনের শাসনের প্রতি সরকারের আস্থাও ক্রমশ কমে আসছে। যত দিন যাচ্ছে, নাগরিকের স্বাধীনতা হননের দৃষ্টান্ত বাড়ছে, এমনকি তার আইনের সংখ্যাও বেড়েই করেছে। নাগরিকের স্বাধীনতা হননের যতগুলি আইন দেশে আছে, তার তুলনায়, নাগরিকের স্বাধীনতা রক্ষার একটাও কোন বিশদ ও ব্যাপক আইন নেই, সব সময়েই তা আদালতের রায়ের উপর নির্ভরশীল। প্রয়োজন হয়ে পড়েছে একটি 'Protection of Personal Liberties Act' যেখানে একদিকে যেমন ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষার জন্য রাষ্ট্রের ক্ষমতার উপর যথেষ্ট শক্ত বেড়ি টানার ব্যবস্থা থাকবে এবং আদালতের ভাষায় রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের তরফে 'যথেষ্ট চিন্তাভাবনার অভাব (inadequate application of mind)' বা 'দুরভিপ্রেত (malafide)' প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হলে সেই প্রতিনিধির যথেষ্ট শাস্তি বিধানের ব্যবস্থা থাকবে। কিছু জেলাশাসক, পুলিশ সুপার, ইন্সপেক্টর, ইত্যাদি জেলে গেলেই অবস্থা পাল্টাতে পারে, অন্যথা নয়।