আরেক রকম ● দশম বর্ষ দ্বাদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ জুন, ২০২২ ● ১-১৫ আষাঢ়, ১৪২৯

প্রবন্ধ

শিক্ষা-সংস্কৃতির স্বাধিকার

সৌরীন ভট্টাচার্য


পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা-সংস্কৃতির স্বাধিকার ভাবনায় টান পড়েছে। কথাটা একটু বুঝে নেওয়া দরকার। শিক্ষা-সংস্কৃতির স্বাধিকারে টান কি আজকে নতুন পড়েছে? হয়তো না। সে টান হয়তো অনেকদিন থেকেই পড়ছে। এবারে যা নতুন তা হল এই ভাবনার গোড়া ধরে টান পড়েছে। অর্থাৎ স্বাধিকারের প্রয়োজনীয়তা বিষয়েই আজ প্রশ্ন উঠছে। এবং প্রায় খোলামেলা ভাবে বলে ফেলা সম্ভব হচ্ছে, স্বাধিকার আবার কি? যে টাকা জোগাবে অধিকার তার। এ কথা বলতে ঘোমটা টানার দরকার নেই। লুকোচুরিরও কোনো ব্যাপার নেই। আমার উদ্বেগ এইখানে। বলছি কেন।

তোমার স্বাধিকার আছে কোনো ব্যাপারে, এ কথাটা আমি স্বীকার করছি। আর কাজের বেলায় এমন করে সব ব্যাপার নিয়ন্ত্রণ করছি যাতে তোমার স্বাধিকার তুমি প্রয়োগ করতে পারছ না। আর আমি মুখ ফুটে বলেই দিলাম যে না, এ ব্যাপারে তোমার কোনো স্বাধিকার নেই। এ দুইয়ের মধ্যে অবশ্যই তফাত আছে। প্রথম অবস্থায় তত্ত্বগতভাবে স্বাধিকারের ধারণা স্বীকৃত। কিন্তু বাস্তবে প্রয়োগের ক্ষেত্রে বাধা আসছে। আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে ধারণাটাই স্বীকৃত নয়। এই দুই ক্ষেত্রে প্রতিরোধের চেহারা ও কর্মসূচি আলাদা হবে। হাতের কাছে একটা সহজ উদাহরণ প্রাপ্তবয়স্কের সার্বজনিক ভোটাধিকার। একবার ভাবুন, এই অধিকার পেতে দেশে দেশে কালে কালে মানুষকে কী না করতে হয়েছে। আর এই অধিকার পাবার পরেও অন্য নানা দুরভিসন্ধিমূলক কাজের জন্য এই প্রাপ্ত অধিকারের সুষ্ঠু প্রয়োগ সব সময়ে সম্ভব হচ্ছে না। এই দুটো অবস্থান অবশ্যই এক নয়। ভোটের আগে হিংসা, ভোটের পরে হিংসা, বুথ দখল, ছাপ্পা ভোট, এসব কেউই বলবেন না, সুস্থ গণতান্ত্রিক লক্ষণ।

এই অন্তরায় দূর করা এক জিনিস। কিন্তু আমি যদি বলি স্বাধিকারের ধারণাই অবলুপ্ত হল, তাহলে সে প্রতিরোধ আন্দোলনের চেহারাই আলাদা হবে। সে হবে পুরোপুরি রাজনৈতিক আন্দোলন। তার জন্য থানা পুলিশ লাগবে না। বরঞ্চ রাষ্ট্র তখন সে আন্দোলন দমন করার জন্য পুলিশ মিলিটারি ডাকতে পারে। আর দুর্বৃত্ত দমনের জন্য যা যা ব্যবস্থা নিতে হবে তার চরিত্র আলাদা।

আমাদের এখানে স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় বলতে মূলত তিন রকমের প্রতিষ্ঠানকে বোঝায়। রাজ্য স্তরের, কেন্দ্রীয় স্তরের ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। আপাতত সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির কথা ভাবা যাক। রাজ্য বিধানসভায় আইন পাশ করে যে সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তারা রাজ্য স্তরের প্রতিষ্ঠান। আমাদের রাজ্যে কলকাতা, যাদবপুর, বর্ধমান, কল্যাণী, উত্তরবঙ্গ, বিদ্যাসাগর, বারাসাত প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়গুলি এই শ্রেণিভুক্ত। এ ছাড়াও আরো আছে। কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় এ রাজ্যে একটিই, বিশ্বভারতী। এই সব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাঠামো কেমন হবে তা বলা থাকে সংশ্লিষ্ট আইন সভায় পাশ হওয়া সেই সব বিশ্ববিদ্যালয় আইনে। রাজ্য স্তরে বিধানসভার আইনে আর কেন্দ্র স্তরে সংসদের আইনে। বর্তমানে আমাদের রাজ্য স্তরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে আইনি কাঠামো অনুসারে বিধান আছে আভ্যন্তরিক প্রশাসনে সর্বোচ্চ পদে বহাল থাকবেন উপাচার্য। আর কমিটির স্তরে থাকবে মূলত দুটি কক্ষ - মোটামুটিভাবে বলা চলে কোর্ট আর কাউন্সিল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই দুটি কক্ষের প্রথাগত নাম সেনেট আর সিণ্ডিকেট। নির্মাণ শিল্পের প্রসঙ্গে ইঁট সিমেন্ট বালি সুরকির অনুষঙ্গে আমাদের এখানে 'সিন্ডিকেট' বলে একটি শব্দের প্রচলন হয়েছে। তার সঙ্গে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত 'সিণ্ডিকেট' শব্দটিকে গুলিয়ে ফেলার এখনো কোনো কারণ নেই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের এই আভ্যন্তরিক প্রশাসনের বাইরে আছে আচার্যের পদ। আমাদের রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে এখনো পর্যন্ত যে ব্যবস্থা আছে তাতে পদাধিকার বলে রাজ্যপাল বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্য। আমার ধারণা এটাই সাধারণ আইনি ব্যবস্থা। একটু আধটু ব্যতিক্রম এখানে ওখানে থাকতে পারে। যেমন গোড়ার দিকে যাদবপুরে রাজ্যপাল আচার্য ছিলেন না। তখন যাদবপুরে আভ্যন্তরিক প্রশাসনের প্রধান পদে যিনি ছিলেন তাঁকে উপাচার্যও বলা হত না। সেই পদটি ছিল 'রেক্টর'। আর বাইরের প্রধানের পদের নাম ছিল 'সভাপতি', ইংরেজিতে 'প্রেসিডেন্ট'। এই পদ দুটি ছিল আসলে বঙ্গীয় জাতীয় শিক্ষা পরিষদের ঐতিহ্যবাহী। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় আইন যখন প্রথম পাশ হয় তখন ওই দুটি পদকে ওইভাবেই রেখে দেওয়া হয়েছিল। বিধানচন্দ্র রায় ছিলেন প্রেসিডেন্ট এবং ত্রিগুণা সেন ছিলেন রেক্টর। কিছুদিন পরে আইন পরিবর্তন করে আচার্য ও উপাচার্যের আদল চালু করা হয়।

আমি উপরের আলোচনায় আভ্যন্তরিক প্রশাসন ও তার বাইরের স্তর, এইভাবে দুটো পর্যায়ে প্রশাসনের কথা তুলেছি। যে-কোনো গঠনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এইরকম কিছু কিছু ধূসর এলাকা থাকে। তার তাৎপর্য আমাদের খেয়াল করা দরকার। এই ধূসর এলাকার কথা ভুলে গেলে আমাদের ভাবনাচিন্তায় একরোখা এক ধরনের ঝোঁক এসে পড়ে। ওই যে দুটো পর্যায়, খেয়াল করা দরকার যে, আভ্যন্তরিক পর্যায়ের হাতে যে ক্ষমতা আছে, তাই সাধারণভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ক্ষমতা। সর্বোচ্চ, কিন্তু সীমাহীন নয়, বেপরোয়া নয়। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় বিভিন্ন বিষয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে কোর্ট-কাউন্সিলের সভায়। দৈনন্দিন কাজকর্মের জন্যে আছে উপাচার্যের দায়িত্ব। মনে রাখতে হবে সাধারণভাবে এই স্তরে বাইরের যে-স্তরের কথা বলেছি তার কোনো ভূমিকা থাকার কথা নয়। চাইলেও কি আচার্য কোনো হস্তক্ষেপ করতে পারেন না? হয়তো অনেক ক্ষেত্রে পারেন। কিন্তু ওরকম হস্তক্ষেপ সাধারণ পরিস্থিতির ব্যাপার নয়। যে-ধূসরতার কথা তুলেছিলাম তা এইসব পরিস্থিতিতে জরুরি। আচার্যের স্তরের বাইরের যে-হস্তক্ষেপ তা যত নিঃশব্দ তত মঙ্গল। মনে রাখতে হবে এরকম অবস্থা কোনো সাধারণ অবস্থা নয়, এমনকি হয়তো স্বাভাবিক অবস্থাও নয়। তাই প্রতিষ্ঠানের স্বাস্থ্যের কথা মাথায় রেখেই সবাইকে সন্তর্পণে চলতে হয়। আভ্যন্তরিক প্রশাসনেরও এমন কোনো বেয়াড়াপনার দিকে ঝুঁকে না পড়াই বাঞ্ছনীয় যেখানে বাইরের স্তরের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হতে পারে। স্বাধিকার বজায় রাখার এটা প্রায় প্রাথমিক শর্ত। স্বাধিকার যেন স্বেচ্ছাচারে না পৌঁছোয়। অন্যদিকে বাইরের যে-স্তর তার ভূমিকা যথাযথ পালনের জন্যে এমন অনেক ক্ষমতা সেই কর্তৃপক্ষের হাতে দেওয়া থাকে যা অনির্দিষ্ট। তা প্রয়োগ করতে হয়, যদি আদৌ তা করার প্রয়োজন পড়ে, অতি সাবধানে। এটা মনে রাখতে হয় যে, এরকম ক্ষমতা প্রয়োগ না করে পরিস্থিতি সামলাতে পারলে ভালো হত। সেই জন্যেই অনেক ক্ষেত্রে অনেক কিছু করতে হয় নিঃশব্দে। কূটনীতির পরিভাষায় যাকে 'ট্র্যাক টু ডিপ্লোমেসি' বলে, এই কারণেই তার দরকার পড়ে। সব পক্ষকে খেয়াল রাখতে হয় কেউ কারো ক্ষমতা যেন মাড়িয়ে না যায়। এবং একই সঙ্গে এও দেখতে হয় যে ক্ষমতার সবটুকু যেন প্রয়োগ না করতে হয়।

তার বদলে পরিস্থিতি যদি দড়ি টানাটানিতে পৌঁছে যায়, অবস্থা যদি এমন হয় যে সব সময়ে আমরা কে কার উপরে টেক্কা দিতে পারি তাই দেখিয়ে দিতে চাই, তাহলে বুঝতে হবে যে, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সেটা দারুণ দুর্দিন। তখন এঁর বদলে তাঁকে এ পদের বদলে ও পদে বসিয়ে অসুখ সারানো যাবে বলে মনে হয় না। আমাদের বর্তমান ব্যবস্থায় রাজ্যপাল আচার্য। ওই বাইরের স্তরের প্রধান কর্তৃপক্ষ। মনে রাখতে হবে তিনি পদাধিকার বলে 'আচার্য'। অর্থাৎ রাজ্যপাল বলেই আচার্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য হবার কোনো বিশেষ গুণসম্পন্ন ব্যক্তি বলে তাঁকে আচার্য মনোনীত করা হয়েছে তা নয়। এই যে তিনি রাজ্যপাল বলেই আচার্য তার মধ্যেই এই বার্তা নিহিত আছে যে, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় তাঁর কোনো বিশেষ গুণের জন্যে তিনি এই পদে নেই। তিনি রাজ্যের সবকটি বিশ্ববিদ্যালয়েরই আচার্য। ওই পদাধিকার বলেই। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দিষ্ট কোনো বিশেষ চরিত্র যদি থাকে তবে সে বিষয়েও তাঁর কোনো বিশেষ গুণপনা বা পারদর্শিতার প্রশ্ন এখানে উঠছে না। কেননা তিনি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েরই আভ্যন্তরিক প্রশাসনের অঙ্গ নন। আসলে রাজ্যপাল হিসেবেও যে-বিশেষ গুণ তাঁর পক্ষে জরুরি তা হল নির্লিপ্ততা। তিনি সরকারের আভ্যন্তরিক প্রশাসনের বাইরে অবস্থিত। তিনি দৈনন্দিন প্রশাসনের অঙ্গ নন। সেই জন্যেই এই ধরনের পদাধিকারীদের বেলায় আলংকারিক শব্দটা প্রয়োগ করা হয়। ইংরেজিতে পরিষ্কার করে 'টিটিউলার চিফ' কথাটা ব্যবহারে আছে। এই ধরনের পদাধিকারীদের বস্তুত কার্যকরী ক্ষমতা থাকে না। এঁদের সে কথা মনে করিয়ে দিতে হলে তা খুব দুঃখের। তবে কখনো কখনো সেরকম পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। কিছুদিন আগেই ইংল্যাণ্ডের ব্রেক্সিট প্রসঙ্গে রানি নাকি কিছু একটা মন্তব্য করেছিলেন। তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিতে হয়েছিল এ কাজ রানির করণীয় নয়। ভারতের রাষ্ট্রপতির তো কত ক্ষমতা, কিন্তু মনে রাখতে হবে তিনি এইসব ক্ষমতার প্রকৃত আধিকারী নন। তিনি আলংকারিক প্রধান। এইরকম ধূসর পরিসর থাকে বলেই মাঝে মাঝে সংঘর্ষের পরিস্থিতি তৈরি হয় বা হতে পারে। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সরকারের কয়েকবারই এরকম হয়েছে। জৈল সিং যখন রাষ্ট্রপতি আর রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী তখন একবার সংঘর্ষ তীব্র আকার ধারণ করে সংকটময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের বেলায় এরকম অবকাশ ও সম্ভাবনা থাকে, তাই বলে কথায় কথায় ব্যবস্থার পরিবর্তন কোনো কাজের কথা নয়।

বর্তমানে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্য নিয়ে এরকম এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের এখানে রাজ্যপালের সঙ্গে রাজ্য সরকারের সংঘর্ষময় পরিস্থিতি অনেকদিন ধরে চলছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্য সরকারের তরফে চিন্তা করা হয়েছে রাজ্যপালের বদলে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে পদাধিকারবলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্য করা হোক। সে মর্মে নাকি আইন প্রণয়ন করা হবে। আইনে কী থাকবে না থাকবে তা এখনো পরিষ্কার না। আপাতত কথা এই ভাবনা নিয়ে। এক কথায় এই ভাবনা অতি বিপজ্জনক। মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান। আর সে প্রাধান্য আলংকারিক নয়। তিনি প্রকৃত প্রধান। সরকারের প্রকৃত প্রধান যদি পদাধিকারবলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য হন তাহলে আচার্যপদের আলংকারিকতা রাতারাতি ঘুচে যাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকার ভাবনায় তাতে মূলে আঘাত লাগবে। রাজ্যপাল আর মুখ্যমন্ত্রীর পদের চরিত্রই আলাদা। রাজ্যপাল সরকারের আলংকারিক প্রধান আর মুখ্যমন্ত্রী সরকারের প্রকৃত প্রধান। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকার নিয়ে কোনো মায়াদয়া থাকলে এমন ভাবনাকে আদৌ প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়।

আসলে হয়েছে কি, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকারের ধারণাতেই আমাদের গোলমাল হয়ে গেছে। আমাদের প্রায় সকলেরই মনে এরকম একটা কথা চেপে বসেছে যে, যে টাকা জোগায় সব ক্ষমতা তার, এটাই স্বাভাবিক কথা। না, এটা একেবারে স্বাভাবিক কথা না। এটা ক্ষমতার কথা, স্বেচ্ছাচারের কথা। বাংলা সিনেমার বেয়াড়া পুত্র-কন্যাকে কমল মিত্র কিংবা ছবি বিশ্বাসের মতো রাশভারি অভিভাবক পিতা যেমন কথায় কথায় ত্যাজ্য করে দেন, সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করেন, এ যেন ব্যাপারটা সেরকম। পুত্র-কন্যার আর্থিক দায়িত্ব যদি অভিভাবক পালন করেন, তাহলে তিনি তা করেন সেটা তাঁর কর্তব্য, করার কথা বলেই করেন। সে দায়িত্ব পালন অবশ্যই এই শর্তাধীন হতে পারে না যে, পুত্র-কন্যা পিতার কাছে বশ্যতা স্বীকার করে আশ্রিত হয়ে থাকবে। পিতার অর্থের উপরে নির্ভরশীল অবস্থায় যদি কোনো পুত্র বা কন্যা ‘বেয়াড়া’ পথে চলে, তাহলে পিতাকে সে সমস্যা আলোচনা করে হোক, অন্য যেভাবে হোক মীমাংসার কথা ভাবতে হবে। তার বদলে তিনি যদি তাদের আর্থিক দায়ভার অস্বীকার করেন, তাহলে তিনি অভিভাবক হিসেবে আগাগোড়া ব্যর্থ, কেননা একদিকে ‘বেয়াড়া’পনা সামলাতে তিনি অসমর্থ এবং অন্যদিকে আর্থিক দায়িত্ব অস্বীকার করে অভিভাবকের কর্তব্য থেকেও বিচ্যুত।

আজ আমাদের সরকারকে পরিষ্কার করে ভাবতে হবে যে, শিক্ষাখাতে সরকারের ব্যয় আধুনিক সরকারের ন্যূনতম সামাজিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এবং এই দায়িত্ব নিঃশর্ত। অন্য কোনো স্তরে কোথাও যদি কোনো সমস্যা দেখা দেয় তাহলে সে সমস্যা সমস্যার চরিত্র অনুযায়ী উপযুক্তভাবে সকলের চেষ্টায় সমবেতভাবে সমাধানের কথা ভাবতে হবে। মুশকিল হয়েছে এই ‘সকলের চেষ্টা’ জাতীয় চিন্তা আমাদের চিন্তা পরিধির একেবারে বাইরে বেরিয়ে গেছে। দলীয় সত্তা ছাড়া আর সব কিছুই আমাদের আছে অবান্তর হয়ে এসেছে। এই মানসিক আবহাওয়ার পরিবর্তন একান্ত প্রয়োজনীয়।

কোনো একজন বিশেষ আচার্যের কাজকর্ম যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকারের দিক থেকে আপত্তিজনক মনে হয়, তাহলে তার প্রতিকার হিসেবে নিশ্চয়ই আইন বদল করে মুখ্যমন্ত্রীকে আচার্য করে দেওয়া কোনো কাজের কথা হতে পারে না। আমার স্বাধিকারের পরে কালো ছায়া দেখা দিলে সেই স্বাধিকার কি আমি সরকারের লকারে জমা রাখব। আচার্যের ক্ষমতার সঙ্কোচন মানে কি মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষমতার প্রসার। এ তো বড়ো অদ্ভুত যুক্তি। দেখলে মনে হয় ক্ষমতা বিস্তারের অছিলা খোঁজা হচ্ছে। পদাধিকারী কোনো ব্যক্তির আচরণে অসুবিধা দেখা দিলে ব্যবস্থাটা বদলে ফেলা যায় নাকি। আইনি ব্যবস্থার মধ্যে পদাধিকারীকে সংযত করার যা পন্থা আছে তার আশ্রয় নিতে হবে। তাতেও সম্ভব না হলে সেই পদাধিকারীর নিয়োগকালের মেয়াদ যতদিন আছে অপেক্ষা করতে হবে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে তাই করণীয়।

আশঙ্কার কারণ আছে শিক্ষা সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সরকারের হাত লম্বা করে বাড়ানোর ইচ্ছা বিকশিত হচ্ছে। স্বশাসিত সংস্থার ধারণায় বেশ হিসেব করে আঘাত হানা হচ্ছে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের পরে আমাদের আস্থা কি আর অটুট থাকছে না। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির মতো স্বশাসিত সরকার পৃষ্ঠপোষিত প্রতিষ্ঠানের চেহারা চরিত্র যা দাঁড়াচ্ছে তাতে এরকম ভাবনার কারণ ঘটছে। প্রথমত, বর্তমানে বাংলা আকাদেমির প্রশাসনিক প্রধান, সভাপতি পদে নিয়োগ করা হয়েছে স্বয়ং রাজ্যের শিক্ষা মন্ত্রীকে। যদিও আমার কাছে অন্তত খুব পরিষ্কার নয় যে তিনি কি পদাধিকারবলে সভাপতি, না শিক্ষা সংস্কৃতি ক্ষেত্রের মান্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে সভাপতি। দ্বিতীয় সম্ভাবনা বর্তমান পদাধিকারীর বেলাতে একেবারেই অস্বাভাবিক কিছু না। হতেই পারে। কিন্তু সমস্যা এই যে, এ কথাটা জন পরিসরে আদৌ পরিষ্কার আছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। একটু ভাবলে বোঝা যাবে এ কথাগুলো অবান্তর নয়। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম যখন জবাহরলাল নেহরুকে আচার্য করা হয়েছিল তা কিন্তু আদৌ পদাধিকার বলে নয়। আজও যে প্রধানমন্ত্রীরাই আচার্য হয়ে থাকেন তাও কিন্তু পদাধিকার বলে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের গঠনতন্ত্র অনুসারে ওইভাবে নির্বাচন করা হয়। না করাই যেতে পারে। একবার অন্তত অন্যরকম হয়েও ছিল। বর্তমানে বাংলা আকাদেমির এই ব্যাপারটা পরিষ্কার হওয়া দরকার। বর্তমান সভাপতি যদি পদাধিকার বলে সভাপতি না হয়ে থাকেন তাহলে তাঁর সভাপতি সত্তা আর শিক্ষামন্ত্রী সত্তা সাবধানে স্বতন্ত্র রাখা উচিত। সন্দেহ নেই শক্ত কাজ। যেমন আমাদের সমস্ত সরকারি মন্ত্রীদের মন্ত্রীসত্তা আর তাঁদের নিজ নিজ রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীসত্তার ভিন্নতা নিয়ে অনেক জটিলতা আছে। এমনকি ইন্দিরা গান্ধীর ইলাহাবাদ হাই কোর্টের রায়ও এই সমস্যারই প্রকাশ। জনজীবনে তাই সাবধান হবার দরকার হয় বইকি।

দ্বিতীয় আর একটা প্রশ্নও আছে আমার মনে। সেটা হয়তো ততটা স্বাধিকারের প্রশ্ন নয়। আমি যতদূর জানি বাংলা আকাদেমির প্রাতিষ্ঠানিক চরিত্র ছিল রেজিস্টার্ড সোসাইটি। পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সোসাইটিজ রেজিস্ট্রেশন আক্ট অনুসারে রেজিস্ট্রিকৃত একটি সংস্থা। বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি সংশ্লিষ্ট প্রায় পঞ্চাশ-ষাট জন মানুষ ছিলেন এই আকাদেমির সদস্য। এঁদের নিয়েই গঠিত আকাদেমির সাধারণ সভা। এঁদেরই মধ্যে কয়েকজনকে নিয়ে গঠিত পরিচালন সভা বা একজিকিউটিভ কমিটি। মোটামুটি এই ছিল আকাদেমির সাংগঠনিক কাঠামো। এখনো কি তাই আছে? সাধারণ সভা ও পরিচালন সভা, এই স্তরভেদ কি এখনো বর্তমান? না হলে সংস্থার মূল গঠনতান্ত্রিক কাঠামোয় কোথাও বিঘ্ন ঘটছে না তো?