আরেক রকম ● দশম বর্ষ দ্বাদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ জুন, ২০২২ ● ১-১৫ আষাঢ়, ১৪২৯

সমসাময়িক

আর্থিক সংকট ও রাজনীতি


কোন মসজিদের নিচে শিবলিঙ্গ লুকিয়ে আছে তা নিয়ে যখন দেশের রাজনীতি তোলপাড়, মিডিয়াতে অসংখ্য আলোচনা, ফুটেজ, ঝগড়া, ঠিক সেই সময় দেশের পাইকারি মূল্যবৃদ্ধির হার বিগত ত্রিশ বছরের রেকর্ড ভেঙে, মে ২০২২-এর হিসেব অনুযায়ী ১৫.৮৮ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে ১২.৩৪ শতাংশ, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি ৪০.৬২ শতাংশ, যার মধ্যে পেট্রোলের মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে ৫৮.৭৮ শতাংশ এবং রান্নার গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি ৪৭.৭১ শতাংশ। খুচরো মূল্যের সূচক বা কনসিউমার প্রাইস ইন্ডেক্সের হিসেবে ২০২২ সালের মে মাসে মূল্যবৃদ্ধির হার ছিল ৭.০৪ শতাংশ। বিগত ৩২ মাসের মধ্যে ১৮ মাস এই সূচক অনুযায়ী মূল্যবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের উপরে থেকেছে।

উপরের এই তথ্যকে অর্থনীতির জটিল আবর্তের বাইরে এনে সহজ ভাষায় বললে বলা যায় যে, দেশের অধিকাংশ মানুষের জীবন মূল্যবৃদ্ধির জন্য দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। মনে রাখতে হবে যে আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ অসংগঠিত ক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত যেখানে মহার্ঘ ভাতা বা ডিএ দেওয়া হয় না। ফলত, মূল্যবৃদ্ধি ঘটলে তাদের আয় বাড়ে না, যার ফলে তাদের প্রকৃত আয় কমে যায়। অতএব বলা যেতে পারে যে, বিগত বহু মাস ধরে দেশের অধিকাংশ মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে।

একই সময় দেশের আর্থিক বৃদ্ধির হার বাড়ার তেমন কোনো লক্ষণ নেই। অতিমারির বছর অর্থাৎ ২০২০-২১ সালকে আমরা হিসেবের বাইরে রাখছি কারণ এই বছরে লকডাউনের কারণে ভারতে অর্থব্যবস্থার বৃদ্ধির হার তলানিতে এসে ঠেকেছিল। কিন্তু আমরা যদি অতিমারির আগের বছর অর্থাৎ ২০১৯-২০ সাল এবং ২০২১-২২ সালের জিডিপি-র তুলনা করি, তাহলে দেখা যাবে যে, ২০১৯-২০ সালের তুলনায় ২০২১-২২ সালে ভারতে আর্থিক বৃদ্ধির হার ছিল মাত্র ১.৫ শতাংশ। এই সময়ে ভারতের জনসংখ্যা বৃদ্ধির ছিল ২ শতাংশ। সুতরাং ভারতের মাথাপিছু আয়ের বৃদ্ধি ঋণাত্বক ছিল। অর্থাৎ ২০১৯-২০ সালের তুলনায় ২০২১-২২ সালে ভারতের গড় মাথাপিছু আয় কমেছে। একদিকে মূল্যবৃদ্ধির জ্বালা, অন্যদিকে আর্থিক বৃদ্ধির হার কমে যাওয়ার ফলে আয়ের সঙ্কোচন - এই দুইয়ের সাঁড়াশি চাপে ভারতের আপামর জনগণের প্রাণ ওষ্ঠাগত।

মনে রাখতে হবে যে গড় মাথাপিছু আয়ের হিসেবটি আর্থিক বৈষম্যের সমস্যাকে ধরতে পারে না। যেহেতু ভারতের সব মানুষের আয় এক নয়, ধনী শ্রেণির আয় অনেক বেশি, তাই যখন মাথাপিছু আয় কমছে তার অধিকাংশই যে গরীবের আয় কমছে সে কথা হলপ করে বলা যায়। করোনাকালে পুঁজিপতি এবং কর্পোরেট ক্ষেত্রের আয় কমেনি। বরং ভারতে ১০০ কোটি ডলারের বেশি সম্পদশালী মানুষের সংখ্যা এই সময়ে বেড়েছে, কর্পোরেট ক্ষেত্রের মুনাফা লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। শুধু মার খেয়েছে গরীব মানুষ।অন্যদিকে ডলারের দাম ভারতের মুদ্রার নিরিখে বেড়েই চলেছে। বর্তমানে তা ৭৮ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। ভারত থেকে ডলারের পলায়ন আটকানো যাচ্ছে না। শেয়ার বাজারেও অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে।

এই সমস্ত প্রবণতা থেকে এই সিদ্ধান্তেই এসে পৌঁছনো যায় যে, মোদী সরকার ভারতের অর্থব্যবস্থাকে এক গভীর সংকটের কিনারে নিয়ে গিয়েছে। নির্লজ্জ বিজেপি সরকারের অবশ্য অজুহাতের অভাব নেই। আর্থিক বৃদ্ধি হ্রাস পাওয়ার কারণ হিসেবে তারা আঙুল তোলে করোনা এবং লকডাউনের দিকে। মূল্যবৃদ্ধি বেড়ে যাওয়ার কারণে নাকি ইউক্রেণ-রাশিয়ার যুদ্ধ। মুশকিল হল যে দুটি যুক্তিই ফালতু।

আমরা আগেই বলেছি যে, করোনার বছরকে হিসেবের বাইরে রাখলেও দেখা যাচ্ছে যে, ভারতের মাথাপিছু আয় আসলে কমেছে। শুধু তাই নয়, আর্থিক বৃদ্ধি করোনাকাল শুরু হওয়ার বহু আগে থেকেই নিম্নগামী। সুতরাং করোনার উপর সমস্ত দোষ চাপানো বৃথা। অন্যদিকে ভারতে মূল্যবৃদ্ধির হার ২০১৯ সালের অক্টোবর মাস থেকেই ৪ শতাংশের উপরে এবং বহু মাসে তা ৬ শতাংশের উপরে থেকেছে, যখন ইউক্রেণ-রাশিয়ার যুদ্ধের কোনো আভাস পর্যন্ত ছিল না। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সম্প্রতি সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যবৃদ্ধির উপর লাগাম পরাতে চাইছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়তে থাকা তেলের দাম, তেলের উপর সরকারের চাপানো বিপুল শুল্ক, দেশে কমতে থাকা বৃদ্ধির হার, সব মিলিয়ে চট করে যে ভারত এই সমস্যার সমাধান করতে পারবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।

এখানেই রাজনৈতিক-অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলতে হয়। এত কঠিন আর্থিক সমস্যার মধ্যেও বিজেপি লাগাতার নির্বাচনগুলিতে জয়লাভ করছে কী করে? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে গভীর গবেষণার প্রয়োজন। তবু দুই-একটি কথা বলা যায়। প্রথমত, বিজেপি তথা আরএসএস জনগণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের মনে তীব্র মুসলমান বিদ্বেষ ঢুকিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে যেখানে মুসলমান বিরোধী ক্রিয়াকলাপ এবং হিন্দুত্বের জিগির বিজেপি-র পক্ষে এক বিশাল সংখ্যক জনগণকে টানছে। দ্বিতীয়ত, বিজেপি আর্থিক উন্নয়নের সংজ্ঞাটাই পালটে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। গরীবদের ব্যাঙ্ক এ্যাকাউন্ট খোলানো হয়েছে - সেখানে টাকা না থাকলেও এই যে দরিদ্র মানুষের এ্যাকাউন্ট আছে সেটাই তাদেরকে উন্নয়নের সূচক হিসেবে দেখানো হচ্ছে। তদুপরি, রেশন ব্যবস্থাকে এখনও বিজেপি ব্যবহার করছে ন্যূনতম খাদ্য মানুষের কাছে পৌঁছোনোর জন্য, যদিও তারা কংগ্রেস দ্বারা গঠিত সমস্ত উন্নয়নমূলক কর্মসূচীকেই বাতিল করবে বলে এক সময় বড়াই করত। তৃতীয়ত, বিরোধী শক্তির অপদার্থতা - যেখানে আট বছর কেটে যাওয়ার পরেও তারা বিজেপি-র বিরুদ্ধে কোনো বলিষ্ঠ সাংগঠনিক-রাজনৈতিক-মতাদর্শগত আখ্যান গড়ে তুলতে পারেনি। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছিয়েছে যে রান্নার গ্যাসের দাম হাজার টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার পরেও বিরোধীদের তরফে রাস্তায় নেমে তেমন প্রতিবাদ করতে দেখা যায়নি। এরই পরিণতিতে মন্দা-মূল্যবৃদ্ধি-র মধ্যেও মানুষ বিজেপি তথা মোদীর উপরেই ভরসা রাখছে। এই পরিস্থিতির পরিবর্তন রাতারাতি হবে না। এর জন্য বিরোধীদের একজোট হয়ে একটি বিকল্প আখ্যান নির্মাণ করে এই জনবিরোধী সরকারের বিরুদ্ধে আপসহীন নিরন্তর সংগ্রামে নামতে হবে।