আরেক রকম ● দশম বর্ষ দ্বাদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ জুন, ২০২২ ● ১-১৫ আষাঢ়, ১৪২৯

সম্পাদকীয়

বিদ্বেষ-বিষ


প্রশ্নটি সহজ। ভারতের জনসংখ্যার ১১ শতাংশ মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষের সংবিধান বর্ণিত অধিকার সুরক্ষিত আছে কি? নাকি সংবিধানকে জলাঞ্জলি দিয়ে ভারত বর্তমানে একটি হিন্দু রাষ্ট্রে পর্যবসিত হয়েছে?

প্রশ্নটি সহজ হলেও বেশ পুরোনো। স্বাধীন ভারত জন্ম নিয়েছে সাম্প্রদায়িকতার দগদগে ক্ষত বুকে নিয়ে। সেই সময় ভারতের স্বাধীনতার নায়করা - জওহরলাল নেহরু, গান্ধীজি প্রমুখ - ভারতে একটি ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের প্রচলন করে সাম্প্রদায়িকতার প্রাতিষ্ঠানিক বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ ধর্মনিরপেক্ষ ভারতীয় সংবিধানের বিরোধিতা করে এসেছে জন্মলগ্ন থেকেই। বহু বছর আরএসএস-এর নেতৃত্বাধীন হিন্দুত্ববাদী শক্তি দেশের রাজনীতিতে প্রান্তিক বা fringe ভূমিকা পালন করে এসেছে। কিন্তু ২০১৪ সাল থেকে এই fringe ভারতের রাজনীতির মূলধারা রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। সুতরাং ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের মুখে আরএসএস-এর নেতৃত্বাধীন সরকার যে চপেটাঘাত করবে তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।

তবু হতচকিত হয়ে যেতে হয় আরএসএস-বিজেপি-র নিরন্তর অবিচ্ছিন্ন সাম্প্রদায়িক আক্রমণ দেখে। ১৯৯২ সালে গোটা পৃথিবীর সামনে তারা বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে। ধ্বংস করার আগে থেকেই তাদের স্লোগান ছিল ‘অযোধ্যা ঝাঁকি হ্যায়, কাশী-মথুরা বাকি হ্যায়’। ২০১৯ সালে ভারতের মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট বাবরি মসজিদের জমি হিন্দু পক্ষের হাতে তুলে দেয়। অনেকেই ভেবেছিলেন যে হিন্দুত্ববাদীরা তৃপ্তির হাসি হেসে চায়ে চুমুক দিয়ে বাড়ি ফিরে যাবে। কিন্তু না। বর্তমানে কাশী-মথুরা-তাজমহল সমস্ত জায়গায় মসজিদকে কবজা করে নেওয়ার ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে হিন্দুত্ববাদীরা। তাদের হিন্দু রাষ্ট্র বানানোর প্রক্রিয়া বিরামহীনভাবে চলছে।

২০১৯ সালে গোটা দেশে এনআরসি-এনপিআর করে তথাকথিত বেআইনি নাগরিককে চিহ্নিত করে তাদের দেশ থেকে বিতাড়িত করার হুজুগ তোলা হল। সংসদে সিএএ আইন পাশ হল। শিশুরাও জানে যে, এই আইনের মূল অভিপ্রায় মুসলমানদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করার, যাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার লক্ষ্যেই এই কানুন পাশ করানো হয়েছে। দেশজুড়ে প্রতিবাদ হওয়াতে সরকার কিছুটা হলেও পিছু হটেছে। কিন্তু তারা এই কানুন এবং এনআরসি করার অভিপ্রায়কে বাতিল করেনি।

২০১৪ সাল থেকেই দেশে মুসলমান সমাজের মানুষদের নিশানা করে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। আখলাখ-জুনেইদ-আশরাফুল সহ বহু মুসলমান মানুষের লাশ গুনতে হয়েছে আমাদের, যাদের একমাত্র অপরাধ তারা মুসলমান। এ ছাড়াও মুসলমানদের পেশাকে নিশানা করা হয়েছে, কসাইখানা বন্ধ করা হয়েছে, গো-হত্যাকে ফৌজদারি মামলার আওতায় নিয়ে এসে তাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মন্দিরের আশেপাশে মুসলমান দোকানদাররা যেন পশরা সাজিয় বসতে না পারে সেই ফরমানও জারি হয়েছে বিভিন্ন রাজ্যে।

হিন্দুত্ববাদীদের নেতৃত্বে মুসলমান সমাজের উপর যে সংগঠিত আক্রমণ নামিয়ে আনা হচ্ছে বিগত আট বছর ধরে তারই সূত্র ধরে পয়গম্বর মহম্মদের নামে আপত্তিকর এবং অসম্মানজনক কথা বললেন বিজেপি-র মুখপাত্ররা লাইভ টিভিতে। দেশে হইচই হওয়ার আগে মধ্য প্রাচ্যের দেশে প্রবল প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়। ভারতের রাষ্ট্রদূতদের ডেকে তিরস্কার করে কুয়েত, কাতার, ইরানের মতন সরকার। সেখানে ভারতীয় পণ্য বয়কটের ডাক দেওয়া হয়। বিপদের মুখে পড়েন লক্ষ লক্ষ ভারতীয় যারা এই দেশগুলিতে চাকরি করেন। এমতাবস্থায় বিজেপি বাধ্য হয় তাদের মুখপাত্রদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। প্রচুর পরিমাণ ডলার এই দেশগুলি থেকে ভারতীয়রা আমাদের দেশে পাঠায়। একজন নগন্য মুখপাত্রের কথায় সেই ডলারের প্রবাহ যদি শুকিয়ে যায় তাহলে ভারত বিপদে পড়বে। অতএব ভূতের মুখে রাম নামের মতই বিজেপি-র মুখেও হঠাৎ আমরা শুনলাম যে, তারা নাকি সব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল! বিজেপি সরকার বিদেশের সরকারদের বলে যে, কিছু প্রান্তিক ব্যক্তিরা নবীর নামে অসম্মানজনক কথা বলেছে। আশ্চর্যের ব্যাপার হল এই যে, বিজেপি সরকারের মতে বিজেপি-র মুখপাত্র হয়ে গেছেন প্রান্তিক ব্যক্তি যিনি কিনা বিজেপি-র হয়ে দিনের পর দিন মিডিয়াতে বসে গলা ফাটিয়েছেন।

ভারতের মুসলমান সমাজের মধ্যেও তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। গোটা দেশে প্রতিবাদ করেন অসংখ্য মানুষ। উত্তরপ্রদেশের মতন রাজ্যে এই প্রতিবাদে সামিল হওয়ার জন্য বুলডোজার দিয়ে বাড়ি ভেঙে দেওয়া হয়েছে রাতারাতি। একটা সরকার কতটা স্বৈরতান্ত্রিক হলে এই নীতি নিয়ে চলতে পারে, যেখানে প্রতিবাদীদের বাড়ি পুলিশ-প্রশাসন বুলডোজার দিয়ে ভেঙে দেয়। গোটা দেশজুড়েই এই প্রবণতা চলছে যেখানে মুসলমানদের বসতি গুড়িয়ে দেওয়ার জন্য বুলডোজারের দাপাদাপি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। উত্তরপ্রদেশের যোগী মুখ্যমন্ত্রীকে এখন হিন্দুত্ববাদীদের মধ্যে ‘বুলডোজার বাবা’ বলে সম্বোধনও করা হচ্ছে। ভারতের ফ্যাসিবাদের গেরুয়া নিশানের মধ্যে বুলডোজার এক ভয়াবহ প্রতীক রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

দুঃখের হলেও বলতেই হয় যে, সব জায়গায় এই প্রতিবাদ শান্তিপূর্ণ থাকেনি। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলায় যেভাবে জাতীয় সড়ক ১২ ঘন্টার কাছাকাছি অবরোধ করে রাখা হল, যেভাবে অনেক দোকানপাটে আগুন লাগানো হল, ভাঙচুড় চালানো হল তা অত্যন্ত অন্যায় এবং অপরাধমূলক কাজ হয়েছে। মুর্শিদাবাদ জেলার কিছু অংশেও একইরকমের গন্ডগোলের ঘটনা ঘটেছে। হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাকে রোখার একমাত্র উপায় ধর্মনিরপেক্ষ শান্তিপূর্ণ সমাবেশ। মুসলমান সমাজের মৌলবাদী অথবা দুর্বৃত্ত অংশের হাতে যদি আন্দোলনের রাশ চলে যায় তবে তাতে পুষ্ট হবে হিন্দুত্ববাদীরা। এই সহজ সত্যটা সবার উপলব্ধি করা দরকার। তবে একথাও অনস্বীকার্য বিভিন্ন মুসলমান সংগঠন, ইমামদের সংগঠনের তরফে সমস্ত হিংসাত্মক ঘটনার তীব্র নিন্দা করে শান্তি বজায় রাখার আহ্বান জানানো হয়।

এই প্রসঙ্গে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হল পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকা। আমরা পশ্চিমবঙ্গে দেখলাম একটি জাতীয় সড়ক ১২ ঘন্টা অবরোধ হয়ে থাকল, কিন্তু পুলিশ সেই অবরোধ তুলতে ব্যর্থ হল। জায়গায় জায়গায় গোলমাল রুখতেও তারা ব্যর্থ। প্রশাসন অথবা পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ যাদের কাজ আগাম খবর জানা এবং উচ্চ মহলে জানানো, তারা কি দিবানিদ্রায় ছিল? এত বড় সংখ্যক মানুষ রাস্তায় নেমে অবরোধ করলেন আর তাদের কাছে কোনো আগাম খবর ছিল না? নাকি প্রশাসন তথা সরকারের রাজনৈতিক নেতৃত্ব অন্য কোনো জটিল রাজনৈতিক সমীকরণ কষতে ব্যস্ত ছিলেন, যেই সমীকরণে দুই ধরনের সাম্প্রদায়িকতার আস্ফালন তৃণমূলকে বলশালী করবে? মানুষ এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে। আমরা আশা রাখব আগামীদিনে সমস্ত রকম অরাজকতা এবং সংগঠিত অশান্তির বিরুদ্ধে পুলিশ-প্রশাসন দল-মত-ধর্ম নির্বিশেষে কড়া ব্যবস্থা নেবে।

কিন্তু এই ঘটনা পরম্পরায় সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিজেপি মুখপাত্র অথবা মুসলমান প্রতিবাদীরা নন। সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভারতের তথাকথিত স্বাতন্ত্র বিচারব্যবস্থা এবং মিডিয়ার ভূমিকা। ভারতের মিডিয়ার এক বৃহদাংশ বর্তমানে ফ্যাসিবাদীদের ‘চিয়ার লিডার’-এর ভূমিকায় অবতীর্ণ। বুলডোজারকে তারা পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় মুসলমান বসতির দিকে। মৃত মুসলমান কৃষকের বুকের উপর কদর্য নৃত্য করে রিপোর্টার। দিনের পর দিন টিভিতে বসে সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়ায় ভারতের মিডিয়া। বিজেপি ও কর্পোরেটদের টাকায় পুষ্ট বর্তমান মিডিয়া ভারতের গণতন্ত্রের জন্য বিপজ্জনক গোষ্ঠী। তাদের স্বাতন্ত্র বলে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। আরএসএস-বিজেপির অফিস থেকে প্রকাশিত হিংসার বাণী প্রচার করাই তাদের প্রধান কাজ।

কিন্তু বিচারব্যবস্থা তো তার স্বাতন্ত্রের জন্য জগৎ বিখ্যাত। তাহলে বর্তমান পরিস্থিতিতে তারা জড়ভরতের ভূমিকায় কেন? কেন কাশীর জ্ঞানব্যাপী মসজিদে সমীক্ষা চালানোর নির্দেশ দিল আদালত যেখানে ১৯৯১ সালের উপাসনা স্থল আইনেই পরিষ্কার বলা আছে, ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টের পরে উপাসনা স্থলের চরিত্রে কোনো পরিবর্তন করা যাবে না। কেন সুপ্রিম কোর্ট নিম্ন আদালতের এই রায়কে ছুঁড়ে ফেলে দিল না? কেন একের পর এক বিজেপি শাসিত রাজ্যে বুলডোজার দিয়ে প্রতিবাদীদের ঘর ভেঙে দেওয়া হলেও মহামান্য আদালত কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে না? কেন সিএএ ২০১৯, কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা রদের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে দাখিল করা গুরুত্বপূর্ণ মামলার শুনানি হচ্ছে না? কেন নির্বাচনী বন্ড নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট টালবাহানা করছে?

‘প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তরও তো জানা’। আসলে ভারতের রাষ্ট্রের চরিত্র পরিবর্তন হচ্ছে। আগে ধর্মনিরপেক্ষতা, তার সমস্ত দুর্বলতা নিয়েও, ভারত রাষ্ট্রের মতাদর্শ ছিল। এখন রাষ্ট্রের মতাদর্শ ক্রমাগত হিন্দুত্বের দিকে ঢলে পড়ছে। সুপ্রিম কোর্ট অথবা বিচারব্যবস্থা তার বাইরে নয়। তাই বাবরি মসজিদের জমি রাম মন্দিরের জন্য হস্তান্তর করা হয়, জ্ঞানবাপী মসজিদে সমীক্ষার রায় দেওয়া হয়, কিন্তু বিজেপি সরকারের নীতিসমূহকে প্রশ্নের সম্মুখীন করবে এমন গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলির শুনানি হয় না। মিডিয়া যেহেতু বিজেপি-র ভৃত্যে পরিণত হয়েছে, তাই এই প্রশ্নগুলি কোনো মূলধারার মিডিয়ায় খবর হয় না।

আসলে ভারতে বর্তমানে একটি ফ্যাসিবাদী সরকার চলছে, যার প্রভাবে রাষ্ট্রের উদারনৈতিক সমস্ত প্রতিষ্ঠান - কোর্ট, মিডিয়া, আমলাতন্ত্র, পুলিশ ইত্যাদি - আস্তে আস্তে হিন্দুত্ববাদের কর্তৃত্ববাদী রাজনীতির প্রভাবে চলে আসছে। হিন্দুত্ববাদকে ভারতের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রতিহত করার সম্ভাবনা ক্রমশ কমছে। সদ্য প্রয়াত মার্কসবাদী তাত্ত্বিক আইজাজ আহমেদের কথায় বললে বলতে হয়, ধীরে ধীরে ভারত রাষ্ট্রের দখল নিচ্ছে হিন্দুত্ববাদী শক্তি।

এমতাবস্থায়, একদিকে যেমন আইনের পথ ধরে যতটা লড়া যায় লড়তে হবে, তেমনি সার কথাটি মনে রাখতে হবে যে, আসলে হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে লড়াইটি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক এবং মতাদর্শগত লড়াই। এই লড়াই কীভাবে লড়া উচিত তা নিয়ে এখনও অবধি বিরোধী শক্তির মধ্যে কোনোরকম স্বচ্ছতা নেই। হিন্দুত্ববাদের ক্রমাগত উত্থানকে প্রতিহত করার মতন রাজনৈতিক, সাংগঠনিক অথবা মতাদর্শগত প্রস্তুতি বিরোধীদের নেই। কিন্তু সেই কাজটিই তাদের বর্তমান সময়ে প্রধান করণীয়। তারা কতটা সফলভাবে এই কাজটি করতে পারবেন, তার উপর নির্ভর করবে আগামীদিনের ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ।